প্রণোদনা প্যাকেজের অপব্যবহার

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

দেশে করোনার প্রকোপ ব্যাপক আকার ধারণ করে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে। করোনার আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তখন থেকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। ২৩টি প্যাকেজের আওতায় কয়েক দফায় আড়াই লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নির্ভর প্রণোদনা বাকি টাকা অন্যান্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছিল, ঋণনির্ভর প্রণোদনার টাকা ব্যবসার চলতি মূলধন হিসাবে ঋণ গ্রহীতাদের মাঝে বিতরণ করা, যাতে করে তারা মূল ঘাটতি কাটাতে ব্যবহার করতে পারে। এই প্রণোদনা ঋণ বিতরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূলধন ঘাটতি মিটিয়ে যথাযথভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পারে এবং এর ফলে শ্রমিকের কর্মহীন হওয়া বা ঝরে পড়াটা রোধ হবে। সরকারের নির্দেশনা ছিলযে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা তহবিল থেকে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ দেয়া যাবে। প্রণোদনা দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো করোনা কারণে যে মূলধন ঘাটতি হয়েছে তা প্রণোদনা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করে নেবে । এর ফলে শিল্পগুলো সচল থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো সচল থাকলে কর্মক্ষম মানুষের কাজের ক্ষেত্রের অভাব হবে না। কিন্তু বাস্তবে এই প্রণোদনা ঋণ কতটা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা দেখার বিষয়।

রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের টাকার নয়-ছয় ব্যবহারের দায়টা কার? প্রণোদনা ঋণের শর্ত ছিল যে প্রণোদনায় প্রাপ্ত ঋণের টাকায় আগের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। তাছাড়া যারা ঋণ খেলাপি তাদের দেয়া যাবে না প্রণোদনার ঋণ। প্রণোদনার প্রাপ্ত অর্থ স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করতে হবে। প্রণোদনায় প্রাপ্ত ঋণ কে কোথায় কীভাবে ব্যবহার করছেÑতা কঠোরভাবে তদারকি করা হবে। দেখা গেল যে অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতাই প্রণোদনার শর্ত মানেনি। যারা মানেনি তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায়নি। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দেয়া হয়েছে। এই ঋণ যে সব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রদান করেছে তাদের সরকার ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে ভর্তুকি হিসাবে প্রদান করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে. সিলোমো ইলেকট্রনিকস নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার ঋণ নিয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সিলোমো প্রণ্যেদনার ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে এই টাকা জমা রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার পূর্বের ঋণ পরিশোধ করে। এলকো ওয়্যার কেমিক্যাল নামে এক প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অন্য ব্যাংকে তার বেশি সুদের হারের ঋণের টাকা পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ থাই অ্যালমিনিয়াম নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা বাবদ ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। ঋণের টাকা প্রতিষ্ঠানটি তাদের একই ব্যাংকে থাকা চলতি হিসাবে স্থানান্তর করে। পরে তা নগদে তুলে নিয়ে অন্য ব্যাংকে জমা রাখে। তবে তারা যে এই টাকা শিল্প খাতে ব্যবহার করেছে তার কোন নজির পাওয়া যায়নি, রশিদ ব্রিকস ৮ কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ নিয়ে অন্য ব্যংকের তাদের বেশি সুদের ৭ কোটি টাকা ঋণ সমন্বয় করে।

প্রণোদনার ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ আর বাণিজ্যিক অন্য সুদের হার ১২ শতাংশ। সুতরাং প্রণোদনার ঋণে অন্য ব্যাংকের ঋণ সমন্বয় করে দেশের ধনীরা মোটা অঙ্কের হাতিয়ে নেন। এ রকম বহু অনিয়মের কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, জানা গেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮টি পরিদর্শন বিভাগ ও আটটি শাখা অফিস এই অনিয়মগুলো নিয়ে তদন্ত করেছে। বিবিসির সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রণোদনা ঋণের সুদ কম হওয়ায়, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তার চেয়ে এই স্বল্প সুদের এই ঋণের সুবিধা ভোগ করেছেন বড় বড় শিল্প কারখানা। দেশের একটি গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশের মোট শ্রম শক্তির পরিমাণ ছয় কোটি ৪০ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গবেষক দল জানিয়েছেন, করোনার কারণে ২০২০ সালে এই শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেকার হয়েছে, ফলে ২০২০ সালেই শুধু কর্মহীন হয়েছেন ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ মানুষ। এই হিসাবে বলা যায় উপার্জন হীন হয়ে পড়েছে প্রায় ২৬ লাখ পরিবার। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের হার ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ (করোনার প্রভাবহীন) যা ২০১০ সালে ছিল ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে প্রতি চারজনে একজন যুবক বেকার হয়েছে।

দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত করোনাকালীন সময়ের দেশের মানুষের কর্মক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন, অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে , দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ছয় কোটি ৮২ লাখ আট হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছিল ৩ কোটি ৭৩ হাজার ২৭১ জন অর্থাৎ মোট কর্ম শক্তির ৫৯ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে করোনার সময়। প্রতি তাহলে করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ দেশের মানুষের কতটা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পেরেছে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ সেই প্রবাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়, “তেলে মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙ্গো বেল”। ২০২১ সালেও করোনার ছোবলে মানুষ কর্মহীন হয়। কারণ মাঝারি এবং ক্ষুদ্র সংগঠনগুলো প্রণোদনা বঞ্চিত থাকায় এ রকম ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বড় ব্যবসায়ীরাই প্রণোদনার সুযোগটা গ্রহণ করতে পেরেছে। বিবিসির প্রকাশিত সংবাদ থেকে জনা যায় বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রণোদনার প্যাকেজ থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং অতিক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে তেমন কোন সহায়তা পায়নি। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের ঠিকাদার যারা ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা মূল্যের কাজ করেছেন এবং স্বল্প মূলধনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ছোট ছোট ঠিকাদাররা করোনার কারণে পড়েছে বড় ধরনের লোকসানে। কারণ করোনার লকডাউনে দোকান পাট বন্ধ ছিল। ফলে তারা নির্মানসামগ্রী কিনতে পড়তে হয়েছে বড় ধরনের সমস্যায়। তাছাড়া নির্মান উপকরণ এর মূল্য বেড়ে গিয়েছিল অনেক।

এদিকে লকডাউন চললেও ছোট ছোট ঠিকাদারকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে হয়েছে। আর যারা নির্ধারিত সময় কাজ শেষ করতে পারেনি তাদের গুনতে হয়েছে জরিমানা। ছোট ছোট ঠিকাদারকে কার্যাদেশে ঘোষিত তারিখের মধ্যে কাজ করতে বলা হয়। সরকারি কোন সংস্থাই এই লকডাউনের কারণে ছোট ছোট ঠিকাদারকে সময় বাড়িয়ে দেয় নাই। ফলে তাদের পড়তে হয় লোকসানে। ছোট ছোট ঠিকাদাররা সরকার ঘোষিত কোন প্রকার প্রণোদনাও পায়নি।

অথচ দেখা যায়, বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় সরকার বাড়িয়ে দিয়েছেন। করোনা মহামারীতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র এবং অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে ভ্যান অটোরিকশা চালাচ্ছে। অন্যদিকে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষ আর হতদিরদ্র পরিবারগুলোকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনার কথা থাকলেও তা আনা সম্ভব হয়নি, নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে । সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে এ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা। দেখা যায় তালিকা প্রণয়নে বড় ধরনের ত্রুটি তাই তালিকা প্রণয়নেই বাদ পড়ে যায় ১৫ লাখ পরিবার। যে ৩৫ লাখ পরিবার প্রণোদনা সহায়তা পেয়েছে তার সঠিক তদন্ত করলে দেখা যাবে সেখানে অনেক ভুয়া পরিবারও রয়েছে। প্রণোদনা প্রদানের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, যাদের ক্ষমতা আছে এবং ওপরের মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তারাই করোনার প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেয়েছেন।

রাষ্ট্রের কোষাগারের কোটি কোটি টাকা নিয়ে এ ধরনের জালিয়াতি হওয়ার ফলে দরিদ্র মানুষের হার বাড়ছে। বর্তমানে দরিদ্রের হার প্রায় ৩০ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিতে এ ধরনের অসম বণ্টন ব্যবস্থা বিরাজমান থাকলে কোন ধরনের প্রণোদনার মাধ্যমে দরিদ্রতা নিরসন এবং বেকারত্ব হ্রাস করা সম্ভব না। তাই জাতীয় অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা এবং সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

সোমবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২২ , ১৯ পৌষ ১৪২৮ ২৯ জমাদিউল আউয়াল

প্রণোদনা প্যাকেজের অপব্যবহার

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

দেশে করোনার প্রকোপ ব্যাপক আকার ধারণ করে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে। করোনার আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তখন থেকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। ২৩টি প্যাকেজের আওতায় কয়েক দফায় আড়াই লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নির্ভর প্রণোদনা বাকি টাকা অন্যান্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছিল, ঋণনির্ভর প্রণোদনার টাকা ব্যবসার চলতি মূলধন হিসাবে ঋণ গ্রহীতাদের মাঝে বিতরণ করা, যাতে করে তারা মূল ঘাটতি কাটাতে ব্যবহার করতে পারে। এই প্রণোদনা ঋণ বিতরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূলধন ঘাটতি মিটিয়ে যথাযথভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পারে এবং এর ফলে শ্রমিকের কর্মহীন হওয়া বা ঝরে পড়াটা রোধ হবে। সরকারের নির্দেশনা ছিলযে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা তহবিল থেকে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ দেয়া যাবে। প্রণোদনা দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো করোনা কারণে যে মূলধন ঘাটতি হয়েছে তা প্রণোদনা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করে নেবে । এর ফলে শিল্পগুলো সচল থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো সচল থাকলে কর্মক্ষম মানুষের কাজের ক্ষেত্রের অভাব হবে না। কিন্তু বাস্তবে এই প্রণোদনা ঋণ কতটা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা দেখার বিষয়।

রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের টাকার নয়-ছয় ব্যবহারের দায়টা কার? প্রণোদনা ঋণের শর্ত ছিল যে প্রণোদনায় প্রাপ্ত ঋণের টাকায় আগের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না। তাছাড়া যারা ঋণ খেলাপি তাদের দেয়া যাবে না প্রণোদনার ঋণ। প্রণোদনার প্রাপ্ত অর্থ স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করতে হবে। প্রণোদনায় প্রাপ্ত ঋণ কে কোথায় কীভাবে ব্যবহার করছেÑতা কঠোরভাবে তদারকি করা হবে। দেখা গেল যে অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতাই প্রণোদনার শর্ত মানেনি। যারা মানেনি তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায়নি। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দেয়া হয়েছে। এই ঋণ যে সব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রদান করেছে তাদের সরকার ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে ভর্তুকি হিসাবে প্রদান করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে. সিলোমো ইলেকট্রনিকস নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার ঋণ নিয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সিলোমো প্রণ্যেদনার ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে এই টাকা জমা রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার পূর্বের ঋণ পরিশোধ করে। এলকো ওয়্যার কেমিক্যাল নামে এক প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অন্য ব্যাংকে তার বেশি সুদের হারের ঋণের টাকা পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ থাই অ্যালমিনিয়াম নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা বাবদ ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। ঋণের টাকা প্রতিষ্ঠানটি তাদের একই ব্যাংকে থাকা চলতি হিসাবে স্থানান্তর করে। পরে তা নগদে তুলে নিয়ে অন্য ব্যাংকে জমা রাখে। তবে তারা যে এই টাকা শিল্প খাতে ব্যবহার করেছে তার কোন নজির পাওয়া যায়নি, রশিদ ব্রিকস ৮ কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ নিয়ে অন্য ব্যংকের তাদের বেশি সুদের ৭ কোটি টাকা ঋণ সমন্বয় করে।

প্রণোদনার ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ আর বাণিজ্যিক অন্য সুদের হার ১২ শতাংশ। সুতরাং প্রণোদনার ঋণে অন্য ব্যাংকের ঋণ সমন্বয় করে দেশের ধনীরা মোটা অঙ্কের হাতিয়ে নেন। এ রকম বহু অনিয়মের কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, জানা গেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮টি পরিদর্শন বিভাগ ও আটটি শাখা অফিস এই অনিয়মগুলো নিয়ে তদন্ত করেছে। বিবিসির সংবাদ থেকে জানা যায়, প্রণোদনা ঋণের সুদ কম হওয়ায়, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তার চেয়ে এই স্বল্প সুদের এই ঋণের সুবিধা ভোগ করেছেন বড় বড় শিল্প কারখানা। দেশের একটি গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশের মোট শ্রম শক্তির পরিমাণ ছয় কোটি ৪০ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গবেষক দল জানিয়েছেন, করোনার কারণে ২০২০ সালে এই শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেকার হয়েছে, ফলে ২০২০ সালেই শুধু কর্মহীন হয়েছেন ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ মানুষ। এই হিসাবে বলা যায় উপার্জন হীন হয়ে পড়েছে প্রায় ২৬ লাখ পরিবার। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের হার ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ (করোনার প্রভাবহীন) যা ২০১০ সালে ছিল ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে প্রতি চারজনে একজন যুবক বেকার হয়েছে।

দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত করোনাকালীন সময়ের দেশের মানুষের কর্মক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন, অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে , দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ছয় কোটি ৮২ লাখ আট হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছিল ৩ কোটি ৭৩ হাজার ২৭১ জন অর্থাৎ মোট কর্ম শক্তির ৫৯ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে করোনার সময়। প্রতি তাহলে করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ দেশের মানুষের কতটা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পেরেছে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ সেই প্রবাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়, “তেলে মাথায় ঢালো তেল, ন্যাড়া মাথায় ভাঙ্গো বেল”। ২০২১ সালেও করোনার ছোবলে মানুষ কর্মহীন হয়। কারণ মাঝারি এবং ক্ষুদ্র সংগঠনগুলো প্রণোদনা বঞ্চিত থাকায় এ রকম ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে বড় ব্যবসায়ীরাই প্রণোদনার সুযোগটা গ্রহণ করতে পেরেছে। বিবিসির প্রকাশিত সংবাদ থেকে জনা যায় বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রণোদনার প্যাকেজ থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং অতিক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে তেমন কোন সহায়তা পায়নি। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের ঠিকাদার যারা ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা মূল্যের কাজ করেছেন এবং স্বল্প মূলধনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ছোট ছোট ঠিকাদাররা করোনার কারণে পড়েছে বড় ধরনের লোকসানে। কারণ করোনার লকডাউনে দোকান পাট বন্ধ ছিল। ফলে তারা নির্মানসামগ্রী কিনতে পড়তে হয়েছে বড় ধরনের সমস্যায়। তাছাড়া নির্মান উপকরণ এর মূল্য বেড়ে গিয়েছিল অনেক।

এদিকে লকডাউন চললেও ছোট ছোট ঠিকাদারকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে হয়েছে। আর যারা নির্ধারিত সময় কাজ শেষ করতে পারেনি তাদের গুনতে হয়েছে জরিমানা। ছোট ছোট ঠিকাদারকে কার্যাদেশে ঘোষিত তারিখের মধ্যে কাজ করতে বলা হয়। সরকারি কোন সংস্থাই এই লকডাউনের কারণে ছোট ছোট ঠিকাদারকে সময় বাড়িয়ে দেয় নাই। ফলে তাদের পড়তে হয় লোকসানে। ছোট ছোট ঠিকাদাররা সরকার ঘোষিত কোন প্রকার প্রণোদনাও পায়নি।

অথচ দেখা যায়, বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় সরকার বাড়িয়ে দিয়েছেন। করোনা মহামারীতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র এবং অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে ভ্যান অটোরিকশা চালাচ্ছে। অন্যদিকে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষ আর হতদিরদ্র পরিবারগুলোকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনার কথা থাকলেও তা আনা সম্ভব হয়নি, নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে । সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে এ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা। দেখা যায় তালিকা প্রণয়নে বড় ধরনের ত্রুটি তাই তালিকা প্রণয়নেই বাদ পড়ে যায় ১৫ লাখ পরিবার। যে ৩৫ লাখ পরিবার প্রণোদনা সহায়তা পেয়েছে তার সঠিক তদন্ত করলে দেখা যাবে সেখানে অনেক ভুয়া পরিবারও রয়েছে। প্রণোদনা প্রদানের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, যাদের ক্ষমতা আছে এবং ওপরের মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তারাই করোনার প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেয়েছেন।

রাষ্ট্রের কোষাগারের কোটি কোটি টাকা নিয়ে এ ধরনের জালিয়াতি হওয়ার ফলে দরিদ্র মানুষের হার বাড়ছে। বর্তমানে দরিদ্রের হার প্রায় ৩০ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিতে এ ধরনের অসম বণ্টন ব্যবস্থা বিরাজমান থাকলে কোন ধরনের প্রণোদনার মাধ্যমে দরিদ্রতা নিরসন এবং বেকারত্ব হ্রাস করা সম্ভব না। তাই জাতীয় অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা এবং সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]