জীবনানন্দ দাশ, অবসরের গান ও অধুনাবাদ

ওবায়েদ আকাশ

কথিত আছে, রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট নিরো রোম পুড়ে যাবার প্রাক্কালে বাঁশি (ভায়োলিন) বাজাচ্ছিলেন। একদিকে নিরো যেমন ছিলেন খুনি, নিষ্ঠুর, স্বৈরাচারী শাসক; অপরদিকে নিরো ছিলেন কথিত কবি, শিল্পী ও থিয়েটারকর্মী। শিল্পী হওয়ার জন্য গ্রিসেও নাকি তিনি এক বছর ঘোরাঘুরি করেছিলেন। আবার তিনি যখন শত্রুর আক্রমণের মুখে আত্মহত্যা করেন, তখনো বলেছিলেন, তবে কি একজন শিল্পীর মৃত্যু হচ্ছে? নিরো এতটাই একরোখা নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন যে, তিনি তার গর্ভধারিণী মা’কে হত্যা করেছিলেন, গর্ভবতী স্ত্রীকে লাথি মেরে হত্যা করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন সম্রাট নিরো নিজেই রোম নগরীতে আগুন দিয়ে বসে বসে ভায়োলিন বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহ নয় এ কারণে যে, আগুনে তার সাধের রাজপ্রাসাদটিও পুড়ে গিয়েছিলো। এবং তার দগ্ধরাজ্য পুনর্নির্মাণে তিনি বিপুল শ্রম-ভাবনা-অর্থ ব্যয় করেছিলেন। আবার রোম জ্বালিয়ে দেবার জন্য খ্রিস্টানদের অভিযুক্ত করে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের অগণিত নাগরিককে হত্যা করেছিলেন নিরো, গুলি করে ও বন্য প্রাণি লেলিয়ে দিয়ে বর্বর ও নির্মমতার চূড়ান্ত উপায়ে। এখন প্রশ্ন হলো এইসব কুলাঙ্গার, বিকৃত, খুনি, চিরধিকৃত ঘাতক, ঘৃণিত কালো আত্মার মানুষদের এভাবে শিল্প-সাহিত্যের কর্মী বলে দাবি করার বিষয়টা কতোটা যৌক্তিক? আর তারা দাবি করবেন বলেই কি তাদের বন্দুকের নলের মুখে কিংবা স্বগোত্রীয় হবার কারণে আমাদের মেনে নিতে হবে যে- তারাও কবি, তারাও শিল্পী? আমাদেরও তো একজন নির্লজ্জ শাসক নিজেকে ‘কবি’ বলে দাবি করে গেছেন। তার হাতও ছিলো মনুষ্যরক্তে রঞ্জিত। আবার অনেকে এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, রক্তচোষা দেশদ্রোহী, খুনি-ধর্ষকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তাদের দলভুক্ত হয়ে বা একাত্মতা প্রকাশ করে কবিতা লিখেছেন, লিখছেন, আবার শিল্প-সংস্কৃতির নানা শাখায় নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন। আর যাই হোক, তাদেরকে হয়তো ‘নিরো’র মতো ‘বিকৃত’, ‘ঘৃণিত’, ‘বিলাসী’ কিংবা ‘অপর স্বৈরশাসকের’ মতো ‘লোভী-স্বার্থান্ধ’ বলা য়ায়; কিন্তু ‘শিল্পী’ বা ‘কবি’ বলে এই মহতী সম্বোধনগুলোকে কলঙ্কিত করা যায় না। শিল্প বা শিল্পীর মতো মানবিক, উদার, অহিংস, অবর্ণ, শান্তিপ্রিয়, সাম্যবাদী স্রষ্টা সর্বত্র বিরল। মানুষ বা যে কোনো প্রাণির রক্তে যে হাত রঞ্জিত, তিনি শিল্পী নন, এ রক্তরঞ্জিত হাতের যারা দোসর তারা শিল্পী নন। এসবই অমানবিক, হিংস্র, খুনিদের বংশপরম্পরা। লোভী, স্বার্থান্ধ, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট প্রত্যাশী এরা। আর একথা প্রমাণের জন্য কোনো যুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। এখন, এত কথার পর এই শিশির-শিশির ভোরে ক’পঙ্ক্তি কবিতাসিক্ত হয়ে আসা যাক:

ফলন্ত মাঠের ’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান,

প্রেম আর পিপাসার গান

আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন;

ফসল- ধানের ফলে যাহাদের মন

ভ’রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যের, অবহেলা করে

গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন-

[অবসরের গান, জীবনানন্দ দাশ]

যে সাম্রাজ্য আর সিংহাসনরে অবহেলা করে সেই তো কবি, সেই তো শিল্পী। এই প্রেম আর পিপাসার গানের আচ্ছন্নতায় যে জীবন অবগাহিত সে জীবন শিল্পের, মানবতার, কল্যাণের, প্রেমের, শান্তির ও সৌন্দর্য আচ্ছন্নতার। সেখানে হিংস্রতা নেই, হত্যা নেই, রিরংসা নেই। লোভ নেই, অকল্যাণ নেই।

কবি জীবনানন্দ দাশ এখনো পর্যন্ত বাংলা কবিতার আইডল। তাঁর মতো এত বড় প্রভাবশালী কবি আর দ্বিতীয়জন নেই অন্তত বাংলা ভাষায়। তাঁর কবি জীবন কিংবা কাব্যের চর্চিত ভূমি বিচরণে আমরা বারবার বিস্মিত হই। আমরা উল্লম্ফন শিখি এবং পরম্পরা অতিক্রম করতে করতে আবার ভিন্ন এক পরম্পরায় অবগাহন কবি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ নীরব, স্থির তবু আকৃষ্ট করেন অন্য কোনো অভাবিত আসক্তিতে, মোহাচ্ছন্নতায়। এভাবে দেখতে গেলে জীবনানন্দ দাশের সম্পূর্ণ কাব্যভুবনটাই বিপুল বৈচিত্র্যে ঠাসা এক সোহাগী ফসলের মাঠ। তাতে যা কিছু ইচ্ছা রোপণ করেছেন কবি, কাব্যপাঠকের গৃহে তুলে দিয়েছেন কাক্সিক্ষত পরিচিত ফসলের ভাঁড়ার, আবার পরিচয় করিয়েছেন কত কত অজানা-অচেনা শস্যের সঙ্গে। কেবল বিস্ময় আর বিস্ময়ের জিজ্ঞাসায় পঠিত হয় জীবনানন্দ, বিস্তৃত হয় পাঠ-পরিধি।

জীবনানন্দ দাশের কিছু পরিচিত অনুষঙ্গে আমরা কিছু মুখস্থ ব্যাখ্যা থেকে এখনো উত্তীর্ণ হতে পারিনি। তাঁর মনোজাগতিক কিংবা চিন্তাকুশলতার বিকিরিত রশ্মিতে স্নিগ্ধ সাদা ভোরে যে উষ্ণতা পেয়েছি, এখনো কি সেখানেই ডুবে আছেন জীবনানন্দ পাঠক! মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও, প্রকৃতার্থে জীবনানন্দ দাশ যে বিস্ময়ের কবি, সেই ধারণাকে অতিক্রমণের চেষ্টা-নিষ্ঠতা কাক্সিক্ষতভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁর কিছু পুরনো ট্রাঙ্কভর্তি পাণ্ডুলিপি উদ্ধার, তাঁর কিছু চিঠিপত্রের খোঁজখবরের মতো ক্লারিক্যাল জব কিংবা সংগ্রাহকের বাইরে তাঁর কবিতার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে নতুনত্ব, প্রতিটি পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে যে বিস্ময়, তা মূলত অমীমাংসিত, অবিশ্লেষিত, অনাবিষ্কৃত, অনুদ্ধারিতই থেকে যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যে কারণে অন্তত ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসায় বলতে পারি, যতবার জীবনানন্দ দাশ পাঠ করি, ততবারই তিনি নতুন, ততবারই তিনি নিজেকে অন্যভাবে কাছে টেনে নেন। তাঁর বহুল পঠিত, নানা উদ্ধৃত কবিতাগুলোর মধ্যেও সারাদিন ডুবে থেকে কখনো ঘোর ভেঙে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে পারি না। কখনো যেমন পুরনো পাঠ-অভিজ্ঞতায়ই আটকে যাই, আবার কখনো কোথাও কোথাও হঠাৎ যেন উঁকি দেয় নবতর আচ্ছন্নতা।

জীবনানন্দ দাশের বহুল পঠিত একটি দীর্ঘ কবিতা ‘অবসরের গান’। কবিতাটি স্থান পেয়েছে তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গ্রন্থে। কবিতাটি ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও বহুবার পাঠ নিয়েছি। তার সম্মোহনী শক্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছি। তার যাদুকরী বিভায় প্লাবিত হয়েছি। অন্ধের মতো মেনে নিয়েছি কবির শক্তিমত্তা। কিন্তু এমন কখনো ঘটেনি যে, আলো-ছায়ার মতো কোনো কোনো পঙ্ক্তি আমারো চোখ এড়িয়ে যায়নি। জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতা পাঠাগ্রহের মতো এই কবিতাটিও আমার পাঠাগ্রহের শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে। আর কতবার যে মনে হয়েছে, এই ৫ পৃষ্ঠার একটি কবিতা দিয়ে অন্তত পাঁচ হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও যেন শেষ হবে না। এই কবিতাটি এমন একটি কবিতা, যেখানে একবার আচ্ছন্ন হয়ে সারাদিনে সেই আচ্ছন্নতা কাটাতে পারি নি। আমি জানি, আজ সকাল থেকে এই কবিতাটি নিয়ে লিখতে বসেছি, এই আচ্ছন্নতা কখন কাটবে ঠিক করে বলা দুরূহ। মনে পড়ছে, প্রকৃতিবিমুগ্ধ কবিকে একটি সকাল পেয়ে বসেছে অলসতায়: “মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় / সকাল বেলার রোদে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।”

কবি মূলত তাঁর চিরপিপাসিত হেমন্ত কিংবা কার্তিকের দিনের ভাললাগার আচ্ছন্নতায় এই কবিতাটিকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন। কিন্তু এর ভেতরে তিনি সমগ্র বিশ্বপ্রেক্ষাপট থেকে রাজনীতি ও ক্ষমতার আসক্তচেতনাকেও সংযুক্ত করেছেন। মূলত তিনি এটাতে নিমগ্ন হয়েছেন যে, এমন হেমন্তের দিনে তাঁকে পৃথিবীর আর কোনো শ্রেষ্ঠ প্রলোভনই লালায়িত করতে পারবে না। তিনি শুরু করেছেন যেমন ভোরের মাছির গানের শব্দের আলসেমি দিয়ে, তেমনি রাতের পেঁচাকেও দেখে নিচ্ছেন- যারা সব গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে রাত্রিকে মহিমান্বিত করেছে।

আসলে এ কবিতাটি নিয়ে একটু গভীরে ঢোকার অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রকৃত কবিরা যে, নন্দন নির্মাণ ও প্রাকৃতিক সারল্য থেকে সৌন্দর্যকে খুঁজে বের করে তাতেই নিমজ্জিত থাকতে পছন্দ করেন- সেটাই অন্যকে শেয়ার করা।

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে

অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে;

মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার- চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,

তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,

হেমন্তের একটি প্রারম্ভিক প্রকৃতিচিত্র এ চার পঙ্ক্তিতে আশ্রয় পেয়েছে। এরকম বর্ণনার পর তিনি পাঠককে অদ্ভুত এক আনন্দে ভাসিয়ে দেন- “রোদের নরম রোদ শিশুর গালের মতো লাল”। এরকম উপমা কেবল জীবনানন্দ দাশের মতো শক্তিমান কবিদের হৃদয়জাত হতে পারে। এবং তিনিই বলতে পারেন উপমাই কবিত্ব।

আসলে এ দীর্ঘ একটি কবিতার মূলে যে স্বদেশপ্রীতি, স্বপ্রকৃতিকে নিপুণ ও অভিনব তুলিতে অঙ্কন এবং এতো বিশাল বিপুল সৌন্দর্যের ক্যানভাসে বাংলার ঋতু-স্নিগ্ধতাকে আঁকতে আঁকতে তাঁর মধ্যে বুঁদ হয়ে যাওয়া- তাই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে। কবি কি হেমন্তের ভোরের শিশিরের ফোঁটাকে মদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, নাকি হেন্তের ফসলের ঘ্রাণ নাকি নাতিশীতোষ্ণতা কিংবা এর ভেতরে বসে মনের অগাধ প্রফুল্লতাকে মদের ফোঁটার রূপান্তর ভেবেছেন- যা কোনো গেঁয়ো কবিকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখিয়ে নেয়? যে কবিতার শেষ পৃষ্ঠা পাঠ করতে করতে লোভ জাগে না কোনো রাজা-রাজ্য-সাম্রাজ্যের?

গাছের ছায়ার তলে মদ ল’য়ে কোন্ ভাঁড় বেঁধেছিলো ছড়া।

তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;

ভুলে গিয়ে রাজ্য- জয়- সাম্রাজ্যের কথা।

এবার পৃথিবীর যাবতীয় বৈষয়িক লোভ-লালসার উর্ধে উঠে তিনি ডেকে নেবেন পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের। তাদের নিয়ে মেতে উঠবেন তিনি নৃত্যে, হেমন্ত উৎসবে :

মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে-

শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

শুধু কি তাতেই ক্ষান্ত হবেন কবি? আছে- আছে- আরো অসীম অনুষঙ্গ। আগেই বলেছি, প্রতিটি লাইন ধরে হাঁটতে গেলে মিলিয়ন মাইল হেঁটেও এ কবিতার ভ্রমণ কখনো শেষ হবে না। এটি একটি মহাকাব্যিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপটও হতে পারে। হতে পারে একটি বাঙালি প্রকৃতির মহাযাত্রার ইশতেহার। কবি সার্থক মহাকাব্যের ডিটেইল থেকে ডিটেইলে ভ্রমণ করেন। পাঠককে মুগ্ধতায় অস্থির করে তোলেন। কিন্তু তাতেও কবির ভ্রমণ শেষ হয় না। পাঠক ঘুরতে থাকে কবির পদচ্ছাপ অনুসরণ করে:

হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে

কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;

ফলন্ত ধানের গন্ধে- রঙে তার- স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের

সকলের দেহ;

রাগ কেহ করিবে না;- আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।

তবে কী হবে এই রাজ্য, রাজ্যপাট আর সাম্রাজ্যের? অন্তত কবির উপরে যে রাগ করবে না কেহ, তা কি স্পষ্ট? নাকি তার ওপরে, তাদের ওপরে রাগ করবার কেহ নাই? তবে আবার শোষকের কী হবে? এখানে অবশ্য একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, কার্তিকের মিঠে রোদে মুখ পুড়ে যাবার ব্যাপারটিকে সমালোচকগণ কি কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, নাকি ব্যাপারটি স্বতঃসিদ্ধ? এ জিজ্ঞাসা আমারো। এবং থাক অমীমাংসিত। না হয় ধরে নিলাম কবিতা রহস্যের এ এক গভীর রহস্যজাল- যা একদিন মীমাংসা খুঁজে পাবে। কার্তিকের মিঠে রোদে মুখ পুড়ে যাবার যন্ত্রণা থাকতে পারে; তা কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ নয়।

এই প্রকৃতির কাছে আমরা কবিকে যেভাবে ‘গেঁয়ো কবি’ / ‘গেঁয়ো ভাঁড়ের’ ভূমিকায় দেখি, দেখি কেবলই প্রকৃতি বন্দনায়; তখন কবিপ্রতিকৃতির যে সংসারবিবাগী রূপটি ধরা পড়ে, সেই কবিই কিন্তু সংসারের তাবৎ সৌন্দর্য নির্মাণের কারিগর। সেই কবিই শাসকের হৃদয়ে মানবতার সঙ্গীত ঢুকিয়ে দেবার প্রতিচ্ছবি। তখন রাজার রাজ্যে, প্রজার জমিনে ফসলের সমাহার দেখেন কবি, দেখেন শাসক, দেখেন দেবতা। সেই ফসলে ভরে ওঠে আমাদের মন। সুখ নেমে আসে রাজ্যে। কবি রচনা করেন সেই সদর্থ সঙ্গীত। কবি আপ্লুত হন পাকা ধানের ঘ্রাণে:

চারিদিকে ছায়া- রোদ- খুদ- কুঁড়ো- কার্তিকের ভিড়;

চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান

পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর

শরীরের ঘ্রাণ।

মহাকবি, যেনতেন কোনো বর্ণনায় তৃপ্ত নন। সামান্যমাত্র রহস্যোন্মোচনে ক্ষান্ত নন তিনি। তিনি চান গভীর থেকে গভীরে ভ্রমণের আনন্দ। প্রতি ভূমি, প্রতি টুকরো মাটি খুঁচিয়ে-খামচে তাঁর আনন্দ। সুতরাং তিনি তাঁর শেষ না দেখে ক্ষান্ত হন না। প্রকৃতার্থে ‘অধুনাবাদী’ কবি মাত্রই বড় কবি। অধুনাবাদ প্রকৃতিমুগ্ধতার, শেকড় অনুসন্ধিৎসার এক অপার বিস্ময় জগৎ। যার কোনো শেষ নেই। প্রতিটি নতুনত্বকে, প্রতিটি প্রাকৃত আবির্ভাবকে নিজের দেহে জুড়ে নেন। জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটিকে প্রকৃতার্থে ‘অধুনাবাদী কবিতা’র শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বলা যায়। অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’-এর সহযোগী সম্পাদক, অধুনাবাদের প্রবক্তা, কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন অধুনাবাদ সম্পর্কে বলেন, “পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে প্রিয় ধরিত্রীর সকল প্রজাতির টিকে থাকার অধিকার পুনর্ব্যক্ত করতে চায় অধুনাবাদ। সকল কালের সকল যুগের সাহিত্যকৃতি ও শিল্পসুকৃতিকে মানবজাতির মহামূল্যবান ঐতিহ্যসম্পদ জ্ঞান করে তা সংরক্ষণ, অধ্যয়ন, মূল্যায়ন এবং ঐগুলোকে বাণিজ্যিক পণ্যায়নের কবলমুক্ত করে সার্বজনীনভাবে সেসবের শিল্পসুষমা যাতে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করতে পারে সে বিষয়টির অগ্রগণ্যতা জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে চায় অধুনাবাদ।” [প্রবন্ধ : “শালুক ও অধুনাবাদ : চিন্তনের যৌক্তিক কাঠামো এবং শ্রেয়বোধের উজ্জীবন”]

আবার আলোচ্য প্রবন্ধকারের “শালুক ও অধুনাবাদ : প্রকৃতিমুগ্ধ, প্রথাহীনতার নির্ভার অসীমতা” রচনায় বলা হয়েছে: “প্রকৃতি থেকে শেখা মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে আশ্রয় করে প্রকৃতিতেই সমন্বিত হতে চায় অধুনাবাদ। তাই তার প্রধান কাজ হয়ে পড়ে, যে প্রকৃতিতে সে বড় হয়েছে, তার সমগ্র সৃষ্টিশীলতায় প্রবাহিত হোক তার সৃষ্টির ধারা। এভাবেই গড়ে উঠুক তার বিশ্ব। বরং বিশ্বই একদিন ঝুঁকে পড়ুক শিল্পীর প্রকৃতিমুগ্ধতায়।”

একদিকে মাহফুজ আল-হোসেন যখন বলছেন মানবজাতির পরিবেশ প্রতিবেশ ও ঐতিহ্যসম্পদের কথা, অপরদিকে পরবর্তী প্রবন্ধে বলা হচ্ছে প্রকৃতিমুগ্ধতার ভিতর দিয়ে প্রকৃতিতেই সমন্বিত হওয়ার কথা একজন স্রষ্টার, একজন কবির, শিল্পীর বা নবচিন্তকের।

অধুনাবাদী ধারণা সৃষ্টির আগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু তিনি এতোটাই দূরের চিন্তা করতে পারতেন, তাঁর ভাবনার প্রাগ্রসরতা এতোটাই গভীর ছিলো যে, আজকের অধুনাবাদী চিন্তাকেও তাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল। এটা কবির দূরদর্শিতা। আমি সন্দেহাতীতভাবেই বলতে চাই যে, ‘অবসরের গান’ কবিতাটি সার্থক, চরমভাবে উত্তীর্ণ ‘অধুনাবাদী’ কবিতা। অধুনাবাদ এইভাবে প্রকৃতিমুগ্ধতায় ডুবে যেতে যেতে বাংলা প্রকৃতির সৌন্দর্য পান করতে করতে হারিয়ে যেতে চায়। আর পিছে পড়ে থাকে, লোভ-লালসা-রিরংসা-হিংসা-রাজ্য-ক্ষমতা। জীবনানন্দ দাশ ‘অবসরের গান’ কবিতায় যে দীর্ঘ ভ্রমণের মানচিত্র অঙ্কন করেছেন, তা একজন প্রকৃত কবির বিশ্ব মানচিত্র। তা সারা বিশে^র কবির মানচিত্র। যাকে আপাত দৃষ্টিতে শুধু বাংলার হেমন্তের মানচিত্র বলে মনে হয়। এ ভ্রমণ অচেনা-অজানা ট্রেন ভ্রমণ যেমন মনে হয়, তেমনি তার অভিজ্ঞতারও পাঠ-পরাপাঠ। কবি ভ্রমণ করেন আর গভীরের তাড়না তাঁকে দুচোখ জুড়িয়ে দেয় মুগ্ধতায়:

আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এ-পারে

বিয়োবার দেরি নাই- রূপ ঝ’রে পড়ে তার-

শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে;

আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,

মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ- ভাঁড়ারের রস।

আবার উল্লম্ফন করেন কবি। শীত এসে যাবে তাই তার হেমন্তের সৌন্দর্য নষ্ট হবার বেদনায় সিক্ত হন আগেই। কিন্তু তিনি যে পরিব্রাজক, যে পর্যটক, যে তীরন্দাজ বাংলার মুগ্ধ প্রকৃতির, তাঁকে তাই বাংলা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, শ্রেষ্ঠ আখ্যানকারের আখ্যা দেয়া যায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যায়, তিনিই প্রকৃত কবি, যিনি নিজের শেকড় ও প্রাকৃতিক ঐশ^র্যকে ধারণ করে ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে গড়ে তোলেন তাঁর কাব্যবিশ^। জীবনানন্দ দাশ মূলত তাই করেছেন। একটি সার্থক কবিতার জন্য সারা বিশে^র তাবৎ প্রকৃতিকে স্পর্শ করার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলার ঘরে বসে তুষারপাত দেখার প্রয়োজন পড়ে না। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কিংবা গাছের ডাল থেকে পেঁচা উড়ে যাবার শব্দ কিংবা ভোরের কুয়াশায় শিশির পতনের মৃদু ধ্বনি দিয়েও একটি সার্থক বিশ^মানের কবিতা রচনা সম্ভব। এবং তার অকাট্য উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের কবিতা।

কালে মহাকালে এমন কবিরা আসেন, একদিন তাঁর জীবনাবসানে বিলীন হয়ে যান। মিশে যান মাটিতে, অন্ধকারে; কিন্তু “যোদ্ধা- জয়ী- বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে- পাশাপাশি-/জিতিয়া রয়েছে আজ তাহাদের খুলির অট্টহাসি!” কবি মনে করেন তাঁরা হারিয়ে গেলেও তাদেরই ফলন্ত দেহ থেকে আবার নতুন বৃক্ষের পাতা জন্ম লয়। গাছে গাছে ফুল ফোটে, পৃথিবী ভরিয়া যায় ফসলের বিপুল সমারোহে। একথা কবির নিজের নয়। একথা বলবে এই পৃথিবীর প্রাণিজগতের অগণিত বাসিন্দা:

তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই ক্ষেতের ফসল;

অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা- জানে তাহা

নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল।

শুধুই প্রকৃতিকে অবলম্বন করে, শুধুই নৈসর্গিক অনিবার্যতাকে প্রশ্রয় দিয়ে এমন অনন্য কাব্য রচনার জন্য বাংলার প্রকৃতির অপরূপতা জীবনানন্দকে ঋণী করেছে সন্দেহ নাই। সন্দেহ নাই, এই বাংলার হেমন্ত-প্রকৃতিও ধন্য হয়েছে জীবনানন্দ কাব্যে।

জীবনানন্দ দাশ আবার উচ্চারণ করেন এক জীবনের হিসাব নিকাশ। সেখানেও প্রকৃতি পায় শ্রেষ্ঠত্বের আশ্রয়। কবি যখন প্রতিভাবিদ্ধ হয়ে, কালবিদ্ধ হয়ে, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ হয়ে কোনো একটি ক্ষণকে বিবেচনায় নিয়ে বসেন- তখন খনিশ্রমিকের মতোই তুলে আনেন তার মণিমুক্তা। জীবনানন্দ দাশ হেমন্ত-কার্তিকের সেই সৌন্দর্য ও পিপাসা আবিষ্কার করেছেন “অবসরের গান” কবিতায়। সেখানে তিনি এতো বেশি আসক্তিতে ডুবেছেন যে, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তাঁকে আর সেখান থেকে ফেরানো সম্ভব নয়:

শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধ’রে

আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে

দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন;

অগাধ ধানের রসে আমাদের মন

আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি- পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন।

কী অসামান্য এক কবিপ্রাণ, যিনি নিসর্গরে, প্রকৃতিরে, তোমারে, আমারে, তাহারে প্রবল সম্মোহনীতে নিয়ে যাবেন গভীরতর নিসর্গ আসক্ততায়। যেখান থেকে মুগ্ধ না হয়ে ফেরার কোনো পথ থাকে না।

স্বভাব উচ্ছ্বাসে, ব্যক্তিগত কমিটমেন্টকে আশ্রয় করে, দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ করে উপহার দেন আরো এক দুঃসাহসী কবির উচ্চারণ:

জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্খানে-

কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়;

আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং;

দামামা থামায়ে ফেল- পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।

এমন করে রাজ্য আর সাম্রাজ্যের ভণ্ডামিকে অস্বীকার করে বলেন, “এখানে নাহিকো কাজ- উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা।/এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা।”

এ কী কথা শোনালেন কবি! আমরা যে জীবনানন্দ দাশকে চিনি- আহত, চিরে যাওয়া, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া, না পাওয়া, অতৃপ্ত আর অবহেলার- সেই জীবনানন্দকে কিন্তু নির্ভার অবমুক্ত করে দিলো বাংলার ঋতুপরিক্রমা, হেমন্ত স্নিগ্ধতা। স্বগোতোক্তি করলেন উদ্যম প্রচুর, তবু ফুরিয়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। আমরা স্নিগ্ধ হই, আমরাও ভাবনামুক্ত হই, উত্তেজনাদমিত হই প্রিয় কবির সঙ্গে সঙ্গে, তার উত্তেজনা প্রশমনে।

সেই শুরু করেছিলাম লেখাটি সকালের মাছির গানের মতো অলস সময়ের কথা বলে আবার শেষ করবো দিন শেষে বিপুল ভ্রমণ শেষ, অগাধ প্রকৃতিমুগ্ধতা পান করে কবির পঙ্ক্তি দিয়ে। এমন পৃথিবী ছেড়ে কি কবি সত্যি অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিলেন? না চাননি। রয়ে যেতে চেয়িছিলেন বাংলার পারে। আবার চলে গেলেও বারবার ফিরে ফিরে আসতে চেয়েছেন দোয়েল শালিখ ফিঙে মাছরাঙার মুখর ডানার ভিড়ে। কেননা পৃথিবীরে যে তার মায়াবীর নদীর পারের দেশ মনে হয়।

অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,

পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়;

image

জীবনানন্দ দাশ / জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ প্রতিকৃতি : এম. এ কুদ্দুস

আরও খবর
স্বাতন্ত্র্যের মুদ্রাদোষ
নির্বাক লাবণ্য ল্যান্সডাউন রোড
সাময়িকী কবিতা
শিকিবু
ফেরা না ফেরা

বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২ , ২৯ পৌষ ১৪২৮ ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

জীবনানন্দ দাশ, অবসরের গান ও অধুনাবাদ

ওবায়েদ আকাশ

image

জীবনানন্দ দাশ / জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ প্রতিকৃতি : এম. এ কুদ্দুস

কথিত আছে, রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট নিরো রোম পুড়ে যাবার প্রাক্কালে বাঁশি (ভায়োলিন) বাজাচ্ছিলেন। একদিকে নিরো যেমন ছিলেন খুনি, নিষ্ঠুর, স্বৈরাচারী শাসক; অপরদিকে নিরো ছিলেন কথিত কবি, শিল্পী ও থিয়েটারকর্মী। শিল্পী হওয়ার জন্য গ্রিসেও নাকি তিনি এক বছর ঘোরাঘুরি করেছিলেন। আবার তিনি যখন শত্রুর আক্রমণের মুখে আত্মহত্যা করেন, তখনো বলেছিলেন, তবে কি একজন শিল্পীর মৃত্যু হচ্ছে? নিরো এতটাই একরোখা নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন যে, তিনি তার গর্ভধারিণী মা’কে হত্যা করেছিলেন, গর্ভবতী স্ত্রীকে লাথি মেরে হত্যা করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন সম্রাট নিরো নিজেই রোম নগরীতে আগুন দিয়ে বসে বসে ভায়োলিন বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহ নয় এ কারণে যে, আগুনে তার সাধের রাজপ্রাসাদটিও পুড়ে গিয়েছিলো। এবং তার দগ্ধরাজ্য পুনর্নির্মাণে তিনি বিপুল শ্রম-ভাবনা-অর্থ ব্যয় করেছিলেন। আবার রোম জ্বালিয়ে দেবার জন্য খ্রিস্টানদের অভিযুক্ত করে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের অগণিত নাগরিককে হত্যা করেছিলেন নিরো, গুলি করে ও বন্য প্রাণি লেলিয়ে দিয়ে বর্বর ও নির্মমতার চূড়ান্ত উপায়ে। এখন প্রশ্ন হলো এইসব কুলাঙ্গার, বিকৃত, খুনি, চিরধিকৃত ঘাতক, ঘৃণিত কালো আত্মার মানুষদের এভাবে শিল্প-সাহিত্যের কর্মী বলে দাবি করার বিষয়টা কতোটা যৌক্তিক? আর তারা দাবি করবেন বলেই কি তাদের বন্দুকের নলের মুখে কিংবা স্বগোত্রীয় হবার কারণে আমাদের মেনে নিতে হবে যে- তারাও কবি, তারাও শিল্পী? আমাদেরও তো একজন নির্লজ্জ শাসক নিজেকে ‘কবি’ বলে দাবি করে গেছেন। তার হাতও ছিলো মনুষ্যরক্তে রঞ্জিত। আবার অনেকে এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, রক্তচোষা দেশদ্রোহী, খুনি-ধর্ষকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তাদের দলভুক্ত হয়ে বা একাত্মতা প্রকাশ করে কবিতা লিখেছেন, লিখছেন, আবার শিল্প-সংস্কৃতির নানা শাখায় নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন। আর যাই হোক, তাদেরকে হয়তো ‘নিরো’র মতো ‘বিকৃত’, ‘ঘৃণিত’, ‘বিলাসী’ কিংবা ‘অপর স্বৈরশাসকের’ মতো ‘লোভী-স্বার্থান্ধ’ বলা য়ায়; কিন্তু ‘শিল্পী’ বা ‘কবি’ বলে এই মহতী সম্বোধনগুলোকে কলঙ্কিত করা যায় না। শিল্প বা শিল্পীর মতো মানবিক, উদার, অহিংস, অবর্ণ, শান্তিপ্রিয়, সাম্যবাদী স্রষ্টা সর্বত্র বিরল। মানুষ বা যে কোনো প্রাণির রক্তে যে হাত রঞ্জিত, তিনি শিল্পী নন, এ রক্তরঞ্জিত হাতের যারা দোসর তারা শিল্পী নন। এসবই অমানবিক, হিংস্র, খুনিদের বংশপরম্পরা। লোভী, স্বার্থান্ধ, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট প্রত্যাশী এরা। আর একথা প্রমাণের জন্য কোনো যুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। এখন, এত কথার পর এই শিশির-শিশির ভোরে ক’পঙ্ক্তি কবিতাসিক্ত হয়ে আসা যাক:

ফলন্ত মাঠের ’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান,

প্রেম আর পিপাসার গান

আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন;

ফসল- ধানের ফলে যাহাদের মন

ভ’রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যের, অবহেলা করে

গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন-

[অবসরের গান, জীবনানন্দ দাশ]

যে সাম্রাজ্য আর সিংহাসনরে অবহেলা করে সেই তো কবি, সেই তো শিল্পী। এই প্রেম আর পিপাসার গানের আচ্ছন্নতায় যে জীবন অবগাহিত সে জীবন শিল্পের, মানবতার, কল্যাণের, প্রেমের, শান্তির ও সৌন্দর্য আচ্ছন্নতার। সেখানে হিংস্রতা নেই, হত্যা নেই, রিরংসা নেই। লোভ নেই, অকল্যাণ নেই।

কবি জীবনানন্দ দাশ এখনো পর্যন্ত বাংলা কবিতার আইডল। তাঁর মতো এত বড় প্রভাবশালী কবি আর দ্বিতীয়জন নেই অন্তত বাংলা ভাষায়। তাঁর কবি জীবন কিংবা কাব্যের চর্চিত ভূমি বিচরণে আমরা বারবার বিস্মিত হই। আমরা উল্লম্ফন শিখি এবং পরম্পরা অতিক্রম করতে করতে আবার ভিন্ন এক পরম্পরায় অবগাহন কবি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ নীরব, স্থির তবু আকৃষ্ট করেন অন্য কোনো অভাবিত আসক্তিতে, মোহাচ্ছন্নতায়। এভাবে দেখতে গেলে জীবনানন্দ দাশের সম্পূর্ণ কাব্যভুবনটাই বিপুল বৈচিত্র্যে ঠাসা এক সোহাগী ফসলের মাঠ। তাতে যা কিছু ইচ্ছা রোপণ করেছেন কবি, কাব্যপাঠকের গৃহে তুলে দিয়েছেন কাক্সিক্ষত পরিচিত ফসলের ভাঁড়ার, আবার পরিচয় করিয়েছেন কত কত অজানা-অচেনা শস্যের সঙ্গে। কেবল বিস্ময় আর বিস্ময়ের জিজ্ঞাসায় পঠিত হয় জীবনানন্দ, বিস্তৃত হয় পাঠ-পরিধি।

জীবনানন্দ দাশের কিছু পরিচিত অনুষঙ্গে আমরা কিছু মুখস্থ ব্যাখ্যা থেকে এখনো উত্তীর্ণ হতে পারিনি। তাঁর মনোজাগতিক কিংবা চিন্তাকুশলতার বিকিরিত রশ্মিতে স্নিগ্ধ সাদা ভোরে যে উষ্ণতা পেয়েছি, এখনো কি সেখানেই ডুবে আছেন জীবনানন্দ পাঠক! মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও, প্রকৃতার্থে জীবনানন্দ দাশ যে বিস্ময়ের কবি, সেই ধারণাকে অতিক্রমণের চেষ্টা-নিষ্ঠতা কাক্সিক্ষতভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। তাঁর কিছু পুরনো ট্রাঙ্কভর্তি পাণ্ডুলিপি উদ্ধার, তাঁর কিছু চিঠিপত্রের খোঁজখবরের মতো ক্লারিক্যাল জব কিংবা সংগ্রাহকের বাইরে তাঁর কবিতার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে নতুনত্ব, প্রতিটি পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে যে বিস্ময়, তা মূলত অমীমাংসিত, অবিশ্লেষিত, অনাবিষ্কৃত, অনুদ্ধারিতই থেকে যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যে কারণে অন্তত ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসায় বলতে পারি, যতবার জীবনানন্দ দাশ পাঠ করি, ততবারই তিনি নতুন, ততবারই তিনি নিজেকে অন্যভাবে কাছে টেনে নেন। তাঁর বহুল পঠিত, নানা উদ্ধৃত কবিতাগুলোর মধ্যেও সারাদিন ডুবে থেকে কখনো ঘোর ভেঙে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে পারি না। কখনো যেমন পুরনো পাঠ-অভিজ্ঞতায়ই আটকে যাই, আবার কখনো কোথাও কোথাও হঠাৎ যেন উঁকি দেয় নবতর আচ্ছন্নতা।

জীবনানন্দ দাশের বহুল পঠিত একটি দীর্ঘ কবিতা ‘অবসরের গান’। কবিতাটি স্থান পেয়েছে তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গ্রন্থে। কবিতাটি ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও বহুবার পাঠ নিয়েছি। তার সম্মোহনী শক্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছি। তার যাদুকরী বিভায় প্লাবিত হয়েছি। অন্ধের মতো মেনে নিয়েছি কবির শক্তিমত্তা। কিন্তু এমন কখনো ঘটেনি যে, আলো-ছায়ার মতো কোনো কোনো পঙ্ক্তি আমারো চোখ এড়িয়ে যায়নি। জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতা পাঠাগ্রহের মতো এই কবিতাটিও আমার পাঠাগ্রহের শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে। আর কতবার যে মনে হয়েছে, এই ৫ পৃষ্ঠার একটি কবিতা দিয়ে অন্তত পাঁচ হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও যেন শেষ হবে না। এই কবিতাটি এমন একটি কবিতা, যেখানে একবার আচ্ছন্ন হয়ে সারাদিনে সেই আচ্ছন্নতা কাটাতে পারি নি। আমি জানি, আজ সকাল থেকে এই কবিতাটি নিয়ে লিখতে বসেছি, এই আচ্ছন্নতা কখন কাটবে ঠিক করে বলা দুরূহ। মনে পড়ছে, প্রকৃতিবিমুগ্ধ কবিকে একটি সকাল পেয়ে বসেছে অলসতায়: “মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় / সকাল বেলার রোদে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।”

কবি মূলত তাঁর চিরপিপাসিত হেমন্ত কিংবা কার্তিকের দিনের ভাললাগার আচ্ছন্নতায় এই কবিতাটিকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন। কিন্তু এর ভেতরে তিনি সমগ্র বিশ্বপ্রেক্ষাপট থেকে রাজনীতি ও ক্ষমতার আসক্তচেতনাকেও সংযুক্ত করেছেন। মূলত তিনি এটাতে নিমগ্ন হয়েছেন যে, এমন হেমন্তের দিনে তাঁকে পৃথিবীর আর কোনো শ্রেষ্ঠ প্রলোভনই লালায়িত করতে পারবে না। তিনি শুরু করেছেন যেমন ভোরের মাছির গানের শব্দের আলসেমি দিয়ে, তেমনি রাতের পেঁচাকেও দেখে নিচ্ছেন- যারা সব গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে রাত্রিকে মহিমান্বিত করেছে।

আসলে এ কবিতাটি নিয়ে একটু গভীরে ঢোকার অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রকৃত কবিরা যে, নন্দন নির্মাণ ও প্রাকৃতিক সারল্য থেকে সৌন্দর্যকে খুঁজে বের করে তাতেই নিমজ্জিত থাকতে পছন্দ করেন- সেটাই অন্যকে শেয়ার করা।

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে

অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের খেতে;

মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার- চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,

তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,

হেমন্তের একটি প্রারম্ভিক প্রকৃতিচিত্র এ চার পঙ্ক্তিতে আশ্রয় পেয়েছে। এরকম বর্ণনার পর তিনি পাঠককে অদ্ভুত এক আনন্দে ভাসিয়ে দেন- “রোদের নরম রোদ শিশুর গালের মতো লাল”। এরকম উপমা কেবল জীবনানন্দ দাশের মতো শক্তিমান কবিদের হৃদয়জাত হতে পারে। এবং তিনিই বলতে পারেন উপমাই কবিত্ব।

আসলে এ দীর্ঘ একটি কবিতার মূলে যে স্বদেশপ্রীতি, স্বপ্রকৃতিকে নিপুণ ও অভিনব তুলিতে অঙ্কন এবং এতো বিশাল বিপুল সৌন্দর্যের ক্যানভাসে বাংলার ঋতু-স্নিগ্ধতাকে আঁকতে আঁকতে তাঁর মধ্যে বুঁদ হয়ে যাওয়া- তাই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে। কবি কি হেমন্তের ভোরের শিশিরের ফোঁটাকে মদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, নাকি হেন্তের ফসলের ঘ্রাণ নাকি নাতিশীতোষ্ণতা কিংবা এর ভেতরে বসে মনের অগাধ প্রফুল্লতাকে মদের ফোঁটার রূপান্তর ভেবেছেন- যা কোনো গেঁয়ো কবিকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখিয়ে নেয়? যে কবিতার শেষ পৃষ্ঠা পাঠ করতে করতে লোভ জাগে না কোনো রাজা-রাজ্য-সাম্রাজ্যের?

গাছের ছায়ার তলে মদ ল’য়ে কোন্ ভাঁড় বেঁধেছিলো ছড়া।

তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;

ভুলে গিয়ে রাজ্য- জয়- সাম্রাজ্যের কথা।

এবার পৃথিবীর যাবতীয় বৈষয়িক লোভ-লালসার উর্ধে উঠে তিনি ডেকে নেবেন পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের। তাদের নিয়ে মেতে উঠবেন তিনি নৃত্যে, হেমন্ত উৎসবে :

মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে-

শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

শুধু কি তাতেই ক্ষান্ত হবেন কবি? আছে- আছে- আরো অসীম অনুষঙ্গ। আগেই বলেছি, প্রতিটি লাইন ধরে হাঁটতে গেলে মিলিয়ন মাইল হেঁটেও এ কবিতার ভ্রমণ কখনো শেষ হবে না। এটি একটি মহাকাব্যিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপটও হতে পারে। হতে পারে একটি বাঙালি প্রকৃতির মহাযাত্রার ইশতেহার। কবি সার্থক মহাকাব্যের ডিটেইল থেকে ডিটেইলে ভ্রমণ করেন। পাঠককে মুগ্ধতায় অস্থির করে তোলেন। কিন্তু তাতেও কবির ভ্রমণ শেষ হয় না। পাঠক ঘুরতে থাকে কবির পদচ্ছাপ অনুসরণ করে:

হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে

কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;

ফলন্ত ধানের গন্ধে- রঙে তার- স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের

সকলের দেহ;

রাগ কেহ করিবে না;- আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।

তবে কী হবে এই রাজ্য, রাজ্যপাট আর সাম্রাজ্যের? অন্তত কবির উপরে যে রাগ করবে না কেহ, তা কি স্পষ্ট? নাকি তার ওপরে, তাদের ওপরে রাগ করবার কেহ নাই? তবে আবার শোষকের কী হবে? এখানে অবশ্য একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, কার্তিকের মিঠে রোদে মুখ পুড়ে যাবার ব্যাপারটিকে সমালোচকগণ কি কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, নাকি ব্যাপারটি স্বতঃসিদ্ধ? এ জিজ্ঞাসা আমারো। এবং থাক অমীমাংসিত। না হয় ধরে নিলাম কবিতা রহস্যের এ এক গভীর রহস্যজাল- যা একদিন মীমাংসা খুঁজে পাবে। কার্তিকের মিঠে রোদে মুখ পুড়ে যাবার যন্ত্রণা থাকতে পারে; তা কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ নয়।

এই প্রকৃতির কাছে আমরা কবিকে যেভাবে ‘গেঁয়ো কবি’ / ‘গেঁয়ো ভাঁড়ের’ ভূমিকায় দেখি, দেখি কেবলই প্রকৃতি বন্দনায়; তখন কবিপ্রতিকৃতির যে সংসারবিবাগী রূপটি ধরা পড়ে, সেই কবিই কিন্তু সংসারের তাবৎ সৌন্দর্য নির্মাণের কারিগর। সেই কবিই শাসকের হৃদয়ে মানবতার সঙ্গীত ঢুকিয়ে দেবার প্রতিচ্ছবি। তখন রাজার রাজ্যে, প্রজার জমিনে ফসলের সমাহার দেখেন কবি, দেখেন শাসক, দেখেন দেবতা। সেই ফসলে ভরে ওঠে আমাদের মন। সুখ নেমে আসে রাজ্যে। কবি রচনা করেন সেই সদর্থ সঙ্গীত। কবি আপ্লুত হন পাকা ধানের ঘ্রাণে:

চারিদিকে ছায়া- রোদ- খুদ- কুঁড়ো- কার্তিকের ভিড়;

চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান

পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর

শরীরের ঘ্রাণ।

মহাকবি, যেনতেন কোনো বর্ণনায় তৃপ্ত নন। সামান্যমাত্র রহস্যোন্মোচনে ক্ষান্ত নন তিনি। তিনি চান গভীর থেকে গভীরে ভ্রমণের আনন্দ। প্রতি ভূমি, প্রতি টুকরো মাটি খুঁচিয়ে-খামচে তাঁর আনন্দ। সুতরাং তিনি তাঁর শেষ না দেখে ক্ষান্ত হন না। প্রকৃতার্থে ‘অধুনাবাদী’ কবি মাত্রই বড় কবি। অধুনাবাদ প্রকৃতিমুগ্ধতার, শেকড় অনুসন্ধিৎসার এক অপার বিস্ময় জগৎ। যার কোনো শেষ নেই। প্রতিটি নতুনত্বকে, প্রতিটি প্রাকৃত আবির্ভাবকে নিজের দেহে জুড়ে নেন। জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটিকে প্রকৃতার্থে ‘অধুনাবাদী কবিতা’র শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বলা যায়। অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’-এর সহযোগী সম্পাদক, অধুনাবাদের প্রবক্তা, কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক মাহফুজ আল-হোসেন অধুনাবাদ সম্পর্কে বলেন, “পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে প্রিয় ধরিত্রীর সকল প্রজাতির টিকে থাকার অধিকার পুনর্ব্যক্ত করতে চায় অধুনাবাদ। সকল কালের সকল যুগের সাহিত্যকৃতি ও শিল্পসুকৃতিকে মানবজাতির মহামূল্যবান ঐতিহ্যসম্পদ জ্ঞান করে তা সংরক্ষণ, অধ্যয়ন, মূল্যায়ন এবং ঐগুলোকে বাণিজ্যিক পণ্যায়নের কবলমুক্ত করে সার্বজনীনভাবে সেসবের শিল্পসুষমা যাতে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করতে পারে সে বিষয়টির অগ্রগণ্যতা জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে চায় অধুনাবাদ।” [প্রবন্ধ : “শালুক ও অধুনাবাদ : চিন্তনের যৌক্তিক কাঠামো এবং শ্রেয়বোধের উজ্জীবন”]

আবার আলোচ্য প্রবন্ধকারের “শালুক ও অধুনাবাদ : প্রকৃতিমুগ্ধ, প্রথাহীনতার নির্ভার অসীমতা” রচনায় বলা হয়েছে: “প্রকৃতি থেকে শেখা মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে আশ্রয় করে প্রকৃতিতেই সমন্বিত হতে চায় অধুনাবাদ। তাই তার প্রধান কাজ হয়ে পড়ে, যে প্রকৃতিতে সে বড় হয়েছে, তার সমগ্র সৃষ্টিশীলতায় প্রবাহিত হোক তার সৃষ্টির ধারা। এভাবেই গড়ে উঠুক তার বিশ্ব। বরং বিশ্বই একদিন ঝুঁকে পড়ুক শিল্পীর প্রকৃতিমুগ্ধতায়।”

একদিকে মাহফুজ আল-হোসেন যখন বলছেন মানবজাতির পরিবেশ প্রতিবেশ ও ঐতিহ্যসম্পদের কথা, অপরদিকে পরবর্তী প্রবন্ধে বলা হচ্ছে প্রকৃতিমুগ্ধতার ভিতর দিয়ে প্রকৃতিতেই সমন্বিত হওয়ার কথা একজন স্রষ্টার, একজন কবির, শিল্পীর বা নবচিন্তকের।

অধুনাবাদী ধারণা সৃষ্টির আগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু তিনি এতোটাই দূরের চিন্তা করতে পারতেন, তাঁর ভাবনার প্রাগ্রসরতা এতোটাই গভীর ছিলো যে, আজকের অধুনাবাদী চিন্তাকেও তাঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল। এটা কবির দূরদর্শিতা। আমি সন্দেহাতীতভাবেই বলতে চাই যে, ‘অবসরের গান’ কবিতাটি সার্থক, চরমভাবে উত্তীর্ণ ‘অধুনাবাদী’ কবিতা। অধুনাবাদ এইভাবে প্রকৃতিমুগ্ধতায় ডুবে যেতে যেতে বাংলা প্রকৃতির সৌন্দর্য পান করতে করতে হারিয়ে যেতে চায়। আর পিছে পড়ে থাকে, লোভ-লালসা-রিরংসা-হিংসা-রাজ্য-ক্ষমতা। জীবনানন্দ দাশ ‘অবসরের গান’ কবিতায় যে দীর্ঘ ভ্রমণের মানচিত্র অঙ্কন করেছেন, তা একজন প্রকৃত কবির বিশ্ব মানচিত্র। তা সারা বিশে^র কবির মানচিত্র। যাকে আপাত দৃষ্টিতে শুধু বাংলার হেমন্তের মানচিত্র বলে মনে হয়। এ ভ্রমণ অচেনা-অজানা ট্রেন ভ্রমণ যেমন মনে হয়, তেমনি তার অভিজ্ঞতারও পাঠ-পরাপাঠ। কবি ভ্রমণ করেন আর গভীরের তাড়না তাঁকে দুচোখ জুড়িয়ে দেয় মুগ্ধতায়:

আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এ-পারে

বিয়োবার দেরি নাই- রূপ ঝ’রে পড়ে তার-

শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে;

আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,

মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ- ভাঁড়ারের রস।

আবার উল্লম্ফন করেন কবি। শীত এসে যাবে তাই তার হেমন্তের সৌন্দর্য নষ্ট হবার বেদনায় সিক্ত হন আগেই। কিন্তু তিনি যে পরিব্রাজক, যে পর্যটক, যে তীরন্দাজ বাংলার মুগ্ধ প্রকৃতির, তাঁকে তাই বাংলা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, শ্রেষ্ঠ আখ্যানকারের আখ্যা দেয়া যায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যায়, তিনিই প্রকৃত কবি, যিনি নিজের শেকড় ও প্রাকৃতিক ঐশ^র্যকে ধারণ করে ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে গড়ে তোলেন তাঁর কাব্যবিশ^। জীবনানন্দ দাশ মূলত তাই করেছেন। একটি সার্থক কবিতার জন্য সারা বিশে^র তাবৎ প্রকৃতিকে স্পর্শ করার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলার ঘরে বসে তুষারপাত দেখার প্রয়োজন পড়ে না। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কিংবা গাছের ডাল থেকে পেঁচা উড়ে যাবার শব্দ কিংবা ভোরের কুয়াশায় শিশির পতনের মৃদু ধ্বনি দিয়েও একটি সার্থক বিশ^মানের কবিতা রচনা সম্ভব। এবং তার অকাট্য উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের কবিতা।

কালে মহাকালে এমন কবিরা আসেন, একদিন তাঁর জীবনাবসানে বিলীন হয়ে যান। মিশে যান মাটিতে, অন্ধকারে; কিন্তু “যোদ্ধা- জয়ী- বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে- পাশাপাশি-/জিতিয়া রয়েছে আজ তাহাদের খুলির অট্টহাসি!” কবি মনে করেন তাঁরা হারিয়ে গেলেও তাদেরই ফলন্ত দেহ থেকে আবার নতুন বৃক্ষের পাতা জন্ম লয়। গাছে গাছে ফুল ফোটে, পৃথিবী ভরিয়া যায় ফসলের বিপুল সমারোহে। একথা কবির নিজের নয়। একথা বলবে এই পৃথিবীর প্রাণিজগতের অগণিত বাসিন্দা:

তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই ক্ষেতের ফসল;

অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা- জানে তাহা

নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল।

শুধুই প্রকৃতিকে অবলম্বন করে, শুধুই নৈসর্গিক অনিবার্যতাকে প্রশ্রয় দিয়ে এমন অনন্য কাব্য রচনার জন্য বাংলার প্রকৃতির অপরূপতা জীবনানন্দকে ঋণী করেছে সন্দেহ নাই। সন্দেহ নাই, এই বাংলার হেমন্ত-প্রকৃতিও ধন্য হয়েছে জীবনানন্দ কাব্যে।

জীবনানন্দ দাশ আবার উচ্চারণ করেন এক জীবনের হিসাব নিকাশ। সেখানেও প্রকৃতি পায় শ্রেষ্ঠত্বের আশ্রয়। কবি যখন প্রতিভাবিদ্ধ হয়ে, কালবিদ্ধ হয়ে, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ হয়ে কোনো একটি ক্ষণকে বিবেচনায় নিয়ে বসেন- তখন খনিশ্রমিকের মতোই তুলে আনেন তার মণিমুক্তা। জীবনানন্দ দাশ হেমন্ত-কার্তিকের সেই সৌন্দর্য ও পিপাসা আবিষ্কার করেছেন “অবসরের গান” কবিতায়। সেখানে তিনি এতো বেশি আসক্তিতে ডুবেছেন যে, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তাঁকে আর সেখান থেকে ফেরানো সম্ভব নয়:

শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভেজা পথ ধ’রে

আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে

দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন;

অগাধ ধানের রসে আমাদের মন

আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি- পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন।

কী অসামান্য এক কবিপ্রাণ, যিনি নিসর্গরে, প্রকৃতিরে, তোমারে, আমারে, তাহারে প্রবল সম্মোহনীতে নিয়ে যাবেন গভীরতর নিসর্গ আসক্ততায়। যেখান থেকে মুগ্ধ না হয়ে ফেরার কোনো পথ থাকে না।

স্বভাব উচ্ছ্বাসে, ব্যক্তিগত কমিটমেন্টকে আশ্রয় করে, দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ করে উপহার দেন আরো এক দুঃসাহসী কবির উচ্চারণ:

জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্খানে-

কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়;

আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং;

দামামা থামায়ে ফেল- পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।

এমন করে রাজ্য আর সাম্রাজ্যের ভণ্ডামিকে অস্বীকার করে বলেন, “এখানে নাহিকো কাজ- উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা।/এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা।”

এ কী কথা শোনালেন কবি! আমরা যে জীবনানন্দ দাশকে চিনি- আহত, চিরে যাওয়া, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া, না পাওয়া, অতৃপ্ত আর অবহেলার- সেই জীবনানন্দকে কিন্তু নির্ভার অবমুক্ত করে দিলো বাংলার ঋতুপরিক্রমা, হেমন্ত স্নিগ্ধতা। স্বগোতোক্তি করলেন উদ্যম প্রচুর, তবু ফুরিয়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। আমরা স্নিগ্ধ হই, আমরাও ভাবনামুক্ত হই, উত্তেজনাদমিত হই প্রিয় কবির সঙ্গে সঙ্গে, তার উত্তেজনা প্রশমনে।

সেই শুরু করেছিলাম লেখাটি সকালের মাছির গানের মতো অলস সময়ের কথা বলে আবার শেষ করবো দিন শেষে বিপুল ভ্রমণ শেষ, অগাধ প্রকৃতিমুগ্ধতা পান করে কবির পঙ্ক্তি দিয়ে। এমন পৃথিবী ছেড়ে কি কবি সত্যি অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিলেন? না চাননি। রয়ে যেতে চেয়িছিলেন বাংলার পারে। আবার চলে গেলেও বারবার ফিরে ফিরে আসতে চেয়েছেন দোয়েল শালিখ ফিঙে মাছরাঙার মুখর ডানার ভিড়ে। কেননা পৃথিবীরে যে তার মায়াবীর নদীর পারের দেশ মনে হয়।

অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,

পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়;