রাজউকের ভবনেই ছিল ‘গোল্ডেন’ মনিরের জাল নথি তৈরির কার্যক্রম

নথি চুরি করে জাল কাগজ বানিয়ে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা

রাজউকের এনেক্স ভবনের একটি কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। আর সেই কক্ষেই ছিল রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পের প্লট এবং ফ্ল্যাটের জাল নথিপত্র তৈরির কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পের প্লটের জাল নথিপত্র তৈরি করে তা নিজের কব্জায় নিয়েছিল মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির, যিনি র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলে আছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দুই বছর আগে (২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর) রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এক অভিযানে একটি কক্ষ থেকে ৭০ প্লটের নথি, সাবেক চেয়ারম্যানের সিল স্বাক্ষর দেয়া দলিল, কর্মকর্তাদের সিলসহ বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার হয়। ওই অভিযানে রাজউকের এক কর্মচারীকে আটক করা হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উদ্ধার করা নথিগুলো গোল্ডেন মনিরের নেতৃত্বে রাজউকের কয়েক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এনেছিলেন। ওই ঘটনায় সে সময় মামলা হলেও পরবর্তীতে তা দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২ বছর ৩ মাস অনুসন্ধান শেষে দুদক সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ এনে গোল্ডেন মনিরসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। গোল্ডেন মনির ছাড়া আটজনের মধ্যে দুইজন গোল্ডেন মনিরের কর্মচারী এবং বাকি ছয়জন রাউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে (২০ থেকে ২১ ডিসেম্বর) অভিযান চালিয়ে মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব। এক সময় বিমানবন্দর কেন্দ্রিক স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকায় মনির হোসেন গোল্ডেন মনির নামে পরিচিতি পান। সে সময় খবর বের হয়, গোল্ডেন মনির সরকারি ২০ প্লটসহ ২৩টি প্লটের মালিক এবং একাধিক বাড়ি রয়েছে তার। এ ছাড়া সে প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও মালিক। নামে-বেনামে তার রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ আরিফ সাদেক জানিয়েছেন, দুই বছর আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে সরকারি নথিপত্র চুরির ঘটনায় নতুন করে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে করা এ মামলায় আসামি করা হয়েছে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরসহ রাজউকের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। গতকাল দুদকের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) মো. শফিউল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন।

গোল্ডেন মনির ছাড়াও মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেনÑ রাজউকের অফিস সহায়ক (বর্তমানে বরখাস্ত) মো. পারভেজ চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মো. নাসির উদ্দিন খান, রাজউকের এসেস্ট ও ভূমি-১ এর সাবেক সহকারী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন শরীফ, উপপরিচালক মো. দিদারুল আলম, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর (এসেস্ট ও ভূমি-১) মো. আনোয়ার হোসেন, নিরীক্ষা ও বাজেট শাখার ঊর্ধ্বতন হিসাব সহকারী এসএম তৌহিদুল ইসলাম এবং মো. আলাউদ্দিন সরকার ( কার্য তদারকি মান-২)।

দুদক জানিয়েছে, আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ লাভ ও লোভের বশবর্তী হয়ে অসৎ উদ্দশে ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অফিস হতে নিয়মানুযায়ী নথিসমূহ মুভমেন্ট রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে এবং কাজ শেষে রেকর্ড রুমে প্রেরণ না করে সরকারি নথিপত্র কৌশলে সরিয়ে ও বিভিন্ন কর্মকর্তার সিল অবৈধভাবে তৈরি করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভবে ভুয়া নথি সৃজন ও লিজ দলিল সম্পাদন করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন।

মামলায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয় ঢাকা কর্তৃক অভিযোগ অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় প্রতিয়মান হয় যে, বিগত ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর বেলা ১১টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে একটি টিম রাজউক এনেক্স ভবনের ৫ম তলার এ-৫১৪ নম্বর কক্ষটি তল্লাশি এবং পরিদর্শন করেন। অনুসন্ধানকালে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদসহ উপস্থিত সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে জানান, বিগত ওইদিন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে রাজউক এনেক্স ভবনের ৫ম তলার এ-৫১৪ নম্বর কক্ষটি রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্টেট জেসমিন আক্তার, এসেস্ট ও ভূমি শাখার সদস্য মো. শফিউল হক, পরিচালক (প্রশাসন) খন্দকার অলিউর রহমান, পরিচালক (এসেস্ট ও ভূমি-১) মো. আকতারুজ্জামান, পরিচালক (আইন) আনন্দ কুমার বিশ্বাস, আইন কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল করিম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম তল্লাশি কার্যক্রমে অংশ নেন।

মামলায় বলা হয়, কক্ষটি তল্লাশিকালে ৭০টি প্লটের নথি, একটি ল্যাপটপ, রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে ১৫টি সিলসহ স্ট্যাম্প প্যাড, সিটি করপোরেশনের ১৭০টি বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্র, ডিমান্ড কালেকশন রেজিস্টার (ডিসিআর), লিজ ডিডের কপি চারটি, বরাদ্দপত্রের কপিসহ বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি মতিঝিল থানা পুলিশকে অবহিত করা হলে মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। (জিডি নং-৯৭৭) পরে মতিঝিল থানার এসআই মো. সফিকুল ইসলাম জব্দ তালিকা করে উদ্ধারকৃত আলামত জব্দ করেন। তল্লাশিকালে জব্দ করা রাজউকের মূল্যবান নথিপত্রের সঙ্গে জনৈক মনির হোসেনের (গোল্ডেন মনির) কর্মচারী মো. নাসির ও রাজউকের পিয়ন মো. পারভেজ চৌধুরীকে কর্মরত দেখা যায়। এক পর্যায়ে মো. নাসির পালিয়ে গেলেও রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২ এর পরিচাক অফিসের অফিস সহকারী মো. পারভেজ চৌধুরীকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দুদক বলছে, অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে রাজউক এনেক্স ভবনের ৫ম তলার এ- ৫১৪ নম্বর কক্ষটি ১৯৮৬ সাল হতে পলি ওভারসিজ লি.র স্বত্বাধিকারী ফজলুল হককে চুক্তিভিত্তিক ভাড়া দেয়া হয়েছে। রাজউকের কাছ থেকে কক্ষটি ভাড়া নিয়ে ফজলুল হক কক্ষের তিন ভাগের এক ভাগ জায়গা মনির হোসেনকে (গোল্ডেন মনির) সাবলেট হিসেবে ভাড়া প্রদান করেছেন। আটক হওয়া রাজউক কর্মচারী মো. পারভেজ চৌধুরী জানান, যে ফাইলগুলো তারা সরাতে গিয়ে ধরা পড়েছে সেই ফাইলগুলো গোল্ডেন মনিরের নির্দেশে রেকর্ডরুম ও সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে সংগ্রহ করে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই কক্ষে এনেছেন। পারভেজ চৌধুরী আরও জানান, মনির হোসেনের (গোল্ডেন মনির) নির্দেশেই সেসহ জিন্নাহ ও নাসির এবং আরও কয়েকজন মিলে ৭০টি নথি কৌশলে রাজউক মূলভবন থেকে রাজউক এনেক্স ভবনের এ-৫১৪ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসেন। রাজউকের ফাইল সংশ্লিষ্ট শাখা এবং রেকর্ডরুম ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথা নয়। নথিগুলো যে রুম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেই রুমটি রাজউকের অফিস রুম নয়। ভাড়াটিয়ার রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

পরে এ ঘটনায় রাজউকের দক্ষিণ বিভাগের নির্বাহী মো. নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় রাজউকের কর্মচারী মো. পারভেজ চৌধুরী, মনির হোসেন (গোল্ডেন মনির) এবং মনিরের কর্মচারী জিন্নাহসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পরে ওই মামলা দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় তদন্তের জন্য দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জব্দকৃত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ৭০টি প্লটের নথি বিভিন্ন সময়ে রেকর্ডরুম থেকে রেকর্ডরুমের স্টক রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে নাসির উদ্দিন শরীফ, মো. আনোয়ার হোসেন ও মো. পারভেজ চৌধুরী গ্রহণ করেছেন। ৭০টি নথির মধ্যে ৫৪টি নথি নাসির উদ্দিন শরীফ, সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১), রাজউক, দুটি নথি মো. আনোয়ার হোসেন, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর (এস্টেট ও ভূমি-১), ও পাঁচটি নথি মো. পারভেজ চৌধুরী অফিস সহায়ক রাজউক গ্রহণ করেন। বাকি ৯টি নথির গ্রহণ ও হস্তান্তরের কোন রেকর্ড নেই। পারভেজ চৌধুরী যে পাঁচটি নথি গ্রহণ করেছেন সেগুলো ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর রেকর্ডরুম থেকে গ্রহণ করেছেন বাকি নথিগুলো ২০১৬ সালে রেকর্ডরুম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ওই নথিগুলো রেকর্ড রুম থেকে গ্রহণ করার পর আর রেকর্ডরুমে ফেরত দেয়া হয়নি।

নথির মুভমেন্ট রেজিস্টারের মাধ্যমে যেকোনো নথি চলাচলের নিয়ম রয়েছে। নথি ডেসপাসে যাওয়ার পর ইস্যু রেস্ট্রিারের মাধ্যমে রেকর্ডরুমে পাঠানো হয়। কিন্তু রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নথিগুলো নিয়মানুযায়ী মুভমেন্ট রেজিস্টার এবং ইস্যু রেজিস্টারের মাধ্যমে চলাচল করেনি। অধিকাংশ নথিতে সহকারী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন শরীফ, সহকারী পরিচালক মো. দিদারুল আলম, অফিস সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন ও মো. আলাউদ্দিন সরকার একই দিনে সব শেষে স্বাক্ষর করেছেন। নথিগুলো পরবর্তীতে অফিস কক্ষ বা রেকর্ডরুমে ছিল না।

আটককৃত পারভেজ চৌধুরী তল্লাশিকালে কর্মকর্তাদের জানান, মনির হোসেন (গোল্ডেন মনির), তার কর্মচারী জিন্নাহ এবং নাসিরসহ রাজউকের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীর সহযোগিতায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রাজউক অফিস থেকে সরকারি নথিপত্র কৌশলে সরিয়েছেন। বিভিন্ন কর্মকর্তার সিল তৈরি করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভবে ভুয়া নথি সৃজন ও লিজ দলিল সম্পাদন করেছেন।

দুদক বলছে, গোন্ডেন মনিরের এসব কর্মকা-ে রাজউকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সহযোগিতা করেছেন। তাদের সহযোগিতায় সরকারি নথি বিভিন্ন সময়ে চুরি হয়েছে এবং অফিস কক্ষের বাইরে আনা হয়েছে। গোল্ডেন মনিরের সাবলেটে ভাড়া নেয়া কক্ষটিতে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমানের নামে সিল ও স্বাক্ষরিত দলিলও মিলেছে যা তিনি বিদায় নেয়ার পর জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের প্লট আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়েছে। আত্মসাৎ চেষ্টা করা প্লটের অধিকাংশই রাজউকের বাড্ডা প্রকল্পের ছিল।

বুধবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২২ , ২১ পৌষ ১৪২৮ ১ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

রাজউকের ভবনেই ছিল ‘গোল্ডেন’ মনিরের জাল নথি তৈরির কার্যক্রম

নথি চুরি করে জাল কাগজ বানিয়ে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা

রাজউকের এনেক্স ভবনের একটি কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। আর সেই কক্ষেই ছিল রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পের প্লট এবং ফ্ল্যাটের জাল নথিপত্র তৈরির কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পের প্লটের জাল নথিপত্র তৈরি করে তা নিজের কব্জায় নিয়েছিল মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির, যিনি র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে এখন জেলে আছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দুই বছর আগে (২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর) রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এক অভিযানে একটি কক্ষ থেকে ৭০ প্লটের নথি, সাবেক চেয়ারম্যানের সিল স্বাক্ষর দেয়া দলিল, কর্মকর্তাদের সিলসহ বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার হয়। ওই অভিযানে রাজউকের এক কর্মচারীকে আটক করা হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উদ্ধার করা নথিগুলো গোল্ডেন মনিরের নেতৃত্বে রাজউকের কয়েক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এনেছিলেন। ওই ঘটনায় সে সময় মামলা হলেও পরবর্তীতে তা দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২ বছর ৩ মাস অনুসন্ধান শেষে দুদক সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ এনে গোল্ডেন মনিরসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। গোল্ডেন মনির ছাড়া আটজনের মধ্যে দুইজন গোল্ডেন মনিরের কর্মচারী এবং বাকি ছয়জন রাউকের কর্মকর্তা-কর্মচারী।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে (২০ থেকে ২১ ডিসেম্বর) অভিযান চালিয়ে মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব। এক সময় বিমানবন্দর কেন্দ্রিক স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকায় মনির হোসেন গোল্ডেন মনির নামে পরিচিতি পান। সে সময় খবর বের হয়, গোল্ডেন মনির সরকারি ২০ প্লটসহ ২৩টি প্লটের মালিক এবং একাধিক বাড়ি রয়েছে তার। এ ছাড়া সে প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও মালিক। নামে-বেনামে তার রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ আরিফ সাদেক জানিয়েছেন, দুই বছর আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দপ্তরে সরকারি নথিপত্র চুরির ঘটনায় নতুন করে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে করা এ মামলায় আসামি করা হয়েছে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরসহ রাজউকের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। গতকাল দুদকের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) মো. শফিউল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন।

গোল্ডেন মনির ছাড়াও মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেনÑ রাজউকের অফিস সহায়ক (বর্তমানে বরখাস্ত) মো. পারভেজ চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মো. নাসির উদ্দিন খান, রাজউকের এসেস্ট ও ভূমি-১ এর সাবেক সহকারী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন শরীফ, উপপরিচালক মো. দিদারুল আলম, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর (এসেস্ট ও ভূমি-১) মো. আনোয়ার হোসেন, নিরীক্ষা ও বাজেট শাখার ঊর্ধ্বতন হিসাব সহকারী এসএম তৌহিদুল ইসলাম এবং মো. আলাউদ্দিন সরকার ( কার্য তদারকি মান-২)।

দুদক জানিয়েছে, আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ লাভ ও লোভের বশবর্তী হয়ে অসৎ উদ্দশে ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অফিস হতে নিয়মানুযায়ী নথিসমূহ মুভমেন্ট রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে এবং কাজ শেষে রেকর্ড রুমে প্রেরণ না করে সরকারি নথিপত্র কৌশলে সরিয়ে ও বিভিন্ন কর্মকর্তার সিল অবৈধভাবে তৈরি করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভবে ভুয়া নথি সৃজন ও লিজ দলিল সম্পাদন করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন।

মামলায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয় ঢাকা কর্তৃক অভিযোগ অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় প্রতিয়মান হয় যে, বিগত ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর বেলা ১১টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে একটি টিম রাজউক এনেক্স ভবনের ৫ম তলার এ-৫১৪ নম্বর কক্ষটি তল্লাশি এবং পরিদর্শন করেন। অনুসন্ধানকালে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদসহ উপস্থিত সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে জানান, বিগত ওইদিন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে রাজউক এনেক্স ভবনের ৫ম তলার এ-৫১৪ নম্বর কক্ষটি রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্টেট জেসমিন আক্তার, এসেস্ট ও ভূমি শাখার সদস্য মো. শফিউল হক, পরিচালক (প্রশাসন) খন্দকার অলিউর রহমান, পরিচালক (এসেস্ট ও ভূমি-১) মো. আকতারুজ্জামান, পরিচালক (আইন) আনন্দ কুমার বিশ্বাস, আইন কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল করিম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম তল্লাশি কার্যক্রমে অংশ নেন।

মামলায় বলা হয়, কক্ষটি তল্লাশিকালে ৭০টি প্লটের নথি, একটি ল্যাপটপ, রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে ১৫টি সিলসহ স্ট্যাম্প প্যাড, সিটি করপোরেশনের ১৭০টি বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্র, ডিমান্ড কালেকশন রেজিস্টার (ডিসিআর), লিজ ডিডের কপি চারটি, বরাদ্দপত্রের কপিসহ বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি মতিঝিল থানা পুলিশকে অবহিত করা হলে মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। (জিডি নং-৯৭৭) পরে মতিঝিল থানার এসআই মো. সফিকুল ইসলাম জব্দ তালিকা করে উদ্ধারকৃত আলামত জব্দ করেন। তল্লাশিকালে জব্দ করা রাজউকের মূল্যবান নথিপত্রের সঙ্গে জনৈক মনির হোসেনের (গোল্ডেন মনির) কর্মচারী মো. নাসির ও রাজউকের পিয়ন মো. পারভেজ চৌধুরীকে কর্মরত দেখা যায়। এক পর্যায়ে মো. নাসির পালিয়ে গেলেও রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২ এর পরিচাক অফিসের অফিস সহকারী মো. পারভেজ চৌধুরীকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দুদক বলছে, অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে রাজউক এনেক্স ভবনের ৫ম তলার এ- ৫১৪ নম্বর কক্ষটি ১৯৮৬ সাল হতে পলি ওভারসিজ লি.র স্বত্বাধিকারী ফজলুল হককে চুক্তিভিত্তিক ভাড়া দেয়া হয়েছে। রাজউকের কাছ থেকে কক্ষটি ভাড়া নিয়ে ফজলুল হক কক্ষের তিন ভাগের এক ভাগ জায়গা মনির হোসেনকে (গোল্ডেন মনির) সাবলেট হিসেবে ভাড়া প্রদান করেছেন। আটক হওয়া রাজউক কর্মচারী মো. পারভেজ চৌধুরী জানান, যে ফাইলগুলো তারা সরাতে গিয়ে ধরা পড়েছে সেই ফাইলগুলো গোল্ডেন মনিরের নির্দেশে রেকর্ডরুম ও সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে সংগ্রহ করে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই কক্ষে এনেছেন। পারভেজ চৌধুরী আরও জানান, মনির হোসেনের (গোল্ডেন মনির) নির্দেশেই সেসহ জিন্নাহ ও নাসির এবং আরও কয়েকজন মিলে ৭০টি নথি কৌশলে রাজউক মূলভবন থেকে রাজউক এনেক্স ভবনের এ-৫১৪ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসেন। রাজউকের ফাইল সংশ্লিষ্ট শাখা এবং রেকর্ডরুম ছাড়া অন্য কোথাও থাকার কথা নয়। নথিগুলো যে রুম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেই রুমটি রাজউকের অফিস রুম নয়। ভাড়াটিয়ার রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

পরে এ ঘটনায় রাজউকের দক্ষিণ বিভাগের নির্বাহী মো. নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় রাজউকের কর্মচারী মো. পারভেজ চৌধুরী, মনির হোসেন (গোল্ডেন মনির) এবং মনিরের কর্মচারী জিন্নাহসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পরে ওই মামলা দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় তদন্তের জন্য দুদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জব্দকৃত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ৭০টি প্লটের নথি বিভিন্ন সময়ে রেকর্ডরুম থেকে রেকর্ডরুমের স্টক রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে নাসির উদ্দিন শরীফ, মো. আনোয়ার হোসেন ও মো. পারভেজ চৌধুরী গ্রহণ করেছেন। ৭০টি নথির মধ্যে ৫৪টি নথি নাসির উদ্দিন শরীফ, সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১), রাজউক, দুটি নথি মো. আনোয়ার হোসেন, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর (এস্টেট ও ভূমি-১), ও পাঁচটি নথি মো. পারভেজ চৌধুরী অফিস সহায়ক রাজউক গ্রহণ করেন। বাকি ৯টি নথির গ্রহণ ও হস্তান্তরের কোন রেকর্ড নেই। পারভেজ চৌধুরী যে পাঁচটি নথি গ্রহণ করেছেন সেগুলো ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর রেকর্ডরুম থেকে গ্রহণ করেছেন বাকি নথিগুলো ২০১৬ সালে রেকর্ডরুম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ওই নথিগুলো রেকর্ড রুম থেকে গ্রহণ করার পর আর রেকর্ডরুমে ফেরত দেয়া হয়নি।

নথির মুভমেন্ট রেজিস্টারের মাধ্যমে যেকোনো নথি চলাচলের নিয়ম রয়েছে। নথি ডেসপাসে যাওয়ার পর ইস্যু রেস্ট্রিারের মাধ্যমে রেকর্ডরুমে পাঠানো হয়। কিন্তু রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নথিগুলো নিয়মানুযায়ী মুভমেন্ট রেজিস্টার এবং ইস্যু রেজিস্টারের মাধ্যমে চলাচল করেনি। অধিকাংশ নথিতে সহকারী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন শরীফ, সহকারী পরিচালক মো. দিদারুল আলম, অফিস সহকারী মো. আনোয়ার হোসেন ও মো. আলাউদ্দিন সরকার একই দিনে সব শেষে স্বাক্ষর করেছেন। নথিগুলো পরবর্তীতে অফিস কক্ষ বা রেকর্ডরুমে ছিল না।

আটককৃত পারভেজ চৌধুরী তল্লাশিকালে কর্মকর্তাদের জানান, মনির হোসেন (গোল্ডেন মনির), তার কর্মচারী জিন্নাহ এবং নাসিরসহ রাজউকের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীর সহযোগিতায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রাজউক অফিস থেকে সরকারি নথিপত্র কৌশলে সরিয়েছেন। বিভিন্ন কর্মকর্তার সিল তৈরি করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বেআইনিভবে ভুয়া নথি সৃজন ও লিজ দলিল সম্পাদন করেছেন।

দুদক বলছে, গোন্ডেন মনিরের এসব কর্মকা-ে রাজউকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সহযোগিতা করেছেন। তাদের সহযোগিতায় সরকারি নথি বিভিন্ন সময়ে চুরি হয়েছে এবং অফিস কক্ষের বাইরে আনা হয়েছে। গোল্ডেন মনিরের সাবলেটে ভাড়া নেয়া কক্ষটিতে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমানের নামে সিল ও স্বাক্ষরিত দলিলও মিলেছে যা তিনি বিদায় নেয়ার পর জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের প্লট আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়েছে। আত্মসাৎ চেষ্টা করা প্লটের অধিকাংশই রাজউকের বাড্ডা প্রকল্পের ছিল।