ভারতকে গণহত্যার মুখে ঠেলার চেষ্টা এবং রাজনীতিকেরা

গৌতম রায়

নাজিমুদ্দিনকে খুন করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার বেগুনবাড়ি গাঁয়ের যুবক নাজিমুদ্দিন। শিয়ালদহ মেমু ট্রেনে সে উঠেছিল বাড়ি যাওয়ার জন্যে। দেবগ্রামের কাছে নিত্যযাত্রী, ছানার ব্যবসায়ীরা নাজিমুদ্দিনকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে খুন করে। রেল পুলিশ মামুলি পদক্ষেপ নেয় এই ঘটনার। প্রথম সারির কোন খবরের কাগজে নাজিমুদ্দিনের ঘটনা ঠাঁই পায় না। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমেও না। সামাজিক গণমাধ্যমের বড়াই করেন যারা, তারাও নীরব থাকেন। দু-চারজন মানুষ, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান, তারাই সরব হন সামাজিক গণমাধ্যমে। একটি খবরের কাগজ, যেটি শাসক ঘনিষ্ঠ হলেও, ‘মুসলমানদের কাগজ’ বলেই শাসকের ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠের নাক সিটকোনোর শিকার, একমাত্র সেই কাগজটিতেই নাজিমুদ্দিনের ঘটনা ঠাঁই পায়। এই লেখা পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনা সম্পর্কে কোন প্রতিক্রিয়া দেননি। বামপন্থি নেতারা নীরব। মানুষের অধিকারের কথা বলার দাবি করা বামপন্থি পত্রপত্রিকা গুলিও নীরব।

নাজিমুদ্দিনের ঘটনা কি নিছক রেলের মুর্শিদাবাদ শাখায় ছানা ব্যবসায়ীদের দাপটের পরিণতি? এই বর্বরতার সঙ্গে গোটা ভারত জুড়ে যে ঘৃণার রাজনীতির সামাজিকীকরণ চালানোর চেষ্টা চলছে, পশ্চিমবঙ্গেও সেই ঘৃণার রাজনীতির নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি না? দিল্লিতে কয়েক বছর আগে যেভাবে দিনের আলোয় ট্রেনের কামরা থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিল পহেলু খানকে শুধু ‘মুসলমান’ হওয়ার কারণে, নাজিমুদ্দিনের ঘটনাও কি সেই বর্বরতার ছায়াকেই আমাদের সামনে প্রকট করে তুলছে না? দিল্লির ট্রেনের কামরাটিতে একাংশের নিত্যযাত্রীরা ভজন কীর্তনের নামে সাময়িক মন্দির নাকি তৈরি করে ফেলতেন। আর সেই সাময়িক মন্দিরে কোনো অহিন্দু থাকতে পারেন না। তাই পাশবিক আচরণ করে চলন্ত ট্রেনের কামরা থেকে ঠেলে ফেলে দেয়া হয়েছিল পহেলু খান কে।

এই পশ্চিমবঙ্গের লালগোলা মেমু ট্রেনটিতে কয়েকটি কামরা ছানা ব্যবসায়ীদের দখলে থাকে। সেই কামরাতে তারা যাতায়াত করবার কালে বিনোদনের মতো করেই ভজন কীর্তন করে থাকে। সেই ভজনকীর্তনের আঙ্গিকের সঙ্গে ভক্তিরসের কোন সম্পর্ক থাকে না। বরংচ থাকে একটা সূক্ষ্ম যৌন আবেদন। চলতে থাকে ধূমপান থেকে শুরু করে নানা ধরনের নেশা। রেলের আইন অনুযায়ী অন্য নেশা তো দূরের কথা, ধূমপান পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনে নিষিদ্ধ। সেখানে এসব নিত্যযাত্রীরা নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে চলাফেরা করবার সময়ে ট্রেনের ভেতরে যে অবাধে নেশা করে চলে, এটা রেল পুলিশের না জানার কথা নয়। ভজন-কীর্তন করতে করতে মাদক ভরা সিগারেট টানতে টানতে এসব নিত্য ছানা ব্যবসায়ীদের যাতায়াত সাধারণ যাত্রীদের কাছে নানা সমস্যা তৈরি করে। সাধারণ যাত্রীরা তাদের সমস্যার কথা রেল পুলিশকে জানালেও, কোনো কাজ হয়নি।

নাজিমুদ্দিন কে যে চলন্ত ট্রেন থেকে এই ছানা ব্যবসায়ীরা ঠেলে ফেলে দিয়েছে, তার পেছনে নেশাগ্রস্তদের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে গোটা ঘটনার পেছনে যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক প্রবণতা আছে, সেটাকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। প্রতিরোধহীন ঘেণার রাজনীতি আজ গোটা ভারতের রাজনীতির পরিম-লকে কার্যত বিষ নিঃশ্বাসে ভরে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘নিরুদ্ধ সমীরণ’ আজ ভারতের গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলেছে।

উত্তরাখ-ের হরিদ্বারে তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ বসেছিল। এই ধর্মসংসদের নেপথ্যে যেমন চিরকাল ইআরএসএস বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা থাকে, এইবার ও তার অন্যথা হয়নি। সেই তথাকথিত ‘ধর্মসংসদে’ সব ভেকধারী সাধুরা প্রায় একযোগে ভারতকে মুসলমানশূন্য করার লক্ষ্যে গণহত্যার নিদান দিয়েছে। এই বর্বরতা যারা উচ্চারণ করেছে, তাদের ভেতরে বিজেপির নানা পদাধিকারীরা আছে। এমন কি আইনসভার সভ্যেরা আছেন বলে অভিযোগ।

এই বর্বরতার পর গোটা ভারতজুড়েই প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। বামপন্থি দলগুলোর সর্বোচ্চস্থর থেকে চরম প্রতিবাদ এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও যে প্রতিবাদ করেননি, তা নয়। তবে বামপন্থি দলগুলোর প্রতিবাদের মাত্রা আর মমতার প্রতিবাদের মাত্রার ভেতরে বিস্তর ফারাক আছে। বামপন্থিরা একদিন প্রতিবাদ করেই প্রতিবাদ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেননি। অপরপক্ষে ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিন্দা করলেও পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক ঘিরে আর কথা বলতে শোনা যায়নি।

‘মুসলমান মুক্ত’ রাজনৈতিক হিন্দুদের ভারত গড়বার স্বপ্ন হিন্দুত্ববাদীদের আজকের নয়। প্রায় একলো বছর আগে ১৯২৫ সালে যখন হিটলার, মুসোলিনীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ও অনেক আগে থেকেই এই ভাবনা হিন্দুত্ববাদীরা ভাবছে। আরএসএসের তাত্ত্বিক ভিত্তির অন্যতম প্রধান নির্মাতা এমএস গোলওয়ালকর বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে তার তথাকথিত, ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর তত্ত্বের ভেতর দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের এই ‘মুসলমান মুক্ত’ ভারতের ভাবনা একটা সুনির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় ছড়াতে শুরু করেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেই রাজ্যে যে মুসলমান বিধ্বংসী গণহত্যা চালিয়েছিলেন, সেটি ছিল আজ যে গণহত্যার কথা তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ করে সঙ্ঘনেতারা প্রকাশ্যে বলছে, তার মকশো।

নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বাজপেয়ী জামানাতেই এই মুসলমান শূন্য ভারত তৈরির চেষ্টায় কেবল গুজরাট গণহত্যাই নয়, গোটা দেশজুড়ে প্রবাহমান ভারতের সমন্বয়ী, বহুত্ববাদী চরিত্রটি ভেঙে তছনছ করবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র হিন্দুত্ববাদীরা করেছিল। শুধু নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, ক্ষমতা দখল করবার তাগিদে নবীন পট্টনায়ক, চন্দ্রবাবু নাইডু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রয়াত জয়রাম জয়ললিতারা হিন্দুত্ববাদীদের সেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাকে সফল করবার তাগিদে নিজেদের বোড়ের গুটি হিসেবে মেলে ধরে রেখেছিলেন। তাই আজ ধর্ম সংসদ নিয়ে মমতা একটু সরব হওয়ার ভান দেখান, কিন্তু তার রাজ্যে, তার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালেই যখন চলন্ত ট্রেন থেকে সংখ্যালঘু মুসলমান যে জেলায় সংখ্যাগুরু, সেই জেলাতেই মব লিঞ্চিং এর শিকার হয় অসহায় যুবক নাজিমুদ্দিন। প্রায় একমাস কেটে গেলেও সেই পাশবিকতা নিয়ে মমতার একটি প্রতিক্রিয়াও আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায় না।

যে আরএসএস ঘনিষ্ঠ স্বঘোষিত সন্তেরা হরিদ্বারে তথাকথিত ধর্মসংসদ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দেয়, সেই আরএসএস প্রভাবিত ‘হনুমানগড়ি আখড়া’ ই অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মীয়মান তথাকথিত রামমন্দিরের প্রধান ব্যবস্থাপক, সেই ‘হনুমানগড়ি আখড়া’রই স্বঘোষিত ‘সন্ত’ জ্ঞানদাস মোহন্ত সম্প্রতি গঙ্গাসাগরে কপিলমুনি (এই আশ্রমটির পরিচালক এই ‘হনুমানগড়ি আখড়া’। তারা এই মন্দিরে ভক্তদের যে বিপুল পরিমাণ দান সামগ্রী আসে, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণে কোনো রকম খরচ না করে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যায়) আশ্রমে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পাশে দাঁড় করিয়ে, মমতার প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে সাওয়াল করেছে। এই স্বঘোষিত সন্তটি এর আগে বেশ কয়েকবছর ধরেই, ‘মমতাকেই প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাই’ বলে সাগরদ্বীপ থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন। একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাওয়া এবং তার আড়ালে কাকে না চাওয়ার মতো রাজনৈতিক প্রসঙ্গ উঠেছে মমতার উপস্থিতিতে। মমতা কিন্তু কখনো একটি বারের জন্যেও বলেননি; ধর্ম আর রাজনীতিকে মেশাবেন না। কপিলমুনির আশ্রমে দাঁড়িয়ে রাজনীতির কথা বলবেন না।

কদিন আগে যে আরএসএসের শাখা সংগঠনগুলো হরিদ্বারে তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাকের মতো বর্বরোচিত উচ্চারণ করতে পারে, সেই আরএসএসেরই শাখা সংগঠন ‘হনুমানগড়ি আখড়া’ যে সংগঠনটি চিরনাতন ভারতের সমন্বয়ী সাধনার সৌধ ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর তথাকথিত রামমন্দির তৈরি করছে, সেই সংগঠনের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক শংসাকে সাড়ম্বরে উপভোগ করছেন মমতা- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই দ্বিচারিতা, এই সামগ্রিক ভ-ামি এখন ভারতে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দ্বিচারিতা, সামাজিক ভ-ামির সঙ্গে কার্যত পাল্লা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরএসএসের সাঙ্গপাঙ্গেরা সরাসরি গণহত্যার ডাক দেয়ার পর সেসব বর্বরদের বিরুদ্ধে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ পর্যন্ত কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি। দুই একজনের বিরুদ্ধে মামুলি এফআইআর অবশ্য হয়েছে। এইএফআই আর দিয়ে বিজেপি শাসিত উত্তরাখ- প্রশাসন নিজেদের রাষ্ট্রধর্ম পালনের অভিনয় করে যাচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই ধরনের অপরাধমূলক ঘোষণার প্রেক্ষিতে উতুতরাখ-ের পুলিশ একজনকেও গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেনি। মামলা দায়ের তো দূরের কথা। বেশ কয়েকজন অপরাধী আইনের হাত থেকে বাঁচতে গা বাঁচানো দুঃখপ্রকাশ করেছে। এই দুঃখপ্রকাশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে উত্তরাখ-ের বিজেপি প্রশাসন।

বস্তুত উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি আদৌ জেতবার মতো অবস্থায় নেই। সেখানকার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী অজয় বিশোওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের অপশাসনের ফলে উত্তরপ্রদেশের সাধারণ মানুষ আজ বিজেপির ওপর মারাত্মক বিরক্ত। শুধু বিভাজনের রাজনীতি আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ছাড়া উত্তরপ্রদেশে গত পাঁচ বছরে বিজেপি প্রশাসন কার্যত কিছুই করেনি। কোভিড মহামারীর সময়ে দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশের চিকিৎসা পরিষেবা কার্যত ধসে পড়েছিল। অক্সিজেনের অভাবে সেই রাজ্যে শত শত শিশু মারা গিয়েছে। শিশুদের যতখানি সম্ভব পরিষেবা দিতে যে চিকিৎসক তৎপর ছিলেন, সেই ডা. কাফিল খান জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ার দরুণ আদিত্যনাথের প্রশাসন তাকে হাজতবাস থেকে শুরু করে সব ধরনের হেনস্থা পর্যন্ত করেছিল।

উত্তরপ্রদেশে ভোট দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। আগামী ২০২২ সালের গোড়ার দিকেই উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, ত্রিপুরা, গোয়াতে ভোট। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে উত্তরপ্রদেশের ভোট বিজেপি, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির কাছে অগ্নিপরীক্ষা। তাই উত্তরপ্রদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে মোদি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গেরা অতিরিক্ত তৎপর। সেই তৎপরতার অঙ্গ হিসেবেই ব্যাপক উচ্ছেদ ঘটিয়ে বেনারসে বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন করিডর কয়েকশ’ কোটি টাকা খরচ করে উদ্বোধন করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি। ওই মন্দিরসংলগ্ন করিডর উদ্বোধনের নামে ছোট ছোট দোকানদার, যারা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান তাদের গণহারে উচ্ছেদ করেছে আদিত্যনাথের প্রশাসন। যে সব দোকানদারেরা জন্ম পরিচয়ে হিন্দু, তাদের পুনরুবাসিত করা হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু যেসব দোকানদারেরা জন্ম পরিচয়ে মুসলমান, ভারতের চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসারে ওই বিশ্বনাথ মন্দির-সংলগ্ন স্বল্প পরিসরের রাস্তায় নানা মনোহারী সামগ্রীর দোকান দিয়ে পুরুষানুক্রমে পেটের ভাত জোগার করছিল, সেসব মানুষদের উচ্ছেদ করে ঝাঁ চকচকে করিডর তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের ন্যূনতম ব্যবস্থাও করা হয়নি।

হরিদ্বারে তথাকথিত ধর্মসংসদে যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দিয়েছে আরএসএসের ছত্রছায়ায় থাকা তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনগুলো, সেই গণহত্যার প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে মোদি কেন্দ্রে ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই অত্যন্ত গোপনে অথচ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করা হয়েছে আরএসএসের পক্ষ থেকে। সেই অর্থনৈতিক অবরোধের অঙ্গ হিসেবেই মুসলমানদের ভাতে মারবার ষড়যন্ত্র চলছে গোটা ভারতজুড়ে। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এবং ওই দল যে রাজ্যগুলোতে ক্ষমতাসীন রয়েছে, সেখানে মুসলমানদের ভাতে মারবার আরএসএসের কর্মসূচি তো একদম নগ্নভাবে চলছে। তার বাইরে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যার মতো যে রাজ্যগুলিতে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির অদৃশ্য বন্ধুরা ক্ষমতাসীন আছে, সেই রাজ্যগুলোতেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই অর্থনৈতিক অবরোধের কাজটি সেখানকার প্রশাসকদের সাহায্যেই ভালোভাবে চলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরএসএস- বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে ওয়াকফের টাকা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ একাংশের ইমাম- মুয়াজ্জিনদের সামান্য কিছু টাকা ভাতা দেয়া হলেও সরকারি চাকরিসহ সব রকমের অর্থনৈতিক উন্নতির দরজাটা মুসলমান সম্প্রদায়ের সামনে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মমতা একদিকে নিজেকে সংখ্যালঘুপ্রেমী বলে প্রচারের ঢক্কানিনাদকে সর্বোচ্চ গ্রামে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, অপরপক্ষে নাজিমুদ্দিনরা তারই রাজ্যে মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী নীরব। অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। মমতাকে দেখা যাচ্ছে এমন তথাকথিত ধর্মগুরুদের পাশে যারা বাবরি মসজিদের ওপর নির্মীয়মান তথাকথিত রামমন্দিরের প্রধান পরিচালক। যে বাবরি মসজিদের জমি তদাকথিত রামমন্দিরের জন্য বরাদ্দ করে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি (যিনি এখন রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদ সদস্য) পরবর্তীতে নিজের আত্মজীবনীতে রায়দানের পর উচ্ছ্বাসে নিজের পানভোজনের কথাও অকপটে লেখেন। বলাবাহুল্য সেই পক্ষপাতমূলক রায়, যা ভারতের চিরন্তন সমন্বয়ী, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির পরিপন্থি, সেই রায় সম্পর্কে মমতা কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি। মমতার এই নীরবতা এবং বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর তথাকথিত রামমন্দিরের পরিচালকদের পাশে নিজের স্তূতি উপভোগ থেকেই বোঝা যাচ্ছে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ঘিরে মমতার প্রকৃত অবস্থানটা কি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ০১ জানুয়ারী ২০২২ , ১৭ পৌষ ১৪২৮ ২৭ জমাদিউল আউয়াল

ভারতকে গণহত্যার মুখে ঠেলার চেষ্টা এবং রাজনীতিকেরা

গৌতম রায়

নাজিমুদ্দিনকে খুন করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার বেগুনবাড়ি গাঁয়ের যুবক নাজিমুদ্দিন। শিয়ালদহ মেমু ট্রেনে সে উঠেছিল বাড়ি যাওয়ার জন্যে। দেবগ্রামের কাছে নিত্যযাত্রী, ছানার ব্যবসায়ীরা নাজিমুদ্দিনকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে খুন করে। রেল পুলিশ মামুলি পদক্ষেপ নেয় এই ঘটনার। প্রথম সারির কোন খবরের কাগজে নাজিমুদ্দিনের ঘটনা ঠাঁই পায় না। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমেও না। সামাজিক গণমাধ্যমের বড়াই করেন যারা, তারাও নীরব থাকেন। দু-চারজন মানুষ, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান, তারাই সরব হন সামাজিক গণমাধ্যমে। একটি খবরের কাগজ, যেটি শাসক ঘনিষ্ঠ হলেও, ‘মুসলমানদের কাগজ’ বলেই শাসকের ভেতর সংখ্যাগরিষ্ঠের নাক সিটকোনোর শিকার, একমাত্র সেই কাগজটিতেই নাজিমুদ্দিনের ঘটনা ঠাঁই পায়। এই লেখা পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনা সম্পর্কে কোন প্রতিক্রিয়া দেননি। বামপন্থি নেতারা নীরব। মানুষের অধিকারের কথা বলার দাবি করা বামপন্থি পত্রপত্রিকা গুলিও নীরব।

নাজিমুদ্দিনের ঘটনা কি নিছক রেলের মুর্শিদাবাদ শাখায় ছানা ব্যবসায়ীদের দাপটের পরিণতি? এই বর্বরতার সঙ্গে গোটা ভারত জুড়ে যে ঘৃণার রাজনীতির সামাজিকীকরণ চালানোর চেষ্টা চলছে, পশ্চিমবঙ্গেও সেই ঘৃণার রাজনীতির নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি না? দিল্লিতে কয়েক বছর আগে যেভাবে দিনের আলোয় ট্রেনের কামরা থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিল পহেলু খানকে শুধু ‘মুসলমান’ হওয়ার কারণে, নাজিমুদ্দিনের ঘটনাও কি সেই বর্বরতার ছায়াকেই আমাদের সামনে প্রকট করে তুলছে না? দিল্লির ট্রেনের কামরাটিতে একাংশের নিত্যযাত্রীরা ভজন কীর্তনের নামে সাময়িক মন্দির নাকি তৈরি করে ফেলতেন। আর সেই সাময়িক মন্দিরে কোনো অহিন্দু থাকতে পারেন না। তাই পাশবিক আচরণ করে চলন্ত ট্রেনের কামরা থেকে ঠেলে ফেলে দেয়া হয়েছিল পহেলু খান কে।

এই পশ্চিমবঙ্গের লালগোলা মেমু ট্রেনটিতে কয়েকটি কামরা ছানা ব্যবসায়ীদের দখলে থাকে। সেই কামরাতে তারা যাতায়াত করবার কালে বিনোদনের মতো করেই ভজন কীর্তন করে থাকে। সেই ভজনকীর্তনের আঙ্গিকের সঙ্গে ভক্তিরসের কোন সম্পর্ক থাকে না। বরংচ থাকে একটা সূক্ষ্ম যৌন আবেদন। চলতে থাকে ধূমপান থেকে শুরু করে নানা ধরনের নেশা। রেলের আইন অনুযায়ী অন্য নেশা তো দূরের কথা, ধূমপান পর্যন্ত চলন্ত ট্রেনে নিষিদ্ধ। সেখানে এসব নিত্যযাত্রীরা নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে চলাফেরা করবার সময়ে ট্রেনের ভেতরে যে অবাধে নেশা করে চলে, এটা রেল পুলিশের না জানার কথা নয়। ভজন-কীর্তন করতে করতে মাদক ভরা সিগারেট টানতে টানতে এসব নিত্য ছানা ব্যবসায়ীদের যাতায়াত সাধারণ যাত্রীদের কাছে নানা সমস্যা তৈরি করে। সাধারণ যাত্রীরা তাদের সমস্যার কথা রেল পুলিশকে জানালেও, কোনো কাজ হয়নি।

নাজিমুদ্দিন কে যে চলন্ত ট্রেন থেকে এই ছানা ব্যবসায়ীরা ঠেলে ফেলে দিয়েছে, তার পেছনে নেশাগ্রস্তদের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে গোটা ঘটনার পেছনে যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক প্রবণতা আছে, সেটাকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। প্রতিরোধহীন ঘেণার রাজনীতি আজ গোটা ভারতের রাজনীতির পরিম-লকে কার্যত বিষ নিঃশ্বাসে ভরে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘নিরুদ্ধ সমীরণ’ আজ ভারতের গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলেছে।

উত্তরাখ-ের হরিদ্বারে তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ বসেছিল। এই ধর্মসংসদের নেপথ্যে যেমন চিরকাল ইআরএসএস বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা থাকে, এইবার ও তার অন্যথা হয়নি। সেই তথাকথিত ‘ধর্মসংসদে’ সব ভেকধারী সাধুরা প্রায় একযোগে ভারতকে মুসলমানশূন্য করার লক্ষ্যে গণহত্যার নিদান দিয়েছে। এই বর্বরতা যারা উচ্চারণ করেছে, তাদের ভেতরে বিজেপির নানা পদাধিকারীরা আছে। এমন কি আইনসভার সভ্যেরা আছেন বলে অভিযোগ।

এই বর্বরতার পর গোটা ভারতজুড়েই প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। বামপন্থি দলগুলোর সর্বোচ্চস্থর থেকে চরম প্রতিবাদ এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও যে প্রতিবাদ করেননি, তা নয়। তবে বামপন্থি দলগুলোর প্রতিবাদের মাত্রা আর মমতার প্রতিবাদের মাত্রার ভেতরে বিস্তর ফারাক আছে। বামপন্থিরা একদিন প্রতিবাদ করেই প্রতিবাদ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেননি। অপরপক্ষে ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিন্দা করলেও পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক ঘিরে আর কথা বলতে শোনা যায়নি।

‘মুসলমান মুক্ত’ রাজনৈতিক হিন্দুদের ভারত গড়বার স্বপ্ন হিন্দুত্ববাদীদের আজকের নয়। প্রায় একলো বছর আগে ১৯২৫ সালে যখন হিটলার, মুসোলিনীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ও অনেক আগে থেকেই এই ভাবনা হিন্দুত্ববাদীরা ভাবছে। আরএসএসের তাত্ত্বিক ভিত্তির অন্যতম প্রধান নির্মাতা এমএস গোলওয়ালকর বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে তার তথাকথিত, ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর তত্ত্বের ভেতর দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের এই ‘মুসলমান মুক্ত’ ভারতের ভাবনা একটা সুনির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় ছড়াতে শুরু করেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেই রাজ্যে যে মুসলমান বিধ্বংসী গণহত্যা চালিয়েছিলেন, সেটি ছিল আজ যে গণহত্যার কথা তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ করে সঙ্ঘনেতারা প্রকাশ্যে বলছে, তার মকশো।

নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বাজপেয়ী জামানাতেই এই মুসলমান শূন্য ভারত তৈরির চেষ্টায় কেবল গুজরাট গণহত্যাই নয়, গোটা দেশজুড়ে প্রবাহমান ভারতের সমন্বয়ী, বহুত্ববাদী চরিত্রটি ভেঙে তছনছ করবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র হিন্দুত্ববাদীরা করেছিল। শুধু নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, ক্ষমতা দখল করবার তাগিদে নবীন পট্টনায়ক, চন্দ্রবাবু নাইডু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রয়াত জয়রাম জয়ললিতারা হিন্দুত্ববাদীদের সেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাকে সফল করবার তাগিদে নিজেদের বোড়ের গুটি হিসেবে মেলে ধরে রেখেছিলেন। তাই আজ ধর্ম সংসদ নিয়ে মমতা একটু সরব হওয়ার ভান দেখান, কিন্তু তার রাজ্যে, তার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালেই যখন চলন্ত ট্রেন থেকে সংখ্যালঘু মুসলমান যে জেলায় সংখ্যাগুরু, সেই জেলাতেই মব লিঞ্চিং এর শিকার হয় অসহায় যুবক নাজিমুদ্দিন। প্রায় একমাস কেটে গেলেও সেই পাশবিকতা নিয়ে মমতার একটি প্রতিক্রিয়াও আজ পর্যন্ত জানতে পারা যায় না।

যে আরএসএস ঘনিষ্ঠ স্বঘোষিত সন্তেরা হরিদ্বারে তথাকথিত ধর্মসংসদ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দেয়, সেই আরএসএস প্রভাবিত ‘হনুমানগড়ি আখড়া’ ই অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মীয়মান তথাকথিত রামমন্দিরের প্রধান ব্যবস্থাপক, সেই ‘হনুমানগড়ি আখড়া’রই স্বঘোষিত ‘সন্ত’ জ্ঞানদাস মোহন্ত সম্প্রতি গঙ্গাসাগরে কপিলমুনি (এই আশ্রমটির পরিচালক এই ‘হনুমানগড়ি আখড়া’। তারা এই মন্দিরে ভক্তদের যে বিপুল পরিমাণ দান সামগ্রী আসে, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণে কোনো রকম খরচ না করে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যায়) আশ্রমে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পাশে দাঁড় করিয়ে, মমতার প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে সাওয়াল করেছে। এই স্বঘোষিত সন্তটি এর আগে বেশ কয়েকবছর ধরেই, ‘মমতাকেই প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাই’ বলে সাগরদ্বীপ থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন। একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাওয়া এবং তার আড়ালে কাকে না চাওয়ার মতো রাজনৈতিক প্রসঙ্গ উঠেছে মমতার উপস্থিতিতে। মমতা কিন্তু কখনো একটি বারের জন্যেও বলেননি; ধর্ম আর রাজনীতিকে মেশাবেন না। কপিলমুনির আশ্রমে দাঁড়িয়ে রাজনীতির কথা বলবেন না।

কদিন আগে যে আরএসএসের শাখা সংগঠনগুলো হরিদ্বারে তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাকের মতো বর্বরোচিত উচ্চারণ করতে পারে, সেই আরএসএসেরই শাখা সংগঠন ‘হনুমানগড়ি আখড়া’ যে সংগঠনটি চিরনাতন ভারতের সমন্বয়ী সাধনার সৌধ ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর তথাকথিত রামমন্দির তৈরি করছে, সেই সংগঠনের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক শংসাকে সাড়ম্বরে উপভোগ করছেন মমতা- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই দ্বিচারিতা, এই সামগ্রিক ভ-ামি এখন ভারতে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দ্বিচারিতা, সামাজিক ভ-ামির সঙ্গে কার্যত পাল্লা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরএসএসের সাঙ্গপাঙ্গেরা সরাসরি গণহত্যার ডাক দেয়ার পর সেসব বর্বরদের বিরুদ্ধে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা আজ পর্যন্ত কোন কার্যকরী ভূমিকা পালন করেনি। দুই একজনের বিরুদ্ধে মামুলি এফআইআর অবশ্য হয়েছে। এইএফআই আর দিয়ে বিজেপি শাসিত উত্তরাখ- প্রশাসন নিজেদের রাষ্ট্রধর্ম পালনের অভিনয় করে যাচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই ধরনের অপরাধমূলক ঘোষণার প্রেক্ষিতে উতুতরাখ-ের পুলিশ একজনকেও গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেনি। মামলা দায়ের তো দূরের কথা। বেশ কয়েকজন অপরাধী আইনের হাত থেকে বাঁচতে গা বাঁচানো দুঃখপ্রকাশ করেছে। এই দুঃখপ্রকাশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে উত্তরাখ-ের বিজেপি প্রশাসন।

বস্তুত উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি আদৌ জেতবার মতো অবস্থায় নেই। সেখানকার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী অজয় বিশোওয়াত ওরফে স্বঘোষিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথের অপশাসনের ফলে উত্তরপ্রদেশের সাধারণ মানুষ আজ বিজেপির ওপর মারাত্মক বিরক্ত। শুধু বিভাজনের রাজনীতি আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ছাড়া উত্তরপ্রদেশে গত পাঁচ বছরে বিজেপি প্রশাসন কার্যত কিছুই করেনি। কোভিড মহামারীর সময়ে দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশের চিকিৎসা পরিষেবা কার্যত ধসে পড়েছিল। অক্সিজেনের অভাবে সেই রাজ্যে শত শত শিশু মারা গিয়েছে। শিশুদের যতখানি সম্ভব পরিষেবা দিতে যে চিকিৎসক তৎপর ছিলেন, সেই ডা. কাফিল খান জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ার দরুণ আদিত্যনাথের প্রশাসন তাকে হাজতবাস থেকে শুরু করে সব ধরনের হেনস্থা পর্যন্ত করেছিল।

উত্তরপ্রদেশে ভোট দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। আগামী ২০২২ সালের গোড়ার দিকেই উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, ত্রিপুরা, গোয়াতে ভোট। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে উত্তরপ্রদেশের ভোট বিজেপি, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির কাছে অগ্নিপরীক্ষা। তাই উত্তরপ্রদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে মোদি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গেরা অতিরিক্ত তৎপর। সেই তৎপরতার অঙ্গ হিসেবেই ব্যাপক উচ্ছেদ ঘটিয়ে বেনারসে বিশ্বনাথ মন্দির সংলগ্ন করিডর কয়েকশ’ কোটি টাকা খরচ করে উদ্বোধন করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি। ওই মন্দিরসংলগ্ন করিডর উদ্বোধনের নামে ছোট ছোট দোকানদার, যারা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান তাদের গণহারে উচ্ছেদ করেছে আদিত্যনাথের প্রশাসন। যে সব দোকানদারেরা জন্ম পরিচয়ে হিন্দু, তাদের পুনরুবাসিত করা হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু যেসব দোকানদারেরা জন্ম পরিচয়ে মুসলমান, ভারতের চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসারে ওই বিশ্বনাথ মন্দির-সংলগ্ন স্বল্প পরিসরের রাস্তায় নানা মনোহারী সামগ্রীর দোকান দিয়ে পুরুষানুক্রমে পেটের ভাত জোগার করছিল, সেসব মানুষদের উচ্ছেদ করে ঝাঁ চকচকে করিডর তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের ন্যূনতম ব্যবস্থাও করা হয়নি।

হরিদ্বারে তথাকথিত ধর্মসংসদে যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দিয়েছে আরএসএসের ছত্রছায়ায় থাকা তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনগুলো, সেই গণহত্যার প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে মোদি কেন্দ্রে ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই অত্যন্ত গোপনে অথচ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করা হয়েছে আরএসএসের পক্ষ থেকে। সেই অর্থনৈতিক অবরোধের অঙ্গ হিসেবেই মুসলমানদের ভাতে মারবার ষড়যন্ত্র চলছে গোটা ভারতজুড়ে। বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এবং ওই দল যে রাজ্যগুলোতে ক্ষমতাসীন রয়েছে, সেখানে মুসলমানদের ভাতে মারবার আরএসএসের কর্মসূচি তো একদম নগ্নভাবে চলছে। তার বাইরে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যার মতো যে রাজ্যগুলিতে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির অদৃশ্য বন্ধুরা ক্ষমতাসীন আছে, সেই রাজ্যগুলোতেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই অর্থনৈতিক অবরোধের কাজটি সেখানকার প্রশাসকদের সাহায্যেই ভালোভাবে চলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরএসএস- বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে ওয়াকফের টাকা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ একাংশের ইমাম- মুয়াজ্জিনদের সামান্য কিছু টাকা ভাতা দেয়া হলেও সরকারি চাকরিসহ সব রকমের অর্থনৈতিক উন্নতির দরজাটা মুসলমান সম্প্রদায়ের সামনে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মমতা একদিকে নিজেকে সংখ্যালঘুপ্রেমী বলে প্রচারের ঢক্কানিনাদকে সর্বোচ্চ গ্রামে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, অপরপক্ষে নাজিমুদ্দিনরা তারই রাজ্যে মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী নীরব। অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। মমতাকে দেখা যাচ্ছে এমন তথাকথিত ধর্মগুরুদের পাশে যারা বাবরি মসজিদের ওপর নির্মীয়মান তথাকথিত রামমন্দিরের প্রধান পরিচালক। যে বাবরি মসজিদের জমি তদাকথিত রামমন্দিরের জন্য বরাদ্দ করে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি (যিনি এখন রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদ সদস্য) পরবর্তীতে নিজের আত্মজীবনীতে রায়দানের পর উচ্ছ্বাসে নিজের পানভোজনের কথাও অকপটে লেখেন। বলাবাহুল্য সেই পক্ষপাতমূলক রায়, যা ভারতের চিরন্তন সমন্বয়ী, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির পরিপন্থি, সেই রায় সম্পর্কে মমতা কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেননি। মমতার এই নীরবতা এবং বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর তথাকথিত রামমন্দিরের পরিচালকদের পাশে নিজের স্তূতি উপভোগ থেকেই বোঝা যাচ্ছে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ঘিরে মমতার প্রকৃত অবস্থানটা কি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]