আমদানিকারক থেকে উৎপাদনকারী

আমরা ডিজিটাল যন্ত্র বানাচ্ছি, রপ্তানিও করছি

মোস্তাফা জব্বার

দুই ॥

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির প্রস্তাবনায় মূলত উৎপাদিত পণ্যের যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক, উৎপাদিত পণ্যের ওপর এটিভি, খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রি র ওপর শুল্ক ও কর ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়কর খাতে শূণ্য ব্যবস্থা প্রচলনের অনুরোধ করা হয়। এছাড়াও ১০ বছরের কর রেয়াত, শতকরা ৫ ভাগ নগদ ইনসেনটিভ, বিশ্বমেলাসমূহে শতভাগ সমর্থন ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিউট স্থাপনের দাবি করা হয়।

২০১৬-১৭ সালের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বা কম্পিউটার সমিতির দাবিসমূহের কোনটাই পূরণ করা হয়নি। তবে ১৭-১৮ সালের বাজেট ও তার পরে ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদনের অনুকূল পরিবশ তৈরির সকল ব্যবস্থাই করা হয়।

তখন থেকেই সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেই থেকেই মোবাইল পণ্যের ওপর করারোপ ও ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। যন্ত্রাংশ বা কাঁচামালের শুল্ক ও ভ্যাট কমানো হয়েছে। রপ্তানীতে শতকরা ১০ ভাগ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে দেশের রাজস্ব বেড়েছে, কর্মসংস্থান হয়েছে এবং ডিজিটাল যন্ত্র দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।

২১ সালে সেই অবস্থাটি একদম পাল্টে গেছে। ২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার দৈনিক ডেইলী স্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি মাগুরার পলিটেকনিক ইন্সিিটউটরে ছাত্র আব্দুল্লাহ আল নোমানকে দিয়ে শুরু হয়। সে কেমন করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের আনিরা ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি মোবাইল উৎপাদক কারখানায় কর্মসংস্থান করতে পারে তার বিবরণ দিয়ে মোবাইল শিল্পে বাংলাদেশের অর্জনকে তুলে ধরা হয়েছে। নোমানের ভাষায়, ‘আমি কখনও ভাবতে পারিনি যে একটি কাজ যোগাড় করা এতো সহজ হবে’ ডেইল স্টারের মন্তব্য যে স্থানীয় মোবাইল উৎপাদক ও সংযোজনকারী এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মসৃষ্টির জন্য এই তরুণ সুবিধাটি পেয়েছে। ডেইলি স্টার প্রতিবেদনে বলেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকার প্রদত্ত বিশাল কর সুবিধার ফলে হ্যান্ডসেট উৎপাদনে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। কর সুবিধার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এ পর্যন্ত দেশে ১৪টি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে এবং আরও চারটি কারখানা স্থাপন কার্যক্রম চলছে। এর ফলে প্রায় ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে বিদেশ থেকে স্মার্টফোন আমদানিতে শতকরা ৫৮ ভাগ কর দিতে হয়, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের জন্য এ হার মাত্র শতকরা ১৫ভাগ। আনিরা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, আমরা মাঝে মধ্যেই দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল কারখানায় চাকরির প্রস্তাব দিচ্ছি। যারা আমাদের প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছেন তাদের প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ প্রদান করার পর তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনায়াসে কাজ শুরু করতে পারছেন। আমদানি করা হ্যান্ডসেটের তুলনায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের দাম সস্তা হওয়ায় বাংলাদেশে উৎপাদিত সেটের চাহিদা বাড়ছে বলে তিনি জানান। এ লক্ষ্যে তিনি ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এক হাজার লোক নিয়োগ প্রদানের তার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান। বিটিআরসি তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ৯৪ লাখ হ্যান্ডসেটের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে শতকরা ৫১ ভাগ সেট স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং অবশিষ্ট শতকরা ৪৯ ভাগ আমদানি করতে হয়। এছাড়া গত অর্থবছরে দেশে চার কোটি ১২ লাখ হ্যান্ডসেটের চাহিদার মধ্যে শতকরা ৬৩ ভাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে মেটানো হয়।

স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মেড ইন বাংলাদেশ হ্যান্ডসেটের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মোবাইল কারখানাসমূহ তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। চাহিদার সাথে উৎপাদনের সামঞ্জস্য রাখতে উদ্যোক্তাদের আরও দশ হাজার কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক গতি সঞ্চারে এটি একটি ভালো লক্ষণ। ২০২১ সালের গোড়ার দিকে করোনার প্রভাবে হ্যান্ডসেট বিক্রয়ের মন্দা কাটিয়ে চলতি বছর বিক্রির পরিমাণ আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়। একটি মোবাইল উৎপাদন শিল্পের হিসেব মতে করোনা অতিমারির পর থেকে শিল্পটি শতকরা ১৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মোবাইল ফোনের বিক্রয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালে ৭ শতাংশ এবং ২৩ সালে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে একটি আন্তর্জাতিক একটি ডেটা প্রতিষ্ঠান এমনটিই ধারণা দিয়েছে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে গত পাঁচ বছরে দেশে মোবাইল ফোনের দাম ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যার দিক থেকে মোবাইল বিক্রির হার বেড়েছে শতকরা ৮ভাগ। আমদানি করা মোবাইলের তুলনায় স্থানীয় উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের মূল্য শতকরা ৩৫ভাগ কম বলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান।

মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন কারখানাসমূহে কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এবং শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া প্রায় সকল বাংলাদেশি কর্মচারী দ্ধারা এসব কারখানা উৎপাদন প্রক্রিয়া দক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। স্যামসাংয়ের স্থানীয় পার্টনার ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেছেন, তারা এ পর্যন্ত এক হাজার দুইশত পঞ্চাশ জনকে নিয়োগ করেছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে আরও এক হাজার লোক তারা নিয়োগ করবে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন প্লাট চালু করে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে তিন লাখ ফোনসেট উৎপাদনে সক্ষম। গাজীপুরের বোর্ড বাজারে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটিতে ৬৫০ জন কর্মী রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে কারখানাটি দ্বিগুণ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই লক্ষ্যে কারখানাটিতে সমান সংখ্যক কর্মচারী বাড়ানো হবে বলে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান আশরাফুল হাসান জানান। বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড কোম্পানির অধীনে ভিভো ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন করা শুরু করে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া হ্যান্ডসেটের ৯৯ শতাংশ উৎপাদন করছে। কোম্পানিটির সিনিয়র ম্যানেজার ইমাম উদ্দিন বলেন, ভিভো কারখানাটিতে ১২০০ জন কর্মী কাজ করছে। আগামী বছরের মধ্যে আরও এক হাজার লোকের নিয়োগ দেবে তারা। সিম্পনি হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতিমাসে ৫ লাখের বেশি ফোন উৎপাদন করছে। আশুলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত আট লাইনের প্লান্টটিতে ১২শ জন লোক কাজ করে। কোম্পানির এমডি জাকারিয়া শহিদ বলেন, আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফোন রপ্তানি শুরু করার কারণে আমাদের জনবল আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন ডিজিÑটেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্লাট প্রতি মাসে ৫ লাখ ফোন তৈরি করে। এই প্লান্টটিতে ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কোম্পানিটি ২০২২ সালের ভিতর প্রতি মাসে ২০ লাখ ফোন উৎপাদন করবে এবং আরও এক হাজার লোককে নিয়োগ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

সম্প্রতি নোকিয়া ও শাওমি বাংলাদেশে মোবাইলসেট উৎপাদন শুরু করেছে এবং তারা এক সাথে ৫শ জনকে নিয়োগ দিয়েছে। মোবাইলসেটের স্থানীয় উৎপাদন ও সংযোজন দেশের তরুণদের উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষতা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বেস্ট টাইকুনের কর্মকর্তা ইমাম বলেন, উৎপাদন লাইনে কর্মরত কর্মীদের শিক্ষাগত সনদের প্রয়োজনীয়তা এইচএসসি থেকে শুরু হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। লাইন ম্যানেজার থেকে ইউনিট ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পেতে বিএসসি ডিগ্রি প্রয়োজন। তাদেরকে ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট এক্সিকিউটিভ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজারের পদেও পদায়ন করা যায়। বেশির ভাগ কর্মী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। নিয়োগের পর তারা সাধারণত ইনÑহাউজ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। অনেককে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও পাঠানো হয় বিশেষ করে চীনে।

গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের হাসানের মতে কারখানা প্রতিষ্ঠার আগে তারা ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে চীন থেকে যখন ফোনসেট ক্রয় করেছিলেন তখন ত্রুটিজনিত কারণে দুই পার্সেন্ট ফোন ফেরত পাঠাতে হতো। এখন স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ফোনের এক শতাংশ ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি প্রযুক্তি গ্রহণে স্থানীয় কর্মচারীদের দক্ষতারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখন গ্রাহক সন্তুষ্টিও আগের তুলনায় বেশ ভালো।

মোবাইল ফোন উৎপাদনে তিনটি প্রধান উপাদান জড়িত, এগুলো হচ্ছে ডিসপ্লে, চিপসেট এবং ব্যাটারি। এ তিনটি উপাদান সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের কোন কোম্পানি এগুলো উৎপাদন করে না। বিশ্বের মাত্র কয়েকটি দেশ তাইওয়ান, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া এগুলো উৎপাদন করে। স্যামসাং, বিওই টেকনোলজি এবং এলজির মতো কয়েকটি কোম্পানিও ডিসপ্লে তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু বাংলাদেশি কোম্পানি দাবি করছে যে তারা ব্যাটারি তৈরি করছে, আসলে তা সত্য নয়। তারা কেবল কাঁচামাল (লিথিয়াম-আয়ন) আমদানি করে এবং সেটি কেটে শুধু নিজেদের নামে লেভেল পরিয়ে দেয়। ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের মেসবাহ বলেন, ফোন ব্যবহারকারীর দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম দেশ কিন্তু বেশিরভাগ গ্রাহক কম দামের ফোন ব্যবহার করেন। মেসবাহ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে ডিসপ্লে, ব্যাটারি এবং চিপসেটের কারখানাও গড়ে উঠবে। এ অর্জনের জন্য আমি কৃতজ্ঞচিত্তে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

তবে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :

ক) সফটওয়্যারের মতো হার্ডওয়্যার উৎপাদনকেও শূন্যকর সুবিধা প্রদান করা যায়। মোবাইলের মতো আমদানির ওপর শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো যেতে পারে। বারবার অনুরোধ করেও এটি করা যায়নি। যদিও দেশে ওয়ালটনের মতো কারখানায় ল্যাপটপ উৎপাদিত বা সংযোজিত হয় এবং রপ্তানিও হয়; তথাপি এ খাতের প্রণোদনা মোবাইলের মতো নয়। আগামী বাজেটে এটি বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।

খ) সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশি ব্রান্ড কেনার বদলে দেশীয় ব্রান্ড ডিজিটাল ডিভাইস কেনার বিধান করা যায়। (সমাপ্ত)

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী]

ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯।

আপডেট : ১ জানুয়ারি, ২০২১।

মঙ্গলবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২২ , ২০ পৌষ ১৪২৮ ৩০ জমাদিউল আউয়াল

আমদানিকারক থেকে উৎপাদনকারী

আমরা ডিজিটাল যন্ত্র বানাচ্ছি, রপ্তানিও করছি

মোস্তাফা জব্বার

image

দুই ॥

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির প্রস্তাবনায় মূলত উৎপাদিত পণ্যের যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক, উৎপাদিত পণ্যের ওপর এটিভি, খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রি র ওপর শুল্ক ও কর ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়কর খাতে শূণ্য ব্যবস্থা প্রচলনের অনুরোধ করা হয়। এছাড়াও ১০ বছরের কর রেয়াত, শতকরা ৫ ভাগ নগদ ইনসেনটিভ, বিশ্বমেলাসমূহে শতভাগ সমর্থন ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিউট স্থাপনের দাবি করা হয়।

২০১৬-১৭ সালের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বা কম্পিউটার সমিতির দাবিসমূহের কোনটাই পূরণ করা হয়নি। তবে ১৭-১৮ সালের বাজেট ও তার পরে ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদনের অনুকূল পরিবশ তৈরির সকল ব্যবস্থাই করা হয়।

তখন থেকেই সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেই থেকেই মোবাইল পণ্যের ওপর করারোপ ও ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। যন্ত্রাংশ বা কাঁচামালের শুল্ক ও ভ্যাট কমানো হয়েছে। রপ্তানীতে শতকরা ১০ ভাগ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এতে দেশের রাজস্ব বেড়েছে, কর্মসংস্থান হয়েছে এবং ডিজিটাল যন্ত্র দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।

২১ সালে সেই অবস্থাটি একদম পাল্টে গেছে। ২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার দৈনিক ডেইলী স্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি মাগুরার পলিটেকনিক ইন্সিিটউটরে ছাত্র আব্দুল্লাহ আল নোমানকে দিয়ে শুরু হয়। সে কেমন করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের আনিরা ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি মোবাইল উৎপাদক কারখানায় কর্মসংস্থান করতে পারে তার বিবরণ দিয়ে মোবাইল শিল্পে বাংলাদেশের অর্জনকে তুলে ধরা হয়েছে। নোমানের ভাষায়, ‘আমি কখনও ভাবতে পারিনি যে একটি কাজ যোগাড় করা এতো সহজ হবে’ ডেইল স্টারের মন্তব্য যে স্থানীয় মোবাইল উৎপাদক ও সংযোজনকারী এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মসৃষ্টির জন্য এই তরুণ সুবিধাটি পেয়েছে। ডেইলি স্টার প্রতিবেদনে বলেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকার প্রদত্ত বিশাল কর সুবিধার ফলে হ্যান্ডসেট উৎপাদনে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। কর সুবিধার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এ পর্যন্ত দেশে ১৪টি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে এবং আরও চারটি কারখানা স্থাপন কার্যক্রম চলছে। এর ফলে প্রায় ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে বিদেশ থেকে স্মার্টফোন আমদানিতে শতকরা ৫৮ ভাগ কর দিতে হয়, অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের জন্য এ হার মাত্র শতকরা ১৫ভাগ। আনিরা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানান, আমরা মাঝে মধ্যেই দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল কারখানায় চাকরির প্রস্তাব দিচ্ছি। যারা আমাদের প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছেন তাদের প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ প্রদান করার পর তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনায়াসে কাজ শুরু করতে পারছেন। আমদানি করা হ্যান্ডসেটের তুলনায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের দাম সস্তা হওয়ায় বাংলাদেশে উৎপাদিত সেটের চাহিদা বাড়ছে বলে তিনি জানান। এ লক্ষ্যে তিনি ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এক হাজার লোক নিয়োগ প্রদানের তার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান। বিটিআরসি তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ৯৪ লাখ হ্যান্ডসেটের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে শতকরা ৫১ ভাগ সেট স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং অবশিষ্ট শতকরা ৪৯ ভাগ আমদানি করতে হয়। এছাড়া গত অর্থবছরে দেশে চার কোটি ১২ লাখ হ্যান্ডসেটের চাহিদার মধ্যে শতকরা ৬৩ ভাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে মেটানো হয়।

স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মেড ইন বাংলাদেশ হ্যান্ডসেটের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মোবাইল কারখানাসমূহ তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। চাহিদার সাথে উৎপাদনের সামঞ্জস্য রাখতে উদ্যোক্তাদের আরও দশ হাজার কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক গতি সঞ্চারে এটি একটি ভালো লক্ষণ। ২০২১ সালের গোড়ার দিকে করোনার প্রভাবে হ্যান্ডসেট বিক্রয়ের মন্দা কাটিয়ে চলতি বছর বিক্রির পরিমাণ আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়। একটি মোবাইল উৎপাদন শিল্পের হিসেব মতে করোনা অতিমারির পর থেকে শিল্পটি শতকরা ১৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মোবাইল ফোনের বিক্রয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালে ৭ শতাংশ এবং ২৩ সালে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে একটি আন্তর্জাতিক একটি ডেটা প্রতিষ্ঠান এমনটিই ধারণা দিয়েছে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে গত পাঁচ বছরে দেশে মোবাইল ফোনের দাম ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যার দিক থেকে মোবাইল বিক্রির হার বেড়েছে শতকরা ৮ভাগ। আমদানি করা মোবাইলের তুলনায় স্থানীয় উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের মূল্য শতকরা ৩৫ভাগ কম বলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান।

মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন কারখানাসমূহে কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এবং শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া প্রায় সকল বাংলাদেশি কর্মচারী দ্ধারা এসব কারখানা উৎপাদন প্রক্রিয়া দক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। স্যামসাংয়ের স্থানীয় পার্টনার ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেছেন, তারা এ পর্যন্ত এক হাজার দুইশত পঞ্চাশ জনকে নিয়োগ করেছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে আরও এক হাজার লোক তারা নিয়োগ করবে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন প্লাট চালু করে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে তিন লাখ ফোনসেট উৎপাদনে সক্ষম। গাজীপুরের বোর্ড বাজারে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটিতে ৬৫০ জন কর্মী রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে কারখানাটি দ্বিগুণ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই লক্ষ্যে কারখানাটিতে সমান সংখ্যক কর্মচারী বাড়ানো হবে বলে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান আশরাফুল হাসান জানান। বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড কোম্পানির অধীনে ভিভো ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন করা শুরু করে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া হ্যান্ডসেটের ৯৯ শতাংশ উৎপাদন করছে। কোম্পানিটির সিনিয়র ম্যানেজার ইমাম উদ্দিন বলেন, ভিভো কারখানাটিতে ১২০০ জন কর্মী কাজ করছে। আগামী বছরের মধ্যে আরও এক হাজার লোকের নিয়োগ দেবে তারা। সিম্পনি হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতিমাসে ৫ লাখের বেশি ফোন উৎপাদন করছে। আশুলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত আট লাইনের প্লান্টটিতে ১২শ জন লোক কাজ করে। কোম্পানির এমডি জাকারিয়া শহিদ বলেন, আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফোন রপ্তানি শুরু করার কারণে আমাদের জনবল আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন ডিজিÑটেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্লাট প্রতি মাসে ৫ লাখ ফোন তৈরি করে। এই প্লান্টটিতে ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কোম্পানিটি ২০২২ সালের ভিতর প্রতি মাসে ২০ লাখ ফোন উৎপাদন করবে এবং আরও এক হাজার লোককে নিয়োগ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

সম্প্রতি নোকিয়া ও শাওমি বাংলাদেশে মোবাইলসেট উৎপাদন শুরু করেছে এবং তারা এক সাথে ৫শ জনকে নিয়োগ দিয়েছে। মোবাইলসেটের স্থানীয় উৎপাদন ও সংযোজন দেশের তরুণদের উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষতা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বেস্ট টাইকুনের কর্মকর্তা ইমাম বলেন, উৎপাদন লাইনে কর্মরত কর্মীদের শিক্ষাগত সনদের প্রয়োজনীয়তা এইচএসসি থেকে শুরু হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। লাইন ম্যানেজার থেকে ইউনিট ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পেতে বিএসসি ডিগ্রি প্রয়োজন। তাদেরকে ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট এক্সিকিউটিভ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজারের পদেও পদায়ন করা যায়। বেশির ভাগ কর্মী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। নিয়োগের পর তারা সাধারণত ইনÑহাউজ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। অনেককে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও পাঠানো হয় বিশেষ করে চীনে।

গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের হাসানের মতে কারখানা প্রতিষ্ঠার আগে তারা ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে চীন থেকে যখন ফোনসেট ক্রয় করেছিলেন তখন ত্রুটিজনিত কারণে দুই পার্সেন্ট ফোন ফেরত পাঠাতে হতো। এখন স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ফোনের এক শতাংশ ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি প্রযুক্তি গ্রহণে স্থানীয় কর্মচারীদের দক্ষতারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখন গ্রাহক সন্তুষ্টিও আগের তুলনায় বেশ ভালো।

মোবাইল ফোন উৎপাদনে তিনটি প্রধান উপাদান জড়িত, এগুলো হচ্ছে ডিসপ্লে, চিপসেট এবং ব্যাটারি। এ তিনটি উপাদান সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের কোন কোম্পানি এগুলো উৎপাদন করে না। বিশ্বের মাত্র কয়েকটি দেশ তাইওয়ান, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া এগুলো উৎপাদন করে। স্যামসাং, বিওই টেকনোলজি এবং এলজির মতো কয়েকটি কোম্পানিও ডিসপ্লে তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু বাংলাদেশি কোম্পানি দাবি করছে যে তারা ব্যাটারি তৈরি করছে, আসলে তা সত্য নয়। তারা কেবল কাঁচামাল (লিথিয়াম-আয়ন) আমদানি করে এবং সেটি কেটে শুধু নিজেদের নামে লেভেল পরিয়ে দেয়। ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের মেসবাহ বলেন, ফোন ব্যবহারকারীর দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম দেশ কিন্তু বেশিরভাগ গ্রাহক কম দামের ফোন ব্যবহার করেন। মেসবাহ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে ডিসপ্লে, ব্যাটারি এবং চিপসেটের কারখানাও গড়ে উঠবে। এ অর্জনের জন্য আমি কৃতজ্ঞচিত্তে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

তবে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :

ক) সফটওয়্যারের মতো হার্ডওয়্যার উৎপাদনকেও শূন্যকর সুবিধা প্রদান করা যায়। মোবাইলের মতো আমদানির ওপর শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো যেতে পারে। বারবার অনুরোধ করেও এটি করা যায়নি। যদিও দেশে ওয়ালটনের মতো কারখানায় ল্যাপটপ উৎপাদিত বা সংযোজিত হয় এবং রপ্তানিও হয়; তথাপি এ খাতের প্রণোদনা মোবাইলের মতো নয়। আগামী বাজেটে এটি বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।

খ) সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশি ব্রান্ড কেনার বদলে দেশীয় ব্রান্ড ডিজিটাল ডিভাইস কেনার বিধান করা যায়। (সমাপ্ত)

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী]

ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯।

আপডেট : ১ জানুয়ারি, ২০২১।