৩শ’বর্ষী ‘ঝাউদি গিরি’ অবহেলায় : সংরক্ষণ দাবি

মাদারীপুরের মগদের দিক নির্দেশনার কাজে ব্যবহৃত স্তম্ভ ‘ঝাউদি গিরি’ এখন জমি-জমা পরিমাপের মূল স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করা হচেছ। একশ ফুট উচ্চতার এই গিরিটি এখন কালের গর্ভে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকে প্রায় দশ ফুটেরও বেশি মাটির নিচে দেবে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক সময় পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই সুউচ্চ গিরিটিকে এখন জমি-জমা পরিমাপ করার মূলস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মাদারীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে ঝাউদি গিরিটিকে স্থানীয়রা সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মতান্তরে প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর আগে ১৭১৫ সাল থেকে ১৭২০ সালের মধ্যে আরাকানের মগ দস্যুরা মাদারীপুর অঞ্চলে আসে। তখন তারা দিক নির্দেশনার জন্য গহীন জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলে দুই শতাংশ জমির ওপরে একশ ফুট উচ্চতার এই গিরিটি নির্মাণ করে। যা ঝাউদি এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এটি ‘ঝাউদি গিরি’ নামে পরিচিতি পায়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদারীপুর শহর দক্ষিণে মোবারকদী এলাকা হয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ আরো দক্ষিণের দিকে গেলেই ঝাউদি গিরি। গিরিটি কয়েক দশকে প্রায় দশ ফুটের বেশি মাটির নিচে দেবে গেছে। তবে, এখনো ৭০ ফুটের মত মাটির উপরে গিরিটি টিকে আছে। গিরিটির ছাদ অনেক আগেই ভেঙ্গে গেছে। ইটগুলো পুরনো হয়ে যাওয়ায় অনেক স্থানে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে গেছে। পশ্চিম পাশের দেওয়ালে বড় একটি ফাটলও দেখা দিয়েছে। গিরিটির পশ্চিম ও পূর্ব দিকে দুটি বড় প্রবেশ পথ রয়েছে। বর্তমানে গিরিটি পুরোপুরি অযতœ আর অবহেলায় ধ্বংসে হতে চলেছে। গিরিটি যে স্থানে নির্মিত হয়েছে সেই জমির মালিক দাবি করা ঝাউদি এলাকাবার বাসিন্দা রোকেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই গিরিটি বর্তমানে যে স্থানে অবস্থিত এই এখন আমাদের। আমার স্বামী সিরাজ ভুইয়া এই জমিটি কিনেছে। গিরিটির চারপাশের গাছ-গাছালি সব আমাদের। আমরাই এগুলো ভোগ দখল করে খাই। তবে, এই গিরিটি কখন এখানে বানানো হয়েছিল তিনি তা বলতে পারেননি। তবে, গিরিটিকে কেন্দ্র করে আমাদের এলাকার লোকজনে জমি জমা মাপঝোপ করে।’

বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সদস্য সুবল বিশ^াস বলেন, ‘মাদারীপুরের ঝাউদি গিরি মগদের এই অঞ্চলে বিচরণের একটি কালের সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। অযতœ আর অবহেলায় ঝাউদি গিরি ইতিহাসটুকুও এখন আর অনেকেই জানেন না। সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর যদি গিরিটিকে তাদের অধীনে নিয়ে সংস্কার করে সংরক্ষণ করত। তাহলে গিরিটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারত। সরকার সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে কয়েকশ বছর ধরে ঝাউদিতে দাড়িয়ে থাকা এই গিরিটি একসময় হারিয়ে যাবে।’

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘ঝাউদি গিরি কি? এটিই এখন স্থানীয়রা ভাল করে বলতে পারি না। সরকারিভাবে যদি এটিকে আরও অনেক আগেই সংরক্ষণ করা হতো, তাহলে কমবেশি অনেকেই মাদারীপুরের ঝাউদি গিরি সম্পর্কে কমবেশি ধারণা রাখতে পারতো। তাই সরকারের কাছে দাবি করছি, মাদারীপুর অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেসকল স্থাপনা রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হোক। আমি দাবি করছি, মাদারীপুরে প্রতœতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে ঝাউদি গিরিটিকে দ্রুত সংস্কার করে সংরক্ষণ করা হোক।’

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মাদারীপুরে যে সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্থাপনা রয়েছে। সেইগুলোকে সংরক্ষণের জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে সদর উপজেলার ঝাউদি গিরিও রয়েছে। আমি আশা করছি, ঝাউদি গিরিটিকে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হলে এটিকে নতুন ভাবে সংস্কার করে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে সংরক্ষণ করা যাবে।

রবিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২২ , ২৫ পৌষ ১৪২৮ ৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

৩শ’বর্ষী ‘ঝাউদি গিরি’ অবহেলায় : সংরক্ষণ দাবি

রিপন চন্দ্র মল্লিক, মাদারীপুর

image

মাদারীপুর : মগদের দিক নির্দেশনার কাজে ব্যবহৃত ধংসপ্রায় ‘ঝাউদি গিরি’ স্তম্ভ -সংবাদ

মাদারীপুরের মগদের দিক নির্দেশনার কাজে ব্যবহৃত স্তম্ভ ‘ঝাউদি গিরি’ এখন জমি-জমা পরিমাপের মূল স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করা হচেছ। একশ ফুট উচ্চতার এই গিরিটি এখন কালের গর্ভে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকে প্রায় দশ ফুটেরও বেশি মাটির নিচে দেবে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক সময় পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই সুউচ্চ গিরিটিকে এখন জমি-জমা পরিমাপ করার মূলস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মাদারীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে ঝাউদি গিরিটিকে স্থানীয়রা সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মতান্তরে প্রায় সাড়ে তিন’শ বছর আগে ১৭১৫ সাল থেকে ১৭২০ সালের মধ্যে আরাকানের মগ দস্যুরা মাদারীপুর অঞ্চলে আসে। তখন তারা দিক নির্দেশনার জন্য গহীন জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলে দুই শতাংশ জমির ওপরে একশ ফুট উচ্চতার এই গিরিটি নির্মাণ করে। যা ঝাউদি এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এটি ‘ঝাউদি গিরি’ নামে পরিচিতি পায়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদারীপুর শহর দক্ষিণে মোবারকদী এলাকা হয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ আরো দক্ষিণের দিকে গেলেই ঝাউদি গিরি। গিরিটি কয়েক দশকে প্রায় দশ ফুটের বেশি মাটির নিচে দেবে গেছে। তবে, এখনো ৭০ ফুটের মত মাটির উপরে গিরিটি টিকে আছে। গিরিটির ছাদ অনেক আগেই ভেঙ্গে গেছে। ইটগুলো পুরনো হয়ে যাওয়ায় অনেক স্থানে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে গেছে। পশ্চিম পাশের দেওয়ালে বড় একটি ফাটলও দেখা দিয়েছে। গিরিটির পশ্চিম ও পূর্ব দিকে দুটি বড় প্রবেশ পথ রয়েছে। বর্তমানে গিরিটি পুরোপুরি অযতœ আর অবহেলায় ধ্বংসে হতে চলেছে। গিরিটি যে স্থানে নির্মিত হয়েছে সেই জমির মালিক দাবি করা ঝাউদি এলাকাবার বাসিন্দা রোকেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই গিরিটি বর্তমানে যে স্থানে অবস্থিত এই এখন আমাদের। আমার স্বামী সিরাজ ভুইয়া এই জমিটি কিনেছে। গিরিটির চারপাশের গাছ-গাছালি সব আমাদের। আমরাই এগুলো ভোগ দখল করে খাই। তবে, এই গিরিটি কখন এখানে বানানো হয়েছিল তিনি তা বলতে পারেননি। তবে, গিরিটিকে কেন্দ্র করে আমাদের এলাকার লোকজনে জমি জমা মাপঝোপ করে।’

বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সদস্য সুবল বিশ^াস বলেন, ‘মাদারীপুরের ঝাউদি গিরি মগদের এই অঞ্চলে বিচরণের একটি কালের সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। অযতœ আর অবহেলায় ঝাউদি গিরি ইতিহাসটুকুও এখন আর অনেকেই জানেন না। সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর যদি গিরিটিকে তাদের অধীনে নিয়ে সংস্কার করে সংরক্ষণ করত। তাহলে গিরিটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারত। সরকার সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে কয়েকশ বছর ধরে ঝাউদিতে দাড়িয়ে থাকা এই গিরিটি একসময় হারিয়ে যাবে।’

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘ঝাউদি গিরি কি? এটিই এখন স্থানীয়রা ভাল করে বলতে পারি না। সরকারিভাবে যদি এটিকে আরও অনেক আগেই সংরক্ষণ করা হতো, তাহলে কমবেশি অনেকেই মাদারীপুরের ঝাউদি গিরি সম্পর্কে কমবেশি ধারণা রাখতে পারতো। তাই সরকারের কাছে দাবি করছি, মাদারীপুর অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেসকল স্থাপনা রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হোক। আমি দাবি করছি, মাদারীপুরে প্রতœতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে ঝাউদি গিরিটিকে দ্রুত সংস্কার করে সংরক্ষণ করা হোক।’

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মাদারীপুরে যে সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্থাপনা রয়েছে। সেইগুলোকে সংরক্ষণের জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে সদর উপজেলার ঝাউদি গিরিও রয়েছে। আমি আশা করছি, ঝাউদি গিরিটিকে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হলে এটিকে নতুন ভাবে সংস্কার করে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে সংরক্ষণ করা যাবে।