সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দিন বদলের স্বপ্নে বিভোর কৃষক

চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইলে সরিষার ব্যাপক ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দিচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি। ইতোমধ্যেই আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সরিষার বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষার চাষ করায় কৃষকের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।

চলতি মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৮৪০ মে.টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। মৌসুমের শুরুতে নিম্নœচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ায় সরিষা আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঝুঁকি দেখা দেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের তৎপরতা ও পরামর্শে কৃষকরা সরিষা চাষে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস পায়। ফলে ইতোমধ্যে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২ উপজেলায় মোট ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৮৪০ মে.টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫ হাজার ২৯০ হেক্টরে ৬ হাজার ৩৪৮ মেট্রিক টন, বাসাইলে ৪ হাজার ৮২০ হেক্টরে ৫ হাজার ৭৮৪ মে.টন, কালিহাতীতে ৩ হাজার ১৩০ হেক্টরে ৩ হাজার ৭৫৬ মে.টন, ঘাটাইলে ২ হাজার ৩৫৫ হেক্টরে ২ হাজার ৮২৬ মে.টন, নাগরপুরে ১০ হাজার ১০০ হেক্টরে ১২ হাজার ১২০ মে.টন, মির্জাপুরে ৮ হাজার ৯৫০ হেক্টরে ১০ হাজার ৭৪০ মে.টন, মধুপুরে ৪৬৫ হেক্টরে ৫৫৮ মে.টন, ভূঞাপুরে ১ হাজার ৮৩০ হেক্টরে ২ হাজার ১৯৬ মে.টন, গোপালপুরে ৩ হাজার ৬০০ হেক্টরে ৪ হাজার ৩২০ মে.টন, সখীপুরে ২ হাজার ১৪০ হেক্টরে ২ হাজার ৫৬৮ মে.টন, দেলদুয়ারে ২ হাজার ৫৫০ হেক্টরে ৩ হাজার ৬০ মে.টন, ধনবাড়ী উপজেলায় ৪৭০ হেক্টরে ৫৬৪ মে.টন।

লক্ষ্য পূরণে জেলার ১২ উপজেলায় সরিষার আবাদ বাড়ানোর লক্ষে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সার্চ কমিটির সদস্যরা হলেন- জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, অতিরিক্ত পরিচালক (শষ্য), অতিরিক্ত পরিচালক (উদ্যান) এবং স্ব স্ব উপজেলা কৃষি অফিসার ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্চ কমিটির তৎপরতা ও প্রণোদনার ফলে হাল জরিপে ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেড়েছে।

এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৩৫ হেক্টর, বাসাইলে ৫৭৫ হেক্টর, কালিহাতীতে ৪৭০ হেক্টর, ঘাটাইলে ৬৩৫ হেক্টর, নাগরপুরে ৮০ হেক্টর, মির্জাপুরে ১ হাজার ২৩৫ হেক্টর, মধুপুরে ১৩৫ হেক্টর, ভূঞাপুরে ৩০০ হেক্টর, গোপালপুরে ৩৫০ হেক্টর, সখীপুরে ৩৮ হেক্টর, দেলদুয়ারে ২৩৫ হেক্টর এবং ধনবাড়ী উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, গত দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় কৃষকরা অধিকাংশ জমিতে আমন ধান চাষ করতে পারেনি। সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, গত বছর সরিষার বাজারমূল্য আশানুরূপ হওয়া, কৃষি প্রণোদনার আওতায় জেলার ২৪ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে এক কেজি বীজ ও সার প্রদান এবং সার্চ কমিটির তৎপরতার কারণে কৃষকরা বেশি জমিতে সরিষা আবাদ করায় লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের বারি-১৪ ও বারি-১৫ এবং স্থানীয় জাতের (পেচি/টরি-৭) সরিষা জেলায় বেশি আবাদ হয়ে থাকে। এছাড়া বারি-৯, বিনা-৯/১০, সরিষা-১৫, সোনালী সরিষা (এসএস-৭৫) জাতের সরিষাও আবাদ হয়। কৃষকরা আরও জানায়, সরিষা চাষে প্রতি বিঘা জমিতে ব্যয় হয় ৪-৫ হাজার টাকা।

ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ হাজার টাকা লাভ করা যায়। সরিষা ক্ষেতে ‘জাত’ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এঁটেল মাটিতেও সরিষা চাষ হয়। এঁটেল-দোআঁশ মাটিতে সরিষার চাষ সবচেয়ে ভালো হয়। জেলার মধ্যে নাগরপুর উপজেলার জমিতে এঁটেল-দোআঁশ মাটি বেশি হওয়ায় ফলনও অনেক ভালো হয়।

কৃষকরা বলেন, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি ও প্রজাপতির আনাগোনা বেশি হলে সহজে পরাগায়ণ হয়। এতে ফলন অনেকাংশে ভালো হয়।

ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা জমিতে ৫-৬ মণ সরিষা পাওয়া যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সরিষার বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষার চাষ করায় কৃষকের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের দিগন্তজোড়া হলুদরাঙা সরিষার রাজ্যে দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নাটোর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল ও সুন্দরবন এলাকা থেকে মৌয়াল বা মৌচাষিরা সারি সারি মৌবাক্স বসিয়ে সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে।

এখান থেকে মধু সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করা হয়।

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মধু সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করলে সরিষায় পরাগায়ণের ফলে আবাদ শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ফলন বেশি হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, ক্ষেতের পাশে সারি সারি মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে কাজে ব্যস্ত মৌয়াল বা মৌচাষী। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেখান থেকে মধু বিক্রিও করা হচ্ছে। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে।

মধু সংগ্রহকারী ময়মনসিংহের খোরশেদ আলম, আব্দুল করিম, সাতক্ষীরার কামরুল হাসান, রহমত আলী, ফরিদপুরের হায়দার মিয়া, বাদশা মিয়া, ইন্তাজ আলী, শরিয়তপুরের বাবলু মিয়া, আজমত আলী, খায়রুল ইসলাম জানান, তারা ৬-৮ বছর যাবত মৌবাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করছেন। তাদের কারও কারও নানা নামে মৌ খামার রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে আর প্রতি বাক্সে চার থেকে সাড়ে চার কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। খুচরা ও পাইকারি দরে মধু বিক্রি করা হয়। তাদের প্রত্যেকের ৫০ থেকে ২০০টি মৌবাক্স রয়েছে।

তারা জানান, এবার সরিষার ফলন ভালো হওয়ায় টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকায় মধু আহরণও আশানুরূপ হচ্ছে। তাদের দাবি, মৌ চাষের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য মৌচাষের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং মৌচাষিদের সহজে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হলে মধু সংগ্রহ আরও ব্যাপক আকারে করা যাবে। সেই সাথে সরিষার আবাদও অনেক বেড়ে যাবে।

মগড়া ইউনিয়নের ছোটবাসালিয়া গ্রামের সরিষা চাষী কামরুল হাসান, রতন চক্রবর্তী, আসলাম আহাম্মেদ, কাজী রশিদ, নুরুজ্জামান শেখ, আলআমিন, রুবেল মিয়া, দুলাল হোসেনসহ অনেকেই জানান, এবার তারা বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষা চাষ করেছেন। গতবছর বাজারে সরিষার দাম আশানুরূপ হওয়ায় অনেকেই এবার সরিষা আবাদে ঝুঁকেছেন। মৌসুমের প্রথমদিকে বৃষ্টি হলেও কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে এক কেজি বীজ ও সার পাওয়ায় তারা বৃষ্টির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছেন। এছাড়া গত বন্যায় আমন ধানের চাষ করতে না পারার ক্ষতিও তারা সরিষা আবাদের মাধ্যমে পূরণ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার জানান, টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলায় এবার ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। গত দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় আমন ধান চাষ ভালো না হওয়ায় কৃষকরা সরিষা আবাদের মাধ্যমে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করা হলে মৌমাছির কারণে পরাগায়ণে প্রায় ২০ শতাংশ ফলন বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছরই ৩৫-৪৫ ভাগ জমিতে মৌবাক্স স্থাপন করা হয়। সরিষার বাজার ভালো থাকায় চাষীদের ও মৌবাক্স স্থাপনকারীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে তারা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারী ২০২২ , ২৭ পৌষ ১৪২৮ ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দিন বদলের স্বপ্নে বিভোর কৃষক

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, টাঙ্গাইল

image

টাঙ্গাইল : যতদূর চোখ যায় সরিষার হলুদ ফুল ও সৌরভের স্নিগ্ধতা -সংবাদ

চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইলে সরিষার ব্যাপক ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দিচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি। ইতোমধ্যেই আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সরিষার বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষার চাষ করায় কৃষকের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।

চলতি মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৮৪০ মে.টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। মৌসুমের শুরুতে নিম্নœচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ায় সরিষা আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঝুঁকি দেখা দেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের তৎপরতা ও পরামর্শে কৃষকরা সরিষা চাষে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস পায়। ফলে ইতোমধ্যে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২ উপজেলায় মোট ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৮৪০ মে.টন সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫ হাজার ২৯০ হেক্টরে ৬ হাজার ৩৪৮ মেট্রিক টন, বাসাইলে ৪ হাজার ৮২০ হেক্টরে ৫ হাজার ৭৮৪ মে.টন, কালিহাতীতে ৩ হাজার ১৩০ হেক্টরে ৩ হাজার ৭৫৬ মে.টন, ঘাটাইলে ২ হাজার ৩৫৫ হেক্টরে ২ হাজার ৮২৬ মে.টন, নাগরপুরে ১০ হাজার ১০০ হেক্টরে ১২ হাজার ১২০ মে.টন, মির্জাপুরে ৮ হাজার ৯৫০ হেক্টরে ১০ হাজার ৭৪০ মে.টন, মধুপুরে ৪৬৫ হেক্টরে ৫৫৮ মে.টন, ভূঞাপুরে ১ হাজার ৮৩০ হেক্টরে ২ হাজার ১৯৬ মে.টন, গোপালপুরে ৩ হাজার ৬০০ হেক্টরে ৪ হাজার ৩২০ মে.টন, সখীপুরে ২ হাজার ১৪০ হেক্টরে ২ হাজার ৫৬৮ মে.টন, দেলদুয়ারে ২ হাজার ৫৫০ হেক্টরে ৩ হাজার ৬০ মে.টন, ধনবাড়ী উপজেলায় ৪৭০ হেক্টরে ৫৬৪ মে.টন।

লক্ষ্য পূরণে জেলার ১২ উপজেলায় সরিষার আবাদ বাড়ানোর লক্ষে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সার্চ কমিটির সদস্যরা হলেন- জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার, অতিরিক্ত পরিচালক (শষ্য), অতিরিক্ত পরিচালক (উদ্যান) এবং স্ব স্ব উপজেলা কৃষি অফিসার ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্চ কমিটির তৎপরতা ও প্রণোদনার ফলে হাল জরিপে ৪ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেড়েছে।

এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৩৫ হেক্টর, বাসাইলে ৫৭৫ হেক্টর, কালিহাতীতে ৪৭০ হেক্টর, ঘাটাইলে ৬৩৫ হেক্টর, নাগরপুরে ৮০ হেক্টর, মির্জাপুরে ১ হাজার ২৩৫ হেক্টর, মধুপুরে ১৩৫ হেক্টর, ভূঞাপুরে ৩০০ হেক্টর, গোপালপুরে ৩৫০ হেক্টর, সখীপুরে ৩৮ হেক্টর, দেলদুয়ারে ২৩৫ হেক্টর এবং ধনবাড়ী উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, গত দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় কৃষকরা অধিকাংশ জমিতে আমন ধান চাষ করতে পারেনি। সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, গত বছর সরিষার বাজারমূল্য আশানুরূপ হওয়া, কৃষি প্রণোদনার আওতায় জেলার ২৪ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে এক কেজি বীজ ও সার প্রদান এবং সার্চ কমিটির তৎপরতার কারণে কৃষকরা বেশি জমিতে সরিষা আবাদ করায় লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের বারি-১৪ ও বারি-১৫ এবং স্থানীয় জাতের (পেচি/টরি-৭) সরিষা জেলায় বেশি আবাদ হয়ে থাকে। এছাড়া বারি-৯, বিনা-৯/১০, সরিষা-১৫, সোনালী সরিষা (এসএস-৭৫) জাতের সরিষাও আবাদ হয়। কৃষকরা আরও জানায়, সরিষা চাষে প্রতি বিঘা জমিতে ব্যয় হয় ৪-৫ হাজার টাকা।

ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ হাজার টাকা লাভ করা যায়। সরিষা ক্ষেতে ‘জাত’ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এঁটেল মাটিতেও সরিষা চাষ হয়। এঁটেল-দোআঁশ মাটিতে সরিষার চাষ সবচেয়ে ভালো হয়। জেলার মধ্যে নাগরপুর উপজেলার জমিতে এঁটেল-দোআঁশ মাটি বেশি হওয়ায় ফলনও অনেক ভালো হয়।

কৃষকরা বলেন, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি ও প্রজাপতির আনাগোনা বেশি হলে সহজে পরাগায়ণ হয়। এতে ফলন অনেকাংশে ভালো হয়।

ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা জমিতে ৫-৬ মণ সরিষা পাওয়া যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার সরিষার বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষার চাষ করায় কৃষকের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের দিগন্তজোড়া হলুদরাঙা সরিষার রাজ্যে দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নাটোর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল ও সুন্দরবন এলাকা থেকে মৌয়াল বা মৌচাষিরা সারি সারি মৌবাক্স বসিয়ে সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে।

এখান থেকে মধু সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করা হয়।

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মধু সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করলে সরিষায় পরাগায়ণের ফলে আবাদ শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ ফলন বেশি হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, ক্ষেতের পাশে সারি সারি মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে কাজে ব্যস্ত মৌয়াল বা মৌচাষী। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেখান থেকে মধু বিক্রিও করা হচ্ছে। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে।

মধু সংগ্রহকারী ময়মনসিংহের খোরশেদ আলম, আব্দুল করিম, সাতক্ষীরার কামরুল হাসান, রহমত আলী, ফরিদপুরের হায়দার মিয়া, বাদশা মিয়া, ইন্তাজ আলী, শরিয়তপুরের বাবলু মিয়া, আজমত আলী, খায়রুল ইসলাম জানান, তারা ৬-৮ বছর যাবত মৌবাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করছেন। তাদের কারও কারও নানা নামে মৌ খামার রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে আর প্রতি বাক্সে চার থেকে সাড়ে চার কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। খুচরা ও পাইকারি দরে মধু বিক্রি করা হয়। তাদের প্রত্যেকের ৫০ থেকে ২০০টি মৌবাক্স রয়েছে।

তারা জানান, এবার সরিষার ফলন ভালো হওয়ায় টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকায় মধু আহরণও আশানুরূপ হচ্ছে। তাদের দাবি, মৌ চাষের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য মৌচাষের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং মৌচাষিদের সহজে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হলে মধু সংগ্রহ আরও ব্যাপক আকারে করা যাবে। সেই সাথে সরিষার আবাদও অনেক বেড়ে যাবে।

মগড়া ইউনিয়নের ছোটবাসালিয়া গ্রামের সরিষা চাষী কামরুল হাসান, রতন চক্রবর্তী, আসলাম আহাম্মেদ, কাজী রশিদ, নুরুজ্জামান শেখ, আলআমিন, রুবেল মিয়া, দুলাল হোসেনসহ অনেকেই জানান, এবার তারা বারি-১৪ ও বারি-১৫ জাতের সরিষা চাষ করেছেন। গতবছর বাজারে সরিষার দাম আশানুরূপ হওয়ায় অনেকেই এবার সরিষা আবাদে ঝুঁকেছেন। মৌসুমের প্রথমদিকে বৃষ্টি হলেও কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে এক কেজি বীজ ও সার পাওয়ায় তারা বৃষ্টির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছেন। এছাড়া গত বন্যায় আমন ধানের চাষ করতে না পারার ক্ষতিও তারা সরিষা আবাদের মাধ্যমে পূরণ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার জানান, টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলায় এবার ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। গত দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় আমন ধান চাষ ভালো না হওয়ায় কৃষকরা সরিষা আবাদের মাধ্যমে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করা হলে মৌমাছির কারণে পরাগায়ণে প্রায় ২০ শতাংশ ফলন বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছরই ৩৫-৪৫ ভাগ জমিতে মৌবাক্স স্থাপন করা হয়। সরিষার বাজার ভালো থাকায় চাষীদের ও মৌবাক্স স্থাপনকারীদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে তারা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।