শুঁটকির ভরা মৌসুম : ২ হাজার কোটি টাকার উৎপাদনের আশা

শীত মৌসুমের শুরু থেকে কক্সবাজার উপকূলে চলছে পুরোদমে শুঁটকি তৈরি। সাগর থেকে আহরণ করে আনা ছুরি, লইট্টা, সুরমা, সুন্দরী, রূপচাঁদাসহ ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। তিন থেকে ৭ দিনের মধ্যে এসব মাছ শুঁকিয়ে তৈরি হচ্ছে শুটকি। শুঁটকি তৈরির কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার নারী-পুরুষের। ব্যবসায়ীদের দাবি, মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার ও প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকানো এই শুঁটকি মানসম্পন্ন হওয়ায় চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। আর মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানালেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে শতভাগ মানসম্মত শুঁটকি আরো বেশি রফতানি সম্ভব।

এ নিয়ে কক্সবাজারের নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির নেতা সোহেল বলেন, এ বছর আমরা আড়াই লাখ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন করতে সক্ষম হবো, যার বাজার মূল্য ২ হাজার কোটি টাকা। এসব শুঁটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক।

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার ৬টি স্থানে প্রতিবছরের মতো পর্যটন ও শীত মৌসুমের শুরু থেকে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, শাপলাপুর, সেন্টমার্টিন, কুুতুবদিয়াসহ জেলার বিভিন্ন শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ওপর ও বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচায় সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। বিভিন্ন শুঁটকি মহালে দেখা যায়, শ্রমিকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ মাছ পরিষ্কার করছেন, কেউ মাচায় মাছ তুলছেন। কথা বলার সময় নেই শুঁটকি শ্রমিকদের।

শুঁটকি মহালের ব্যবসায়ী এরশাদ জানান, শীত ও পর্যটন মৌসুম শুরুর আগে থেকে শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে বছরের অধিকাংশ সময় বিরুপ আবহাওয়া থাকায় ও করোনাকালীন উৎপাদন বন্ধ ছিল। এখন আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদন। এ বছরও রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, টেকচাঁদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ ২০-২৫ প্রজাতির মাছ শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে।

বর্ষাকাল ছাড়া বছরের ৯ মাস এখানে শুঁটকি উৎপাদন চলে। তবে, সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলে উৎপাদনে একটু ভাটা পড়ে।

নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ জানান, প্রায় ১শ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এ শুঁটকি মহালে রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ৎ। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল হলো নাজিরারটেক। এখানে ব্যবসায়ীও আছেন প্রায় দুই হাজার। এ মহাল থেকে সবমিলে প্রতিদিন প্রায় দুইশ টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি। যার বাজারমূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা।

জেলার ৬টি স্থান মিলে প্রতি মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদন হয় আড়াই লাখ মেট্রিক টন যার বাজার মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকা। এসব শুঁটকি মহালে উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক। জেলার শুঁটকি মহলগুলো থেকে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন শুঁটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, প্রতিবছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেয়া হলেও শুঁটকি মহালে সুযোগ-সুবিধা তেমন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শুঁটকির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকতা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে সমগ্র দেশের মানুষের চাহিদা মিটানো হচ্ছে। এমনকি শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

কীটনাশক ব্যবহারের কথা স্বীকার করে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এ প্রবণতা শুঁটকি উৎপাদনে দিন দিন কমে আসছে। নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে কয়েকটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে জেলার শুঁটকি ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের নিয়ে আমরা উদ্বুদ্ধকরণ সভা করে যাচ্ছি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে উৎপাদিত শুঁটকির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় পর্যটন শহর কক্সবাজারে। একসময় কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি শুঁটকির গ্রাম ছিল। কিছু দরিদ্র মানুষ শুঁটকি তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন শুঁটকি উৎপাদন হয় বাণিজ্যিকভাবে, বিশাল কলেবরে।

কক্সবাজারে শুঁটকি উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মহাল নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল। কক্সবাজার শহরের পশ্চিম সাগরের তীরে এই নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লি। এটি নতুন চর এলাকা। বছরজুড়ে এখানে চলে শুঁটকি মাছের উৎপাদন। বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত বাঁশের মাচায় নানা জাতের মাছ শুকানো হয়।

image

কক্সবাজার : মাচায়-মাচায় শুকানো হচ্ছে শুঁটকি। চারপাশ মুখরিত শুঁটকির সৌরভে -সংবাদ

আরও খবর
রামপালে জামিনে এসেই বাদীর ওপর হামলা
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত
নান্দাইলে মোট ভোটের ২শ’ ভোট বেশি কাস্টিং

রবিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২২ , ২৫ পৌষ ১৪২৮ ৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

শুঁটকির ভরা মৌসুম : ২ হাজার কোটি টাকার উৎপাদনের আশা

প্রতিনিধি, কক্সবাজার

image

কক্সবাজার : মাচায়-মাচায় শুকানো হচ্ছে শুঁটকি। চারপাশ মুখরিত শুঁটকির সৌরভে -সংবাদ

শীত মৌসুমের শুরু থেকে কক্সবাজার উপকূলে চলছে পুরোদমে শুঁটকি তৈরি। সাগর থেকে আহরণ করে আনা ছুরি, লইট্টা, সুরমা, সুন্দরী, রূপচাঁদাসহ ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। তিন থেকে ৭ দিনের মধ্যে এসব মাছ শুঁকিয়ে তৈরি হচ্ছে শুটকি। শুঁটকি তৈরির কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার নারী-পুরুষের। ব্যবসায়ীদের দাবি, মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার ও প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকানো এই শুঁটকি মানসম্পন্ন হওয়ায় চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। আর মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানালেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে শতভাগ মানসম্মত শুঁটকি আরো বেশি রফতানি সম্ভব।

এ নিয়ে কক্সবাজারের নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির নেতা সোহেল বলেন, এ বছর আমরা আড়াই লাখ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন করতে সক্ষম হবো, যার বাজার মূল্য ২ হাজার কোটি টাকা। এসব শুঁটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক।

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার ৬টি স্থানে প্রতিবছরের মতো পর্যটন ও শীত মৌসুমের শুরু থেকে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, শাপলাপুর, সেন্টমার্টিন, কুুতুবদিয়াসহ জেলার বিভিন্ন শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ওপর ও বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচায় সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। বিভিন্ন শুঁটকি মহালে দেখা যায়, শ্রমিকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ মাছ পরিষ্কার করছেন, কেউ মাচায় মাছ তুলছেন। কথা বলার সময় নেই শুঁটকি শ্রমিকদের।

শুঁটকি মহালের ব্যবসায়ী এরশাদ জানান, শীত ও পর্যটন মৌসুম শুরুর আগে থেকে শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে বছরের অধিকাংশ সময় বিরুপ আবহাওয়া থাকায় ও করোনাকালীন উৎপাদন বন্ধ ছিল। এখন আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদন। এ বছরও রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, টেকচাঁদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ ২০-২৫ প্রজাতির মাছ শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে।

বর্ষাকাল ছাড়া বছরের ৯ মাস এখানে শুঁটকি উৎপাদন চলে। তবে, সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলে উৎপাদনে একটু ভাটা পড়ে।

নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ জানান, প্রায় ১শ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এ শুঁটকি মহালে রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ৎ। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মহাল হলো নাজিরারটেক। এখানে ব্যবসায়ীও আছেন প্রায় দুই হাজার। এ মহাল থেকে সবমিলে প্রতিদিন প্রায় দুইশ টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি। যার বাজারমূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা।

জেলার ৬টি স্থান মিলে প্রতি মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদন হয় আড়াই লাখ মেট্রিক টন যার বাজার মূল্য দেড় হাজার কোটি টাকা। এসব শুঁটকি মহালে উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক। জেলার শুঁটকি মহলগুলো থেকে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন শুঁটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে ব্যবসায়ীরা নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, প্রতিবছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেয়া হলেও শুঁটকি মহালে সুযোগ-সুবিধা তেমন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শুঁটকির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এ নিয়ে কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকতা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি দিয়ে সমগ্র দেশের মানুষের চাহিদা মিটানো হচ্ছে। এমনকি শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

কীটনাশক ব্যবহারের কথা স্বীকার করে এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এ প্রবণতা শুঁটকি উৎপাদনে দিন দিন কমে আসছে। নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে কয়েকটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে জেলার শুঁটকি ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের নিয়ে আমরা উদ্বুদ্ধকরণ সভা করে যাচ্ছি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে উৎপাদিত শুঁটকির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় পর্যটন শহর কক্সবাজারে। একসময় কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি শুঁটকির গ্রাম ছিল। কিছু দরিদ্র মানুষ শুঁটকি তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন শুঁটকি উৎপাদন হয় বাণিজ্যিকভাবে, বিশাল কলেবরে।

কক্সবাজারে শুঁটকি উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মহাল নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল। কক্সবাজার শহরের পশ্চিম সাগরের তীরে এই নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লি। এটি নতুন চর এলাকা। বছরজুড়ে এখানে চলে শুঁটকি মাছের উৎপাদন। বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত বাঁশের মাচায় নানা জাতের মাছ শুকানো হয়।