কেমন কাটল বিদায়ী বছর

মিহির কুমার রায়

২০২১ সালটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ (মুজিববর্ষ) পালনের বছর, স্বাধীনতা ও বিজযের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর।

কভিড-১৯ এর প্রভাবে ২০২০ সালে প্রবাসে কর্মী পাঠানো হ্রাস পেলেও ২০২১ সালে কর্মী পাঠানো বেড়েছে, আবার একই সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে বিধায় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাস পুরোপুরি বন্ধ ছিল বিদেশে গমন করোনার প্রভাবের কারনে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন কর্মী। এই অভিঘাতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় ১৬ লাখ এবং মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ।

করোনার কারণে রপ্তানি খাতে ২০২০ সালে যে কমতি দেখা দিয়েছিল, ২০২১ সালে সেটা অনেকটা কেটে গেছে। প্রবাসী আয় কমলেও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক বড খাত পণ্য রপ্তানি এ বছরে বেেেডছ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বরে) ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ২১৫ কোটি টাকার সমান। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছে, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। তবে এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন, যার নাম ‘অমিক্রন’ যার ফলে রপ্তানিকারকেরা কিছুটা শঙ্কায় রয়েছেন। কারণ বিশেষত ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোর আয় বাডার পাশাপাশি বেড়েছে মুনাফাও। ২০২১ সালে ৩২টি ব্যাংকের মধ্যে ২৬টি ব্যাংক ২০২০-এর তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে এবং ছয়টি ব্যাংকের মুনাফায় নেগেটিভ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তবে করোনার মধ্যে ব্যাংক খাত বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলছে, সব ধরনের সুদের হারের সীমারেখা বেঁধে দেয়ার ফলে ভোক্তা-ঋণ ও অন্যান্য রিটেইল ব্যবসায় ব্যাংকগুলো আগ্রহ হাড়িয়েছে। তবে বিশাল জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ২০২১ সালের সফলতা ছিল উল্লেখযোগ্য যেমন এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা ইত্যাদি।

করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালে কোন টাকা পরিশোধ না করলেও সেই গ্রাহককে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। ২০২১ সালে নতুন সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়েছে গ্রাহকদের, অন্য দিকে তলবি ঋণ চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আটটি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর পরও ২০২১ সালে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেেেডছ প্রায় ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ‘ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মার্চের শেষে ছিল ৯৪ হাজার ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। শুধু এপ্রিল-জুন ’২১ সসপড খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। জুন ’২১ পর্যন্ত দেশে বিতরণকৃত মোট ঋণ ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার মধ্যে বেড়েছে ১০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, যেটি মোট ঋণের ৮.৬১ শতাংশ এবং গত মার্চে এর হার ছিল ৮. ৪৮ শতাংশ।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে বেসরকারি খাতে শিল্প তিন হাজার থেকে বেড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে(২০২১) প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। এককালের বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যেখানে দেশের কর্মক্ষম সাড়ে ৮ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত বেসরকারি শিল্প খাতের সঙ্গে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিনির্ভর থেকে পুরোপুরি শিল্পনির্ভর দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯. ৪ শতাংশ, আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে মাত্র ৬.৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে, ক্রমশ শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাবে, মোট জিডিপি তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে, সেবা খাতের অবদান শীর্ষে।

গত অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতে অবদান ছিল ৫৩.১২ শতাংশ আর কৃষি খাতের অবদান কমে ১২.৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প খাত জোগান দিয়েছে ৩৪.৫৪ শতাংশ। শিল্পায়নের সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে যার মূল লক্ষ্য বিনিয়োগকারী আকর্ষণ ও শিল্পায়নের মাধ্যমে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। শিল্প-বাণিজ্যসহ সব খাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৪৫টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আওতায় খাতভিত্তিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার মূলক ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে ১৯০টি দেশে। কৃষিভিত্তিক এবং আমদানিনির্ভর দেশ হতে বাংলাদেশ ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একটি উৎপাদননির্ভর রপ্তানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। শিল্প খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭.৭ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হবে এই ধারণা সংস্থাটি দিয়ে রেখেছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। করোনার আঘাত খানিকটা থমকে দিলেও সার্বিক চিত্র বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ সে পথেই হাঁটছে এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে পেরেছে যার চূড়ান্ত রূপ মিলবে

২০৭১ সালে বাংলাদেশের বয়স হবে ১০০ বছর তখন ৮৫ শতাংশ মানুষ হবে শহরবাসী। শহরের মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, গ্রামের মানুষও একই রকম সুবিধা ভোগ করবে। যেমন পাইপের মাধ্যমে পানি যাবে, বিদ্যুৎ যাবে এবং গ্রাম গড়ে তোলা হবে পরিকল্পিতভাবে। এই ভাবেই এগুচ্ছে দেশ। তবে করোনা কাল (২০২০-২১) আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের সব ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে হবে মানবিকতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে।

[লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

শনিবার, ০১ জানুয়ারী ২০২২ , ১৭ পৌষ ১৪২৮ ২৭ জমাদিউল আউয়াল

কেমন কাটল বিদায়ী বছর

মিহির কুমার রায়

২০২১ সালটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ (মুজিববর্ষ) পালনের বছর, স্বাধীনতা ও বিজযের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর।

কভিড-১৯ এর প্রভাবে ২০২০ সালে প্রবাসে কর্মী পাঠানো হ্রাস পেলেও ২০২১ সালে কর্মী পাঠানো বেড়েছে, আবার একই সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে বিধায় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাস পুরোপুরি বন্ধ ছিল বিদেশে গমন করোনার প্রভাবের কারনে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন কর্মী। এই অভিঘাতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় ১৬ লাখ এবং মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ।

করোনার কারণে রপ্তানি খাতে ২০২০ সালে যে কমতি দেখা দিয়েছিল, ২০২১ সালে সেটা অনেকটা কেটে গেছে। প্রবাসী আয় কমলেও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক বড খাত পণ্য রপ্তানি এ বছরে বেেেডছ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বরে) ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ২১৫ কোটি টাকার সমান। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছে, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। তবে এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন, যার নাম ‘অমিক্রন’ যার ফলে রপ্তানিকারকেরা কিছুটা শঙ্কায় রয়েছেন। কারণ বিশেষত ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোর আয় বাডার পাশাপাশি বেড়েছে মুনাফাও। ২০২১ সালে ৩২টি ব্যাংকের মধ্যে ২৬টি ব্যাংক ২০২০-এর তুলনায় বেশি মুনাফা করেছে এবং ছয়টি ব্যাংকের মুনাফায় নেগেটিভ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তবে করোনার মধ্যে ব্যাংক খাত বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলছে, সব ধরনের সুদের হারের সীমারেখা বেঁধে দেয়ার ফলে ভোক্তা-ঋণ ও অন্যান্য রিটেইল ব্যবসায় ব্যাংকগুলো আগ্রহ হাড়িয়েছে। তবে বিশাল জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ২০২১ সালের সফলতা ছিল উল্লেখযোগ্য যেমন এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা ইত্যাদি।

করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালে কোন টাকা পরিশোধ না করলেও সেই গ্রাহককে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। ২০২১ সালে নতুন সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়েছে গ্রাহকদের, অন্য দিকে তলবি ঋণ চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আটটি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর পরও ২০২১ সালে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেেেডছ প্রায় ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ‘ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ১৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মার্চের শেষে ছিল ৯৪ হাজার ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। শুধু এপ্রিল-জুন ’২১ সসপড খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। জুন ’২১ পর্যন্ত দেশে বিতরণকৃত মোট ঋণ ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার মধ্যে বেড়েছে ১০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, যেটি মোট ঋণের ৮.৬১ শতাংশ এবং গত মার্চে এর হার ছিল ৮. ৪৮ শতাংশ।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে বেসরকারি খাতে শিল্প তিন হাজার থেকে বেড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে(২০২১) প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। এককালের বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যেখানে দেশের কর্মক্ষম সাড়ে ৮ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত বেসরকারি শিল্প খাতের সঙ্গে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিনির্ভর থেকে পুরোপুরি শিল্পনির্ভর দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯. ৪ শতাংশ, আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে মাত্র ৬.৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে, ক্রমশ শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাবে, মোট জিডিপি তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে, সেবা খাতের অবদান শীর্ষে।

গত অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতে অবদান ছিল ৫৩.১২ শতাংশ আর কৃষি খাতের অবদান কমে ১২.৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প খাত জোগান দিয়েছে ৩৪.৫৪ শতাংশ। শিল্পায়নের সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে যার মূল লক্ষ্য বিনিয়োগকারী আকর্ষণ ও শিল্পায়নের মাধ্যমে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। শিল্প-বাণিজ্যসহ সব খাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৪৫টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আওতায় খাতভিত্তিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার মূলক ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে ১৯০টি দেশে। কৃষিভিত্তিক এবং আমদানিনির্ভর দেশ হতে বাংলাদেশ ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একটি উৎপাদননির্ভর রপ্তানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। শিল্প খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭.৭ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হবে এই ধারণা সংস্থাটি দিয়ে রেখেছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। করোনার আঘাত খানিকটা থমকে দিলেও সার্বিক চিত্র বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ সে পথেই হাঁটছে এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে পেরেছে যার চূড়ান্ত রূপ মিলবে

২০৭১ সালে বাংলাদেশের বয়স হবে ১০০ বছর তখন ৮৫ শতাংশ মানুষ হবে শহরবাসী। শহরের মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, গ্রামের মানুষও একই রকম সুবিধা ভোগ করবে। যেমন পাইপের মাধ্যমে পানি যাবে, বিদ্যুৎ যাবে এবং গ্রাম গড়ে তোলা হবে পরিকল্পিতভাবে। এই ভাবেই এগুচ্ছে দেশ। তবে করোনা কাল (২০২০-২১) আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের সব ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে হবে মানবিকতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে।

[লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]