বিল না পেয়ে জমজ শিশুসহ মাকে বের করে দেয়া হয়

পথে এক শিশুর মৃত্যু, হাসপাতালের মালিক গ্রেপ্তার

জমজ দুই সন্তানকে দালালের মাধ্যমে ভাগিয়ে ভর্তি করা হয় হয় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে। ভর্তির দুইদিন পর এক লাখ ২৫ হাজার টাকার বিল ভুক্তভোগী মা আয়েশা আক্তারের হাতে ধরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গোলাম সরোয়ার। ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ধীরে ধীরে পুরো টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিলের জন্য চাপ প্রয়োগ করে মালিক গোলাম সরোয়ার। এরপর টাকা পরিশোধ না করায় জমজ দুই ভাইয়ের চিকিৎসাসেবাও বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী মাকে হাসপাতালেই শারীরিক নির্যাতন করে এবং হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন জমজ দুই শিশুকে রাস্তায় বের করে দেয় গোলাম সরোয়ার। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মা আয়েশা আক্তারের এক সন্তানের মৃত্যু হয়। এই মা মৃত আহমেদ (৬ মাস) ও অসুস্থ আবদুল্লাহকে (৬ মাস) কোলে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। বর্তমানে শিশু আবদুল্লাহ চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ভুক্তভোগী মায়ের দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদপুর ও শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক গোলাম সরোয়ারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে গতকাল বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আমার বাংলাদেশ হাসাপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ারকে (৫৭) গ্রেপ্তার করা হয়। সে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার গোলাম সারওয়ার জানায়, আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দালাল নিয়োগ করা আছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেসরকারি ওই হাসপাতালটিতে গত ২ জানুয়ারি যমজ শিশুকে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর থেকে বিল পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয় অন্যথায় চিকিৎসা করা হবে না বলে জানায়। ভিকটিম ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। তবে অতিরিক্ত আরও টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। টাকা না দেয়ায় চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয় বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে অর্থ না পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ভুক্তভোগীর যমজ সন্তানকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়। গ্রেপ্তার সারওয়ার র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে দীর্ঘ ২০-২২ বছর যাবত রাজারবাগ, বাসাবো, মুগদা, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ৬টি হাসপাতালে পরিচালনা করে আসছে। সেগুলো হলো ঢাকা ট্রমা, বাংলাদেশ ট্রমা হাসপাতাল, মমতাজ মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক, আরাব ডায়াগনস্টিক, মোহাম্মদিয়া মেডিকেল সার্ভিসেস ও আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। এর মধ্যে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল বাদে সবই বন্ধ করেছেন নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ উঠার পর। প্রায় এক বছর যাবত শ্যামলীতে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল খুলে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে দালাল সিন্ডিকেটকে জড়ান। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল হতে রোগীদের ফুসলিয়ে নিজের হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসতেন।

এক চিকিৎসক-নার্সে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল

এদিকে নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউ থাকার কথা, কিন্তু সেখানে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ চারটি আইসিইউ বেশি। এর মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে মাত্র ?দুটিতে। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর মাত্র একটি। করোনাকালে আইসিইউর চাহিদা বেশি থাকার সুযোগে অধিক মুনাফার ফাঁদ হিসেবেই অনুমোদন ছাড়াই চলছিল অতিরিক্ত চারটি আইসিইউ।

শুধু তাই নয়, ৩০টি সাধারণ বেড থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৫টি। পরিচালনার বিধি মোতাবেক ৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও নার্স রয়েছে মাত্র একজন। আর তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজনের দায়িত্বে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতালটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা। যদিও সেই নার্স ও চিকিৎসক আইসিইউ ও এনআইসিইউ পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। সাধারণ নার্স ও চিকিৎসক তারা। র‌্যাব বলছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আমার বাংলাদেশ হাসপাতালতে ভর্তি করার পর বিলের ফাঁদে জিম্মি করা হতো। আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। বনিবনা না হলে বের করে দেয়া হতো।

নির্মম ও অমানবিক এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। যমজ সন্তান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগী মোহাম্মদপুর থানায় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক ও পরিচালককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার পর র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে গতকাল আমার বাংলাদেশ হাসাপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার গোলাম সারওয়ার জানান, হাসপাতাল পরিচালনার বিধি মোতাবেক সার্বক্ষণিক ৩ জন চিকিৎসক ডিউটিরত থাকার কথা থাকলেও সার্বক্ষণিক একজন ডিউটিতে থাকতেন। হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউসহ ৩০টি বেডের প্রাধিকার রয়েছে। তার হাসপাতালে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। তন্মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে দুটির। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর ছিল একটি ও ১৫টি সাধারণ বেড রয়েছে। মূলত আইসিইউ কেন্দ্রিক ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে সে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে।

অনুমোদন পাওয়ার শর্ত না মেনেও কি করে হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন পেয়েছে সে ব্যাপারে কোন তথ্য র‌্যাব পেয়েছে কি-না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিগত সময়ে যখনই অনিয়ম-প্রতারণা ও রোগী জিম্মির বিষয়টি সামনে এসেছে তখনই তিনি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করেছেন। এরপর নতুন নামে ফের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি যখন অনুমোদন পান তখন হয়তো সে ধরনের শর্ত পূরণের বিষয় তিনি ইন্সপেক্টশনে দেখিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযানের সময় ছিলেন, তারাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন। আমরা জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব।

অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। যেহেতেু জোরপূর্বক নির্যাতন করে বের করে দেয়ায় যমজ এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে হত্যার অভিযোগ আনা হবে কি-না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। যেহেতু এখানে ময়নাতদন্তের বিষয় আছে। ভুক্তভোগী মাও অভিযোগ করেছেন মামলায় যে, তাকেসহ যমজ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্তে ও ময়নাতদন্তে তা উঠে আসলে অবশ্যই হত্যার বিষয়টিও অভিযোগপত্রে আসবে। গ্রেপ্তার আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। তার সঙ্গে জড়িত বাকি সহযোগীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।

করোনা চিকিৎসাকে পুঁজি করে প্রতারণা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা

হাসপাতাল ব্যবসাকে যেসব অসৎ ব্যবসায়ী শুধুই অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন তাদের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, করোনা মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চিকিৎসার নামে যারা প্রতারণা করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, করোনাকে পুঁজি করে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা লাভের চেষ্টা করেছে। আমরা অবশ্যই রিজেন্ট খ্যাত শাহেদের কথা বলবো, বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে যে মানুষের কাছ অর্থ হাতিয়ে আত্মসাৎ করেছে। যা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছি। তার বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। আবারও দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সময় হয়তো এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী হাসপাতাল ব্যবসাকে পুঁজি করে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা যখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও আমাদের সঙ্গে থাকেন। এসব অনিয়মের বিষয়ে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।

শনিবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২২ , ২৪ পৌষ ১৪২৮ ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

বিল না পেয়ে জমজ শিশুসহ মাকে বের করে দেয়া হয়

পথে এক শিশুর মৃত্যু, হাসপাতালের মালিক গ্রেপ্তার

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

এক সন্তানকে হারিয়ে আরেক সন্তান কোলে মা আয়েশা আক্তার -সংবাদ

জমজ দুই সন্তানকে দালালের মাধ্যমে ভাগিয়ে ভর্তি করা হয় হয় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে। ভর্তির দুইদিন পর এক লাখ ২৫ হাজার টাকার বিল ভুক্তভোগী মা আয়েশা আক্তারের হাতে ধরিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গোলাম সরোয়ার। ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে ধীরে ধীরে পুরো টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিলের জন্য চাপ প্রয়োগ করে মালিক গোলাম সরোয়ার। এরপর টাকা পরিশোধ না করায় জমজ দুই ভাইয়ের চিকিৎসাসেবাও বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী মাকে হাসপাতালেই শারীরিক নির্যাতন করে এবং হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন জমজ দুই শিশুকে রাস্তায় বের করে দেয় গোলাম সরোয়ার। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মা আয়েশা আক্তারের এক সন্তানের মৃত্যু হয়। এই মা মৃত আহমেদ (৬ মাস) ও অসুস্থ আবদুল্লাহকে (৬ মাস) কোলে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। বর্তমানে শিশু আবদুল্লাহ চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ভুক্তভোগী মায়ের দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদপুর ও শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক গোলাম সরোয়ারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে গতকাল বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আমার বাংলাদেশ হাসাপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ারকে (৫৭) গ্রেপ্তার করা হয়। সে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার গোলাম সারওয়ার জানায়, আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দালাল নিয়োগ করা আছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেসরকারি ওই হাসপাতালটিতে গত ২ জানুয়ারি যমজ শিশুকে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর থেকে বিল পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয় অন্যথায় চিকিৎসা করা হবে না বলে জানায়। ভিকটিম ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। তবে অতিরিক্ত আরও টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। টাকা না দেয়ায় চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয় বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে অর্থ না পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ভুক্তভোগীর যমজ সন্তানকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়। গ্রেপ্তার সারওয়ার র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে দীর্ঘ ২০-২২ বছর যাবত রাজারবাগ, বাসাবো, মুগদা, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ৬টি হাসপাতালে পরিচালনা করে আসছে। সেগুলো হলো ঢাকা ট্রমা, বাংলাদেশ ট্রমা হাসপাতাল, মমতাজ মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক, আরাব ডায়াগনস্টিক, মোহাম্মদিয়া মেডিকেল সার্ভিসেস ও আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। এর মধ্যে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল বাদে সবই বন্ধ করেছেন নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ উঠার পর। প্রায় এক বছর যাবত শ্যামলীতে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল খুলে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে দালাল সিন্ডিকেটকে জড়ান। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল হতে রোগীদের ফুসলিয়ে নিজের হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসতেন।

এক চিকিৎসক-নার্সে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল

এদিকে নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউ থাকার কথা, কিন্তু সেখানে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ চারটি আইসিইউ বেশি। এর মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে মাত্র ?দুটিতে। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর মাত্র একটি। করোনাকালে আইসিইউর চাহিদা বেশি থাকার সুযোগে অধিক মুনাফার ফাঁদ হিসেবেই অনুমোদন ছাড়াই চলছিল অতিরিক্ত চারটি আইসিইউ।

শুধু তাই নয়, ৩০টি সাধারণ বেড থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৫টি। পরিচালনার বিধি মোতাবেক ৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও নার্স রয়েছে মাত্র একজন। আর তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজনের দায়িত্বে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতালটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা। যদিও সেই নার্স ও চিকিৎসক আইসিইউ ও এনআইসিইউ পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। সাধারণ নার্স ও চিকিৎসক তারা। র‌্যাব বলছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আমার বাংলাদেশ হাসপাতালতে ভর্তি করার পর বিলের ফাঁদে জিম্মি করা হতো। আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। বনিবনা না হলে বের করে দেয়া হতো।

নির্মম ও অমানবিক এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। যমজ সন্তান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগী মোহাম্মদপুর থানায় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক ও পরিচালককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার পর র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে গতকাল আমার বাংলাদেশ হাসাপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার গোলাম সারওয়ার জানান, হাসপাতাল পরিচালনার বিধি মোতাবেক সার্বক্ষণিক ৩ জন চিকিৎসক ডিউটিরত থাকার কথা থাকলেও সার্বক্ষণিক একজন ডিউটিতে থাকতেন। হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউসহ ৩০টি বেডের প্রাধিকার রয়েছে। তার হাসপাতালে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। তন্মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে দুটির। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর ছিল একটি ও ১৫টি সাধারণ বেড রয়েছে। মূলত আইসিইউ কেন্দ্রিক ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে সে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে।

অনুমোদন পাওয়ার শর্ত না মেনেও কি করে হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন পেয়েছে সে ব্যাপারে কোন তথ্য র‌্যাব পেয়েছে কি-না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিগত সময়ে যখনই অনিয়ম-প্রতারণা ও রোগী জিম্মির বিষয়টি সামনে এসেছে তখনই তিনি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করেছেন। এরপর নতুন নামে ফের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি যখন অনুমোদন পান তখন হয়তো সে ধরনের শর্ত পূরণের বিষয় তিনি ইন্সপেক্টশনে দেখিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযানের সময় ছিলেন, তারাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন। আমরা জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব।

অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। যেহেতেু জোরপূর্বক নির্যাতন করে বের করে দেয়ায় যমজ এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে হত্যার অভিযোগ আনা হবে কি-না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। যেহেতু এখানে ময়নাতদন্তের বিষয় আছে। ভুক্তভোগী মাও অভিযোগ করেছেন মামলায় যে, তাকেসহ যমজ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্তে ও ময়নাতদন্তে তা উঠে আসলে অবশ্যই হত্যার বিষয়টিও অভিযোগপত্রে আসবে। গ্রেপ্তার আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। তার সঙ্গে জড়িত বাকি সহযোগীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।

করোনা চিকিৎসাকে পুঁজি করে প্রতারণা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা

হাসপাতাল ব্যবসাকে যেসব অসৎ ব্যবসায়ী শুধুই অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন তাদের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, করোনা মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চিকিৎসার নামে যারা প্রতারণা করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, করোনাকে পুঁজি করে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা লাভের চেষ্টা করেছে। আমরা অবশ্যই রিজেন্ট খ্যাত শাহেদের কথা বলবো, বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে যে মানুষের কাছ অর্থ হাতিয়ে আত্মসাৎ করেছে। যা দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছি। তার বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। আবারও দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সময় হয়তো এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী হাসপাতাল ব্যবসাকে পুঁজি করে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা যখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও আমাদের সঙ্গে থাকেন। এসব অনিয়মের বিষয়ে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।