টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

‘সুশাসন’ ও ‘জবাবদিহি’ একটি রাষ্ট্র বা জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এই দুটি না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সুশাসন ও জবাবদিহি কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে বা আদৌ আছে কি না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। যখন যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, সেই সকারের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হয় যে, ‘আমরা বা আমাদের সরকার সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে’। এমন কি নির্বাচনী ইশতেহারেও এ কথাটি বলা হয়। পরবর্তীতে আর সে কথা মনে থাকে না। আর মনে থাকলেও এ বিষয়ে কোন কথাই বলা হয় না।

প্রশাসনে জবাবদিহি না থাকলে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, এটাই স্বাভাবিক। চেইন অব কমান্ড না থাকলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন ভেঙে পড়ে, পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। মনে রাখা দরকার যে, জন প্রশাসন তত্ত্বের সঙ্গে জবাবদিহি সম্পর্কিত। জবাবদিহির ধরন এবং জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের একত্রিততা আছে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণকারী মূল্যবোধের প্ররোচনার মাধ্যমে জবাবদিহি প্রচার করা যেতে পারে। ক্ষমতা, বিচক্ষণতা, কর্মচারীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া যেমন নিয়ন্ত্রক, তদারকি, প্রভাব এবং পরিচালনা ও অন্যান্য অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক মূল্যবোধ জবাবদিহি করে। তা না হলে দুর্নীতি ও দুর্নীতির সমস্য এবং জনস্বার্থের সঙ্গে সরকারি পদক্ষেপের অসামঞ্জস্যতা থেকে যায়।

জবাবদিহি ছাড়া স্বচ্ছতা অসম্ভব। এর সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টিও জড়িত। জবাবদিহির একটি বড় বিষয় হলো দায়িত্ব। জবাবদিহি না থাকলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করাই স্বাভাবিক। আর সুশাসন হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র প্রশাসন। সুশাসন একটি কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময়ের প্রয়োজনে এবং শাসিতের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোন দেশের শাসন পদ্ধতির বিবর্তন হয়ে থাকে। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন-যাকে আমরা সুশাসন বলতে পারি। কোন দেশে সুশাসন আছে কি নাÑতা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে সে দেশে শাসকের বা সরকারের জবাবদিহি আছে কি না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আছে কি না। সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে এক প্রকার মানদ- ও বলা যায় যে মানদ-ের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই রাষ্ট্র বা সমাজ ততো বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়।

দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার ফরে ঘুষ-দুর্নীতি অনিয়ম বিশৃঙ্খলা সর্বত্রই লেগেই আছে। বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, শায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি ও সুশাসন যেন উধাও হয়ে গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার মতো করে লুটপাট করে চলছে, টাকা পাহাড় গড়ে তুলছেন। আমরা যদি সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই? ব্যাংকের তহবিল শূণ্য, মূলধনের ঘাটতি। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি, ঋণ আদায় ঠিক মতো হচ্ছে না। বেসরকারি ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছরই মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় বাজেট থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযোথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে চলছে লুটপাট। এক এক জন শত শত কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন বলা যেতে পারে বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের কথা। ‘হলমার্ক’ নামের তথাকথিত একটি প্রতিষ্ঠান ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটে নেয়া।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও একই অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোন জবাবদিহি। সরকারের সেবা খাতগুলোতে সেবা পেতে গেলে অবশ্যই দুর্নীতিবাজদের সালাম দিতে হয়। আবার সালামি দিয়েও অনেক সময় সেবা পাওয়া যায় না। গ্যাস বিদ্যুৎ পানির লাইন পেতে গেলেও মোটা অঙ্কের সালামি দিতে হয়। প্রায়শই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায় যে, একজন লাইনম্যান কোটি কোটি টাকার মালিক। ব্যাংক হিসাবতো অনেকগুলো, তারপর আবার বিচানার নিচে, বালিশের ভেতর টাকা রাখা হয়। একজন লাইনম্যানের একাধিক আলিশান বাড়ি আর দামি গাড়ি আছে। এক কথায় বলতে গেলে যেখানেই যান, ঘুষ ছাড়া কোনো কথা নেই। স্বচ্ছতা, জবাবদিহির অভাবের কারণে লুটপাট বেড়েই চলছে। দেশের কালোটাকার ছড়াছড়ি। কোথায় থেকে আসে এত টাকা? দুর্নীতিবিরোধী গবেষণা সংস্থা টিআইবি গত বছর বলেছিল যে, জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে কালোটাকা ওঠানামা করে। সরকার প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখেন। কিন্তু আশানুরূপ কালোটাকা সাদা হচ্ছে না। কালোটাকা যায় বিদেশের ব্যাংকে। প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান কি করছে? অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘অর্থ পাচারকারীদের তালিকা তার কাছে নেই। তালিকা দিলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন’। এ সম্পর্কে আমি আর কিছু বলতে চাই না। প্রশাসনে জবাবদিহি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এসব কথা সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হলেও তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে? এপ্রশ্ন থেকেই যায়।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত বিবেচ্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসকরা আনুগত্যশীল হবেন এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার পরিচয় প্রদান একান্ত আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হলে জনপ্রতিনিধি ও জন প্রশাসকদের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। এতে করে স্বেচ্ছাচারিতাও থাকে না। গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়েছে।

গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইন/নীতি প্রণীত হয় সংসদে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে জন-প্রশাসনের ওপর। নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ, সমন্বয় এবং সরবরাহ করে থাকেন প্রশাসকগণ। লক্ষণীয় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ যেহেতু দলীয় সেহেতু নীতি-নির্ধারিত হয়ে থাকে দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে। কিন্তু তার প্রয়োগকারীগণ অর্থাৎ প্রশাসকগণ থাকেন নিরপেক্ষ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একটির অভাবে অন্যটির কার্যক্রম কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়নে চাই এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং সু-সম্পর্ক, যা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আমাদের বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজন আরও বেশি। কাজেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সুশাস ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার;

পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট]

বৃহস্পতিবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২২ , ২২ পৌষ ১৪২৮ ২ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

‘সুশাসন’ ও ‘জবাবদিহি’ একটি রাষ্ট্র বা জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এই দুটি না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সুশাসন ও জবাবদিহি কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে বা আদৌ আছে কি না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। যখন যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, সেই সকারের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হয় যে, ‘আমরা বা আমাদের সরকার সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে’। এমন কি নির্বাচনী ইশতেহারেও এ কথাটি বলা হয়। পরবর্তীতে আর সে কথা মনে থাকে না। আর মনে থাকলেও এ বিষয়ে কোন কথাই বলা হয় না।

প্রশাসনে জবাবদিহি না থাকলে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, এটাই স্বাভাবিক। চেইন অব কমান্ড না থাকলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন ভেঙে পড়ে, পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। মনে রাখা দরকার যে, জন প্রশাসন তত্ত্বের সঙ্গে জবাবদিহি সম্পর্কিত। জবাবদিহির ধরন এবং জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের একত্রিততা আছে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণকারী মূল্যবোধের প্ররোচনার মাধ্যমে জবাবদিহি প্রচার করা যেতে পারে। ক্ষমতা, বিচক্ষণতা, কর্মচারীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া যেমন নিয়ন্ত্রক, তদারকি, প্রভাব এবং পরিচালনা ও অন্যান্য অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক মূল্যবোধ জবাবদিহি করে। তা না হলে দুর্নীতি ও দুর্নীতির সমস্য এবং জনস্বার্থের সঙ্গে সরকারি পদক্ষেপের অসামঞ্জস্যতা থেকে যায়।

জবাবদিহি ছাড়া স্বচ্ছতা অসম্ভব। এর সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টিও জড়িত। জবাবদিহির একটি বড় বিষয় হলো দায়িত্ব। জবাবদিহি না থাকলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করাই স্বাভাবিক। আর সুশাসন হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র প্রশাসন। সুশাসন একটি কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময়ের প্রয়োজনে এবং শাসিতের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোন দেশের শাসন পদ্ধতির বিবর্তন হয়ে থাকে। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন-যাকে আমরা সুশাসন বলতে পারি। কোন দেশে সুশাসন আছে কি নাÑতা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে সে দেশে শাসকের বা সরকারের জবাবদিহি আছে কি না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আছে কি না। সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে এক প্রকার মানদ- ও বলা যায় যে মানদ-ের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই রাষ্ট্র বা সমাজ ততো বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়।

দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার ফরে ঘুষ-দুর্নীতি অনিয়ম বিশৃঙ্খলা সর্বত্রই লেগেই আছে। বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, শায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি ও সুশাসন যেন উধাও হয়ে গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার মতো করে লুটপাট করে চলছে, টাকা পাহাড় গড়ে তুলছেন। আমরা যদি সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি তাকাই তাহলে কি দেখতে পাই? ব্যাংকের তহবিল শূণ্য, মূলধনের ঘাটতি। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি, ঋণ আদায় ঠিক মতো হচ্ছে না। বেসরকারি ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছরই মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় বাজেট থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযোথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে চলছে লুটপাট। এক এক জন শত শত কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন বলা যেতে পারে বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের কথা। ‘হলমার্ক’ নামের তথাকথিত একটি প্রতিষ্ঠান ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটে নেয়া।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও একই অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোন জবাবদিহি। সরকারের সেবা খাতগুলোতে সেবা পেতে গেলে অবশ্যই দুর্নীতিবাজদের সালাম দিতে হয়। আবার সালামি দিয়েও অনেক সময় সেবা পাওয়া যায় না। গ্যাস বিদ্যুৎ পানির লাইন পেতে গেলেও মোটা অঙ্কের সালামি দিতে হয়। প্রায়শই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায় যে, একজন লাইনম্যান কোটি কোটি টাকার মালিক। ব্যাংক হিসাবতো অনেকগুলো, তারপর আবার বিচানার নিচে, বালিশের ভেতর টাকা রাখা হয়। একজন লাইনম্যানের একাধিক আলিশান বাড়ি আর দামি গাড়ি আছে। এক কথায় বলতে গেলে যেখানেই যান, ঘুষ ছাড়া কোনো কথা নেই। স্বচ্ছতা, জবাবদিহির অভাবের কারণে লুটপাট বেড়েই চলছে। দেশের কালোটাকার ছড়াছড়ি। কোথায় থেকে আসে এত টাকা? দুর্নীতিবিরোধী গবেষণা সংস্থা টিআইবি গত বছর বলেছিল যে, জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে কালোটাকা ওঠানামা করে। সরকার প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখেন। কিন্তু আশানুরূপ কালোটাকা সাদা হচ্ছে না। কালোটাকা যায় বিদেশের ব্যাংকে। প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান কি করছে? অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘অর্থ পাচারকারীদের তালিকা তার কাছে নেই। তালিকা দিলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন’। এ সম্পর্কে আমি আর কিছু বলতে চাই না। প্রশাসনে জবাবদিহি, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স এসব কথা সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হলেও তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে? এপ্রশ্ন থেকেই যায়।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত বিবেচ্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসকরা আনুগত্যশীল হবেন এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার পরিচয় প্রদান একান্ত আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হলে জনপ্রতিনিধি ও জন প্রশাসকদের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। এতে করে স্বেচ্ছাচারিতাও থাকে না। গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়েছে।

গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইন/নীতি প্রণীত হয় সংসদে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে জন-প্রশাসনের ওপর। নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ, সমন্বয় এবং সরবরাহ করে থাকেন প্রশাসকগণ। লক্ষণীয় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ যেহেতু দলীয় সেহেতু নীতি-নির্ধারিত হয়ে থাকে দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে। কিন্তু তার প্রয়োগকারীগণ অর্থাৎ প্রশাসকগণ থাকেন নিরপেক্ষ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একটির অভাবে অন্যটির কার্যক্রম কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়নে চাই এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং সু-সম্পর্ক, যা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আমাদের বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজন আরও বেশি। কাজেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সুশাস ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার;

পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট]