কেমন হবে ভবিষ্যতের যুদ্ধ কৌশল

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০২১ সালে প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নীতিতে মৌলিক বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, ব্রিটেন প্রতিরক্ষাখাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সাইবার প্রযুক্তিতে বাজেট বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সনাতনী যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যার পেছনে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়েছে।

একই সময়ে, রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে। মস্কো বেশ কড়া ভাষায় দাবি করেছে, সামরিক জোট ন্যাটো যেন রাশিয়ার ঘরের পাশে তাদের সদস্য দেশগুলোতে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করে।

চীন আরও উচ্চকণ্ঠে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, প্রয়োজন হলে লড়াই করে তারা তাইওয়ান পুনর্দখল করবে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

একইসঙ্গে ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক পর্যায়ে যুদ্ধ বেঁধেছে। ইথিওপিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাতে ২০১৪ সাল থেকে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। এই পটভূমিতে আগামী দিনগুলোতে বড় বড় শক্তির যুদ্ধের কৌশল কী হতে যাচ্ছে?

‘আগামীর যুদ্ধ কৌশল’ শুরু হয়ে গেছে : ভবিষ্যৎ সমর কৌশলের একটা রূপরেখা আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি বলা চলে। একদিকে পশ্চিমা দেশগুলো আর অন্যদিকে বলা যায়, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতে কী ধরনের প্রযুক্তি, কী ধরনের কৌশল ব্যবহার হবে, তা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে, তার মহড়া হয়ে গেছে এমনকি তা মোতায়েনও করা হয়েছে।

গত ১৬ নভেম্বর রাশিয়া মহাকাশে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, যাতে তাদের নিজেদেরই একটি ক্ষেপণাস্ত্র তারা ধ্বংস করে। গ্রীষ্মে চীন তাদের উন্নত হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে অনেক গুণ দ্রুতগতিতে ছুটতে সক্ষম। এর বাইরে, সাইবার দুনিয়ায় ক্ষতিসাধনকারী হামলা চালানো, তা সে কোন ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়ার উদ্দেশে হোক বা কোনো কিছু হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই হোক, একটা দৈনিন্দন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া ও চীন পশ্চিমের জন্য ঝুঁকি

মিশেল ফ্লুওরনয় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালীন আমেরিকান কৌশল নির্ধারণে পেন্টাগনের নীতি বিষয়ক প্রধানের পদে কাজ করেছেন।

তিনি বলছেন, গত দুই দশক ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর নজর ছিল শুধু মধ্যপ্রাচ্যে। এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তারা এতটাই ব্যস্ত থেকেছে যে সে সময় তাদের প্রতিপক্ষ দেশগুলো সামরিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।

তিনি বলছেন, ‘কৌশলগত দিক দিয়ে আসলেই আমরা একটা দুর্বল জায়গায় রয়েছি। আমরা- অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং আমাদের মিত্র দেশগুলো- আমরা বিশ বছর ধরে শুধু নজর দিয়েছি সন্ত্রাস ঠেকাতে আর বিদ্রোহ সামলাতে, ইরাকে আর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে সময় কাটিয়েছি। এখন চোখ খুলে আমরা দেখছি আমরা একটা খুবই গুরুতর, বিশাল একটা শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছি।’

তিনি অবশ্যই এখানে রাশিয়া আর চীনের প্রতি ইঙ্গিত করছেন। ব্রিটিশ সরকারের একটি প্রতিরক্ষা পর্যালোচনায় এই দুই দেশকে ‘চরম ঝুঁকি’ এবং দীর্ঘমেয়াদের জন্য তাদের পশ্চিমের ‘কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

সম্মুখ-সমরের চরিত্র কী হবে?

তবে এর বেশিরভাগটাই বিনিয়োগ করা হয়েছে সাইবার হামলা চালানোর প্রযুক্তি ও কর্মকা-ে, যেমন পশ্চিমা সমাজের মূল্যবোধকে আঘাত করতে, তাদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাতে, নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে এবং স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্ত চুরি করতে চালানো বিভিন্ন হামলায়। এগুলো সম্মুখ-সমরের পর্যায় থেকে অনেক দূরে এবং এ ধরনের হামলার বেশিরভাগই অস্বীকার করা সম্ভব। কিন্তু ধরা যাক, ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা বা তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে উত্তেজনা, তা নিয়ে যুদ্ধ বাঁধল। তখন কী হবে? সেই যুদ্ধ বাধলে তার ধরন কী হবে?

ইন্টারন্যাশানাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস এর সিনিয়র গবেষক মেইয়া নুওয়্ন্সে বলছেন, আমার মনে হয় সেটি তখন খুব দ্রুত বদলে যাওয়া একটা আবহ তৈরি করবে, আর সেটি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে তথ্য প্রবাহের ডোমেইনগুলোর ওপর। তিনি মূলত এই মন্তব্য করেছেন সামরিক কৌশলে তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে চীনের এগিয়ে থাকার প্রতি ইঙ্গিত করে।

তার ভাষায়, ‘চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি, স্ট্র্যাটেজিক ফোর্স নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছে, যাদের কাজ সাইবার জগত, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ এবং ইন্টারনেটের সক্ষমতা নিয়ে।’

সবচেয়ে বড় সামরিক ঝুঁকি কী?

সবচেয়ে বড় সামরিক ঝুঁকির জায়গা হলো অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হামলা। উপগ্রহ ব্যবস্থা অচল হওয়ায় যখন যোগাযোগ বিপর্যস্ত, তখন মাটির নিচে বাঙ্কারে বসে যুদ্ধ পরিকল্পনা করছেন যারা, তারা তো জানতেই পারছেন না কী ঘটছে। তখন লড়াইয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

মেইয়া নুওয়্ন্সে বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের সামনে থাকবে দু’টি রাস্তা হয় ‘ন্যূনতম’ না হয় ‘সর্বোচ্চ’ মাত্রার আঘাত হানা- যেটি হবে অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। আর এর যে কোনো একটারই মধ্যে দিয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতিকে আরও উসকে দেয়ার ঝুঁকি বাড়বে।

আগামীর যুদ্ধ কৌশলে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- সেটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- এআই। এই প্রযুক্তি সমর অধিনায়কদের অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। তারা অনেক দ্রুত তথ্য যাচাই করে তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

রাশিয়া ও চীন কোথায়

পশ্চিমকে টেক্কা দিচ্ছে

একটি ক্ষেত্রে পশ্চিমের দেশগুলো বিপজ্জনকভাবে রাশিয়া ও চীনের পেছনে পড়ে রয়েছে। সেটা হলো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির ক্ষেত্রে। হাইপারসোনিক মিসাইল হলো- উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র যা শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে ২৭ গুণ দ্রুতগতিতে যে কোন জায়গায় উড়তে পারে এবং এই ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে অপারমাণবিক অথবা পারমাণবিক দুই ধরনের অস্ত্রই বসানো সম্ভব।

রাশিয়া হাইপারসোনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণে সাফল্যের কথা ঘোষণা করে বলেছিল যে, এই ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো রকম প্রতিরক্ষাকে পরাস্ত করতে সক্ষম। চীন ২০১৯ সালে তাদের ডং ফেং ১৭ ক্ষেপণাস্ত্রের কথা প্রকাশ করে। এটিতে হাইপারসনিক গ্লাইড প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী একটি যান আছে, যা বায়ুম-লের মধ্যে দিয়ে যে কোনো নিশানায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম। এই ক্ষেপণাস্ত্রর গতিপথ নির্ণয় করা দুরূহ, ফলে তা ধরাও কঠিন।

পরিস্থিতি পশ্চিমের জন্য কি শুধুই হতাশাব্যঞ্জক?

এত উন্নতমানের প্রযুক্তি হাতে থাকার পরেও রাশিয়া ২০২২ সালে এসে ইউক্রেন সীমান্তে যে সেনা সমাবেশ করেছে সেখানে মূলত সনাতনপন্থি যুদ্ধের সরঞ্জামই চোখে পড়ছে যদিও অবশ্যই তারা সাইবার ও ইলেকট্রনিক হামলার পুরোদস্তুর ক্ষমতা রাখে।

ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরনো প্রথার যুদ্ধ সরঞ্জামের পেছনে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করে তা নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের। ফ্রানয-স্টেফান গ্যাডি বলছেন, এর থেকে লাভের ফসল অবশ্যই পাওয়া যাবে- তবে তা বিশ বছর পরে। কিন্তু তার আগে ব্রিটেনের জন্য শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতায় যে ফারাক তৈরি হবে তা উদ্বেগের বৈকি।

আর পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো আসবে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যেই। তাহলে পরিস্থিতি কি পশ্চিমের জন্য শুধুই হতাশাব্যঞ্জক? মিশেল ফ্লুওরনয় তা মনে করেন না। আমেরিকার প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে তিনি অনেক বছর ধরে কাজ করেছেন।

বৃহস্পতিবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২২ , ২২ পৌষ ১৪২৮ ২ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

কেমন হবে ভবিষ্যতের যুদ্ধ কৌশল

image

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০২১ সালে প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নীতিতে মৌলিক বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, ব্রিটেন প্রতিরক্ষাখাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সাইবার প্রযুক্তিতে বাজেট বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সনাতনী যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যার পেছনে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়েছে।

একই সময়ে, রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে। মস্কো বেশ কড়া ভাষায় দাবি করেছে, সামরিক জোট ন্যাটো যেন রাশিয়ার ঘরের পাশে তাদের সদস্য দেশগুলোতে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করে।

চীন আরও উচ্চকণ্ঠে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, প্রয়োজন হলে লড়াই করে তারা তাইওয়ান পুনর্দখল করবে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

একইসঙ্গে ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক পর্যায়ে যুদ্ধ বেঁধেছে। ইথিওপিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাতে ২০১৪ সাল থেকে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। এই পটভূমিতে আগামী দিনগুলোতে বড় বড় শক্তির যুদ্ধের কৌশল কী হতে যাচ্ছে?

‘আগামীর যুদ্ধ কৌশল’ শুরু হয়ে গেছে : ভবিষ্যৎ সমর কৌশলের একটা রূপরেখা আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি বলা চলে। একদিকে পশ্চিমা দেশগুলো আর অন্যদিকে বলা যায়, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতে কী ধরনের প্রযুক্তি, কী ধরনের কৌশল ব্যবহার হবে, তা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে, তার মহড়া হয়ে গেছে এমনকি তা মোতায়েনও করা হয়েছে।

গত ১৬ নভেম্বর রাশিয়া মহাকাশে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, যাতে তাদের নিজেদেরই একটি ক্ষেপণাস্ত্র তারা ধ্বংস করে। গ্রীষ্মে চীন তাদের উন্নত হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের চেয়ে অনেক গুণ দ্রুতগতিতে ছুটতে সক্ষম। এর বাইরে, সাইবার দুনিয়ায় ক্ষতিসাধনকারী হামলা চালানো, তা সে কোন ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়ার উদ্দেশে হোক বা কোনো কিছু হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই হোক, একটা দৈনিন্দন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া ও চীন পশ্চিমের জন্য ঝুঁকি

মিশেল ফ্লুওরনয় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালীন আমেরিকান কৌশল নির্ধারণে পেন্টাগনের নীতি বিষয়ক প্রধানের পদে কাজ করেছেন।

তিনি বলছেন, গত দুই দশক ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর নজর ছিল শুধু মধ্যপ্রাচ্যে। এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তারা এতটাই ব্যস্ত থেকেছে যে সে সময় তাদের প্রতিপক্ষ দেশগুলো সামরিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।

তিনি বলছেন, ‘কৌশলগত দিক দিয়ে আসলেই আমরা একটা দুর্বল জায়গায় রয়েছি। আমরা- অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং আমাদের মিত্র দেশগুলো- আমরা বিশ বছর ধরে শুধু নজর দিয়েছি সন্ত্রাস ঠেকাতে আর বিদ্রোহ সামলাতে, ইরাকে আর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে সময় কাটিয়েছি। এখন চোখ খুলে আমরা দেখছি আমরা একটা খুবই গুরুতর, বিশাল একটা শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছি।’

তিনি অবশ্যই এখানে রাশিয়া আর চীনের প্রতি ইঙ্গিত করছেন। ব্রিটিশ সরকারের একটি প্রতিরক্ষা পর্যালোচনায় এই দুই দেশকে ‘চরম ঝুঁকি’ এবং দীর্ঘমেয়াদের জন্য তাদের পশ্চিমের ‘কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

সম্মুখ-সমরের চরিত্র কী হবে?

তবে এর বেশিরভাগটাই বিনিয়োগ করা হয়েছে সাইবার হামলা চালানোর প্রযুক্তি ও কর্মকা-ে, যেমন পশ্চিমা সমাজের মূল্যবোধকে আঘাত করতে, তাদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাতে, নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে এবং স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্ত চুরি করতে চালানো বিভিন্ন হামলায়। এগুলো সম্মুখ-সমরের পর্যায় থেকে অনেক দূরে এবং এ ধরনের হামলার বেশিরভাগই অস্বীকার করা সম্ভব। কিন্তু ধরা যাক, ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার মধ্যে বর্তমান উত্তেজনা বা তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে উত্তেজনা, তা নিয়ে যুদ্ধ বাঁধল। তখন কী হবে? সেই যুদ্ধ বাধলে তার ধরন কী হবে?

ইন্টারন্যাশানাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস এর সিনিয়র গবেষক মেইয়া নুওয়্ন্সে বলছেন, আমার মনে হয় সেটি তখন খুব দ্রুত বদলে যাওয়া একটা আবহ তৈরি করবে, আর সেটি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে তথ্য প্রবাহের ডোমেইনগুলোর ওপর। তিনি মূলত এই মন্তব্য করেছেন সামরিক কৌশলে তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে চীনের এগিয়ে থাকার প্রতি ইঙ্গিত করে।

তার ভাষায়, ‘চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি, স্ট্র্যাটেজিক ফোর্স নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছে, যাদের কাজ সাইবার জগত, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ এবং ইন্টারনেটের সক্ষমতা নিয়ে।’

সবচেয়ে বড় সামরিক ঝুঁকি কী?

সবচেয়ে বড় সামরিক ঝুঁকির জায়গা হলো অপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হামলা। উপগ্রহ ব্যবস্থা অচল হওয়ায় যখন যোগাযোগ বিপর্যস্ত, তখন মাটির নিচে বাঙ্কারে বসে যুদ্ধ পরিকল্পনা করছেন যারা, তারা তো জানতেই পারছেন না কী ঘটছে। তখন লড়াইয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

মেইয়া নুওয়্ন্সে বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের সামনে থাকবে দু’টি রাস্তা হয় ‘ন্যূনতম’ না হয় ‘সর্বোচ্চ’ মাত্রার আঘাত হানা- যেটি হবে অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। আর এর যে কোনো একটারই মধ্যে দিয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতিকে আরও উসকে দেয়ার ঝুঁকি বাড়বে।

আগামীর যুদ্ধ কৌশলে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- সেটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- এআই। এই প্রযুক্তি সমর অধিনায়কদের অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। তারা অনেক দ্রুত তথ্য যাচাই করে তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

রাশিয়া ও চীন কোথায়

পশ্চিমকে টেক্কা দিচ্ছে

একটি ক্ষেত্রে পশ্চিমের দেশগুলো বিপজ্জনকভাবে রাশিয়া ও চীনের পেছনে পড়ে রয়েছে। সেটা হলো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির ক্ষেত্রে। হাইপারসোনিক মিসাইল হলো- উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র যা শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে ২৭ গুণ দ্রুতগতিতে যে কোন জায়গায় উড়তে পারে এবং এই ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে অপারমাণবিক অথবা পারমাণবিক দুই ধরনের অস্ত্রই বসানো সম্ভব।

রাশিয়া হাইপারসোনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণে সাফল্যের কথা ঘোষণা করে বলেছিল যে, এই ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো রকম প্রতিরক্ষাকে পরাস্ত করতে সক্ষম। চীন ২০১৯ সালে তাদের ডং ফেং ১৭ ক্ষেপণাস্ত্রের কথা প্রকাশ করে। এটিতে হাইপারসনিক গ্লাইড প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী একটি যান আছে, যা বায়ুম-লের মধ্যে দিয়ে যে কোনো নিশানায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম। এই ক্ষেপণাস্ত্রর গতিপথ নির্ণয় করা দুরূহ, ফলে তা ধরাও কঠিন।

পরিস্থিতি পশ্চিমের জন্য কি শুধুই হতাশাব্যঞ্জক?

এত উন্নতমানের প্রযুক্তি হাতে থাকার পরেও রাশিয়া ২০২২ সালে এসে ইউক্রেন সীমান্তে যে সেনা সমাবেশ করেছে সেখানে মূলত সনাতনপন্থি যুদ্ধের সরঞ্জামই চোখে পড়ছে যদিও অবশ্যই তারা সাইবার ও ইলেকট্রনিক হামলার পুরোদস্তুর ক্ষমতা রাখে।

ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরনো প্রথার যুদ্ধ সরঞ্জামের পেছনে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করে তা নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের। ফ্রানয-স্টেফান গ্যাডি বলছেন, এর থেকে লাভের ফসল অবশ্যই পাওয়া যাবে- তবে তা বিশ বছর পরে। কিন্তু তার আগে ব্রিটেনের জন্য শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতায় যে ফারাক তৈরি হবে তা উদ্বেগের বৈকি।

আর পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো আসবে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যেই। তাহলে পরিস্থিতি কি পশ্চিমের জন্য শুধুই হতাশাব্যঞ্জক? মিশেল ফ্লুওরনয় তা মনে করেন না। আমেরিকার প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে তিনি অনেক বছর ধরে কাজ করেছেন।