বিক্রি হচ্ছে দেশের প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষী ভবন

খুলনার মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট

দেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা চিত্রশিল্পী শশীভূষণ পাল প্রতিষ্ঠিত খুলনার ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’র প্রায় শত বছরের পুরোনো ভবনটি নিলামে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ভবনটিকে ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিপ্রেমী ও স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা। এ দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ভবনটির নিলামে অংশ নেয়ার জন্য এরইমধ্যে ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছেন।

ভবনটির দেয়ালে থাকা শিলিলিপি থেকে জানা যায়, ১৯২৯ সালে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারিভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ওই বছরের ১৯ মে ভবনটির উদ্বোধন করেন সে সময়ের খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ কুইনন্টন।

তবে স্থানীয় লোকজন ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন। খুলনার ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক মাজহারুল হান্নান বলেন, শশীভূষণ পালের এই স্থাপনাটি ইতিহাসের অংশ। এই ভবনটির সঙ্গে খুলনা তথা দেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধজুড়ে আছে। এটি সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে সবাইকে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

সরকারি বিএল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক শঙ্কর কুমার মল্লিক বলেন, এটাই এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র। এরসঙ্গে একটা ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধজুড়ে আছে। এটা অবশ্যই সংরক্ষণ করা দরকার।

তিনি আরও বলেন, এই গুরুত্ব বিবেচনায় এই ঐতিহ্যকে রেখে সরকারি উদ্যোগে একটা আর্ট গ্যালারি করলে শিল্পী শশীভূষণ যেমন এর ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকবেন, তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা আছে, সেটিও প্রকাশ পাবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. শেখ সাদী ভূঁঞা বলেন, শতাব্দীর প্রাচীন পথিকৃৎ শিল্পী শশীভূষণের স্মৃতি বিজড়িত ওই ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। যেভাবেই হোক ভবনটি সংরক্ষণ করা উচিত।

শিল্পী শশীভূষণ পাল প্রতিষ্ঠিত মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের মূল ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। রোববার নগরের উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জোটের সভাপতি হুমায়ুন কবির ববি।

শিক্ষাবিদ, ইতিহাস গবেষক এবং খুলনা অঞ্চলের ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯০৪ সালে বাংলাদেশ ভূসীমানায় প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন চিত্রশিল্পী শশীভূষণ পাল।

নগরের দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা কুলিবাগান এলাকায় বর্তমান যশোর রোডের পূর্বপাশে নিজ বাড়িতে ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামে এই অঙ্কন বিদ্যাপীঠটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেসময় পূর্ববঙ্গে আর কোন শিল্পশিক্ষায়তন ছিল না।

১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি জেলা বোর্ড ও সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। ১৯২৯ সালে বিদ্যালয়টি যশোর রোডের পশ্চিমপাশে স্থানান্তরিত হয়। আর সেখানেই সরকারি ওই ভবনটি গড়ে ওঠে। এই শিক্ষায়তনে প্রায় ৪১ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শশীভূষণ।

বাংলার গভর্নর, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতব, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পল্লিকবি জসিমউদ্?দীন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী এস এম সুলতানসহ দেশি-বিদেশি অনেক শিল্পরসিক এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এসেছিলেন। জয়নুল আবেদিনও এটাকে এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

সময়ের পরিক্রমায় মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট নামের সেই বিদ্যায়তনটি খুলনার গল্লামারী এলাকায় স্থানান্তরিত করে ১৯৮৩ সালে প্রথমে শশীভূষণ আর্ট কলেজ, পরে খুলনা আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। ২০০৯ সালে সেটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তবে শুরুর দিকের ওই সরকারি ভবনটিতে প্রায় চারদশক আগে শশীভূষণ শিশু বিদ্যানিকেতন গড়ে তোলেন স্থানীয় সুধীজনরা।

এরপর ১৯৮০ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯১ সালের দিকে সেখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে ওই কমপ্লেক্সেই তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, শত বছরের পুরোনো একতলা ভবনটি চুন-সুরকি আর ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। বারান্দার সামনে ছয়টি প্রবেশপথসহ মোট ৯টি দরজা রয়েছে। ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২৫ ফুট প্রস্থের ভবনটির দরজা-জানালাগুলো বেশ প্রশস্ত। লোহার পাতের ওপর মাটির টালি বসিয়ে তার ওপর ছাদ ঢালাই দেয়া। ভবনের গায়ে কয়েকটি অশ্বত্থগাছ বড় হয়ে উঠছে।

প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ জানুয়ারি মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুলটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত কি-না, জানতে অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় খুলনা সিটি করপোরেশন।

এর উত্তরে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লিখিত আকারে জানান, ভবনটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি স্থাপনা। এটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি নয়। চিত্রশিল্পী শশীভূষণ এই বাংলায় প্রথম চিত্রশিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টির সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতা ও স্থানীয় মানুষের আবেগ সম্পৃক্ত আছে।

মিতা জানান, এটি বিশেষ ব্যক্তিত্বের স্মারক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য ট্যুরিজম অ্যাক্ট ২০১০ অনুযায়ী সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। আর এর সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার স্থানীয় সরকার পরিষদ বা জেলা প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।

সিটি করপোরেশন, স্কুল কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হলে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনের সংস্কার সংরক্ষণে কারিগরি পরামর্শ প্রদান করবে।

শশীভূষণ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও পুরোনো ওই ভবনটিতে পাঠদান করা হতো। পরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে সেখানে আর পাঠদান হয় না। ২০১৬ সালের দিক থেকে ভবনটি অপসারণে বিভিন্ন সময় সভা করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট খুলনা সিটি করপোরেশনের শহীদ আলতাফ মিলনায়তনে খুলনা নগর এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণের জন্য এক সভা হয়। সভায় সেই সময়ের কেসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী খান দৌলতপুরের শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শত বছরের পুরোনো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উত্থাপন করেন।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয় এবং এ বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভবনটি বিধিমোতাবেক ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বিদ্যালয়ের তখনকার প্রধান শিক্ষক নাহিদ সুলতানার কাছে চিঠি পাঠায় সিটি করপোরেশন।

এরপর ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে বিদ্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় বিদ্যালয়ের মাঠের মধ্যে থাকা পুরোনো ভবনটি অপসারণ করে এর আদলে অন্য একটি ভবন নির্মাণ এবং সেই ভবনের সামনে শশীভূষণ পালের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে ভবনটি অপসারণের চিঠি পাওয়ার পর ভবনটি অপসারণ করে এরই আদলে নতুন একটি ভবন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য গত ২১ ডিসেম্বর পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। ৪ জানুয়ারি ভবনটির দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল। মোট ছয়টি দরপত্র পড়েছে।

মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারী ২০২২ , ২৭ পৌষ ১৪২৮ ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

বিক্রি হচ্ছে দেশের প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষী ভবন

খুলনার মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট

জেলা বার্তা পরিবেশক, খুলনা

image

বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়েছে খুলনার মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের শতবর্ষী এই ভবন -সংবাদ

দেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা চিত্রশিল্পী শশীভূষণ পাল প্রতিষ্ঠিত খুলনার ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’র প্রায় শত বছরের পুরোনো ভবনটি নিলামে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ভবনটিকে ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিপ্রেমী ও স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা। এ দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ভবনটির নিলামে অংশ নেয়ার জন্য এরইমধ্যে ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছেন।

ভবনটির দেয়ালে থাকা শিলিলিপি থেকে জানা যায়, ১৯২৯ সালে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারিভাবে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ওই বছরের ১৯ মে ভবনটির উদ্বোধন করেন সে সময়ের খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ কুইনন্টন।

তবে স্থানীয় লোকজন ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন। খুলনার ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক মাজহারুল হান্নান বলেন, শশীভূষণ পালের এই স্থাপনাটি ইতিহাসের অংশ। এই ভবনটির সঙ্গে খুলনা তথা দেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধজুড়ে আছে। এটি সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে সবাইকে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

সরকারি বিএল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক শঙ্কর কুমার মল্লিক বলেন, এটাই এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র। এরসঙ্গে একটা ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধজুড়ে আছে। এটা অবশ্যই সংরক্ষণ করা দরকার।

তিনি আরও বলেন, এই গুরুত্ব বিবেচনায় এই ঐতিহ্যকে রেখে সরকারি উদ্যোগে একটা আর্ট গ্যালারি করলে শিল্পী শশীভূষণ যেমন এর ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকবেন, তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা আছে, সেটিও প্রকাশ পাবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. শেখ সাদী ভূঁঞা বলেন, শতাব্দীর প্রাচীন পথিকৃৎ শিল্পী শশীভূষণের স্মৃতি বিজড়িত ওই ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। যেভাবেই হোক ভবনটি সংরক্ষণ করা উচিত।

শিল্পী শশীভূষণ পাল প্রতিষ্ঠিত মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্টের মূল ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে খুলনা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। রোববার নগরের উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জোটের সভাপতি হুমায়ুন কবির ববি।

শিক্ষাবিদ, ইতিহাস গবেষক এবং খুলনা অঞ্চলের ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯০৪ সালে বাংলাদেশ ভূসীমানায় প্রথম শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন চিত্রশিল্পী শশীভূষণ পাল।

নগরের দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা কুলিবাগান এলাকায় বর্তমান যশোর রোডের পূর্বপাশে নিজ বাড়িতে ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামে এই অঙ্কন বিদ্যাপীঠটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেসময় পূর্ববঙ্গে আর কোন শিল্পশিক্ষায়তন ছিল না।

১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি জেলা বোর্ড ও সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। ১৯২৯ সালে বিদ্যালয়টি যশোর রোডের পশ্চিমপাশে স্থানান্তরিত হয়। আর সেখানেই সরকারি ওই ভবনটি গড়ে ওঠে। এই শিক্ষায়তনে প্রায় ৪১ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শশীভূষণ।

বাংলার গভর্নর, বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতব, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পল্লিকবি জসিমউদ্?দীন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী এস এম সুলতানসহ দেশি-বিদেশি অনেক শিল্পরসিক এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এসেছিলেন। জয়নুল আবেদিনও এটাকে এই বঙ্গের প্রথম শিল্পশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

সময়ের পরিক্রমায় মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট নামের সেই বিদ্যায়তনটি খুলনার গল্লামারী এলাকায় স্থানান্তরিত করে ১৯৮৩ সালে প্রথমে শশীভূষণ আর্ট কলেজ, পরে খুলনা আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। ২০০৯ সালে সেটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তবে শুরুর দিকের ওই সরকারি ভবনটিতে প্রায় চারদশক আগে শশীভূষণ শিশু বিদ্যানিকেতন গড়ে তোলেন স্থানীয় সুধীজনরা।

এরপর ১৯৮০ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯১ সালের দিকে সেখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে ওই কমপ্লেক্সেই তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, শত বছরের পুরোনো একতলা ভবনটি চুন-সুরকি আর ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। বারান্দার সামনে ছয়টি প্রবেশপথসহ মোট ৯টি দরজা রয়েছে। ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২৫ ফুট প্রস্থের ভবনটির দরজা-জানালাগুলো বেশ প্রশস্ত। লোহার পাতের ওপর মাটির টালি বসিয়ে তার ওপর ছাদ ঢালাই দেয়া। ভবনের গায়ে কয়েকটি অশ্বত্থগাছ বড় হয়ে উঠছে।

প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ জানুয়ারি মহেশ্বরপাশা আর্ট স্কুলটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত কি-না, জানতে অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় খুলনা সিটি করপোরেশন।

এর উত্তরে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লিখিত আকারে জানান, ভবনটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি স্থাপনা। এটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি নয়। চিত্রশিল্পী শশীভূষণ এই বাংলায় প্রথম চিত্রশিল্প বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টির সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতা ও স্থানীয় মানুষের আবেগ সম্পৃক্ত আছে।

মিতা জানান, এটি বিশেষ ব্যক্তিত্বের স্মারক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য ট্যুরিজম অ্যাক্ট ২০১০ অনুযায়ী সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। আর এর সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার স্থানীয় সরকার পরিষদ বা জেলা প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।

সিটি করপোরেশন, স্কুল কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হলে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনের সংস্কার সংরক্ষণে কারিগরি পরামর্শ প্রদান করবে।

শশীভূষণ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও পুরোনো ওই ভবনটিতে পাঠদান করা হতো। পরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে সেখানে আর পাঠদান হয় না। ২০১৬ সালের দিক থেকে ভবনটি অপসারণে বিভিন্ন সময় সভা করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট খুলনা সিটি করপোরেশনের শহীদ আলতাফ মিলনায়তনে খুলনা নগর এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণের জন্য এক সভা হয়। সভায় সেই সময়ের কেসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী খান দৌলতপুরের শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শত বছরের পুরোনো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উত্থাপন করেন।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয় এবং এ বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভবনটি বিধিমোতাবেক ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বিদ্যালয়ের তখনকার প্রধান শিক্ষক নাহিদ সুলতানার কাছে চিঠি পাঠায় সিটি করপোরেশন।

এরপর ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে বিদ্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় বিদ্যালয়ের মাঠের মধ্যে থাকা পুরোনো ভবনটি অপসারণ করে এর আদলে অন্য একটি ভবন নির্মাণ এবং সেই ভবনের সামনে শশীভূষণ পালের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে ভবনটি অপসারণের চিঠি পাওয়ার পর ভবনটি অপসারণ করে এরই আদলে নতুন একটি ভবন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভবনটি নিলামে বিক্রির জন্য গত ২১ ডিসেম্বর পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। ৪ জানুয়ারি ভবনটির দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল। মোট ছয়টি দরপত্র পড়েছে।