পাকিস্তানে কারাগারের দিনগুলো

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেনা সদস্যরা প্রথমে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে প্রচ- গুলিবর্ষণ করে। তারপর একজন মেজর বাড়িতে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাকে গ্রেপ্তার করার জন্যই তারা এসেছে। বঙ্গবন্ধু সৈন্যদের সঙ্গে যাওয়ার আগে পরিবার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চান। বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিদায় জানাতে কয়েক মিনিট সময় দেয়া হয়। পরিবারের সবাইকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু জানবে, একদিন আমার মানুষ মুক্ত হবে। আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।’

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে সেনানিবাসে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে (বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একদিন রেখে তাকে নেয়া হয় ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে। সেখান নোংরা ও অন্ধকার একটি ঘরে তাকে রাখা হয়। সে ঘরে ছয় দিন তাকে আটক রাখা হয়।

১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত গোপনে বিমানে করাচি নেয়া হয়। করাচি বিমানবন্দরে পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানওয়ালি কারাগারে। থাকতে দেয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে।

এক পর্যায়ে জেলে রেখে পাকিস্তান সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে ‘বিচার’ শুরু করে। অভিযোগগুলোর একটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’। সামরিক সরকার প্রবীণ আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায় অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।’ গোটা বিচারকালে বঙ্গবন্ধু আদালতের প্রতি তার অনাস্তা প্রকাশের জন্য আদালতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছিলেন।

একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিচার করে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়। দ-াদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হতে থাকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশে কবরও খোঁড়া হয়।

ইয়াহিয়া খান গুলি করে শেখ মুজিবকে হত্যার দ্রুত প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করায় বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। হত্যার দিন হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। তখন বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করা না করা নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল।

১৫ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালি জেলখানার দায়িত্বরতদের জানানো হয়, বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল নিয়াজিকে হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন সকালেই মুজিবকে হত্যা করা হবে।

পরদিন ভোররাত চারটায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে জেলের সুপার জেলে ঢুক বঙ্গবন্ধুর সেলের দরজা খুলে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধু জানতে চান, ‘আমাকে কি ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ তিনি আগেই দেখেছিলেন তার সেলের বাইরে কবর খোঁড়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছিল, তার নিরাপত্তার জন্য পরিখা খনন করা হয়েছে। জেল সুপার জানালেন, তাকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তবু সন্দেহ যায় না বঙ্গবন্ধুর। পরে এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি তাকে বললাম, যদি ফাঁসিই দেয়া হয়, তাহলে আমাকে প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন।’ সুপার বললেন, ‘না না, একদম সময় নেই। আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে আসতে হবে, জলদি।’

এদিকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ভুট্টো।

পাকিস্তানে সেই দুর্দিনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মনে হয়েছিল, মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে পরাজিত এবং আত্মসমর্পণ করা প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যকে বিচার করে হত্যা করা হতে পারে। এ চিন্তা থেকেই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরিকল্পনায় রাজি হননি।

ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর দেখা করা এবং কথোপকথন নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরে বাংলাদেশে ফিরে এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ভুট্টো তাকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোন রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করেন।’ বঙ্গবন্ধু তখন ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ আমি কি মুক্ত না এখনও বন্দী? আমি যদি মুক্ত হই তাহলে আমাকে যেতে দিন। আর যদি বন্দী হই তাহলে কোন কথা বলতে প্রস্তুত নই’।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ তখন পর্যন্ত আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে মনে করিয়ে দেন, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সে ফলাফল মানা হয়নি। ‘পাকিস্তান যদি এখনও অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নন, আমি।’

৭ জানুয়ারি তৃতীয় ও শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টা। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে, এ নিয়ে অযথা বিলম্বের সময় নেই। হয় আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন।’ ভুট্টা তাকে বলেন, এত দ্রুত তাকে মুক্তি দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করা কঠিন।

ভুট্টা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠাতে সম্মত হন। ৭ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অত্যন্ত গোপনে একটি বিমান লন্ডন যাত্রা করে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টায় লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু।

সোমবার, ১০ জানুয়ারী ২০২২ , ২৬ পৌষ ১৪২৮ ৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

পাকিস্তানে কারাগারের দিনগুলো

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেনা সদস্যরা প্রথমে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে প্রচ- গুলিবর্ষণ করে। তারপর একজন মেজর বাড়িতে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাকে গ্রেপ্তার করার জন্যই তারা এসেছে। বঙ্গবন্ধু সৈন্যদের সঙ্গে যাওয়ার আগে পরিবার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চান। বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিদায় জানাতে কয়েক মিনিট সময় দেয়া হয়। পরিবারের সবাইকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু জানবে, একদিন আমার মানুষ মুক্ত হবে। আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।’

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে সেনানিবাসে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে (বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একদিন রেখে তাকে নেয়া হয় ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে। সেখান নোংরা ও অন্ধকার একটি ঘরে তাকে রাখা হয়। সে ঘরে ছয় দিন তাকে আটক রাখা হয়।

১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত গোপনে বিমানে করাচি নেয়া হয়। করাচি বিমানবন্দরে পেছনে দাঁড়ানো দুই পুলিশ কর্মকর্তার সামনের আসনে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানওয়ালি কারাগারে। থাকতে দেয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে।

এক পর্যায়ে জেলে রেখে পাকিস্তান সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে ‘বিচার’ শুরু করে। অভিযোগগুলোর একটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’। সামরিক সরকার প্রবীণ আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম, জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায় অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।’ গোটা বিচারকালে বঙ্গবন্ধু আদালতের প্রতি তার অনাস্তা প্রকাশের জন্য আদালতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছিলেন।

একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিচার করে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়। দ-াদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হতে থাকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশে কবরও খোঁড়া হয়।

ইয়াহিয়া খান গুলি করে শেখ মুজিবকে হত্যার দ্রুত প্রস্তুতির নির্দেশ দেয়। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করায় বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। হত্যার দিন হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। তখন বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করা না করা নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল।

১৫ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালি জেলখানার দায়িত্বরতদের জানানো হয়, বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল নিয়াজিকে হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন সকালেই মুজিবকে হত্যা করা হবে।

পরদিন ভোররাত চারটায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে জেলের সুপার জেলে ঢুক বঙ্গবন্ধুর সেলের দরজা খুলে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধু জানতে চান, ‘আমাকে কি ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ তিনি আগেই দেখেছিলেন তার সেলের বাইরে কবর খোঁড়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছিল, তার নিরাপত্তার জন্য পরিখা খনন করা হয়েছে। জেল সুপার জানালেন, তাকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তবু সন্দেহ যায় না বঙ্গবন্ধুর। পরে এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি তাকে বললাম, যদি ফাঁসিই দেয়া হয়, তাহলে আমাকে প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন।’ সুপার বললেন, ‘না না, একদম সময় নেই। আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে আসতে হবে, জলদি।’

এদিকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে বাংলাদেশ মুক্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ভুট্টো।

পাকিস্তানে সেই দুর্দিনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মনে হয়েছিল, মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে পরাজিত এবং আত্মসমর্পণ করা প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যকে বিচার করে হত্যা করা হতে পারে। এ চিন্তা থেকেই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরিকল্পনায় রাজি হননি।

ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর দেখা করা এবং কথোপকথন নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরে বাংলাদেশে ফিরে এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ভুট্টো তাকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোন রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করেন।’ বঙ্গবন্ধু তখন ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ আমি কি মুক্ত না এখনও বন্দী? আমি যদি মুক্ত হই তাহলে আমাকে যেতে দিন। আর যদি বন্দী হই তাহলে কোন কথা বলতে প্রস্তুত নই’।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ তখন পর্যন্ত আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে মনে করিয়ে দেন, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সে ফলাফল মানা হয়নি। ‘পাকিস্তান যদি এখনও অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নন, আমি।’

৭ জানুয়ারি তৃতীয় ও শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টা। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে, এ নিয়ে অযথা বিলম্বের সময় নেই। হয় আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন।’ ভুট্টা তাকে বলেন, এত দ্রুত তাকে মুক্তি দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করা কঠিন।

ভুট্টা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠাতে সম্মত হন। ৭ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অত্যন্ত গোপনে একটি বিমান লন্ডন যাত্রা করে। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টায় লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু।