তালাক নোটিশে নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ শব্দের ব্যবহার

শান্তা ইসলাম

স্বামী বা স্ত্রী যেই তালাক দিতে চান না কেন, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুসারে, তালাক প্রক্রিয়া শুরু হয় অপরপক্ষকে আইনি নোটিস পাঠানোর মাধ্যমে, এর একটি প্রতিলিপি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছেও পাঠাতে হয়। তালাকের নোটিসে তালাক প্রদানের কারণ এবং কোন আইনে নোটিস পাঠাচ্ছেন তা উল্লেখ থাকে। নোটিস পাওয়ার পর চেয়ারম্যান/মেয়র সালিশ পরিষদ গঠন করে মীমাংসার চেষ্টা করবেন বলে আইনে উল্লে­খ রয়েছে। এভাবে পরপর তিন মাস বা ৯০ দিন (নারীর ইদ্দতকালীন সময়) সালিশির মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা না হলে তালাক কার্যকর হবে। দাম্পত্য সম্পর্ক অব্যাহত থাকাকালীন অথবা স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকেন, তাহলে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত একজন স্ত্রীর ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বাস্তবে দেখা যায়, তালাক নোটিসে নারীর ভরণপোষণের অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে এবং তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে তার ব্যাপারে বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক ও মানহানিকর বিভিন্ন শব্দ ও বক্তব্য উল্লে­খ করা হয়। তার বিরুদ্ধে, অসতী, দুশ্চরিত্রা, কর্তব্যবিমুখ ইত্যাদি অভিযোগ এনে পারিবারিক আদালতে স্ত্রীর বিয়েকালীন ভরণপোষণের অধিকার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করেন।

হাইকোর্টে দায়ের করা সাম্প্রতিক আলোচিত রিট আবেদন

তালাক নোটিসে এ ধরনের বক্তব্য ব্যবহারের সূত্র ধরে সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিট মামলার বিষয় গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, ২০১১ সালে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় কানাডার উইনজা ইউনিভার্সিটির অডেট স্কুল অব বিজনেসে কর্মরত রিট আবেদনকারীর। বিয়ের দুই বছর পর, ২০১৭ সালের অক্টোবরে আবেদনকারীকে তালাক নোটিস? পাঠান তার স্বামী। উক্ত নোটিসে তালাক দেয়ার কারণ হিসেবে উল্লে­খ করা হয় ‘স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য, যাহা শরিয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তাহার উক্ত চালচলন পরিবর্তন করার জন্য আমি নিজেই বহুবার চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু অদ্যাবধি তাহার কোন পরিবর্তন সাধিত হয় নাই।’

পরবর্তী সময়ে, আবেদনকারী নারী পুনরায় বিয়ে করতে গেলে তালাক নোটিসে ব্যবহৃত শব্দের কারণে তাকে বিব্রত ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বিষয়টি উল্লে­খ করে তালাক নোটিসে ব্যবহৃত ‘স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য’, ‘শরিয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থি’ এ ধরনের শব্দকে ‘অবমাননাকর, অমানবিক, অযৌক্তিক’ হিসেবে বর্ণনা করে গত ২ জুন ২০২১ হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন সেই নারী। রুলের পাশাপাশি তালাক নোটিস থেকে নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর, অমানবিক এবং অযৌক্তিক’ শব্দের অপসারণের নির্দেশনা চাওয়া হয় রিটে। এতে বলা হয়, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিয়ে এবং তালাক (নিবন্ধন) আইন অনুযায়ী তালাক নোটিসে ‘অবমাননাকর, অমানবিক, অযৌক্তিক’ শব্দের ব্যবহার স্পষ্টভাবে নারীর ‘মানবাধিকার ও তার মর্যাদা ক্ষুণœ করে’, যা একই সঙ্গে সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদেরও ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’। ‘নিকাহ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে পাঠানো এ ধরনের তালাক নোটিস কেবল অইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূতই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং ১৯৮১ সালের সিডও সনদ অনুযায়ী তা মৌলিক ও মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং সিডও সনদে স্বাক্ষর করে সরকার নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে সংবিধান, আইন, চুক্তি ও সনদের শর্ত রক্ষায় সর্বোপরি নারীর মানবিক মৌলিক অধিকার তালাকের নোটিসে এ ধরনের শব্দের ব্যবহার বন্ধ করা সরকারের আইনগত দায়িত্ব।’

গত ২৭ জুন ২০২১, তালাক নোটিসে নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর, অমানবিক ও অযৌক্তিক’ শব্দের ব্যবহার কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুল্ল­াহ আল নোমান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইনে নারী অধিকার

সংবিধান হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, দেশের অন্যান্য আইনগুলোও সংবিধানের আলোকেই প্রণীত হয়। আমাদের সংবিধান নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাংবিধানিকভাবে লৈঙ্গিক বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮(১) নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, ‘শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ সংবিধানের ২৮ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লে­খ আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’

সংবিধানের ২৮(৩) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ সংবিধানের ২৮(৪) নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লে­খ আছে যে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’

বাংলাদেশের আইনে নারী অধিকারের কিছু ক্ষেত্রে, যেমনÑ পারিবারিক সহিংসতা নিরসনে, অ্যাসিড সন্ত্রাস বন্ধে উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয় হলেও বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ বা তালাক এবং উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের প্রতি নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। বাংলাদেশে বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদসংক্রান্ত যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১; মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ ও মুসলিম বিয়ে ও বিচ্ছেদ (নিবন্ধীকরণ) আইন, ১৯৭৪ (মুসলিমদের জন্য); বিবাহিত হিন্দু নারীর পৃথকবাস ও ভরণপোষণ আইন, ১৯৪৬ (হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য), খ্রিস্টান বিয়ে আইন, ১৮৭২ ও বিচ্ছেদ আইন ১৮৬৯ (খ্রিস্টানদের জন্য)। দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ব্যক্তিগত আইনগুলো নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক। বহু বছর ধরে নারী অধিকারকর্মীদের অনুরোধ, সংগ্রাম, আন্দোলন চলে আসা সত্ত্বেও আধুনিক সময়োপযোগী করে এসব আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধিত হয়নি।

বাংলাদেশ নারী অধিকার, বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদসংক্রান্ত বেশকিছু আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও), নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিইএসসিআর), টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সম্পূর্ণভাবে বিয়ে ও বিয়ে-পরবর্তী সময়ে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিতের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। সিডওর ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রের প্রতি এই বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে যে, ‘বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কের সব ক্ষেত্রে’ নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অনুচ্ছেদ ১৬(১)(সি)-তে বলা হয়েছে, ‘বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র অনুরূপ সমানাধিকার ও দায়িত্বের প্রয়োগ করবে।’ তবে, এই অনুচ্ছেদটি বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষণ রেখেছে। আইসিসিপিআর-এর ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদেও ‘বিয়ে এবং এর পরিসমাপ্তিকালে’ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য সমতার নিশ্চয়তা দেয়। মোটকথা, সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলের মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কার, বৈষম্যমূলক রীতিনীতি দূর করে নারী-পুরুষের জন্য সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশের বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন বা রীতিনীতিগুলো যে শুধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সীমিত করে দেয় তা-ই নয়, এগুলো সামাজিক বৈষম্য এবং পারিবারিক সহিংসতারও ক্ষেত্র তৈরি করে। একজন নারী তার প্রতি ঘটে চলা অন্যায় ও প্রতিবন্ধকতা থেকে পরিত্রাণ পেতে যদি আইনি পরিষেবা গ্রহণের জন্যদ্বারস্থ হন, সেখানেও তিনি পদ্ধতিগতভাবে হেনস্থার শিকার হন। নারীর জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করতে, বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদসংক্রান্ত সব বৈষম্য দূর করে একটি আধুনিক আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী]

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

সোমবার, ০৩ জানুয়ারী ২০২২ , ১৯ পৌষ ১৪২৮ ২৯ জমাদিউল আউয়াল

তালাক নোটিশে নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ শব্দের ব্যবহার

শান্তা ইসলাম

স্বামী বা স্ত্রী যেই তালাক দিতে চান না কেন, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুসারে, তালাক প্রক্রিয়া শুরু হয় অপরপক্ষকে আইনি নোটিস পাঠানোর মাধ্যমে, এর একটি প্রতিলিপি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছেও পাঠাতে হয়। তালাকের নোটিসে তালাক প্রদানের কারণ এবং কোন আইনে নোটিস পাঠাচ্ছেন তা উল্লেখ থাকে। নোটিস পাওয়ার পর চেয়ারম্যান/মেয়র সালিশ পরিষদ গঠন করে মীমাংসার চেষ্টা করবেন বলে আইনে উল্লে­খ রয়েছে। এভাবে পরপর তিন মাস বা ৯০ দিন (নারীর ইদ্দতকালীন সময়) সালিশির মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা না হলে তালাক কার্যকর হবে। দাম্পত্য সম্পর্ক অব্যাহত থাকাকালীন অথবা স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকেন, তাহলে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত একজন স্ত্রীর ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বাস্তবে দেখা যায়, তালাক নোটিসে নারীর ভরণপোষণের অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে এবং তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে তার ব্যাপারে বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক ও মানহানিকর বিভিন্ন শব্দ ও বক্তব্য উল্লে­খ করা হয়। তার বিরুদ্ধে, অসতী, দুশ্চরিত্রা, কর্তব্যবিমুখ ইত্যাদি অভিযোগ এনে পারিবারিক আদালতে স্ত্রীর বিয়েকালীন ভরণপোষণের অধিকার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করেন।

হাইকোর্টে দায়ের করা সাম্প্রতিক আলোচিত রিট আবেদন

তালাক নোটিসে এ ধরনের বক্তব্য ব্যবহারের সূত্র ধরে সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিট মামলার বিষয় গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, ২০১১ সালে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় কানাডার উইনজা ইউনিভার্সিটির অডেট স্কুল অব বিজনেসে কর্মরত রিট আবেদনকারীর। বিয়ের দুই বছর পর, ২০১৭ সালের অক্টোবরে আবেদনকারীকে তালাক নোটিস? পাঠান তার স্বামী। উক্ত নোটিসে তালাক দেয়ার কারণ হিসেবে উল্লে­খ করা হয় ‘স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য, যাহা শরিয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তাহার উক্ত চালচলন পরিবর্তন করার জন্য আমি নিজেই বহুবার চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু অদ্যাবধি তাহার কোন পরিবর্তন সাধিত হয় নাই।’

পরবর্তী সময়ে, আবেদনকারী নারী পুনরায় বিয়ে করতে গেলে তালাক নোটিসে ব্যবহৃত শব্দের কারণে তাকে বিব্রত ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বিষয়টি উল্লে­খ করে তালাক নোটিসে ব্যবহৃত ‘স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য’, ‘শরিয়তের সম্পূর্ণ পরিপন্থি’ এ ধরনের শব্দকে ‘অবমাননাকর, অমানবিক, অযৌক্তিক’ হিসেবে বর্ণনা করে গত ২ জুন ২০২১ হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন সেই নারী। রুলের পাশাপাশি তালাক নোটিস থেকে নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর, অমানবিক এবং অযৌক্তিক’ শব্দের অপসারণের নির্দেশনা চাওয়া হয় রিটে। এতে বলা হয়, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিয়ে এবং তালাক (নিবন্ধন) আইন অনুযায়ী তালাক নোটিসে ‘অবমাননাকর, অমানবিক, অযৌক্তিক’ শব্দের ব্যবহার স্পষ্টভাবে নারীর ‘মানবাধিকার ও তার মর্যাদা ক্ষুণœ করে’, যা একই সঙ্গে সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদেরও ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’। ‘নিকাহ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে পাঠানো এ ধরনের তালাক নোটিস কেবল অইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূতই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং ১৯৮১ সালের সিডও সনদ অনুযায়ী তা মৌলিক ও মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং সিডও সনদে স্বাক্ষর করে সরকার নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে সংবিধান, আইন, চুক্তি ও সনদের শর্ত রক্ষায় সর্বোপরি নারীর মানবিক মৌলিক অধিকার তালাকের নোটিসে এ ধরনের শব্দের ব্যবহার বন্ধ করা সরকারের আইনগত দায়িত্ব।’

গত ২৭ জুন ২০২১, তালাক নোটিসে নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর, অমানবিক ও অযৌক্তিক’ শব্দের ব্যবহার কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুল্ল­াহ আল নোমান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।

বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইনে নারী অধিকার

সংবিধান হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, দেশের অন্যান্য আইনগুলোও সংবিধানের আলোকেই প্রণীত হয়। আমাদের সংবিধান নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাংবিধানিকভাবে লৈঙ্গিক বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮(১) নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, ‘শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ সংবিধানের ২৮ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লে­খ আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’

সংবিধানের ২৮(৩) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘শুধু ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ সংবিধানের ২৮(৪) নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লে­খ আছে যে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’

বাংলাদেশের আইনে নারী অধিকারের কিছু ক্ষেত্রে, যেমনÑ পারিবারিক সহিংসতা নিরসনে, অ্যাসিড সন্ত্রাস বন্ধে উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয় হলেও বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ বা তালাক এবং উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের প্রতি নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। বাংলাদেশে বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদসংক্রান্ত যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১; মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ ও মুসলিম বিয়ে ও বিচ্ছেদ (নিবন্ধীকরণ) আইন, ১৯৭৪ (মুসলিমদের জন্য); বিবাহিত হিন্দু নারীর পৃথকবাস ও ভরণপোষণ আইন, ১৯৪৬ (হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য), খ্রিস্টান বিয়ে আইন, ১৮৭২ ও বিচ্ছেদ আইন ১৮৬৯ (খ্রিস্টানদের জন্য)। দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ব্যক্তিগত আইনগুলো নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক। বহু বছর ধরে নারী অধিকারকর্মীদের অনুরোধ, সংগ্রাম, আন্দোলন চলে আসা সত্ত্বেও আধুনিক সময়োপযোগী করে এসব আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধিত হয়নি।

বাংলাদেশ নারী অধিকার, বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদসংক্রান্ত বেশকিছু আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও), নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর), অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিইএসসিআর), টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সম্পূর্ণভাবে বিয়ে ও বিয়ে-পরবর্তী সময়ে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিতের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। সিডওর ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রের প্রতি এই বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে যে, ‘বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কের সব ক্ষেত্রে’ নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অনুচ্ছেদ ১৬(১)(সি)-তে বলা হয়েছে, ‘বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পরিসমাপ্তির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র অনুরূপ সমানাধিকার ও দায়িত্বের প্রয়োগ করবে।’ তবে, এই অনুচ্ছেদটি বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষণ রেখেছে। আইসিসিপিআর-এর ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদেও ‘বিয়ে এবং এর পরিসমাপ্তিকালে’ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য সমতার নিশ্চয়তা দেয়। মোটকথা, সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলের মূল বিষয়বস্তুই হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কার, বৈষম্যমূলক রীতিনীতি দূর করে নারী-পুরুষের জন্য সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশের বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন বা রীতিনীতিগুলো যে শুধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সীমিত করে দেয় তা-ই নয়, এগুলো সামাজিক বৈষম্য এবং পারিবারিক সহিংসতারও ক্ষেত্র তৈরি করে। একজন নারী তার প্রতি ঘটে চলা অন্যায় ও প্রতিবন্ধকতা থেকে পরিত্রাণ পেতে যদি আইনি পরিষেবা গ্রহণের জন্যদ্বারস্থ হন, সেখানেও তিনি পদ্ধতিগতভাবে হেনস্থার শিকার হন। নারীর জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করতে, বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদসংক্রান্ত সব বৈষম্য দূর করে একটি আধুনিক আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী]

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)