বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

গ্রাহকের টাকা তুলে নিয়েছে ধামাকার মালিক

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ধামাকা শপিংয়ের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ধামাকা শপিং ডটকম-এর কাছে থাকা বিভিন্ন মার্চেন্ট ও গ্রাহকের ৪৭০ কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৫ টাকা প্রতিষ্ঠানটি মালিক তুলে নিয়েছে।

ধামা শপিং ডটকম-এর বিভিন্ন হিসাব ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রোট্রেড গ্রুপের অ্যাকাউন্ট সেকশন, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিডেটের মহাখালী শাখা, সিটি ব্যাংক লিমিটেডের গুলশান শাখা, সফটওয়্যার শপ লিমিডেট এবং বিকাশ লিমিটেডের হিসাবপত্র পর্যালোচনা করে এই তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম।

বিভিন্ন বিভাগের পাঁচ সদস্যের পরিদর্শক দলকে এই পরিদর্শন কাজে সহায়তা দেয় ধামাকা শপিংসহ এর মাদার প্রতিষ্ঠানের আরও ছয় কর্মকর্তা। সাত পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপসহ এ সম্পর্কিত মোট ১৪৫ পৃষ্ঠার তৈরি করা বিস্তারিত প্রতিবেদন সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাহুল হক স্বাক্ষরিত পরিদর্শন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, লোভনীয় বিভিন্ন ডিসকাউন্টের অফারে ব্যবসা ছিল ধামাকা শপিং ডটকমের। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক কম হওয়াতে শেষ পর্যন্ত মূলধনই খুইয়ে বসে ধামাকা। এতে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন ভারসাম্যে মোট ৩২২ কোটি ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৮ টাকার ঘাটতি ধরা পড়েছে।

কারা ধামাকা শপিং কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন ডিসকাউন্টের সুবিধাভোগী সেটিও উঠে এসেছে পরিদর্শক দলের তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ‘কিছু সংখ্যক গ্রাহকই দফায় দফায় এই ডিসকাউন্ট সুবিধায় পণ্য কেনার সুযোগ ভোগ করেছেন, যারা ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেটিভ অফিসার সিরাজুল ইসলামসহ এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট।’

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধামাকার সঙ্গে গ্রাহকের লেনদেন হয়েছে মোট ৭০৫ কোটি ৫১ লাখ ৯৭ হাজার ৫২৮ টাকা। গ্রাহকের ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৪টি ক্রয়াদেশের বিপরীতে এই পরিমাণ লেনদেন হয়। এর মধ্যে ধামাকা শপিং ডটকম কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৭২টি ক্রয়াদেশের অনুকূলে পণ্য সরবরাহ করেছে। টাকার অঙ্ক যার পরিমাণ ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৬ টাকা। অগ্রিম টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি এমন ২ লাখ ১০ হাজার ৬৬২টি ক্রয়াদেশের পরিমাণ ৩০২ কোটি ৯৯ লাখ ৫৪ হাজার ২৩২ টাকা। এটি গ্রাহকের অনুকূলে ধামাকা শপিং কর্তৃপক্ষের অপরিশোধিত বকেয়া দায়।

অন্যদিকে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন মার্চেন্টের সঙ্গে ধামাকা শপিংয়ের পণ্য সরবরাহ বাবদ মোট লেনদেন হয়েছে ৭২৪ কোটি ৫৭ লাখ ২২ হাজার ৫৫৪ টাকার, তবে ধামাকা কর্তৃপক্ষ ওই সব পণ্য বিভিন্ন হারে ডিসকাউন্ট অফারে বিক্রি করেছে মাত্র ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৬ টাকায়। এভাবে ক্রেতা টানতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক লেনদেনে ৩২২ কোটি ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৮ টাকার ঘাটতি পড়েছে।

তবে এর মধ্যেই মার্চেন্টদের পণ্য সরবরাহের বিপরীতে বকেয়া মোট ৫৫৭ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার ২১১ টাকা পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রক্রিয়ায় ধামাকা শপিং কর্তৃপক্ষের কাছে মার্চেন্ট বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনও অপরিশোধিত বকেয়া রয়ে গেছে ১৬৭ কোটি ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টাকার।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্য পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, বিভিন্ন হিসাব থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক জসীম উদ্দিন চিশতি যে ১২৯ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছেন, তার মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদানের নামে তুলে নেন ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ৩১ হাজার ১৪২ টাকা এবং সফটওয়্যার কেনার নামে স্থানান্তর করেছেন ২০ কোটি টাকা। এর বাইরে চিশতি নিজেও ধামাকা শপিং থেকে ৮৪ কোটি ১০ লাখ ২৯০ টাকা অগ্রিম গ্রহণ করেন, যা তিনি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাবে কোন সমন্বয় করেননি।

দেশে একের পর এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট, ২০২১ তারিখে ধামাকাসহ ৯টি ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হালনাগাদ তথ্য চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা, ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে মোট দায়ের পরিমাণ, চলতি ও স্থায়ী মূলধনের পরিমাণ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক কোন অর্থ অন্যত্র সরিয়ে থাকলে তার তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ধামাকা শপিংয়ের বিষয়ে এই সরেজমিন বিশেষ পরিদর্শন চালায়।

সোমবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২২ , ১৯ পৌষ ১৪২৮ ২৯ জমাদিউল আউয়াল

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

গ্রাহকের টাকা তুলে নিয়েছে ধামাকার মালিক

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ধামাকা শপিংয়ের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ধামাকা শপিং ডটকম-এর কাছে থাকা বিভিন্ন মার্চেন্ট ও গ্রাহকের ৪৭০ কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৫ টাকা প্রতিষ্ঠানটি মালিক তুলে নিয়েছে।

ধামা শপিং ডটকম-এর বিভিন্ন হিসাব ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রোট্রেড গ্রুপের অ্যাকাউন্ট সেকশন, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিডেটের মহাখালী শাখা, সিটি ব্যাংক লিমিটেডের গুলশান শাখা, সফটওয়্যার শপ লিমিডেট এবং বিকাশ লিমিটেডের হিসাবপত্র পর্যালোচনা করে এই তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম।

বিভিন্ন বিভাগের পাঁচ সদস্যের পরিদর্শক দলকে এই পরিদর্শন কাজে সহায়তা দেয় ধামাকা শপিংসহ এর মাদার প্রতিষ্ঠানের আরও ছয় কর্মকর্তা। সাত পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপসহ এ সম্পর্কিত মোট ১৪৫ পৃষ্ঠার তৈরি করা বিস্তারিত প্রতিবেদন সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাহুল হক স্বাক্ষরিত পরিদর্শন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, লোভনীয় বিভিন্ন ডিসকাউন্টের অফারে ব্যবসা ছিল ধামাকা শপিং ডটকমের। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক কম হওয়াতে শেষ পর্যন্ত মূলধনই খুইয়ে বসে ধামাকা। এতে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন ভারসাম্যে মোট ৩২২ কোটি ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৮ টাকার ঘাটতি ধরা পড়েছে।

কারা ধামাকা শপিং কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন ডিসকাউন্টের সুবিধাভোগী সেটিও উঠে এসেছে পরিদর্শক দলের তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ‘কিছু সংখ্যক গ্রাহকই দফায় দফায় এই ডিসকাউন্ট সুবিধায় পণ্য কেনার সুযোগ ভোগ করেছেন, যারা ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেটিভ অফিসার সিরাজুল ইসলামসহ এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট।’

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধামাকার সঙ্গে গ্রাহকের লেনদেন হয়েছে মোট ৭০৫ কোটি ৫১ লাখ ৯৭ হাজার ৫২৮ টাকা। গ্রাহকের ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৪টি ক্রয়াদেশের বিপরীতে এই পরিমাণ লেনদেন হয়। এর মধ্যে ধামাকা শপিং ডটকম কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৭২টি ক্রয়াদেশের অনুকূলে পণ্য সরবরাহ করেছে। টাকার অঙ্ক যার পরিমাণ ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৬ টাকা। অগ্রিম টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি এমন ২ লাখ ১০ হাজার ৬৬২টি ক্রয়াদেশের পরিমাণ ৩০২ কোটি ৯৯ লাখ ৫৪ হাজার ২৩২ টাকা। এটি গ্রাহকের অনুকূলে ধামাকা শপিং কর্তৃপক্ষের অপরিশোধিত বকেয়া দায়।

অন্যদিকে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন মার্চেন্টের সঙ্গে ধামাকা শপিংয়ের পণ্য সরবরাহ বাবদ মোট লেনদেন হয়েছে ৭২৪ কোটি ৫৭ লাখ ২২ হাজার ৫৫৪ টাকার, তবে ধামাকা কর্তৃপক্ষ ওই সব পণ্য বিভিন্ন হারে ডিসকাউন্ট অফারে বিক্রি করেছে মাত্র ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৬ টাকায়। এভাবে ক্রেতা টানতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক লেনদেনে ৩২২ কোটি ৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৮ টাকার ঘাটতি পড়েছে।

তবে এর মধ্যেই মার্চেন্টদের পণ্য সরবরাহের বিপরীতে বকেয়া মোট ৫৫৭ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার ২১১ টাকা পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রক্রিয়ায় ধামাকা শপিং কর্তৃপক্ষের কাছে মার্চেন্ট বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনও অপরিশোধিত বকেয়া রয়ে গেছে ১৬৭ কোটি ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টাকার।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্য পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, বিভিন্ন হিসাব থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক জসীম উদ্দিন চিশতি যে ১২৯ কোটি টাকার বেশি সরিয়ে নিয়েছেন, তার মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদানের নামে তুলে নেন ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ৩১ হাজার ১৪২ টাকা এবং সফটওয়্যার কেনার নামে স্থানান্তর করেছেন ২০ কোটি টাকা। এর বাইরে চিশতি নিজেও ধামাকা শপিং থেকে ৮৪ কোটি ১০ লাখ ২৯০ টাকা অগ্রিম গ্রহণ করেন, যা তিনি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাবে কোন সমন্বয় করেননি।

দেশে একের পর এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট, ২০২১ তারিখে ধামাকাসহ ৯টি ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হালনাগাদ তথ্য চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা, ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে মোট দায়ের পরিমাণ, চলতি ও স্থায়ী মূলধনের পরিমাণ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক কোন অর্থ অন্যত্র সরিয়ে থাকলে তার তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ধামাকা শপিংয়ের বিষয়ে এই সরেজমিন বিশেষ পরিদর্শন চালায়।