যাত্রীবাহী লঞ্চে সিসি ক্যামেরা ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম রাখার সুপারিশ

লঞ্চে আগুন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে : নৌ-প্রতিমন্ত্রী

ভবিষ্যতে নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যাত্রীবাহী লঞ্চের প্রতিটি তলায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ইঞ্জিন রুমে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখাসহ একাধিক সুপারিশ করেছে এম ভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি।

এছাড়া লঞ্চ ছাড়ার আগে যাত্রীদের নিরাপত্তার নির্দেশনাগুলো ঘোষণা করা এবং তা পুরোপুরি কার্যকরের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি লঞ্চে অগ্নিকা-ের গাফিলতির কারণে মালিক, মাস্টার (চালক), সুকানি (চালকের সহকারী), ড্রাইভার (ইঞ্জিন পরিচালনাকারী) ও লঞ্চের গ্রিজারকে (ড্রাইভারের সহকারী) সরাসরি দায়ী করে তদন্ত কমিটি। পেনাল কোর্টের মাধ্যমে তাদের যথাযথ শাস্তি সুপারিশ করা হয়েছে। গত সোমবার রাতে নৌ-সচিবের দপ্তরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক দিয়ে নৌ-মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম।

প্রতিবেদন জমার পর গতকাল নৌ-মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সোমবার রাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। মালিক, সুকানিসহ যারা ছিল তাদের দুর্বলতা ছিল। লঞ্চটি নির্মাণের মধ্যেও দুর্বলতা ছিল। মালিক হোক বা যারাই দায়ী হোক সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। লঞ্চের ইঞ্জিনেও সমস্যা ছিল তাই এটার জন্য ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ দায়ী।’ এজন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

কমিটির আহ্বায়ক নৌ-মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘ইঞ্জিন রুম থেকে অগ্নিকা-ে সূত্রপাত হয়েছে। যাত্রী ও লঞ্চের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। লঞ্চে ইঞ্জিন দুটি ছিল পুরাতন। তাই ইঞ্জিনের ত্রুটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।’ এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে উল্লেখ করে যুগ্ম সচিব বলেন, ‘ভবিষ্যতে নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ইঞ্জিন রুমে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। দেখা গেছে অনেক লঞ্চে লাইফ বয়াগুলো এমনভাবে রাখা হয় দুর্ঘটনা সময় তা বের করা যায়। দুর্ঘটনার সময় এসব সরঞ্জাম যাতে সহজেই যাত্রীরা সংগ্রহ করতে পারে সে ব্যবস্থার রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।’

তদন্ত কমিটির সূত্র জানায়, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী এম ভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় চালক ও সুকানি পাশাপাশি নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তরের সদরঘাটের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর এবং বিভিন্ন বিধিবিধান লঙ্ঘনের জন্য ডকইয়ার্ডের মালিককে দায়ী করা হয়েছে।

দুই মাস আগে লঞ্চটিতে ৭২০ হর্সপাওয়ার সম্পন্ন দুটি পুরাতন (রিকন্ডিশন) ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল। পুরোনো ইঞ্জিন থেকে ক্রমাগত নির্গত অতিরিক্ত তাপে লঞ্চের পাটাতন গরম হয়ে ওঠে। যে ডকইয়ার্ডে লঞ্চটিতে ইঞ্জিন বসানো হয় সেটির লাইসেন্সও মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।

এ ছাড়া তিন মাস ধরে বসে থাকা লঞ্চটি কোন পরীক্ষা ছাড়াই চলতে দিয়েছেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর। লঞ্চটির কোন বীমা ছিল না। নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লঞ্চ পরিচালনায় থাকা শ্রমিকরা আগুন লাগার পর যাত্রীদের না বাঁচিয়ে নিজেরা পালিয়ে গেছেন, যা ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এর পরিপন্থি। প্রতিবেদনে লঞ্চটিতে বেশি যাত্রী থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লঞ্চটি সদরঘাট ছাড়ার সময়ে ভয়েজ ডিক্লারেশনে ২৭৫ জন যাত্রী থাকার কথা জানিয়েছিল লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। নাবিক ও শ্রমিক মিলিয়ে ওই সংখ্যা ছিল ৩১০ জন। এছাড়া চাঁদপুর নৌ-বন্দর থেকে আরও ৫০ জন যাত্রী নেয়ার কথা ওই বন্দরে ভয়েজ ডিক্লারেশন দিয়েছে। লঞ্চটির সার্ভে সনদে রাতে ৪২০ জন এবং দিনে ৭৬০ জন বহনের সংখ্যা নির্ধারণ করা ছিল। ওই বিধান লঙ্ঘন করেছেন লঞ্চের মালিক ও পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা। তাই তাদের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে তদন্তে প্রতিবেদনে।

যাত্রীদের নিরাপত্তায় পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন বিআইডব্লিউটিএ’র

ঢাকার সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া সবগুলো লঞ্চ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঁচটি কমিটি গঠন করেছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

সংস্থাটির পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলীদের নেতৃত্বে এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে প্রকৌশলীদের রাখা হয়েছে। অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের মতো ঘটনা যাতে সামনে না হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে এসব কমিটি করা হয়েছে। গতকাল এ সংক্রান্ত দপ্তর আদেশ জারি করা হয়। কমিটিগুলোকে লঞ্চ পরিদর্শন করে ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করা ও এসব ত্রুটি নিরসনে সুপারিশ করতে বলা হয়েছে।

পাঁচ কমিটির প্রধানরা হলেনÑ বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (বওপ) কাজী ওয়াকিল নওয়াজ, পরিচালক (সওপ) মো. শাহজাহান, প্রধান প্রকৌশলী (প্রকৌশল বিভাগ) মো. মহিদুল ইসলাম, পরিচালক (নৌনিট্রা) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং প্রধান প্রকৌশলী (এমএমই বিভাগ) মো. আতাহার আলী সরদার।

পাঁচটি কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ‘নৌপথে কোন ধরনের দুর্ঘটনা হোক তা আমরা কখনই চাই না। তবুও অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ পর্যায়ক্রমে সারা দেশে চলাচল করা লঞ্চগুলোকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়, কমিটিগুলো প্রতি সপ্তাহে দুই দিন সদরঘাট সরেজমিন পরিদর্শন করবে। লঞ্চ পরিদর্শনের সময়ে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেটও কমিটির সঙ্গে থাকবেন। সকাল ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের সাধারণ ও কারিগরি দিক পর্যবেক্ষণ করবে এসব কমিটি। এ সময় যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার মতো কোন ত্রুটি পেলে ওই লঞ্চের যাত্রা বাতিল করবে। এ ছাড়া অনিয়ম ও গাফিলতি পেলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দায়ীদের সাজা দেবেন।

লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১৭ সদস্য নাগরিক কমিটি গঠন

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের কারণ খুঁজে বের করতে ১৭ সদস্যের নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলন এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ ১৫টি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে এ কমিটি গঠন করা হয়।

গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির কলাবাগানে পবা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এ কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কমিটি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।

নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আবু নাসের খানকে। কমিটির সদস্যসচিব ও প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়েছেন যথাক্রমে নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্যসচিব আমিনুর রসুল এবং লেখক ও নৌ-পরিবহনবিষয়ক গবেষক আশীষ কুমার দে।

বুধবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২২ , ২১ পৌষ ১৪২৮ ১ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

নৌ-দুর্ঘটনা, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন

যাত্রীবাহী লঞ্চে সিসি ক্যামেরা ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম রাখার সুপারিশ

লঞ্চে আগুন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে : নৌ-প্রতিমন্ত্রী

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

ভবিষ্যতে নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যাত্রীবাহী লঞ্চের প্রতিটি তলায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ইঞ্জিন রুমে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখাসহ একাধিক সুপারিশ করেছে এম ভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি।

এছাড়া লঞ্চ ছাড়ার আগে যাত্রীদের নিরাপত্তার নির্দেশনাগুলো ঘোষণা করা এবং তা পুরোপুরি কার্যকরের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি লঞ্চে অগ্নিকা-ের গাফিলতির কারণে মালিক, মাস্টার (চালক), সুকানি (চালকের সহকারী), ড্রাইভার (ইঞ্জিন পরিচালনাকারী) ও লঞ্চের গ্রিজারকে (ড্রাইভারের সহকারী) সরাসরি দায়ী করে তদন্ত কমিটি। পেনাল কোর্টের মাধ্যমে তাদের যথাযথ শাস্তি সুপারিশ করা হয়েছে। গত সোমবার রাতে নৌ-সচিবের দপ্তরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক দিয়ে নৌ-মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম।

প্রতিবেদন জমার পর গতকাল নৌ-মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সোমবার রাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। মালিক, সুকানিসহ যারা ছিল তাদের দুর্বলতা ছিল। লঞ্চটি নির্মাণের মধ্যেও দুর্বলতা ছিল। মালিক হোক বা যারাই দায়ী হোক সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। লঞ্চের ইঞ্জিনেও সমস্যা ছিল তাই এটার জন্য ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ দায়ী।’ এজন্য তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

কমিটির আহ্বায়ক নৌ-মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘ইঞ্জিন রুম থেকে অগ্নিকা-ে সূত্রপাত হয়েছে। যাত্রী ও লঞ্চের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। লঞ্চে ইঞ্জিন দুটি ছিল পুরাতন। তাই ইঞ্জিনের ত্রুটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।’ এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে উল্লেখ করে যুগ্ম সচিব বলেন, ‘ভবিষ্যতে নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ইঞ্জিন রুমে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। দেখা গেছে অনেক লঞ্চে লাইফ বয়াগুলো এমনভাবে রাখা হয় দুর্ঘটনা সময় তা বের করা যায়। দুর্ঘটনার সময় এসব সরঞ্জাম যাতে সহজেই যাত্রীরা সংগ্রহ করতে পারে সে ব্যবস্থার রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।’

তদন্ত কমিটির সূত্র জানায়, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী এম ভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় চালক ও সুকানি পাশাপাশি নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তরের সদরঘাটের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর এবং বিভিন্ন বিধিবিধান লঙ্ঘনের জন্য ডকইয়ার্ডের মালিককে দায়ী করা হয়েছে।

দুই মাস আগে লঞ্চটিতে ৭২০ হর্সপাওয়ার সম্পন্ন দুটি পুরাতন (রিকন্ডিশন) ইঞ্জিন লাগানো হয়েছিল। পুরোনো ইঞ্জিন থেকে ক্রমাগত নির্গত অতিরিক্ত তাপে লঞ্চের পাটাতন গরম হয়ে ওঠে। যে ডকইয়ার্ডে লঞ্চটিতে ইঞ্জিন বসানো হয় সেটির লাইসেন্সও মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।

এ ছাড়া তিন মাস ধরে বসে থাকা লঞ্চটি কোন পরীক্ষা ছাড়াই চলতে দিয়েছেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর। লঞ্চটির কোন বীমা ছিল না। নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লঞ্চ পরিচালনায় থাকা শ্রমিকরা আগুন লাগার পর যাত্রীদের না বাঁচিয়ে নিজেরা পালিয়ে গেছেন, যা ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এর পরিপন্থি। প্রতিবেদনে লঞ্চটিতে বেশি যাত্রী থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লঞ্চটি সদরঘাট ছাড়ার সময়ে ভয়েজ ডিক্লারেশনে ২৭৫ জন যাত্রী থাকার কথা জানিয়েছিল লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। নাবিক ও শ্রমিক মিলিয়ে ওই সংখ্যা ছিল ৩১০ জন। এছাড়া চাঁদপুর নৌ-বন্দর থেকে আরও ৫০ জন যাত্রী নেয়ার কথা ওই বন্দরে ভয়েজ ডিক্লারেশন দিয়েছে। লঞ্চটির সার্ভে সনদে রাতে ৪২০ জন এবং দিনে ৭৬০ জন বহনের সংখ্যা নির্ধারণ করা ছিল। ওই বিধান লঙ্ঘন করেছেন লঞ্চের মালিক ও পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা। তাই তাদের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে তদন্তে প্রতিবেদনে।

যাত্রীদের নিরাপত্তায় পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন বিআইডব্লিউটিএ’র

ঢাকার সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া সবগুলো লঞ্চ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঁচটি কমিটি গঠন করেছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

সংস্থাটির পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলীদের নেতৃত্বে এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে প্রকৌশলীদের রাখা হয়েছে। অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের মতো ঘটনা যাতে সামনে না হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে এসব কমিটি করা হয়েছে। গতকাল এ সংক্রান্ত দপ্তর আদেশ জারি করা হয়। কমিটিগুলোকে লঞ্চ পরিদর্শন করে ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করা ও এসব ত্রুটি নিরসনে সুপারিশ করতে বলা হয়েছে।

পাঁচ কমিটির প্রধানরা হলেনÑ বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (বওপ) কাজী ওয়াকিল নওয়াজ, পরিচালক (সওপ) মো. শাহজাহান, প্রধান প্রকৌশলী (প্রকৌশল বিভাগ) মো. মহিদুল ইসলাম, পরিচালক (নৌনিট্রা) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং প্রধান প্রকৌশলী (এমএমই বিভাগ) মো. আতাহার আলী সরদার।

পাঁচটি কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ‘নৌপথে কোন ধরনের দুর্ঘটনা হোক তা আমরা কখনই চাই না। তবুও অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ পর্যায়ক্রমে সারা দেশে চলাচল করা লঞ্চগুলোকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়, কমিটিগুলো প্রতি সপ্তাহে দুই দিন সদরঘাট সরেজমিন পরিদর্শন করবে। লঞ্চ পরিদর্শনের সময়ে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেটও কমিটির সঙ্গে থাকবেন। সকাল ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের সাধারণ ও কারিগরি দিক পর্যবেক্ষণ করবে এসব কমিটি। এ সময় যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার মতো কোন ত্রুটি পেলে ওই লঞ্চের যাত্রা বাতিল করবে। এ ছাড়া অনিয়ম ও গাফিলতি পেলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দায়ীদের সাজা দেবেন।

লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১৭ সদস্য নাগরিক কমিটি গঠন

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের কারণ খুঁজে বের করতে ১৭ সদস্যের নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলন এবং নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ ১৫টি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে এ কমিটি গঠন করা হয়।

গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির কলাবাগানে পবা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এ কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কমিটি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।

নাগরিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আবু নাসের খানকে। কমিটির সদস্যসচিব ও প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়েছেন যথাক্রমে নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্যসচিব আমিনুর রসুল এবং লেখক ও নৌ-পরিবহনবিষয়ক গবেষক আশীষ কুমার দে।