স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত

ব্রিটিশ আমলে মুসলিম ব্যাংকার ছিল হাতে গোনা। পাকিস্তান আমলে এদেশ থেকে অমুসলিম ব্যাংকাররা চলে যাওয়ায় ব্যাংকিং পেশায় মুসলমানদের আগমন শুরু হয়। পাকিস্তান আমলে এ পেশায় বাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। স্বাধীনতা পূর্বকালে মাত্র ১৪ শতাংশ ব্যাংকিং ব্যবসা পূর্ব পাকিস্তানিরা পরিচালনা করতো।

পূর্ব পাকিস্তানে ১২টি ব্যাংকের মধ্যে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত) যা বর্তমানে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড এবং ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন (১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) বর্তমানে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড এই দুটি ব্যাংক ছিল পূর্ব পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানায় পরিচালিত ব্যাংকগুলো এ অঞ্চল থেকে শুধুমাত্র আমানত সংগ্রহ করতো। বিনিয়োগ ও শিল্প উদ্যোগের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো। পূর্ব পাকিস্তানিদের বিনিয়োগের বা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তারা দিত না। ফলে এদেশের মানুষের টাকায় উন্নয়ন হতো পশ্চিম পাকিস্তানে।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ ১২৭নং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে স্বাধীন ব্যাংক ব্যবস্থার সূচনা হয়। ঢাকায় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের পূর্ব শাখার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এদেশে চালু থাকা ১২টি ব্যাংককে জাতীয়করণ করে ছয়টি ব্যাংকে পরিণত করা হয়। স্বল্প সংখ্যক দক্ষ ব্যাংকার তখন দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগ নেন। পাকিস্তানি ও ভিনদেশি ব্যাংকার ও লুটেরাদের রেখে যাওয়া বিধ্বস্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সদ্য স্বাধীন একটি দেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে অপরিসীম পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন এদেশের ব্যাংকাররা। পাকিস্তানিরা শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে ব্যাংকের শাখা গড়ে তুলেছিল এবং ধনিক শ্রেণীকে ব্যাংকিং সেবা দিত।

স্বাধীনতার পরবর্তীতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাংকিং নীতিমালা ঢেলে সাজানো হয় এবং সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোর জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষ দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

একসময় এদেশে মানুষের মধ্যে ব্যাংক বিমুখতা ছিল। মানুষ মাটির কলসিতে, বাঁশের খুটির মধ্যে, মাটির ব্যাংকে ও বালিশের ভেতরে তাদের টাকা, পয়সা ও সম্পদ লুকিয়ে রাখত। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী ব্যাংকিং সেবা উন্নয়ন, সংস্কার ও বিস্তারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছে অবলীলায়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশি- বিদেশি মিলে ১৪টি ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ছিল ১১৬৯টি। বর্তমানে দেশে মোট ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৮১২টি। এছাড়া উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক বিস্তারের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে মোট আমানতকারী সঞ্চয় হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৬টি। ওই সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানত ছিল মাত্র ৩৩৯ কোটি টাকা যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৪,৬২,৮৮৮ কোটি টাকা। স্বাধীনতা অর্জনের সময়ে দেশে ব্যাংকিং পেশাদার ছিলেন ১৬২৫০ জন যা বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি।

১৯৮২ সালে আরব বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের সর্বপ্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ওই বছরই ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরও পাঁচটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং শিল্পের বিস্তার শুরু হয়।

ইসলামী ব্যাংকিং এখন বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধমান। বর্তমানে দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি। আরও অনেক ব্যাংক বিশেষায়িত শাখা ও উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ও বিনিয়োগের ২৭ শতাংশ ইসলামি ব্যাংকগুলোর। আমানত বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স আহরণে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অবস্থান সবার শীর্ষে। ইউকে ভিত্তিক দি ব্যাংকার ম্যাগাজিনের জরিপ অনুযায়ী বিভিন্ন সূচকে এ ব্যাংকটি বিশে^র এক হাজার শক্তিশালী ব্যাংকের একটি। এ তালিকায় এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক।

প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগের মতো। দেশের ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয়েছে অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ক্যাশ ডেপজিট মেশিন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ও বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা বা এজেন্সি। পাড়ার মুদি দোনানটিও এখন পরিণত হয়েছে ব্যাংকের শাখায়। হিসাব খোলা ও বন্ধ করা যায় ঘরে বসেই। ব্যাংকের বিনিয়োগ পাওয়াও এখন অনেক সহজ। পণ্য এবং সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এদেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের দিয়ে যাচ্ছে প্রভূত সেবা।

ব্যাংকিং এখন আর শুধুমাত্র আমানত আর বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বহুমাত্রিক সেবা প্রতিষ্ঠানে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে ইউটিলিটি বিলসহ অটোমেটেড চালান সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি ১৬০ প্রকারের সেবার বিল সংগ্রহ করে মানুষের জীবন সহজকরণে অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান দুটি স্তম্ভ তৈরি পোশাক খাত উন্নয়ন এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণে ব্যাংকগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার এককভাবে সর্বোচ্চ। দেশের মোট রেমিট্যান্সের এক তৃতীয়াংশ এ ব্যাংকের মাধ্যমে আসে।

ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রমেও এগিয়ে রয়েছে ব্যাংকগুলো। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনেও প্রচুর আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে দেশের ব্যাংক খাত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মত ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক।

সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নেতৃত্বে বাংকগুলো সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে একযোগে কাজ করছে।

তবে ব্যাংক খাত বড় হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যাও দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা যা মোট বিনিয়োগের ৮.৬১ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিশেষায়িতসহ ৫৫ টি ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৫৬ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।

গ্রাহকদের অর্থনৈতিক অভ্যাসের পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ব্যাংক খাত বড় ধরণের হুমকির সম্মুখিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

দেশে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হল মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো অনেকগুলো ঘটনা রয়েছে। এ সংকট উত্তরণে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরিপালনের সংস্কৃতি লালন করতে হবে।

লেখক: ব্যাংকার

ইমেইল: iyazenglish@gmail.com

রবিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২২ , ১৮ পৌষ ১৪২৮ ২৮ জমাদিউল আউয়াল

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত

রিয়াজ উদ্দিন

ব্রিটিশ আমলে মুসলিম ব্যাংকার ছিল হাতে গোনা। পাকিস্তান আমলে এদেশ থেকে অমুসলিম ব্যাংকাররা চলে যাওয়ায় ব্যাংকিং পেশায় মুসলমানদের আগমন শুরু হয়। পাকিস্তান আমলে এ পেশায় বাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। স্বাধীনতা পূর্বকালে মাত্র ১৪ শতাংশ ব্যাংকিং ব্যবসা পূর্ব পাকিস্তানিরা পরিচালনা করতো।

পূর্ব পাকিস্তানে ১২টি ব্যাংকের মধ্যে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত) যা বর্তমানে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড এবং ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন (১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) বর্তমানে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড এই দুটি ব্যাংক ছিল পূর্ব পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদের মালিকানাধীন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানায় পরিচালিত ব্যাংকগুলো এ অঞ্চল থেকে শুধুমাত্র আমানত সংগ্রহ করতো। বিনিয়োগ ও শিল্প উদ্যোগের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো। পূর্ব পাকিস্তানিদের বিনিয়োগের বা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তারা দিত না। ফলে এদেশের মানুষের টাকায় উন্নয়ন হতো পশ্চিম পাকিস্তানে।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ ১২৭নং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশে স্বাধীন ব্যাংক ব্যবস্থার সূচনা হয়। ঢাকায় স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের পূর্ব শাখার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এদেশে চালু থাকা ১২টি ব্যাংককে জাতীয়করণ করে ছয়টি ব্যাংকে পরিণত করা হয়। স্বল্প সংখ্যক দক্ষ ব্যাংকার তখন দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগ নেন। পাকিস্তানি ও ভিনদেশি ব্যাংকার ও লুটেরাদের রেখে যাওয়া বিধ্বস্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সদ্য স্বাধীন একটি দেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে অপরিসীম পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন এদেশের ব্যাংকাররা। পাকিস্তানিরা শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে ব্যাংকের শাখা গড়ে তুলেছিল এবং ধনিক শ্রেণীকে ব্যাংকিং সেবা দিত।

স্বাধীনতার পরবর্তীতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাংকিং নীতিমালা ঢেলে সাজানো হয় এবং সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোর জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষ দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

একসময় এদেশে মানুষের মধ্যে ব্যাংক বিমুখতা ছিল। মানুষ মাটির কলসিতে, বাঁশের খুটির মধ্যে, মাটির ব্যাংকে ও বালিশের ভেতরে তাদের টাকা, পয়সা ও সম্পদ লুকিয়ে রাখত। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী ব্যাংকিং সেবা উন্নয়ন, সংস্কার ও বিস্তারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছে অবলীলায়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশি- বিদেশি মিলে ১৪টি ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ছিল ১১৬৯টি। বর্তমানে দেশে মোট ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৮১২টি। এছাড়া উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক বিস্তারের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে মোট আমানতকারী সঞ্চয় হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৬টি। ওই সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানত ছিল মাত্র ৩৩৯ কোটি টাকা যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৪,৬২,৮৮৮ কোটি টাকা। স্বাধীনতা অর্জনের সময়ে দেশে ব্যাংকিং পেশাদার ছিলেন ১৬২৫০ জন যা বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি।

১৯৮২ সালে আরব বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের সর্বপ্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ওই বছরই ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরও পাঁচটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংকিং শিল্পের বিস্তার শুরু হয়।

ইসলামী ব্যাংকিং এখন বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধমান। বর্তমানে দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি। আরও অনেক ব্যাংক বিশেষায়িত শাখা ও উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ও বিনিয়োগের ২৭ শতাংশ ইসলামি ব্যাংকগুলোর। আমানত বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স আহরণে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অবস্থান সবার শীর্ষে। ইউকে ভিত্তিক দি ব্যাংকার ম্যাগাজিনের জরিপ অনুযায়ী বিভিন্ন সূচকে এ ব্যাংকটি বিশে^র এক হাজার শক্তিশালী ব্যাংকের একটি। এ তালিকায় এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক।

প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগের মতো। দেশের ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয়েছে অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ক্যাশ ডেপজিট মেশিন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ও বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা বা এজেন্সি। পাড়ার মুদি দোনানটিও এখন পরিণত হয়েছে ব্যাংকের শাখায়। হিসাব খোলা ও বন্ধ করা যায় ঘরে বসেই। ব্যাংকের বিনিয়োগ পাওয়াও এখন অনেক সহজ। পণ্য এবং সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এদেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের দিয়ে যাচ্ছে প্রভূত সেবা।

ব্যাংকিং এখন আর শুধুমাত্র আমানত আর বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বহুমাত্রিক সেবা প্রতিষ্ঠানে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে ইউটিলিটি বিলসহ অটোমেটেড চালান সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি ১৬০ প্রকারের সেবার বিল সংগ্রহ করে মানুষের জীবন সহজকরণে অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান দুটি স্তম্ভ তৈরি পোশাক খাত উন্নয়ন এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণে ব্যাংকগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের মার্কেট শেয়ার এককভাবে সর্বোচ্চ। দেশের মোট রেমিট্যান্সের এক তৃতীয়াংশ এ ব্যাংকের মাধ্যমে আসে।

ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কার্যক্রমেও এগিয়ে রয়েছে ব্যাংকগুলো। শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনেও প্রচুর আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে দেশের ব্যাংক খাত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মত ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক।

সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নেতৃত্বে বাংকগুলো সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে একযোগে কাজ করছে।

তবে ব্যাংক খাত বড় হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যাও দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা যা মোট বিনিয়োগের ৮.৬১ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিশেষায়িতসহ ৫৫ টি ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৫৬ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।

গ্রাহকদের অর্থনৈতিক অভ্যাসের পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ব্যাংক খাত বড় ধরণের হুমকির সম্মুখিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

দেশে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হল মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো অনেকগুলো ঘটনা রয়েছে। এ সংকট উত্তরণে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরিপালনের সংস্কৃতি লালন করতে হবে।

লেখক: ব্যাংকার

ইমেইল: iyazenglish@gmail.com