গুলিতে নিহত ৪, ক্ষুব্ধ কালাইহাটাবাসী

ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নারীসহ চারজন নিহতের ঘটনায় থমথমে বগুড়ায় গাবতলী। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সকাল থেকে কালাইহাটা বাজারের দোকানপাট বন্ধ রেখে গ্রামের লোকজন বাজারে অবস্থান করছেন। সকাল থেকে গ্রামে প্রবেশ করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য। দুপুরে নিহত চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জীবন ও নির্বাচনী সামগ্রী রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।

গতকাল সরেজমিন কালাইহাটা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় জনগণ চরম উত্তেজিত। তারা সংবাদকর্মীদের দেখলেই ‘ম্যাজিস্ট্রেটের ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বুধবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। কালাইহাটা বাজার ছাড়াও শতশত মানুষ ভিড় করছে নিহতদের বাড়িতে এবং কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্রের মাঠজুড়ে পড়ে আছে অংসখ্য ইটপাটকেল আর ভাঙা কাচের টুকরা। প্রিজাইডিং অফিসারের ও ভোট গণনার কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভোটের পরের দিন শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে এলেও ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ আসেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউছুফ আলী বলেন, ভোটের দিন সন্ধ্যায় গুলিতে চারজন মারা যাওয়ার পর আতঙ্কে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসেনি।

গত বুধবার ভোটগ্রহণ শেষে এমন ঘটনার কারণ জানতে চাইলে কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা বদিউজ্জামান বলেন, ভোটকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আহমেদ। তিনি বিকেল ৫টার দিকে বিজিবিসহ ভোটকেন্দ্রে ঢোকেন। এ সময় ভোট কেন্দ্রের বাইরে সবগুলো প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা অবস্থান করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট গাড়িতে বসেই লোকজন সরিয়ে দিতে বিজিবিকে নির্দেশ দেন। লোকজন ফলাফল না নিয়ে যাবে না এমন কথা বললে বিজিবি সদস্যরা প্রথমে নারী সমর্থকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে উপস্থিত লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এর এক পর্যায়ে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।

একই গ্রামের বাসিন্দা ফয়জাল প্রামানিক বলেন, ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করে ব্যালট পেপার উপজেলা সদরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমন খবরে লোকজন উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। এ সময় বিজিবি সদস্যরা লাঠিচার্জ করলে জনগণ ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যরা প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে আশ্রয় নেন। সেই কক্ষ থেকেই বিজিবি সদস্যরা গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান নারীসহ চারজন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি অধ্যুষিত বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের মালিয়ান ডাঙ্গা এবং কালাইহাটা গ্রামে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি। কালাইহাটা ভোটকেন্দ্রের ফলাফলের ওপর নৌকা মার্কার জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল। সেই কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে নৌকা মার্কার কর্মী সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা ভোটকেন্দ্রে হামলা করে ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি সদস্যরা গুলি ছোড়ে। পরে রাত ১০ টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ফলাফলে নৌকা মার্কার প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ও শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ বলেন, ‘জনগণকে শান্ত করতে সেখানে আমার দেয়া বক্তব্যের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড আছে। জনগণ শান্তি বজায় না রেখে সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।’ তিনি বলেন, অন্য ৮ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার দাবি করেন তারা। একপর্যায়ে কয়েকশ’ নারী ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে আমার গাড়িসহ বিজিবির ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, ভোটকেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষের দরজা জানালা ভাঙচুর করে তছনছ করে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা আত্মরক্ষার্থে প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে অবস্থান নেয়। বিক্ষুদ্ধ লোকজন সেই কক্ষে হামলা চালিয়ে দরজা জানালা ভেঙে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি সদস্যরা গুলিবর্ষণে বাধ্য হন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গাবতলী মডেল থানার ওসি জিয়া লতিফুল ইসলাম জানান, সেখানে নিহত কালাই হাটা গ্রামের খোরশেদ হোসেন (৬০), আবদুর রশিদ (৫৫), আলমগীর হোসেন (৪৫) ও কুলসুম আক্তারের (৫৫) মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ভোটকেন্দ্রে হামলা এবং চারজন নিহতের ঘটনায় গতকাল বিকেল পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি। তবে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থানা প্রিজাইডিং অফিসার বাদী হয়ে মামলা করবেন বলে উল্লেখ করেন ওসি।

যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার জেলা প্রাশাসক জিয়াউল হক বলেন, অন্যান্য কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে কালাইহাটা কেন্দ্রের ভোট গণনা করতে হবে এমন দাবি না মানায় প্রার্থীর সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচন সামগ্রী ও নিজেদের জীবন রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা সেখানে গুলি ছোড়ে।

শুক্রবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২২ , ২৩ পৌষ ১৪২৮ ৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

গুলিতে নিহত ৪, ক্ষুব্ধ কালাইহাটাবাসী

প্রতিনিধি, বগুড়া

ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নারীসহ চারজন নিহতের ঘটনায় থমথমে বগুড়ায় গাবতলী। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সকাল থেকে কালাইহাটা বাজারের দোকানপাট বন্ধ রেখে গ্রামের লোকজন বাজারে অবস্থান করছেন। সকাল থেকে গ্রামে প্রবেশ করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য। দুপুরে নিহত চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জীবন ও নির্বাচনী সামগ্রী রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।

গতকাল সরেজমিন কালাইহাটা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় জনগণ চরম উত্তেজিত। তারা সংবাদকর্মীদের দেখলেই ‘ম্যাজিস্ট্রেটের ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বুধবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। কালাইহাটা বাজার ছাড়াও শতশত মানুষ ভিড় করছে নিহতদের বাড়িতে এবং কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্রের মাঠজুড়ে পড়ে আছে অংসখ্য ইটপাটকেল আর ভাঙা কাচের টুকরা। প্রিজাইডিং অফিসারের ও ভোট গণনার কক্ষের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভোটের পরের দিন শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে এলেও ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ আসেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউছুফ আলী বলেন, ভোটের দিন সন্ধ্যায় গুলিতে চারজন মারা যাওয়ার পর আতঙ্কে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে আসেনি।

গত বুধবার ভোটগ্রহণ শেষে এমন ঘটনার কারণ জানতে চাইলে কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা বদিউজ্জামান বলেন, ভোটকেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আহমেদ। তিনি বিকেল ৫টার দিকে বিজিবিসহ ভোটকেন্দ্রে ঢোকেন। এ সময় ভোট কেন্দ্রের বাইরে সবগুলো প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা অবস্থান করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট গাড়িতে বসেই লোকজন সরিয়ে দিতে বিজিবিকে নির্দেশ দেন। লোকজন ফলাফল না নিয়ে যাবে না এমন কথা বললে বিজিবি সদস্যরা প্রথমে নারী সমর্থকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে উপস্থিত লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এর এক পর্যায়ে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালায়।

একই গ্রামের বাসিন্দা ফয়জাল প্রামানিক বলেন, ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা না করে ব্যালট পেপার উপজেলা সদরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমন খবরে লোকজন উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। এ সময় বিজিবি সদস্যরা লাঠিচার্জ করলে জনগণ ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যরা প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে আশ্রয় নেন। সেই কক্ষ থেকেই বিজিবি সদস্যরা গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান নারীসহ চারজন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি অধ্যুষিত বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের মালিয়ান ডাঙ্গা এবং কালাইহাটা গ্রামে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি। কালাইহাটা ভোটকেন্দ্রের ফলাফলের ওপর নৌকা মার্কার জয়-পরাজয় নির্ভর করছিল। সেই কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে নৌকা মার্কার কর্মী সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা ভোটকেন্দ্রে হামলা করে ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি সদস্যরা গুলি ছোড়ে। পরে রাত ১০ টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ফলাফলে নৌকা মার্কার প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট ও শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আহমেদ বলেন, ‘জনগণকে শান্ত করতে সেখানে আমার দেয়া বক্তব্যের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড আছে। জনগণ শান্তি বজায় না রেখে সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।’ তিনি বলেন, অন্য ৮ কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার দাবি করেন তারা। একপর্যায়ে কয়েকশ’ নারী ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে আমার গাড়িসহ বিজিবির ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, ভোটকেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষের দরজা জানালা ভাঙচুর করে তছনছ করে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা আত্মরক্ষার্থে প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে অবস্থান নেয়। বিক্ষুদ্ধ লোকজন সেই কক্ষে হামলা চালিয়ে দরজা জানালা ভেঙে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি সদস্যরা গুলিবর্ষণে বাধ্য হন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গাবতলী মডেল থানার ওসি জিয়া লতিফুল ইসলাম জানান, সেখানে নিহত কালাই হাটা গ্রামের খোরশেদ হোসেন (৬০), আবদুর রশিদ (৫৫), আলমগীর হোসেন (৪৫) ও কুলসুম আক্তারের (৫৫) মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ভোটকেন্দ্রে হামলা এবং চারজন নিহতের ঘটনায় গতকাল বিকেল পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি। তবে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থানা প্রিজাইডিং অফিসার বাদী হয়ে মামলা করবেন বলে উল্লেখ করেন ওসি।

যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার জেলা প্রাশাসক জিয়াউল হক বলেন, অন্যান্য কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে কালাইহাটা কেন্দ্রের ভোট গণনা করতে হবে এমন দাবি না মানায় প্রার্থীর সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ব্যালট পেপারসহ নির্বাচন সামগ্রী ও নিজেদের জীবন রক্ষার্থে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা সেখানে গুলি ছোড়ে।