‘খেয়ালের বশে’ গণহারে ফাঁসির রায় দেয়ায় হাইকোর্টের উষ্মা

জোড়াখুনের মামলায় ৮ জন খালাস, তিনজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল

নোয়াখালীতে ডাকাতির সময় মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী মিরন ও তার কর্মচারী সুমনকে হত্যার দায়ে বিচারিক আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির ৮ জনকে খালাস দিয়েছে হাইকোর্ট। তিনজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল ও একজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। সাক্ষ্যপ্রমাণের যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ না করে ‘খেয়ালের বশে’ গণহারে ফাঁসির রায় দেয়ায় উচ্চ আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি নিয়ে গতকাল হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেয়।

আদালতে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা, আজাহার উল্লাহ ভুঁইয়া, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও মোহাদ্দেসুল ইসলাম টুটুল। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন আশরাফুল হক জর্জ, শাহীন আহমেদ খান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদা পারভীন ফ্লোরা।

আসামি পক্ষের আইনজীবী আজাহার উল্লাহ ভুঁইয়া রায়ের পর গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্ট রায় ঘোষণার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, আইন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিয়ে খেয়ালিভাবে (বিচারিক আদালত) এ রায় দিয়েছেন, যেটা উচিত নয়। আরও সাবধানতার সঙ্গে সাক্ষ্য-প্রমাণ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে এবং আইনকে যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে এ ধরনের মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালত তাগিদ দিয়েছেন।

তবে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সেগুলো আমলে না নিয়ে হাইকোর্ট ৮ আসামিকে খালাস দিয়েছেন। এ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ, আমরা আপিল করব।

আদালতের রায়ে খালাস পাওয়া ৮ জন হলেনÑ মোফাজ্জল হোসেন জাবেদ, জাফর হোসেন মনু, আলি আকবর সুজন, শামছুদ্দিন ভুট্টু, সাহাব উদ্দিন, নাছির উদ্দিন মঞ্জু, আবু ইউসুফ সুমন ও তোফাজ্জল হোসেন জুয়েল। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ৩ জন হলেনÑ পলাতক কামরুল হাসান প্রকাশ ওরফে সোহাগ, রাশেদ ড্রাইভার ও কামাল হোসেন প্রকাশ। এদের বিচারিক আদালতে দ্রুত আত্মসমর্পণ অথবা গ্রেপ্তার করতে রায়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুস সবুরের দণ্ড কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট।

২০০৭ সালে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ব্যবসায়ী মিরন ও সুমন পালকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে ২০১৬ সালে এই ঘটনায় বিচারিক আদালত ১২ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়। হাইকোর্টে সে মামলায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে ৩ জনের ফাঁসি বহাল রাখা হয়।

আদালত সূত্র জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে নোয়াখালী শহরের জামে মসজিদ মোড় এলাকার দোকান (মোবাইল ফেয়ার) বন্ধ করে দুই ভাই ফিরোজ কবির, সামছুল কবির এবং তাদের দোকানের কর্মচারী সুমন পাল বাসায় ফিরছিলেন। পথে নাপিতের পোল এলাকায় তারা ডাকাতের কবলে পড়েন।

ডাকাতরা তাদের তিনজনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে সড়কের পাশে ফেলে দেন। তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, প্রি-পেইড কার্ডসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করা হয়। আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে সুমন পালকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। গুরুতর আহত ফিরোজ কবির ও সামছুল কবিরকে ঢাকায় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফিরোজ কবির।

পরে নিহত ফিরোজ কবিরের বাবা আবু বকর ছিদ্দিক ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগে সুধারাম থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ২ ভাইসহ ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন নোয়াখালীর দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক এ এন এম মোরশেদ খান।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং জরিমানাও দেয় আদালত। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১০ আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামি আবু ইউছুফ ও তোফাজ্জল হোসেন কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এই মামলার মোট আসামি ২৩ জন। তাদের মধ্যে সোলেমান উদ্দিন ওরফে জিসান নামের এক আসামি র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।

মঙ্গলবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২২ , ২০ পৌষ ১৪২৮ ৩০ জমাদিউল আউয়াল

‘খেয়ালের বশে’ গণহারে ফাঁসির রায় দেয়ায় হাইকোর্টের উষ্মা

জোড়াখুনের মামলায় ৮ জন খালাস, তিনজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল

আদালত বার্তা পরিবেশক

নোয়াখালীতে ডাকাতির সময় মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী মিরন ও তার কর্মচারী সুমনকে হত্যার দায়ে বিচারিক আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির ৮ জনকে খালাস দিয়েছে হাইকোর্ট। তিনজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল ও একজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। সাক্ষ্যপ্রমাণের যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ না করে ‘খেয়ালের বশে’ গণহারে ফাঁসির রায় দেয়ায় উচ্চ আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি নিয়ে গতকাল হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেয়।

আদালতে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা, আজাহার উল্লাহ ভুঁইয়া, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও মোহাদ্দেসুল ইসলাম টুটুল। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন আশরাফুল হক জর্জ, শাহীন আহমেদ খান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফরিদা পারভীন ফ্লোরা।

আসামি পক্ষের আইনজীবী আজাহার উল্লাহ ভুঁইয়া রায়ের পর গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্ট রায় ঘোষণার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, আইন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিয়ে খেয়ালিভাবে (বিচারিক আদালত) এ রায় দিয়েছেন, যেটা উচিত নয়। আরও সাবধানতার সঙ্গে সাক্ষ্য-প্রমাণ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে এবং আইনকে যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে এ ধরনের মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালত তাগিদ দিয়েছেন।

তবে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সেগুলো আমলে না নিয়ে হাইকোর্ট ৮ আসামিকে খালাস দিয়েছেন। এ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ, আমরা আপিল করব।

আদালতের রায়ে খালাস পাওয়া ৮ জন হলেনÑ মোফাজ্জল হোসেন জাবেদ, জাফর হোসেন মনু, আলি আকবর সুজন, শামছুদ্দিন ভুট্টু, সাহাব উদ্দিন, নাছির উদ্দিন মঞ্জু, আবু ইউসুফ সুমন ও তোফাজ্জল হোসেন জুয়েল। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ৩ জন হলেনÑ পলাতক কামরুল হাসান প্রকাশ ওরফে সোহাগ, রাশেদ ড্রাইভার ও কামাল হোসেন প্রকাশ। এদের বিচারিক আদালতে দ্রুত আত্মসমর্পণ অথবা গ্রেপ্তার করতে রায়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুস সবুরের দণ্ড কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট।

২০০৭ সালে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ব্যবসায়ী মিরন ও সুমন পালকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে ২০১৬ সালে এই ঘটনায় বিচারিক আদালত ১২ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়। হাইকোর্টে সে মামলায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে ৩ জনের ফাঁসি বহাল রাখা হয়।

আদালত সূত্র জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে নোয়াখালী শহরের জামে মসজিদ মোড় এলাকার দোকান (মোবাইল ফেয়ার) বন্ধ করে দুই ভাই ফিরোজ কবির, সামছুল কবির এবং তাদের দোকানের কর্মচারী সুমন পাল বাসায় ফিরছিলেন। পথে নাপিতের পোল এলাকায় তারা ডাকাতের কবলে পড়েন।

ডাকাতরা তাদের তিনজনকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে সড়কের পাশে ফেলে দেন। তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, প্রি-পেইড কার্ডসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করা হয়। আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে সুমন পালকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। গুরুতর আহত ফিরোজ কবির ও সামছুল কবিরকে ঢাকায় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফিরোজ কবির।

পরে নিহত ফিরোজ কবিরের বাবা আবু বকর ছিদ্দিক ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগে সুধারাম থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ২ ভাইসহ ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন নোয়াখালীর দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক এ এন এম মোরশেদ খান।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং জরিমানাও দেয় আদালত। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১০ আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামি আবু ইউছুফ ও তোফাজ্জল হোসেন কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এই মামলার মোট আসামি ২৩ জন। তাদের মধ্যে সোলেমান উদ্দিন ওরফে জিসান নামের এক আসামি র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।