ভারতকে সিভিল ওয়ারের দিকে ঠেলে দিতে হিন্দুত্ববাদী প্রচেষ্টা

গৌতম রায়

গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘দেশকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করলে, আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের দুরমুশ দিয়ে না পেটালে, হয়তো বিপ্লবের প্লাবনে না ভাসালে সামাজিক গোঁড়ামি সহজে যাবে না। “( সমাজ ও সেকুলার হবে-অন্নদাশঙ্করের’ খোলা মন খোলা দরজা-প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত প্রবন্ধ) আর একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, এক বছরের ভেতরে অভিন্ন কায়দায় মুসলমান মহিলাদের নাম আর ছবি দিয়ে তাদের ‘নিলামে’ চড়ানোর অ্যাপ তৈরি হয়েছে ভারতে। শুধু মুসলিম নারীদেরই নয়, গোটা বিশ্বের নারী সমাজকে অপমান করতে ওই অ্যাপটির নাম দেয়া হয়েছিল, ‘সুল্লি ডিলস’। আবার আর একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে, ‘বুল্লি বাঈ’। ২০২২ সালেল ১ জানুয়ারি এই অ্যাপ টিকে প্রথম প্রকাশ্যে দেখা যায়।

ভারতে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছেন, অ্যাপটিকে ব্লক করা হয়েছে। মুম্বাইয়ের সাইবার পুলিশ তদন্ত ও শুরু করেছে। দুঃখের কথা হলো, ‘সুল্লি ডিলস’ অ্যাপটি ঘিরে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কজন অপরাধীকে শনাক্ত করতে পেরেছেন, তাদের কি শাস্তি সেসব বর্বরদের দেয়া হয়েছেÑএসব তথ্য কখনো সরকার জানায়নি। জানাবে কি করে? এইসব বর্বরদের উদ্দেশে এতটুকু ঘৃণা কি ভারত সরকারের আছে? এই ধরনের চরম বর্বরতার প্রকাশ যারা করে, বেছে মুসলমান নারীদের সম্পর্কে যারা লেখার অযোগ্য শব্দ ব্যবহার করে নেট দুনিয়ায়, তখন বুঝতে হবে, সেসব বর্বরদের রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ভারতে যে বিজেপি নেতৃত্বধীন সরকার পরিচালিত হচ্ছে, সেই সরকারের রাজনৈতিক ভাবনায় এতটুকু ফারাক নেই। বিজেপির মস্তিষ্ক, আরএসএসের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনগুলো এই ধরনের ইতরামি প্রকাশ্যে করছে। তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভূমিস্তরের নেতাকর্মীরা সেই বর্বরতার সব ধরনের প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছে, আর শীর্ষস্তরের বিজেপি নেতারা, গুজরাট গণহত্যার সময়ে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে পরামর্শ তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী দিয়েছিলেন, তেমনটাই রাজধর্মের পালনের নামে তদন্তের নির্দেশ দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছেন।

গত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি একক ক্ষমতায় ভারতে সরকার গঠন করে। অতীতে ভারতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি নেতৃত্বধীন জোট সরকার তৈরি করলেও সেই সরকারে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে আরএসএসের ‘মুসলমান মুক্ত’ ভারতের যে কর্মসূচি, সেটি খুল্লামখুল্লা ভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির পালন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে ধারা প্রবাহ ছিল, সেই অনুযায়ী আজকের মতো কোণঠাসা আন্তর্জাতিক স্তরে সেদিন বাম রাজনীতি ছিল না। ভারতেও বাম রাজনীতি সেদিন অনেকটাই প্রভাবশালী ছিল। বাম রাজনীতিকে কোণঠাসা করে দক্ষিণপন্থি রাজনীতিল পালে বাতাস জুগিয়ে সব রকমের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে বলবান করবার যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কৌশল, সেই কৌশলের বিষময় ফল এখন ভারতের রাজনীতির সর্বত্র। আজ যে, ‘বুল্লি বাঈ’ অ্যাপস তৈরির বর্বরতা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির দেখাতে পারছে, সেটা সঙ্ঘের শাখা সংগঠন, ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চে’র আদলে পাঞ্জাবি খালসাদের সামনে রেখে তারা করেছে। নারী সমাজের একটা অংশের তুমুল প্রতিবাদের ফলে পুলিশ সামান্য সক্রিয় হয়ে যাকে গ্রেপ্তার করেছে, সে বর্বরটি জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি। আরএসএসের শাখা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সেই ব্যক্তিটির ধর্ম পরিচয় মাথায় রেখেই সেই ব্যক্তিটিকে দিয়ে এই অ্যাপসটি তৈরি করানো হয়েছে যাতে কোন অবস্থাতেই রাজনৈতিক হিন্দুদের ওপর সন্দেহটা না আসে। গোটা ঘটনার দায় যাতে পাঞ্জাবিদের ওপরে পড়ে এবং পাঞ্জাবি বনাম মুসলমান দ্বন্দ্ব, সংঘাত একটা চরম আকার নেয়- সেটাই আরএসএসের লক্ষ্য।

দুই এক মাসের ভেতরেই পাঞ্জাব বিধানসভার ভোট। বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় তো নেই-ই, কৃষি সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে এই কোভিড কালেও, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে উপেক্ষা করে, কার্যত দিল্লিকে অবরুদ্ধ করে কৃষকরা যে ঐতিহাসিক আন্দোলন করলেন, যার জেরে দুর্বিনীত নরেন্দ্র মোদি পিছু হটতে বাধ্য হলেন, সেই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন এই পাঞ্জাবের কৃষকরাই। তাই অতূযন্ত পরিকল্পনা মাফিক মুসলমান নারীদের অমর্যাদা করতে এই অ্যাপসটি জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি একজনকে সামনে রেখে আরএসএস- বিজেপি করেছে। হিন্দুত্ববাদীদের উদ্দেশ্য, পাঞ্জাবিরা মুসলমান নারীদের নিলামে চড়াতে চেয়ে অ্যাপস তৈরি করেছেÑএই প্রচারটাকে সামনে এনে পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি বনাম মুসলমান সংঘাত তৈরি করা। সেই সংঘাতের জেরে পাঞ্জাবে দাঙ্গা বাধানো। অচিরেই সেই দাঙ্গা উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে দেয়া। কারণ, পাঞ্জাবের সঙ্গেই উত্তর প্রদেশেও বিধানসভার ভোট। সবধরণের সমীক্ষাই বলছে, উত্তর প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি আদৌ সুবিধাজনক জায়গাতে নেই। তাই পাঞ্জাবে জিততে, উত্তর প্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির এখন চাই দাঙ্গা। রক্তের হোলির সাহায্যেই বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। যে মুজফফরনগরে দাঙ্গার আগুন জ্বেলে এককভাবে দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি, সেই মুজফফরনগরই কৃষক আন্দোলনে ভারতের ইতিহাসে এক নয়া দিগন্ত রচনা করল।

বিজেপি এককভাবে ২০১৪ তে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই সমস্ত অবিজেপি দলগুলো রাজনৈতিকভাবে খুব এলোমেলো ভাবে ছিল। আন্তর্জাতিক চাপের জন্যেই হোক বা সেই সময়ের সক্রিয় নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চাপের কারণেই হোক অথবা প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে নিউক্লিয়ার চুক্তি ঘিরে সরকার থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের কারণেই হোক- কংগ্রেস ২০১১ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকে যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক মদত দিয়েছে- ভারতের রাজনীতির এই কালোদিনের ক্ষেত্রে সেটা অন্যতম অনুঘটক ছিল।

ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্যতা কংগ্রেসের টিকতে পারে নাÑএই বাস্তবতাটা সোনিয়া- রাহুলের না বুঝতে পারাটা চরম রাজনৈতিক অজ্ঞতা। আর যদি সেটা না বুজে, কেবল অতীতের কারণে, গায়ের জাল মেটাতে সেই কাজ সোনিয়াÑরাহুল সেইদিন করে থাকেন, তবে বলতেই হয়, ভারতের বহুত্ববাদী সাধনাকে উপড়ে ফেলবার জন্যে তাদের দায় এবং ভূমিকা কোন অংশে কম ছিল না।

বহু ত্রুটি-বিচ্যুতির ভেতরেই বামপন্থিরা যে ধর্মনিরপেক্ষতার আপাত পরিবেশ রচনা করতে পেরেছিলেন, সেই পরিবেশকে হমস্ত রকমের প্রতিক্রিয়াশীলরা ভয় পেত। তবে শুধু ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ, দাঙ্গার উত্তাপ থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাঁচানোটাই শেষ কথা ছিল না। দরকার ছিল মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন। আধুনিক শিক্ষার দ্বার তাদের জন্যে উন্মুক্ত করা। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় তাদের সবাইকে, বিশেষ করে নারী ও শিশুকে সর্বাত্মকভাবে আনবার জন্যে প্রশাসনিক পদক্ষেপের বাইরে সামাজিক পদক্ষেপ। এই জন্যে শ্রেণী চিন্তা মাথায় রেখেও দরকার ছিল ভারতের তথা বাংলার সামাজিক বিন্যাসকে মাথায় রেখে দলীয় নেতৃত্বের ভেতরে, রাজ্য থেকে জেলা হয়ে ভূমিস্তরে মুসলমান প্রতিনিধিদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া।

এই সামাজিক বিন্যাসের দিকে নজর না দিয়ে সেই সময়ের বামপন্থি নেতৃত্ব ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মমতা এবং আরএসএস কর্তৃক নানাভাবে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগটাকে অনেকখানি ত্বরান্বিত করে দিয়েছিলেন। নন এলিট একজন মুসলমান নারীকেও কি দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে বামপন্থিরা প্রথম সারিতে এনেছিলেন? শুধু একটা উদাহরণ দিই। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে রায়চক পর্যন্ত আধুনিক রাস্তা তৈরির জন্য যে ব্যাপক হারে মুসলমানদের বাড়ি ভাঙার কথা ছিল, যাদের নিয়ে চরম রাজনীতি মমতা সেই সময়ে করেছিলেন আরএসএস, বিজেপি, কংগ্রেস, এসইউসিপিডিএস, একাংশের বুদ্ধিজীবী ইত্যাদির সঙ্গে নিয়ে, সেই কাজে কি মমতা এতটুকু সফল হতেন যদি পরিকল্পিতভাবে একটা সময় ধরে গোটা মুসলমান সমাজকে আধুনিক করার আরও বেশি সুযোগ দিয়ে, তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব হতো?

ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের নীতি পঙ্গুত্বই শুধু নয়, আরএসএসের অদৃশ্য বন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই মন্ত্রিসভাতে উপস্থিতি-পরবর্তী লোকসভা ভোটে (’১৪) আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে কতোখানি সাহায্য করেছিল তার অনুপুঙ্খ বিবরণ হয়তো আগামী দিনের গবেষকদের গবেষণা থেকে উঠে আসবে। তবে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পর থেকে ’১৯-এর লোকসভা ভোট পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যেভাবে নরম সাম্প্রদায়িকতার পালে বাতাস দিয়ে গিয়েছেন, তা আজ ও গোটা হিন্দুত্ববাদীদের সামাজিক বিভাজনকে তীব্র করে তুলে, নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কাজকে অনেক বেশি বেশি পরিমাণে সার্থক করে তুলেছে।

অতি সম্প্রতি হিন্দু আর হিন্দুত্বের ভেতরে ফারাক বুঝিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিচ্ছেন রাহুল গান্ধী। জওহরলাল নেহরুর পরে আর কোন শীর্ষস্তরের কংগ্রেস নেতা এইভাবে প্রকাশ্যে ধার্মিক আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবসা ঘিরে ফারাক করে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। আজ যে অযোধ্যা ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদীদের মত্ততা, সেই অযোধ্যা ঘিরে ইন্দিরা গান্ধীর ‘দি রাম কি পুরী’ পরিকল্পনাটি আদৌ কোন ধর্মনিরপেক্ষ পরিকল্পনা ছিল, তা কোন অবস্থাতেই বলা যাবে না। আজ যে হরিদ্বারে আরএসএসের সাঙ্গপাঙ্গদের ধর্মসংসদ, মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার হুমকি, শ্রীমতী গান্ধীর জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে খোদ দিল্লিতেই (১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে) তেমন একটি ধর্ম সংসদ হয়। সেখানে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার কথা বলে জমায়েতে কিছু বর্বর সর্বঘোষিত ধর্মগুরু। এদের সম্পর্কে কিন্তু ন্যূনতম ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, একটা বিবৃতি পর্যন্ত শ্রীমতী গান্ধী দেননি সেদিন।

রাহুল গান্ধী আজ যখন হিন্দু আর হিন্দুত্বের ভেতর ফারাক করে প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়েছেন, তখন তাকে অরাজনৈতিকভাবে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করতে শুরু করেছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির। কৃষক আন্দোলনের জেরে উত্তাল পাঞ্জাবে জনবিক্ষোভে নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত রেখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। জরুরি অবস্থার আগে পরে ও শ্রীমতী গান্ধীকে এইভাবে নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে কখনও ফিরে যেতে হয়নি।

ত্রিপুরাতে গিয়ে বিমানবন্দর থেকে রেলপথ ঘিরে যে অনৃতবাদন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে করেছেন, তা ভারতের প্রতিটি মানুষের কাছে শুধু লজ্জারই নয়, চরম বেদনার ও। বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ ঘিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগরতলায় প্রকাশ্য বক্তৃতায় যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন, তার তথাকথিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ তত্বকে। রেললাইন সম্প্রসারণ, বিশেষ করে ভারত- বাংলাদেশ, ত্রিপুরার ভিতর দিয়ে রেল সংযোগের যাবতীয় কৃতিত্ব ও তিনি দিয়েছেন এই ‘ডবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব, অর্থাৎ; দিল্লি আর ত্রিপুরা, দুই জায়গাতেই এক দলের সরকার থাকার বিষয়টিকেই তিনি বলেছেন।

দেশভাগের পর ত্রিপুরার রেলপথের বেশিরভাগ অংশটাই বাংলাদেশে পড়ে যায়। ফলে তখন থেকেই বামপন্থিরা ত্রিপুরায় রেলপথের দাবি জানিয়ে আসছে। বামপন্থিদের প্রতিহত করতে নিজেদের সরকার কেন্দ্রে থাকার সময়ে কংগ্রেস যাতে ত্রিপুরায় রেলপথ না হয়, সেজন্যে সব রকমের চেষ্টা করেছিল। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে, বামপন্থিরা যখন সেই সরকারের অন্যতম সমর্থক, সেই সময়ে মূলত বামপন্থিদের দাবি মেনেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ত্রিপুরার রেলপথের বিষয়ে সবুজ সংকেত দেন।

নয়ের দশকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ট্রানজিট রুটের ভাবনার কথা প্রথম বলেন ’৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে গণভবণে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এই ট্রানজিন রুট সম্পর্কের ক্ষেত্রে কি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে তার বাপ-মা মরা এতিম কন্যা হাসিনাকে বিস্তারিতভাবে বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। সেই ভাবনাকেই ফলপ্রসূ করেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী বিষয় ড. মনমোহন সিং দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তুলে ধরলে। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং ত্রিপুরাতে বামপন্থিদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে আজ সেই রাজ্যে রেলপথের ক্ষেত্রে একটা নয়া সংযোজন ঘটেছে। অথচ, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তিনি বা তার দলের যে রেলপথ বা আধুনিক বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কোন ভূমিকা বা অবদান নেই, তিনি গোটা কৃতিত্বটা নিজের দল এবং দলের সরকারকে দিলেন। মজার কথা হল, ত্রিপুরাতে কয়িকদিন তৃণমূল কংগ্রেস খুব লম্ফঝম্ফ করেছে। অথচ নরেন্দ্র মোদির এই চরম মিথ্যাচারকে ঘিরে সেখানে বামপন্থিরা ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলই টুঁ শব্দটা পর্যন্ত করেনি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২২ , ২৪ পৌষ ১৪২৮ ৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

ভারতকে সিভিল ওয়ারের দিকে ঠেলে দিতে হিন্দুত্ববাদী প্রচেষ্টা

গৌতম রায়

গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘দেশকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করলে, আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের দুরমুশ দিয়ে না পেটালে, হয়তো বিপ্লবের প্লাবনে না ভাসালে সামাজিক গোঁড়ামি সহজে যাবে না। “( সমাজ ও সেকুলার হবে-অন্নদাশঙ্করের’ খোলা মন খোলা দরজা-প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্গত প্রবন্ধ) আর একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, এক বছরের ভেতরে অভিন্ন কায়দায় মুসলমান মহিলাদের নাম আর ছবি দিয়ে তাদের ‘নিলামে’ চড়ানোর অ্যাপ তৈরি হয়েছে ভারতে। শুধু মুসলিম নারীদেরই নয়, গোটা বিশ্বের নারী সমাজকে অপমান করতে ওই অ্যাপটির নাম দেয়া হয়েছিল, ‘সুল্লি ডিলস’। আবার আর একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে, ‘বুল্লি বাঈ’। ২০২২ সালেল ১ জানুয়ারি এই অ্যাপ টিকে প্রথম প্রকাশ্যে দেখা যায়।

ভারতে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছেন, অ্যাপটিকে ব্লক করা হয়েছে। মুম্বাইয়ের সাইবার পুলিশ তদন্ত ও শুরু করেছে। দুঃখের কথা হলো, ‘সুল্লি ডিলস’ অ্যাপটি ঘিরে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কজন অপরাধীকে শনাক্ত করতে পেরেছেন, তাদের কি শাস্তি সেসব বর্বরদের দেয়া হয়েছেÑএসব তথ্য কখনো সরকার জানায়নি। জানাবে কি করে? এইসব বর্বরদের উদ্দেশে এতটুকু ঘৃণা কি ভারত সরকারের আছে? এই ধরনের চরম বর্বরতার প্রকাশ যারা করে, বেছে মুসলমান নারীদের সম্পর্কে যারা লেখার অযোগ্য শব্দ ব্যবহার করে নেট দুনিয়ায়, তখন বুঝতে হবে, সেসব বর্বরদের রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ভারতে যে বিজেপি নেতৃত্বধীন সরকার পরিচালিত হচ্ছে, সেই সরকারের রাজনৈতিক ভাবনায় এতটুকু ফারাক নেই। বিজেপির মস্তিষ্ক, আরএসএসের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনগুলো এই ধরনের ইতরামি প্রকাশ্যে করছে। তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভূমিস্তরের নেতাকর্মীরা সেই বর্বরতার সব ধরনের প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছে, আর শীর্ষস্তরের বিজেপি নেতারা, গুজরাট গণহত্যার সময়ে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে পরামর্শ তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী দিয়েছিলেন, তেমনটাই রাজধর্মের পালনের নামে তদন্তের নির্দেশ দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছেন।

গত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি একক ক্ষমতায় ভারতে সরকার গঠন করে। অতীতে ভারতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি নেতৃত্বধীন জোট সরকার তৈরি করলেও সেই সরকারে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে আরএসএসের ‘মুসলমান মুক্ত’ ভারতের যে কর্মসূচি, সেটি খুল্লামখুল্লা ভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির পালন করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে ধারা প্রবাহ ছিল, সেই অনুযায়ী আজকের মতো কোণঠাসা আন্তর্জাতিক স্তরে সেদিন বাম রাজনীতি ছিল না। ভারতেও বাম রাজনীতি সেদিন অনেকটাই প্রভাবশালী ছিল। বাম রাজনীতিকে কোণঠাসা করে দক্ষিণপন্থি রাজনীতিল পালে বাতাস জুগিয়ে সব রকমের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে বলবান করবার যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কৌশল, সেই কৌশলের বিষময় ফল এখন ভারতের রাজনীতির সর্বত্র। আজ যে, ‘বুল্লি বাঈ’ অ্যাপস তৈরির বর্বরতা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির দেখাতে পারছে, সেটা সঙ্ঘের শাখা সংগঠন, ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চে’র আদলে পাঞ্জাবি খালসাদের সামনে রেখে তারা করেছে। নারী সমাজের একটা অংশের তুমুল প্রতিবাদের ফলে পুলিশ সামান্য সক্রিয় হয়ে যাকে গ্রেপ্তার করেছে, সে বর্বরটি জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি। আরএসএসের শাখা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত সেই ব্যক্তিটির ধর্ম পরিচয় মাথায় রেখেই সেই ব্যক্তিটিকে দিয়ে এই অ্যাপসটি তৈরি করানো হয়েছে যাতে কোন অবস্থাতেই রাজনৈতিক হিন্দুদের ওপর সন্দেহটা না আসে। গোটা ঘটনার দায় যাতে পাঞ্জাবিদের ওপরে পড়ে এবং পাঞ্জাবি বনাম মুসলমান দ্বন্দ্ব, সংঘাত একটা চরম আকার নেয়- সেটাই আরএসএসের লক্ষ্য।

দুই এক মাসের ভেতরেই পাঞ্জাব বিধানসভার ভোট। বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় তো নেই-ই, কৃষি সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে এই কোভিড কালেও, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে উপেক্ষা করে, কার্যত দিল্লিকে অবরুদ্ধ করে কৃষকরা যে ঐতিহাসিক আন্দোলন করলেন, যার জেরে দুর্বিনীত নরেন্দ্র মোদি পিছু হটতে বাধ্য হলেন, সেই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন এই পাঞ্জাবের কৃষকরাই। তাই অতূযন্ত পরিকল্পনা মাফিক মুসলমান নারীদের অমর্যাদা করতে এই অ্যাপসটি জন্মসূত্রে পাঞ্জাবি একজনকে সামনে রেখে আরএসএস- বিজেপি করেছে। হিন্দুত্ববাদীদের উদ্দেশ্য, পাঞ্জাবিরা মুসলমান নারীদের নিলামে চড়াতে চেয়ে অ্যাপস তৈরি করেছেÑএই প্রচারটাকে সামনে এনে পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি বনাম মুসলমান সংঘাত তৈরি করা। সেই সংঘাতের জেরে পাঞ্জাবে দাঙ্গা বাধানো। অচিরেই সেই দাঙ্গা উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে দেয়া। কারণ, পাঞ্জাবের সঙ্গেই উত্তর প্রদেশেও বিধানসভার ভোট। সবধরণের সমীক্ষাই বলছে, উত্তর প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি আদৌ সুবিধাজনক জায়গাতে নেই। তাই পাঞ্জাবে জিততে, উত্তর প্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির এখন চাই দাঙ্গা। রক্তের হোলির সাহায্যেই বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। যে মুজফফরনগরে দাঙ্গার আগুন জ্বেলে এককভাবে দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি, সেই মুজফফরনগরই কৃষক আন্দোলনে ভারতের ইতিহাসে এক নয়া দিগন্ত রচনা করল।

বিজেপি এককভাবে ২০১৪ তে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই সমস্ত অবিজেপি দলগুলো রাজনৈতিকভাবে খুব এলোমেলো ভাবে ছিল। আন্তর্জাতিক চাপের জন্যেই হোক বা সেই সময়ের সক্রিয় নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চাপের কারণেই হোক অথবা প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে নিউক্লিয়ার চুক্তি ঘিরে সরকার থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের কারণেই হোক- কংগ্রেস ২০১১ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকে যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক মদত দিয়েছে- ভারতের রাজনীতির এই কালোদিনের ক্ষেত্রে সেটা অন্যতম অনুঘটক ছিল।

ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্যতা কংগ্রেসের টিকতে পারে নাÑএই বাস্তবতাটা সোনিয়া- রাহুলের না বুঝতে পারাটা চরম রাজনৈতিক অজ্ঞতা। আর যদি সেটা না বুজে, কেবল অতীতের কারণে, গায়ের জাল মেটাতে সেই কাজ সোনিয়াÑরাহুল সেইদিন করে থাকেন, তবে বলতেই হয়, ভারতের বহুত্ববাদী সাধনাকে উপড়ে ফেলবার জন্যে তাদের দায় এবং ভূমিকা কোন অংশে কম ছিল না।

বহু ত্রুটি-বিচ্যুতির ভেতরেই বামপন্থিরা যে ধর্মনিরপেক্ষতার আপাত পরিবেশ রচনা করতে পেরেছিলেন, সেই পরিবেশকে হমস্ত রকমের প্রতিক্রিয়াশীলরা ভয় পেত। তবে শুধু ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ, দাঙ্গার উত্তাপ থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাঁচানোটাই শেষ কথা ছিল না। দরকার ছিল মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন। আধুনিক শিক্ষার দ্বার তাদের জন্যে উন্মুক্ত করা। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় তাদের সবাইকে, বিশেষ করে নারী ও শিশুকে সর্বাত্মকভাবে আনবার জন্যে প্রশাসনিক পদক্ষেপের বাইরে সামাজিক পদক্ষেপ। এই জন্যে শ্রেণী চিন্তা মাথায় রেখেও দরকার ছিল ভারতের তথা বাংলার সামাজিক বিন্যাসকে মাথায় রেখে দলীয় নেতৃত্বের ভেতরে, রাজ্য থেকে জেলা হয়ে ভূমিস্তরে মুসলমান প্রতিনিধিদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া।

এই সামাজিক বিন্যাসের দিকে নজর না দিয়ে সেই সময়ের বামপন্থি নেতৃত্ব ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মমতা এবং আরএসএস কর্তৃক নানাভাবে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগটাকে অনেকখানি ত্বরান্বিত করে দিয়েছিলেন। নন এলিট একজন মুসলমান নারীকেও কি দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে বামপন্থিরা প্রথম সারিতে এনেছিলেন? শুধু একটা উদাহরণ দিই। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে রায়চক পর্যন্ত আধুনিক রাস্তা তৈরির জন্য যে ব্যাপক হারে মুসলমানদের বাড়ি ভাঙার কথা ছিল, যাদের নিয়ে চরম রাজনীতি মমতা সেই সময়ে করেছিলেন আরএসএস, বিজেপি, কংগ্রেস, এসইউসিপিডিএস, একাংশের বুদ্ধিজীবী ইত্যাদির সঙ্গে নিয়ে, সেই কাজে কি মমতা এতটুকু সফল হতেন যদি পরিকল্পিতভাবে একটা সময় ধরে গোটা মুসলমান সমাজকে আধুনিক করার আরও বেশি সুযোগ দিয়ে, তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব হতো?

ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের নীতি পঙ্গুত্বই শুধু নয়, আরএসএসের অদৃশ্য বন্ধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই মন্ত্রিসভাতে উপস্থিতি-পরবর্তী লোকসভা ভোটে (’১৪) আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে কতোখানি সাহায্য করেছিল তার অনুপুঙ্খ বিবরণ হয়তো আগামী দিনের গবেষকদের গবেষণা থেকে উঠে আসবে। তবে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পর থেকে ’১৯-এর লোকসভা ভোট পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যেভাবে নরম সাম্প্রদায়িকতার পালে বাতাস দিয়ে গিয়েছেন, তা আজ ও গোটা হিন্দুত্ববাদীদের সামাজিক বিভাজনকে তীব্র করে তুলে, নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কাজকে অনেক বেশি বেশি পরিমাণে সার্থক করে তুলেছে।

অতি সম্প্রতি হিন্দু আর হিন্দুত্বের ভেতরে ফারাক বুঝিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিচ্ছেন রাহুল গান্ধী। জওহরলাল নেহরুর পরে আর কোন শীর্ষস্তরের কংগ্রেস নেতা এইভাবে প্রকাশ্যে ধার্মিক আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবসা ঘিরে ফারাক করে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। আজ যে অযোধ্যা ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদীদের মত্ততা, সেই অযোধ্যা ঘিরে ইন্দিরা গান্ধীর ‘দি রাম কি পুরী’ পরিকল্পনাটি আদৌ কোন ধর্মনিরপেক্ষ পরিকল্পনা ছিল, তা কোন অবস্থাতেই বলা যাবে না। আজ যে হরিদ্বারে আরএসএসের সাঙ্গপাঙ্গদের ধর্মসংসদ, মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার হুমকি, শ্রীমতী গান্ধীর জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে খোদ দিল্লিতেই (১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে) তেমন একটি ধর্ম সংসদ হয়। সেখানে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার কথা বলে জমায়েতে কিছু বর্বর সর্বঘোষিত ধর্মগুরু। এদের সম্পর্কে কিন্তু ন্যূনতম ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, একটা বিবৃতি পর্যন্ত শ্রীমতী গান্ধী দেননি সেদিন।

রাহুল গান্ধী আজ যখন হিন্দু আর হিন্দুত্বের ভেতর ফারাক করে প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়েছেন, তখন তাকে অরাজনৈতিকভাবে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করতে শুরু করেছে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির। কৃষক আন্দোলনের জেরে উত্তাল পাঞ্জাবে জনবিক্ষোভে নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত রেখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। জরুরি অবস্থার আগে পরে ও শ্রীমতী গান্ধীকে এইভাবে নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে কখনও ফিরে যেতে হয়নি।

ত্রিপুরাতে গিয়ে বিমানবন্দর থেকে রেলপথ ঘিরে যে অনৃতবাদন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে করেছেন, তা ভারতের প্রতিটি মানুষের কাছে শুধু লজ্জারই নয়, চরম বেদনার ও। বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ ঘিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগরতলায় প্রকাশ্য বক্তৃতায় যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন, তার তথাকথিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ তত্বকে। রেললাইন সম্প্রসারণ, বিশেষ করে ভারত- বাংলাদেশ, ত্রিপুরার ভিতর দিয়ে রেল সংযোগের যাবতীয় কৃতিত্ব ও তিনি দিয়েছেন এই ‘ডবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব, অর্থাৎ; দিল্লি আর ত্রিপুরা, দুই জায়গাতেই এক দলের সরকার থাকার বিষয়টিকেই তিনি বলেছেন।

দেশভাগের পর ত্রিপুরার রেলপথের বেশিরভাগ অংশটাই বাংলাদেশে পড়ে যায়। ফলে তখন থেকেই বামপন্থিরা ত্রিপুরায় রেলপথের দাবি জানিয়ে আসছে। বামপন্থিদের প্রতিহত করতে নিজেদের সরকার কেন্দ্রে থাকার সময়ে কংগ্রেস যাতে ত্রিপুরায় রেলপথ না হয়, সেজন্যে সব রকমের চেষ্টা করেছিল। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে, বামপন্থিরা যখন সেই সরকারের অন্যতম সমর্থক, সেই সময়ে মূলত বামপন্থিদের দাবি মেনেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ত্রিপুরার রেলপথের বিষয়ে সবুজ সংকেত দেন।

নয়ের দশকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ট্রানজিট রুটের ভাবনার কথা প্রথম বলেন ’৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে গণভবণে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় এই ট্রানজিন রুট সম্পর্কের ক্ষেত্রে কি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে তার বাপ-মা মরা এতিম কন্যা হাসিনাকে বিস্তারিতভাবে বলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। সেই ভাবনাকেই ফলপ্রসূ করেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী বিষয় ড. মনমোহন সিং দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তুলে ধরলে। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং ত্রিপুরাতে বামপন্থিদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে আজ সেই রাজ্যে রেলপথের ক্ষেত্রে একটা নয়া সংযোজন ঘটেছে। অথচ, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তিনি বা তার দলের যে রেলপথ বা আধুনিক বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কোন ভূমিকা বা অবদান নেই, তিনি গোটা কৃতিত্বটা নিজের দল এবং দলের সরকারকে দিলেন। মজার কথা হল, ত্রিপুরাতে কয়িকদিন তৃণমূল কংগ্রেস খুব লম্ফঝম্ফ করেছে। অথচ নরেন্দ্র মোদির এই চরম মিথ্যাচারকে ঘিরে সেখানে বামপন্থিরা ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলই টুঁ শব্দটা পর্যন্ত করেনি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]