আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
একান্ন.
প্রিন্স অতসুমিচির অবস্থা এমন হয়েছে যে, ইঝোমিকে এখন না দেখতে পেলে বাঁচাই যেন দায়। প্রায় প্রতিদিনই ইঝোমির বাড়িতে আসেন। দেখলেন ইঝোমি বিশ্বাসহীন মহিলা নন। তা দেখে তার অনুরাগ দিন দিন আরো বৃদ্ধি পায়।
একদিন বললেন, তুমি এখানে নির্জনে একাকী বাস কর আমার ভালো লাগছে না। তুমি আমার প্রাসাদে চল। এখানে থাকলে ওরা তোমার সম্পর্কে নানা অপবাদ ছড়াতেই থাকবে। এখন আমিও একা। আমি প্রিন্সেসের বাড়িতে থাকি না। আমি তার উপর রাগ করে সেখানে যাই না, বড় অশান্তি করে। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে শান্তি পাব। তোমার আন্তরিকতায় কোনো খাদ নেই।
কথা শুনে ইঝোমি হাসলেন। পরে বললেন, আপনার স্ত্রী রয়েছে। আপনি তার কাছে না থেকে ভিন্ন বাড়িতে থাকেন। আমি যদি আপনার ওখানে গিয়ে থাকি, আন্তরিকতা দেখাই, তা হলেও আমাকে দোষারোপ করা হবে।
তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দটাই আলাদা। আমার হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়। তবুও আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব। ওরা যা বলে বলুক, যত ইচ্ছা খুশি বদনাম আর কুৎসিত কথা ছড়াক। যখন দেখবে আমরা একাত্ম, কত আর শক্ত হবে তাদের বক্তব্য। এক সময় মাথা নত করবেই।
অপবাদটা ওরা আমাকে দেবে আপনাকে না। আমি আপনাকে একটি ছাড়া বাড়িতে পাব এবং শান্তিতে কথা বলব ঠিকই। কিন্তু....
একথা শেষ হওয়ার আগেই খোলা দরজা দিয়ে প্রিন্স চলে গেলেন। ইঝোমি ভাবলেন,আমি যদি একা একা থাকি তাও হবে সম্মানজনক। তার প্রাসাদে গিয়ে থাকাটাই বরং হবে হাস্যকর।
প্রিন্স গিয়ে পত্র লিখলেন। একই আকুতি তার লেখায়। ইঝোমি বুকে ব্যথা নিয়েও তার অবস্থানে শক্ত রইলেন। অন্যসব কথা বলা হয় পত্রে। প্রিন্স মাঝে মাঝে আসেন ইঝোমির যাওয়ার প্রসঙ্গটা অমীমাংসিত থেকে যায়।
ইঝোমি গেলেন ইমনের প্রাসাদদপ্তরে। হাসি মুখে তাকে বরণ করলেন ইমন। বললেন, এত কিছু ঘটে যাচ্ছে তোমার দেখা নেই। তুমি কেমন আছো আগে বল।
আপু, বড় ঝামেলায় আছি। তাকাকুর কথাই সত্য। ভালোবাসা হচ্ছে যন্ত্রণা।
এখন আবার কি সমস্যা। প্রিন্সের তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তুমি তো বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছ যে, প্রিন্স অতসুমিচিও সম্রাট হবার যোগ্যতা রাখেন। সিংহাসনে তার অধিকার রয়েছে।
কিন্তু তিনি এতটা তৎপর নন।
সময় হলে নিশ্চয়ই তৎপর হয়ে উঠবেন। রাতের অনুষ্ঠানগুলোয় তো তাকে ইদানিং বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। সদা হাস্যোচ্ছ্বল, প্রান্তবন্ত।
স্ত্রীর সঙ্গে সময়টা ভালো যাচ্ছে না। আমাকে বলছে তার সঙ্গে গিয়ে থাকতে।
তুমি কি বললে?
এটা কি সম্মানজনক হবে?
তা হবে না, তার স্ত্রী রয়েছে।
আমিও তা-ই বলেছি।
কিন্তু কষ্ট তো পাচ্ছো।
প্রিন্সও পাচ্ছেন। এখন বুঝতে পারছেন আমাকে ছাড়া তার চলবে না।
খুবই চমৎকার।
চমৎকার কেন?
এতদিন তোমার ব্যথা বুঝতে পারেনি, এখন দিতে চায় সকল শূন্য করে। তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছ।
এখন আমার সম্মানের কথাও ভাবেন।
তা হলে, সম্মানজনকভাবে নিয়ে যাক।
সে কথাই ভাবছেন মনে হয়। লেডি সানুকি নাকি আত্মহত্যা করেছে, কেন?
সে নানা অঘটন ঘটিয়ে ধরা পড়ার ভয়ে এপথ বেছে নিয়েছে।
সে যাদের সঙ্গে থাকে তাদের উচিত ছিল একে দেখভাল করে রাখা। এতটা আগাতে না দেয়া।
মেজর জেনারেল এখনো প্রতিবেদন দেয়নি।
কোন মেজর জেনারেল?
থার্ড র্যাঙ্কের।
সেই শোনাগনরা কি দায়ী?
প্রতিবেদন পেলে দেখা যাবে।
কেন যে এরা এরকম ভুল করে? সম্রাজ্ঞী কেমন আছেন?
এখন ভালো। মাঝখানে অস্থিরতায় ভুগছিলেন।
যদি প্রিন্স নিয়ে যেতে চান, যাবো?
কিভাবে নিতে চান তার ওপর নির্ভর করছে। বিয়ে করতে বল। এটাই হবে বেশি সম্মানজনক। স্ত্রীর মর্যাদার ওপর মর্যাদা নেই।
তার স্ত্রী ঝামেলা করতে চাইবে।
সে তো আবার ক্রাউন প্রিন্সের স্ত্রীর বোন। তাই সমস্যাটা বড়। যোগাযোগ আছে এদের?
খুব। যাই হোক, অবস্থা যদি এমনই হয় জোর করে আমি তার আসল প্রাসাদে উঠবো।
Ÿাহ বাহ! তোমার সাহস আছে।
অধিকারের কথা বলবেন না?
হ্যাঁ, হৃদয়ের অধিকার সবকিছুর উর্ধেŸ।
এসময়ে মুরাসাকি উপস্থিত হলেন। ইঝোমিকে দেখে বললেন, তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কী সৌভাগ্য! দেখা হয়ে গেল। সে দিককার খবর কি?
যত খবর তো এখন তোমাদের এখানে। শিশু সম্রাট আসছেন, উৎসব উৎসব ভাব।
অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। আমি আর ইমন আপার আমন্ত্রিত অতিথি তুমি।
সে একা আসবে কেন? প্রিন্সও আসবেন।
তাই নাকি?
স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নাও তোমরা।
অবস্থা কি সেরকম?
আর বলছি কি আমি?
ইমনের কথায় প্রাণ খুলে হাসলেন এরা।
ইঝোমি বললেন, তাকাকুর লেখা চোখে পড়ে না।
লেখা বন্ধ হয়ে আছে।
সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই। ব্যক্তিগত কাজের সুযোগ নেই। এছাড়া যা সব কান্ড ঘটছে। সিরিয়াস লেখার পরিবেশ নেই। লিখছে শুধু ইঝোমি। শত কবিতার চিঠি।
আমি তো একপক্ষ। জবাব লিখি। তাকাকু কী করে শতশত কবিতার পসরা সাজায়?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে পাত্রের কবিতা লেখে, আবার পাত্রির জবাবটাও দেয়।
ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
তুমি হচ্ছো প্রকৃতই কবি। তাকাকু কবিতা লেখে তবে কম। উপন্যাসে (মনোগাতারিতে) এত এত কবিতা। তাকাকু, এপর্যন্ত কত হবে সংখ্যা?
পাঁচশর বেশি। আরো কয়েক অধ্যায় আছে। উজি ছবির মতো। প্রেম ও প্রকৃতি মিলে সেখানে কবিতার ঝরনাধারা বয়ে যাবে। এটা পরিকল্পনা।
ইমন বললেন, তুমি তো প্রেম করোনি। পাত্র-পাত্রীর প্রেমের কবিতা (চিঠি) কীভাবে লেখ? লেখতো আকর্ষণীয় করে।
প্রেম করিনি তাতে কী হয়েছে? তোমাদেরকে তো প্রেম করতে দেখেছি। দেখিনি? এখনো দেখছি।
বিশ্বাস করলাম তুমি আমার হয়ে পাত্রীর মন বুঝে কবিতাপত্র লিখেছ, ছেলেদেরগুলো লিখলে কেমন করে?
পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতায়।
এজন্মে তুমি ছেলে হলে আমি কষ্ট পেতাম।
কেন?
আমাকে তুমি অতসুমিচির মতই ভোগাতে।
না না। আমি রাজকুমার হয়েই আসতাম, তুমি হতে রাজকুমারী। উজির প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজহংস আর রাজহংসীর মতো ঘুরে বেড়াতাম।
ইমন বললেন, এত বড় কবি আর লেখক তোমরা এখনো শিশুর মতো রয়ে গেছো। ভুলে গেছো উচুঁদরের লেডি-ইন-ওয়েটিং ও তোমরা।
সারাটা সময় কাটে প্রাসাদের এক পাথর চাপা পরিবেশে। গাম্ভীর্য ধারণ করে থাকতে হয় সবটা সময়। সবকিছুতে আচারনিষ্ঠতা। ইঝোমিকে পেলে যেন আচারনিষ্ঠতা ছাড়িয়ে শৈশব কৈশোরে-ছুটে যাই।
তোমাকে দেখে তা মনে হয় না। অবশ্য সব বড়লেখকের মধ্যেই একজন শিশু বাস করে। বললেন ইমন
আজ আমার জন্য স্মরনীয় দিন। বলে ইঝোমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ওঁরা দু’জন তাকিয়ে আছেন তার দিকে। পরে বললেন, সেই ছোট বেলা থেকে তাকাকু আর আমি একসঙ্গে বড় হয়েছি, আজই শুধু তাকে এতটা প্রাণ খোলা শিশু হতে দেখলাম। আমার এত ভালো লেগেছে যে, কখনো এতটা অনুভব করিনি। এসো বন্ধু কোলাকুলি করে নিই।
বায়ান্ন.
ইঝোমি চলে গেলে ইমন বললেন, এতটা প্রাণ খোলা সে।
মুরাসাকি বললেন, তার ভেতর অনেক কষ্টও।
ঠিক বলেছ। তবে এর একটা ভালো দিকও আছে, কষ্ট না থাকলে সে কবিতাই লিখতে পারতো না।
কবিতা আর কষ্ট সমর্থক হয়ে গেছে। মেয়েদের জীবনে এত যন্ত্রনা কেন? আমরা যেন সবাই পুড়ছি। আপনার, আমার এবং ইঝোমির নব্বই ভাগ কবিতার ভাবই
কষ্ট আর বিরহে পড়ে। বিশেষ করে পাত্রীদের বিরহই কবিতার উপজীব্য। আমি নিজেও জানি না কেন করি।
একটি কথা বলি?
বলুন।
আমি কনফুসিয়ান স্কলারকে নিয়ে খুব সুখে আছি। সে ভালোবাসা দিয়েছে। তবুও মিচিতাকার কথা ভুলতে পারি না। লিখতে গেলেই কষ্টের মধুরতা পেয়ে বসে। একদিন মাসাহিরা জিজ্ঞেস করেই বসলেন, আমাকে নিয়ে কি তুমি সুখী নও?
আপনি কী বললেন?
কী বলার আছে বলো। সে তো শুধু কনফুসিয়ান স্কলারই না, কবিও। কবিতার ভাষা সে বুঝবে না? তোমার ভালোবাসা?
গদ্যময়। যা মরূভূমিতে হারায়।
বলবে না এই তো?
মনোগাতারির চরিত্রই আমার ভালোবাসা। জানেন আপা, তাদের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে বোধ হয় লিখতে পারতাম না।
এত এত চরিত্র এনেছ, অবাক লাগে। প্রত্যেকটাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
এরা গল্প, কাহিনী বা ঘটনার প্রয়োজনে আসে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই পালায়। আবার কোনোটি থেকে যায়। তারা যেন রোপন করা গাছ। পাখায় ভর করে উড়াল দেবার ক্ষমতা নেই, তাই ঘটক অনুঘটকের কাজ করে গল্পটি এগিয়ে নেয়।
ইমন বললেন, চমৎকার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আপনারা যে ‘মনোগাতারি’ লিখছেন তা কতদুর?
তুমিও আমাদের সঙ্গে এসো।
আমি তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা।
যা দেখছো, তা-ই লিখবে।
আপনারা লিখুন। আমি সহযোগিতা করব।
ঝামেলাও আছে- বুঝলে?
কিরকম?
শুধু প্রশংসা দিয়ে কি মনোগাতারি হয়? নেতিবাচক কিছু লেখার উপায় নেই।
তা হলে তো এক পেশে হবে।
তাই করতে হচ্ছে।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, করুন, তাই করুন।
এদিকে সেই শোনাগন কিছু দিনের জন্য গভর্নর স্বামী মুনেয়োর কাছে সুদূর সেতসু প্রদেশে চলে গেলেন। এখানকার পরিবেশ তার জন্য আর অনুকূল নয়। যাকে বেশি বিশ্বাস করতেন, তাকে না জানিয়ে সেই সানুকি যা করে নিজেও আত্মহত্যা করলেন, তা তাদের সকলের জন্যই বিপদের কারণ হল। কিছুদিন দূরে সরে থাকাই নিরাপদ তার জন্য।
সেতসু তার জন্য বেশ নিরিবিলি জায়গা। লেখাজোখার জন্য খুবই অনুকূল। তবে তার স্বামী প্রদেশে বদলীর পর থেকে দু’জনের মধ্যে বাদানুবাদ লেগেই আছে। এখন আরো বেড়ে গেছে। তাকে এখন সবই সইতে হবে। কারণ কিছুই তার অনুকূলে নেই। তারপরও মানিয়ে নিয়ে লেখাটা চালিয়ে যেতে চাইছেন।
পুত্র নোরিনাগাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। নোরিনাগা আগের সংসারের ছেলে। চৌদ্দবছর বয়স তার। মায়ের সঙ্গে গভর্নরের সময় ভালো যাচ্ছে না। তা সে বুঝতে পারছে। মন সবসময় খারাপ করে থাকে। সেই শোনাগনকে এই যন্ত্রণাটাও ভোগ করতে হয়। তবে লেখাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওয়াকাকবিতা পর্যবেক্ষণ, প্রাসাদের কথা, ভালো-মন্দ সবই থাকছে এসব লেখার মধ্যে। ‘মাকুরা নো-শোশি’ (পিলুবুকে) পরবর্তীতে এগুলোও স্থান পেয়েছে।
সেতসু প্রদেশে এসে শোনাগন তার অপছন্দের বিষয়ে যেন হাতখুলে লেখার সুযোগ পেলেন। কমিক আকারে লেখা হল বেশকিছু। এগুলোর মধ্যে আছে মানুষের অভব্য ব্যবহার বা আচরণ। উদাহরণও আছে সঙ্গে। সহ্য করা যায় না এমন ব্যবহারও করছে কেউ কেউ। পুরুষ-মহিলা ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে, এমনকি দরবারিক আচরণে। মজা করেও কোনো কোনোটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার সংশোধন ও সংস্কার চেয়েছেন। তিনি খোলামেলাই লিখছেন এসব, কোনো রাখঢাক করছেন না।
স্বামী মুনেয়ো এগুলো পড়ে বললেন, এসব কি লিখছ? তোমার পদ ও সামাজিক অবস্থান তো তা অনুমোদন করে না।
শোনাগন বললেন, আমি আমার সন্তুষ্টির জন্য এসব লিখি, অন্য কারো সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির জন্য নয়।
তুমি ঝামেলাই বাঁধাবে।
ঝামেলা মনে করলে ঝামেলা।
তোমার ওপর এখনকার প্রশাসন ক্ষেপে আছে। এসব লেখা তাতে ঘৃতাহুতি দেবে।
তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
ব্যাপারটা কী ভয় পাবার মতো নয়?
সময় আমাদেরও আসবে। প্রিন্স অতসুইয়াসু এখনো বেঁচে আছে, তিনিই একদিন সম্রাট হবেন।
মিচিনাগা বেঁচে থাকা কালে নয়। এ আশঙ্কায়ই তিনি সানজুকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করিয়ে রেখেছেন।
হেইয়ান সম্রাজ্যে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।
সে আশায়ই থাকো, আমার আর নোরিনাগার বিপদ ঘটিয়ো না।
আমি থামবো না, মুনেয়ো। তোমরা তোমাদের নিরাপত্তা বিধান কর।
আমার কথা বাদ দিলাম, তুমি তোমার ছেলের কথা ভাববে না?
সেও তার নিজের ব্যবস্থা করে নেবে।
নিজের জন্য লিখছো লিখো, অনুগ্রহ করে বিলিবন্টন করো না। প্রচারটা দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে।
এদিকে ইঝোমি শিকিবু মানসিক দ্বন্দের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন না কী করবেন। প্রিন্সের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাসাদে গিয়ে উঠবেন, না কি এখানেই থাকবেন।
প্রিন্স একদিন এলেন। সঙ্গে ইউকোন নো ঝো এবং পত্রবাহক ছেলেটি। এদেরকে পালকির কাছে রেখে তিনি ইঝোমির সঙ্গে দেখা করলেন। এক পর্যায়ে বললেন যে, তার প্রাসাদে থাকবেন পয়তাল্লিশ দিন।
ইঝোমি বললেন, কী করতে হবে আমাকে?
প্রিন্স বললেন, আমার সঙ্গে সেখানে যেতে হবে।
আমাকে ভাবতে দিন। কিছুক্ষণ পর বললেন, এটা আমার জন্য বিব্রতকর। আমি কী পরিচয়ে সেখানে যাব। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
উভয়ে ভাবতে ভাবতে, কথা বলতে বলতে রাত কেটে গেল। কেউ জেগে ওঠার আগেই প্রিন্স দ্রুত সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেলেন। তার ভয় পাছে কেউ দেখে ফেলে।
ইঝোমি প্রিন্স চলে যাবার পর ভাবতে বসলেন। প্রিন্সকে নিয়ে সাংসারিক কাজকর্মে জড়িয়ে ধর্মকর্ম ভুলে গেছেন। মানুষ তার বিশ্বাসপ্রবণতা নিয়ে হাসাহাসি করবে। এখন যেমন আছেন তেমনই কী থাকবেন। নাকি বাবা-মা ভাইবোনের কাছে চলে যাবেন? বাবা তো তাকে ত্যাজ্য করেছেন। এখন আবার বোঝা মনে করবেন নাতো? প্রিন্স পরিত্যাগ করলেই বা কী করবেন? তিনি প্রিন্সের কাছেই যাবেন। একসঙ্গে থাকবেন। তবে তা নিজে জানাবেন না, এ ব্যাপারে লিখবেনও না। তার পুরোনো বন্ধুদের কেউ কেউ পত্র লিখেছেন তিনি এসব পত্রের জবাবই দেননি এই ভেবে যে, কিছুই লেখার নেই। কারণ প্রিন্সের কাছেই চলে যাবেন।
প্রিন্সের কাছ থেকে একটি পত্র এল। তিনি আশান্বিত হয়ে উঠলেন। তাকে নিতে প্রিন্স কখন আসবেন নিশ্চয়ই এই পত্রে তা লেখা আছে। পত্র খুলে অবাক। একি লিখেছেন প্রিন্স। তিনি লিখেছেন, আমি চরম বোকা তোমাকে বিশ্বাস করেছি। একটি পুরোণো কবিতা আছে সঙ্গে: তুমি বিশ্বাসযোগ্য নও/ আমি এনিয়ে কোনো অভিযোগ করিনি/ সমুদ্র যেমন নিরব থাকে/ আমার হৃদয়ে গভীর ঘৃণা।
তাতে ইঝোমির হৃদয় ভেঙ্গে গেল।
তিপ্পান্ন.
আজ আবার বহুদিন পর রাজকীয় ভোজানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ভোজানুষ্ঠানের আগে কবিতা পাঠ, নাচগান এবং নো নাটকের অংশ বিশেষের অভিনয় হচ্ছে। অনুষ্ঠান বেশ জমজমাট।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন যথারীতি কবি (সভাকবি) ফুজিওয়ারা নো কিন্তু। তিনি হঠাৎ করেই বললেন, মুরাসাকি তোমার গেঞ্জি মনোগাতারিতে এই প্রাসাদের কোন কোন চরিত্রের কথা আছে?
মুরাসাকিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাই তার উদ্দেশ্য। প্রাসাদে কেউ তাকে মুরাসাকি বলে ডাকে না, ডাকে তাকাকু বলে। এতে সবাই তার দিকে তাকালো বিস্ময়কর দৃষ্টিতে। মুরাসাকি তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, ‘আমার কোনো চরিত্র এখানে বাস করে না।’ সেদিন থেকে তাকাকু সভায় সবার কাছে মুরাসাকি হয়ে গেলেন। কেউ আর কখনো তাকে তাকাকু নামে ডাকেনি।
অথচ মুরাসাকি চরিত্রে নিজের জীবনের ছিটে ফোটা এসে গেলেও তিনি যেন তার নতুন স্রষ্টা ঈশ্বরই থাকতে চেয়েছেন, উপন্যাসের চরিত্র হতে যান নি।
বিব্রত করার জন্য কিন্তুকে শক্ত কথা বলতে পারতেন, বললেন না। তাতে সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কার মিলল, লেডি সেনশি (সম্রাটমাতা) তাকে কাছে নিয়ে বসালেন। সম্রাটকে বললেন, এর ‘গেঞ্জি পড়েছ? না পড়ে থাকলে পড়বে। সাম্রাজ্য পরিচালনার অনেক কিছু আছে তাতে।
সম্রাট অদ্ভুতভাবে তাকালেন তার দিকে। মিচিনাগা বললেন, আমি কিন্তু প্রতিটি স্ক্রল পাঠ করেছি। অসাধারণ বললেও কম বলা হয়।
লেডিদের অনেকেই তাতে ঈর্ষাবোধ করলেন। উপস্থিত প্রিন্সরা অর্থপূর্ণ তাকালেন।
বিদগ্ধ রমণী সেনশির দরবারে যেসব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন, তারা তখন বললেন, সম্র্রাট মাতা যা বলেছেন একেবারেই অকাট্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষন করার সুযোগ নেই।
রাতের অনুষ্ঠান শেষ হলো মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়।
পরদিনই ‘গেঞ্জি’র অংশ বিশেষসহ মুরাসাকিকে সম্রাটের দরবারে ডাকা হল। তিনি তখন সন্তানসম্ভবা সম্রাজ্ঞীকে চীনা লেখকদের গীতিকা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। সম্রাজ্ঞী বললেন যাও। গতরাতের প্রশংসা সম্রাট এখন যাচাই করে দেখবেন।
মুরাসাকি সহজ-সরল মানুষ। উচ্চাশার পরিবর্তে প্রপিতামহ কবি নাকাসুনের অহংকার নিয়ে বেঁচে আছেন। সম্রাট সভাসদদের নিয়ে দরবার চালাচ্ছেন। মুরাসাকিকে দেখে বললেন, তোমার পছন্দের একটি অংশ শোনাও। মুরাসাকি শুনিয়ে দিলেন। তুমি বুদ্ধিমতী এবং অবশ্যই জাপানের ঘটনাপঞ্জি (ক্রনিক্যাল) জানো। একজন অমাত্য বললেন, উচ্চশিক্ষিতা। সম্রাট বললেন, ভালো। আমাকে পুরো একটি প্রতিলিপি দেবে। দেবে তো?
মুরাসাকি স্কুলের বালিকাদের মতো মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ দেবেন।
সেদিন দরবারে মিচিনাগা উপস্থিত ছিলেন না। তিনি থাকলে হয়ত ব্যাপারটা আরো আনন্দঘন হত। তবে পরে ব্যাপারটা শুনেছেন। তিনি মুরাসাকির কক্ষে উপস্থিত হলেন। সবগুলো স্ক্রল ঘেটে ঘেটে শৈল্পিক ক্যালিগ্রাফি এবং ইলাস্টেশন দেখে একটি ফর্দ তৈরি করলেন। বললেন, এগুলো সম্রাটের দরবারে নিয়ে চল।
মুরাসাকি বললেন, সম্রাজ্ঞীর সেবক কাউকে দিয়ে পাঠানোই ঠিক হবে, এগুলোর ওজন অনেক।
মিচিনাগা তার ডানের জেনারেলকে বললেন, তুমি অর্ধেক নাও, আমি অর্ধেক নিচ্ছি। মুরাসাকিকে বললেন, ভালো কথা, সকল স্ক্রলের অংশ তোমার কাছে আছে তো? মিলিয়ে দেখো। মুরাসাকি এক ফর্দ আলাদাভাবে অনেক আগেই রেখে দিয়েছেন। বললেন, সবঠিক আছে।
এরা দু’জন স্ক্রলগুলো ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন, মুরাসাকি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন এবং ভাবলেন, মিচিনাগা তাকে এতটা ভালোবাসেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তার অর্থ কী! আর কী পাওয়ার বাকী আছে?
স্যামন নো নাইশি সম্রাজ্ঞীর দরবারে আরেকজন লেডি-ইন-ওয়েটিং। তিনি কোনো কারণ ছাড়াই মুরাসাকিকে অপছন্দ এবং ঈর্ষা করেন। মুরাসাকি তা জানেন না। তিনি যেহেতু কারো সামনে-পেছনে নেই, এনিয়ে ভাবিতও নন। এই মহিলা সম্রাজ্ঞীর এক বার্তা নিয়ে সম্রাটের দরবারে গিয়ে ‘গেঞ্জি’ পাঠ এবং সম্রাটের মন্তব্য শুনেছেন। মন্তব্যের পুরোটা মনে হয় শুনতে পাননি, অথবা শুনেছেন এবং তা বিকৃত করে প্রচার করেন যে, সম্রাট মুরাসাকিকে ‘নিহোনজি নো সুবোন’ আখ্যা দিয়েছেন। যার অর্থ হচ্ছে ইংরেজিতে ‘আওয়ার লেডি অব দ্য ক্রনিক্যালস’। দৃশ্যত কথাটা ভালো এবং প্রশংসা মনে হতে পারে। নাইশি সে অর্থে নয়, চাটুক্তি হিসেবে তা প্রচার করে- যা অপমানজনক ও অস্বস্থিকর। কয়েক বছর পর মুরাসাকি তার ডায়েরিতে লেখেন, কী উদ্ভট! যে কিনা প্রাসাদের মহিলাদেরও কিছু জানাতে দ্বিধাবোধ করে, সে তা সম্রাটের দরবারে জানাতে যাবে?
তিনি আসলে ‘গেঞ্জি’র অংশ বিশেষ পাঠ করা ছাড়া সেখানে আর কোনো কথাই বলেননি। তার স্বভাবে তা যায় না। তিনি সেখানে বিচলিতবোধই করেছেন।
অথচ বাইরে একটা অর্থহীন প্রচারণার দুর্ভোগ তাকে পোহাতে হয়েছে এবং হচ্ছে। পরে জেনেছেন নাইশি আগেও তার প্রচুর সমালোচনা এবং অমূলক দুর্নাম ছড়িয়েছেন। এটা কোনো কোনো নারীর স্বভাবজাত। অন্যের সুখ দেখলে ঘুম হয় না, সুনাম শুনলে ঈর্ষায় বুক ফেটে যায়। হেইয়ান সম্রাটদের এত সুন্দর প্রাসাদ, বাগানের ফুল, হ্রদের স্বচ্ছ টলটলে জল এবং উদার নীলাকাশ তাদের উদারতার শিক্ষা দেয় না।
ইমন তা শুনে অবাকই হলেন। বললেন, তুমি চুপ করে বসে আছো কেন?
আমাকেও তাদের দুর্নাম করতে বলছেন?
তাকাকু, আমি তোমাকে সে কথা বলছি না। তোমার ক্ষমতা তুমি প্রয়োগ করো। মিচিনাগাকে জানাও, সম্রাজ্ঞীকে বলো।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, সহ্যের ক্ষমতার চাইতে বড় ক্ষমতা নেই। নিজের ওপর তাই প্রয়োগ করছি। আমার পরিবারের ঐতিহ্য এটা, বিনয়ী এবং ভদ্র থাকা। আপনাকে আজ বলতে অসুবিধা নেই দুই বছর আগের কথা। আমরা, অর্থাৎ আমি এবং মহামান্যা চীনা ধ্রুপদীর চর্চা করছিলাম। তাদেরই কেউ একজন গিয়ে সম্রাটের কানে দিয়েছে রঙচঙ ছড়িয়ে। সম্রাট আমাদের ডাকালেন। আমি অকপটে স্বীকার করলাম। তখন গ্রীষ্মকাল ছিল। মহামান্যা ঘামছিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, বড় কিছু একটা ঘটবে।
তারপর কী হল?
আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সম্রাট সম্রাজ্ঞীকে অনেকগুলো চীনা কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেন। সেখানে মহামান্যার বাবাও উপস্থিত ছিলেন। মহামান্যা কাব্যগ্রন্থগুলোর অনুলিপি করিয়েছিলেন। মনে হয় নাইশি তা জানেন না। জানলে তা নিয়ে নানা সমালোচনা আর বদনাম ছড়াতে ছাড়তেন না। বলে খুব হাসলেন মুরাসাকি।
তোমরা চীনা ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠ করতে। কার লেখা ছিল এগুলো?
আমরা সংগ্রহ করেছিলাম বাইযুয়ীর গীতিকার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খন্ড দু’টি। খুব গোপনে ভাষাটা শেখাতাম সম্রাজ্ঞীকে। তাও কারা যেন জেনে গেল।
মনে হয় আড়ি পেতে ছিল মহামান্যারই কাছের কেউ।
হতে পারে। মহামান্যা যাদের নিয়ে মাঝে-মধ্যে আড্ডায় বসেন তাদের বয়স খুব বেশি না। একবার হলো কী, মহামান্যা কতোগুলো কম বয়সী যুবতীকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। কিন্তু তার পারিষদ মনে করছেন তা সম্রাজ্ঞীর নির্বুদ্ধিতাকে স্পষ্ট করছে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। অথচ এরাই সামনে তার প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।
প্রাসাদের লোকদের চরিত্রই এরকম, বুঝলে? ক্রমশ...
বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২২ , ২৯ পৌষ ১৪২৮ ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৩
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
একান্ন.
প্রিন্স অতসুমিচির অবস্থা এমন হয়েছে যে, ইঝোমিকে এখন না দেখতে পেলে বাঁচাই যেন দায়। প্রায় প্রতিদিনই ইঝোমির বাড়িতে আসেন। দেখলেন ইঝোমি বিশ্বাসহীন মহিলা নন। তা দেখে তার অনুরাগ দিন দিন আরো বৃদ্ধি পায়।
একদিন বললেন, তুমি এখানে নির্জনে একাকী বাস কর আমার ভালো লাগছে না। তুমি আমার প্রাসাদে চল। এখানে থাকলে ওরা তোমার সম্পর্কে নানা অপবাদ ছড়াতেই থাকবে। এখন আমিও একা। আমি প্রিন্সেসের বাড়িতে থাকি না। আমি তার উপর রাগ করে সেখানে যাই না, বড় অশান্তি করে। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে শান্তি পাব। তোমার আন্তরিকতায় কোনো খাদ নেই।
কথা শুনে ইঝোমি হাসলেন। পরে বললেন, আপনার স্ত্রী রয়েছে। আপনি তার কাছে না থেকে ভিন্ন বাড়িতে থাকেন। আমি যদি আপনার ওখানে গিয়ে থাকি, আন্তরিকতা দেখাই, তা হলেও আমাকে দোষারোপ করা হবে।
তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দটাই আলাদা। আমার হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়। তবুও আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করব। ওরা যা বলে বলুক, যত ইচ্ছা খুশি বদনাম আর কুৎসিত কথা ছড়াক। যখন দেখবে আমরা একাত্ম, কত আর শক্ত হবে তাদের বক্তব্য। এক সময় মাথা নত করবেই।
অপবাদটা ওরা আমাকে দেবে আপনাকে না। আমি আপনাকে একটি ছাড়া বাড়িতে পাব এবং শান্তিতে কথা বলব ঠিকই। কিন্তু....
একথা শেষ হওয়ার আগেই খোলা দরজা দিয়ে প্রিন্স চলে গেলেন। ইঝোমি ভাবলেন,আমি যদি একা একা থাকি তাও হবে সম্মানজনক। তার প্রাসাদে গিয়ে থাকাটাই বরং হবে হাস্যকর।
প্রিন্স গিয়ে পত্র লিখলেন। একই আকুতি তার লেখায়। ইঝোমি বুকে ব্যথা নিয়েও তার অবস্থানে শক্ত রইলেন। অন্যসব কথা বলা হয় পত্রে। প্রিন্স মাঝে মাঝে আসেন ইঝোমির যাওয়ার প্রসঙ্গটা অমীমাংসিত থেকে যায়।
ইঝোমি গেলেন ইমনের প্রাসাদদপ্তরে। হাসি মুখে তাকে বরণ করলেন ইমন। বললেন, এত কিছু ঘটে যাচ্ছে তোমার দেখা নেই। তুমি কেমন আছো আগে বল।
আপু, বড় ঝামেলায় আছি। তাকাকুর কথাই সত্য। ভালোবাসা হচ্ছে যন্ত্রণা।
এখন আবার কি সমস্যা। প্রিন্সের তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তুমি তো বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছ যে, প্রিন্স অতসুমিচিও সম্রাট হবার যোগ্যতা রাখেন। সিংহাসনে তার অধিকার রয়েছে।
কিন্তু তিনি এতটা তৎপর নন।
সময় হলে নিশ্চয়ই তৎপর হয়ে উঠবেন। রাতের অনুষ্ঠানগুলোয় তো তাকে ইদানিং বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। সদা হাস্যোচ্ছ্বল, প্রান্তবন্ত।
স্ত্রীর সঙ্গে সময়টা ভালো যাচ্ছে না। আমাকে বলছে তার সঙ্গে গিয়ে থাকতে।
তুমি কি বললে?
এটা কি সম্মানজনক হবে?
তা হবে না, তার স্ত্রী রয়েছে।
আমিও তা-ই বলেছি।
কিন্তু কষ্ট তো পাচ্ছো।
প্রিন্সও পাচ্ছেন। এখন বুঝতে পারছেন আমাকে ছাড়া তার চলবে না।
খুবই চমৎকার।
চমৎকার কেন?
এতদিন তোমার ব্যথা বুঝতে পারেনি, এখন দিতে চায় সকল শূন্য করে। তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছ।
এখন আমার সম্মানের কথাও ভাবেন।
তা হলে, সম্মানজনকভাবে নিয়ে যাক।
সে কথাই ভাবছেন মনে হয়। লেডি সানুকি নাকি আত্মহত্যা করেছে, কেন?
সে নানা অঘটন ঘটিয়ে ধরা পড়ার ভয়ে এপথ বেছে নিয়েছে।
সে যাদের সঙ্গে থাকে তাদের উচিত ছিল একে দেখভাল করে রাখা। এতটা আগাতে না দেয়া।
মেজর জেনারেল এখনো প্রতিবেদন দেয়নি।
কোন মেজর জেনারেল?
থার্ড র্যাঙ্কের।
সেই শোনাগনরা কি দায়ী?
প্রতিবেদন পেলে দেখা যাবে।
কেন যে এরা এরকম ভুল করে? সম্রাজ্ঞী কেমন আছেন?
এখন ভালো। মাঝখানে অস্থিরতায় ভুগছিলেন।
যদি প্রিন্স নিয়ে যেতে চান, যাবো?
কিভাবে নিতে চান তার ওপর নির্ভর করছে। বিয়ে করতে বল। এটাই হবে বেশি সম্মানজনক। স্ত্রীর মর্যাদার ওপর মর্যাদা নেই।
তার স্ত্রী ঝামেলা করতে চাইবে।
সে তো আবার ক্রাউন প্রিন্সের স্ত্রীর বোন। তাই সমস্যাটা বড়। যোগাযোগ আছে এদের?
খুব। যাই হোক, অবস্থা যদি এমনই হয় জোর করে আমি তার আসল প্রাসাদে উঠবো।
Ÿাহ বাহ! তোমার সাহস আছে।
অধিকারের কথা বলবেন না?
হ্যাঁ, হৃদয়ের অধিকার সবকিছুর উর্ধেŸ।
এসময়ে মুরাসাকি উপস্থিত হলেন। ইঝোমিকে দেখে বললেন, তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কী সৌভাগ্য! দেখা হয়ে গেল। সে দিককার খবর কি?
যত খবর তো এখন তোমাদের এখানে। শিশু সম্রাট আসছেন, উৎসব উৎসব ভাব।
অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। আমি আর ইমন আপার আমন্ত্রিত অতিথি তুমি।
সে একা আসবে কেন? প্রিন্সও আসবেন।
তাই নাকি?
স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নাও তোমরা।
অবস্থা কি সেরকম?
আর বলছি কি আমি?
ইমনের কথায় প্রাণ খুলে হাসলেন এরা।
ইঝোমি বললেন, তাকাকুর লেখা চোখে পড়ে না।
লেখা বন্ধ হয়ে আছে।
সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই। ব্যক্তিগত কাজের সুযোগ নেই। এছাড়া যা সব কান্ড ঘটছে। সিরিয়াস লেখার পরিবেশ নেই। লিখছে শুধু ইঝোমি। শত কবিতার চিঠি।
আমি তো একপক্ষ। জবাব লিখি। তাকাকু কী করে শতশত কবিতার পসরা সাজায়?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে পাত্রের কবিতা লেখে, আবার পাত্রির জবাবটাও দেয়।
ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
তুমি হচ্ছো প্রকৃতই কবি। তাকাকু কবিতা লেখে তবে কম। উপন্যাসে (মনোগাতারিতে) এত এত কবিতা। তাকাকু, এপর্যন্ত কত হবে সংখ্যা?
পাঁচশর বেশি। আরো কয়েক অধ্যায় আছে। উজি ছবির মতো। প্রেম ও প্রকৃতি মিলে সেখানে কবিতার ঝরনাধারা বয়ে যাবে। এটা পরিকল্পনা।
ইমন বললেন, তুমি তো প্রেম করোনি। পাত্র-পাত্রীর প্রেমের কবিতা (চিঠি) কীভাবে লেখ? লেখতো আকর্ষণীয় করে।
প্রেম করিনি তাতে কী হয়েছে? তোমাদেরকে তো প্রেম করতে দেখেছি। দেখিনি? এখনো দেখছি।
বিশ্বাস করলাম তুমি আমার হয়ে পাত্রীর মন বুঝে কবিতাপত্র লিখেছ, ছেলেদেরগুলো লিখলে কেমন করে?
পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতায়।
এজন্মে তুমি ছেলে হলে আমি কষ্ট পেতাম।
কেন?
আমাকে তুমি অতসুমিচির মতই ভোগাতে।
না না। আমি রাজকুমার হয়েই আসতাম, তুমি হতে রাজকুমারী। উজির প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজহংস আর রাজহংসীর মতো ঘুরে বেড়াতাম।
ইমন বললেন, এত বড় কবি আর লেখক তোমরা এখনো শিশুর মতো রয়ে গেছো। ভুলে গেছো উচুঁদরের লেডি-ইন-ওয়েটিং ও তোমরা।
সারাটা সময় কাটে প্রাসাদের এক পাথর চাপা পরিবেশে। গাম্ভীর্য ধারণ করে থাকতে হয় সবটা সময়। সবকিছুতে আচারনিষ্ঠতা। ইঝোমিকে পেলে যেন আচারনিষ্ঠতা ছাড়িয়ে শৈশব কৈশোরে-ছুটে যাই।
তোমাকে দেখে তা মনে হয় না। অবশ্য সব বড়লেখকের মধ্যেই একজন শিশু বাস করে। বললেন ইমন
আজ আমার জন্য স্মরনীয় দিন। বলে ইঝোমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ওঁরা দু’জন তাকিয়ে আছেন তার দিকে। পরে বললেন, সেই ছোট বেলা থেকে তাকাকু আর আমি একসঙ্গে বড় হয়েছি, আজই শুধু তাকে এতটা প্রাণ খোলা শিশু হতে দেখলাম। আমার এত ভালো লেগেছে যে, কখনো এতটা অনুভব করিনি। এসো বন্ধু কোলাকুলি করে নিই।
বায়ান্ন.
ইঝোমি চলে গেলে ইমন বললেন, এতটা প্রাণ খোলা সে।
মুরাসাকি বললেন, তার ভেতর অনেক কষ্টও।
ঠিক বলেছ। তবে এর একটা ভালো দিকও আছে, কষ্ট না থাকলে সে কবিতাই লিখতে পারতো না।
কবিতা আর কষ্ট সমর্থক হয়ে গেছে। মেয়েদের জীবনে এত যন্ত্রনা কেন? আমরা যেন সবাই পুড়ছি। আপনার, আমার এবং ইঝোমির নব্বই ভাগ কবিতার ভাবই
কষ্ট আর বিরহে পড়ে। বিশেষ করে পাত্রীদের বিরহই কবিতার উপজীব্য। আমি নিজেও জানি না কেন করি।
একটি কথা বলি?
বলুন।
আমি কনফুসিয়ান স্কলারকে নিয়ে খুব সুখে আছি। সে ভালোবাসা দিয়েছে। তবুও মিচিতাকার কথা ভুলতে পারি না। লিখতে গেলেই কষ্টের মধুরতা পেয়ে বসে। একদিন মাসাহিরা জিজ্ঞেস করেই বসলেন, আমাকে নিয়ে কি তুমি সুখী নও?
আপনি কী বললেন?
কী বলার আছে বলো। সে তো শুধু কনফুসিয়ান স্কলারই না, কবিও। কবিতার ভাষা সে বুঝবে না? তোমার ভালোবাসা?
গদ্যময়। যা মরূভূমিতে হারায়।
বলবে না এই তো?
মনোগাতারির চরিত্রই আমার ভালোবাসা। জানেন আপা, তাদের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে বোধ হয় লিখতে পারতাম না।
এত এত চরিত্র এনেছ, অবাক লাগে। প্রত্যেকটাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
এরা গল্প, কাহিনী বা ঘটনার প্রয়োজনে আসে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই পালায়। আবার কোনোটি থেকে যায়। তারা যেন রোপন করা গাছ। পাখায় ভর করে উড়াল দেবার ক্ষমতা নেই, তাই ঘটক অনুঘটকের কাজ করে গল্পটি এগিয়ে নেয়।
ইমন বললেন, চমৎকার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আপনারা যে ‘মনোগাতারি’ লিখছেন তা কতদুর?
তুমিও আমাদের সঙ্গে এসো।
আমি তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা।
যা দেখছো, তা-ই লিখবে।
আপনারা লিখুন। আমি সহযোগিতা করব।
ঝামেলাও আছে- বুঝলে?
কিরকম?
শুধু প্রশংসা দিয়ে কি মনোগাতারি হয়? নেতিবাচক কিছু লেখার উপায় নেই।
তা হলে তো এক পেশে হবে।
তাই করতে হচ্ছে।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, করুন, তাই করুন।
এদিকে সেই শোনাগন কিছু দিনের জন্য গভর্নর স্বামী মুনেয়োর কাছে সুদূর সেতসু প্রদেশে চলে গেলেন। এখানকার পরিবেশ তার জন্য আর অনুকূল নয়। যাকে বেশি বিশ্বাস করতেন, তাকে না জানিয়ে সেই সানুকি যা করে নিজেও আত্মহত্যা করলেন, তা তাদের সকলের জন্যই বিপদের কারণ হল। কিছুদিন দূরে সরে থাকাই নিরাপদ তার জন্য।
সেতসু তার জন্য বেশ নিরিবিলি জায়গা। লেখাজোখার জন্য খুবই অনুকূল। তবে তার স্বামী প্রদেশে বদলীর পর থেকে দু’জনের মধ্যে বাদানুবাদ লেগেই আছে। এখন আরো বেড়ে গেছে। তাকে এখন সবই সইতে হবে। কারণ কিছুই তার অনুকূলে নেই। তারপরও মানিয়ে নিয়ে লেখাটা চালিয়ে যেতে চাইছেন।
পুত্র নোরিনাগাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। নোরিনাগা আগের সংসারের ছেলে। চৌদ্দবছর বয়স তার। মায়ের সঙ্গে গভর্নরের সময় ভালো যাচ্ছে না। তা সে বুঝতে পারছে। মন সবসময় খারাপ করে থাকে। সেই শোনাগনকে এই যন্ত্রণাটাও ভোগ করতে হয়। তবে লেখাটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওয়াকাকবিতা পর্যবেক্ষণ, প্রাসাদের কথা, ভালো-মন্দ সবই থাকছে এসব লেখার মধ্যে। ‘মাকুরা নো-শোশি’ (পিলুবুকে) পরবর্তীতে এগুলোও স্থান পেয়েছে।
সেতসু প্রদেশে এসে শোনাগন তার অপছন্দের বিষয়ে যেন হাতখুলে লেখার সুযোগ পেলেন। কমিক আকারে লেখা হল বেশকিছু। এগুলোর মধ্যে আছে মানুষের অভব্য ব্যবহার বা আচরণ। উদাহরণও আছে সঙ্গে। সহ্য করা যায় না এমন ব্যবহারও করছে কেউ কেউ। পুরুষ-মহিলা ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে, এমনকি দরবারিক আচরণে। মজা করেও কোনো কোনোটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার সংশোধন ও সংস্কার চেয়েছেন। তিনি খোলামেলাই লিখছেন এসব, কোনো রাখঢাক করছেন না।
স্বামী মুনেয়ো এগুলো পড়ে বললেন, এসব কি লিখছ? তোমার পদ ও সামাজিক অবস্থান তো তা অনুমোদন করে না।
শোনাগন বললেন, আমি আমার সন্তুষ্টির জন্য এসব লিখি, অন্য কারো সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির জন্য নয়।
তুমি ঝামেলাই বাঁধাবে।
ঝামেলা মনে করলে ঝামেলা।
তোমার ওপর এখনকার প্রশাসন ক্ষেপে আছে। এসব লেখা তাতে ঘৃতাহুতি দেবে।
তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
ব্যাপারটা কী ভয় পাবার মতো নয়?
সময় আমাদেরও আসবে। প্রিন্স অতসুইয়াসু এখনো বেঁচে আছে, তিনিই একদিন সম্রাট হবেন।
মিচিনাগা বেঁচে থাকা কালে নয়। এ আশঙ্কায়ই তিনি সানজুকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করিয়ে রেখেছেন।
হেইয়ান সম্রাজ্যে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।
সে আশায়ই থাকো, আমার আর নোরিনাগার বিপদ ঘটিয়ো না।
আমি থামবো না, মুনেয়ো। তোমরা তোমাদের নিরাপত্তা বিধান কর।
আমার কথা বাদ দিলাম, তুমি তোমার ছেলের কথা ভাববে না?
সেও তার নিজের ব্যবস্থা করে নেবে।
নিজের জন্য লিখছো লিখো, অনুগ্রহ করে বিলিবন্টন করো না। প্রচারটা দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে।
এদিকে ইঝোমি শিকিবু মানসিক দ্বন্দের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, বুঝতে পারছেন না কী করবেন। প্রিন্সের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাসাদে গিয়ে উঠবেন, না কি এখানেই থাকবেন।
প্রিন্স একদিন এলেন। সঙ্গে ইউকোন নো ঝো এবং পত্রবাহক ছেলেটি। এদেরকে পালকির কাছে রেখে তিনি ইঝোমির সঙ্গে দেখা করলেন। এক পর্যায়ে বললেন যে, তার প্রাসাদে থাকবেন পয়তাল্লিশ দিন।
ইঝোমি বললেন, কী করতে হবে আমাকে?
প্রিন্স বললেন, আমার সঙ্গে সেখানে যেতে হবে।
আমাকে ভাবতে দিন। কিছুক্ষণ পর বললেন, এটা আমার জন্য বিব্রতকর। আমি কী পরিচয়ে সেখানে যাব। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
উভয়ে ভাবতে ভাবতে, কথা বলতে বলতে রাত কেটে গেল। কেউ জেগে ওঠার আগেই প্রিন্স দ্রুত সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেলেন। তার ভয় পাছে কেউ দেখে ফেলে।
ইঝোমি প্রিন্স চলে যাবার পর ভাবতে বসলেন। প্রিন্সকে নিয়ে সাংসারিক কাজকর্মে জড়িয়ে ধর্মকর্ম ভুলে গেছেন। মানুষ তার বিশ্বাসপ্রবণতা নিয়ে হাসাহাসি করবে। এখন যেমন আছেন তেমনই কী থাকবেন। নাকি বাবা-মা ভাইবোনের কাছে চলে যাবেন? বাবা তো তাকে ত্যাজ্য করেছেন। এখন আবার বোঝা মনে করবেন নাতো? প্রিন্স পরিত্যাগ করলেই বা কী করবেন? তিনি প্রিন্সের কাছেই যাবেন। একসঙ্গে থাকবেন। তবে তা নিজে জানাবেন না, এ ব্যাপারে লিখবেনও না। তার পুরোনো বন্ধুদের কেউ কেউ পত্র লিখেছেন তিনি এসব পত্রের জবাবই দেননি এই ভেবে যে, কিছুই লেখার নেই। কারণ প্রিন্সের কাছেই চলে যাবেন।
প্রিন্সের কাছ থেকে একটি পত্র এল। তিনি আশান্বিত হয়ে উঠলেন। তাকে নিতে প্রিন্স কখন আসবেন নিশ্চয়ই এই পত্রে তা লেখা আছে। পত্র খুলে অবাক। একি লিখেছেন প্রিন্স। তিনি লিখেছেন, আমি চরম বোকা তোমাকে বিশ্বাস করেছি। একটি পুরোণো কবিতা আছে সঙ্গে: তুমি বিশ্বাসযোগ্য নও/ আমি এনিয়ে কোনো অভিযোগ করিনি/ সমুদ্র যেমন নিরব থাকে/ আমার হৃদয়ে গভীর ঘৃণা।
তাতে ইঝোমির হৃদয় ভেঙ্গে গেল।
তিপ্পান্ন.
আজ আবার বহুদিন পর রাজকীয় ভোজানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ভোজানুষ্ঠানের আগে কবিতা পাঠ, নাচগান এবং নো নাটকের অংশ বিশেষের অভিনয় হচ্ছে। অনুষ্ঠান বেশ জমজমাট।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন যথারীতি কবি (সভাকবি) ফুজিওয়ারা নো কিন্তু। তিনি হঠাৎ করেই বললেন, মুরাসাকি তোমার গেঞ্জি মনোগাতারিতে এই প্রাসাদের কোন কোন চরিত্রের কথা আছে?
মুরাসাকিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাই তার উদ্দেশ্য। প্রাসাদে কেউ তাকে মুরাসাকি বলে ডাকে না, ডাকে তাকাকু বলে। এতে সবাই তার দিকে তাকালো বিস্ময়কর দৃষ্টিতে। মুরাসাকি তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, ‘আমার কোনো চরিত্র এখানে বাস করে না।’ সেদিন থেকে তাকাকু সভায় সবার কাছে মুরাসাকি হয়ে গেলেন। কেউ আর কখনো তাকে তাকাকু নামে ডাকেনি।
অথচ মুরাসাকি চরিত্রে নিজের জীবনের ছিটে ফোটা এসে গেলেও তিনি যেন তার নতুন স্রষ্টা ঈশ্বরই থাকতে চেয়েছেন, উপন্যাসের চরিত্র হতে যান নি।
বিব্রত করার জন্য কিন্তুকে শক্ত কথা বলতে পারতেন, বললেন না। তাতে সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কার মিলল, লেডি সেনশি (সম্রাটমাতা) তাকে কাছে নিয়ে বসালেন। সম্রাটকে বললেন, এর ‘গেঞ্জি পড়েছ? না পড়ে থাকলে পড়বে। সাম্রাজ্য পরিচালনার অনেক কিছু আছে তাতে।
সম্রাট অদ্ভুতভাবে তাকালেন তার দিকে। মিচিনাগা বললেন, আমি কিন্তু প্রতিটি স্ক্রল পাঠ করেছি। অসাধারণ বললেও কম বলা হয়।
লেডিদের অনেকেই তাতে ঈর্ষাবোধ করলেন। উপস্থিত প্রিন্সরা অর্থপূর্ণ তাকালেন।
বিদগ্ধ রমণী সেনশির দরবারে যেসব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসেন, তারা তখন বললেন, সম্র্রাট মাতা যা বলেছেন একেবারেই অকাট্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষন করার সুযোগ নেই।
রাতের অনুষ্ঠান শেষ হলো মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়।
পরদিনই ‘গেঞ্জি’র অংশ বিশেষসহ মুরাসাকিকে সম্রাটের দরবারে ডাকা হল। তিনি তখন সন্তানসম্ভবা সম্রাজ্ঞীকে চীনা লেখকদের গীতিকা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন। সম্রাজ্ঞী বললেন যাও। গতরাতের প্রশংসা সম্রাট এখন যাচাই করে দেখবেন।
মুরাসাকি সহজ-সরল মানুষ। উচ্চাশার পরিবর্তে প্রপিতামহ কবি নাকাসুনের অহংকার নিয়ে বেঁচে আছেন। সম্রাট সভাসদদের নিয়ে দরবার চালাচ্ছেন। মুরাসাকিকে দেখে বললেন, তোমার পছন্দের একটি অংশ শোনাও। মুরাসাকি শুনিয়ে দিলেন। তুমি বুদ্ধিমতী এবং অবশ্যই জাপানের ঘটনাপঞ্জি (ক্রনিক্যাল) জানো। একজন অমাত্য বললেন, উচ্চশিক্ষিতা। সম্রাট বললেন, ভালো। আমাকে পুরো একটি প্রতিলিপি দেবে। দেবে তো?
মুরাসাকি স্কুলের বালিকাদের মতো মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ দেবেন।
সেদিন দরবারে মিচিনাগা উপস্থিত ছিলেন না। তিনি থাকলে হয়ত ব্যাপারটা আরো আনন্দঘন হত। তবে পরে ব্যাপারটা শুনেছেন। তিনি মুরাসাকির কক্ষে উপস্থিত হলেন। সবগুলো স্ক্রল ঘেটে ঘেটে শৈল্পিক ক্যালিগ্রাফি এবং ইলাস্টেশন দেখে একটি ফর্দ তৈরি করলেন। বললেন, এগুলো সম্রাটের দরবারে নিয়ে চল।
মুরাসাকি বললেন, সম্রাজ্ঞীর সেবক কাউকে দিয়ে পাঠানোই ঠিক হবে, এগুলোর ওজন অনেক।
মিচিনাগা তার ডানের জেনারেলকে বললেন, তুমি অর্ধেক নাও, আমি অর্ধেক নিচ্ছি। মুরাসাকিকে বললেন, ভালো কথা, সকল স্ক্রলের অংশ তোমার কাছে আছে তো? মিলিয়ে দেখো। মুরাসাকি এক ফর্দ আলাদাভাবে অনেক আগেই রেখে দিয়েছেন। বললেন, সবঠিক আছে।
এরা দু’জন স্ক্রলগুলো ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন, মুরাসাকি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন এবং ভাবলেন, মিচিনাগা তাকে এতটা ভালোবাসেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তার অর্থ কী! আর কী পাওয়ার বাকী আছে?
স্যামন নো নাইশি সম্রাজ্ঞীর দরবারে আরেকজন লেডি-ইন-ওয়েটিং। তিনি কোনো কারণ ছাড়াই মুরাসাকিকে অপছন্দ এবং ঈর্ষা করেন। মুরাসাকি তা জানেন না। তিনি যেহেতু কারো সামনে-পেছনে নেই, এনিয়ে ভাবিতও নন। এই মহিলা সম্রাজ্ঞীর এক বার্তা নিয়ে সম্রাটের দরবারে গিয়ে ‘গেঞ্জি’ পাঠ এবং সম্রাটের মন্তব্য শুনেছেন। মন্তব্যের পুরোটা মনে হয় শুনতে পাননি, অথবা শুনেছেন এবং তা বিকৃত করে প্রচার করেন যে, সম্রাট মুরাসাকিকে ‘নিহোনজি নো সুবোন’ আখ্যা দিয়েছেন। যার অর্থ হচ্ছে ইংরেজিতে ‘আওয়ার লেডি অব দ্য ক্রনিক্যালস’। দৃশ্যত কথাটা ভালো এবং প্রশংসা মনে হতে পারে। নাইশি সে অর্থে নয়, চাটুক্তি হিসেবে তা প্রচার করে- যা অপমানজনক ও অস্বস্থিকর। কয়েক বছর পর মুরাসাকি তার ডায়েরিতে লেখেন, কী উদ্ভট! যে কিনা প্রাসাদের মহিলাদেরও কিছু জানাতে দ্বিধাবোধ করে, সে তা সম্রাটের দরবারে জানাতে যাবে?
তিনি আসলে ‘গেঞ্জি’র অংশ বিশেষ পাঠ করা ছাড়া সেখানে আর কোনো কথাই বলেননি। তার স্বভাবে তা যায় না। তিনি সেখানে বিচলিতবোধই করেছেন।
অথচ বাইরে একটা অর্থহীন প্রচারণার দুর্ভোগ তাকে পোহাতে হয়েছে এবং হচ্ছে। পরে জেনেছেন নাইশি আগেও তার প্রচুর সমালোচনা এবং অমূলক দুর্নাম ছড়িয়েছেন। এটা কোনো কোনো নারীর স্বভাবজাত। অন্যের সুখ দেখলে ঘুম হয় না, সুনাম শুনলে ঈর্ষায় বুক ফেটে যায়। হেইয়ান সম্রাটদের এত সুন্দর প্রাসাদ, বাগানের ফুল, হ্রদের স্বচ্ছ টলটলে জল এবং উদার নীলাকাশ তাদের উদারতার শিক্ষা দেয় না।
ইমন তা শুনে অবাকই হলেন। বললেন, তুমি চুপ করে বসে আছো কেন?
আমাকেও তাদের দুর্নাম করতে বলছেন?
তাকাকু, আমি তোমাকে সে কথা বলছি না। তোমার ক্ষমতা তুমি প্রয়োগ করো। মিচিনাগাকে জানাও, সম্রাজ্ঞীকে বলো।
মুরাসাকি হেসে দিয়ে বললেন, সহ্যের ক্ষমতার চাইতে বড় ক্ষমতা নেই। নিজের ওপর তাই প্রয়োগ করছি। আমার পরিবারের ঐতিহ্য এটা, বিনয়ী এবং ভদ্র থাকা। আপনাকে আজ বলতে অসুবিধা নেই দুই বছর আগের কথা। আমরা, অর্থাৎ আমি এবং মহামান্যা চীনা ধ্রুপদীর চর্চা করছিলাম। তাদেরই কেউ একজন গিয়ে সম্রাটের কানে দিয়েছে রঙচঙ ছড়িয়ে। সম্রাট আমাদের ডাকালেন। আমি অকপটে স্বীকার করলাম। তখন গ্রীষ্মকাল ছিল। মহামান্যা ঘামছিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, বড় কিছু একটা ঘটবে।
তারপর কী হল?
আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সম্রাট সম্রাজ্ঞীকে অনেকগুলো চীনা কাব্যগ্রন্থ উপহার দিলেন। সেখানে মহামান্যার বাবাও উপস্থিত ছিলেন। মহামান্যা কাব্যগ্রন্থগুলোর অনুলিপি করিয়েছিলেন। মনে হয় নাইশি তা জানেন না। জানলে তা নিয়ে নানা সমালোচনা আর বদনাম ছড়াতে ছাড়তেন না। বলে খুব হাসলেন মুরাসাকি।
তোমরা চীনা ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠ করতে। কার লেখা ছিল এগুলো?
আমরা সংগ্রহ করেছিলাম বাইযুয়ীর গীতিকার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খন্ড দু’টি। খুব গোপনে ভাষাটা শেখাতাম সম্রাজ্ঞীকে। তাও কারা যেন জেনে গেল।
মনে হয় আড়ি পেতে ছিল মহামান্যারই কাছের কেউ।
হতে পারে। মহামান্যা যাদের নিয়ে মাঝে-মধ্যে আড্ডায় বসেন তাদের বয়স খুব বেশি না। একবার হলো কী, মহামান্যা কতোগুলো কম বয়সী যুবতীকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তিনি হয়তো ভাবছেন তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। কিন্তু তার পারিষদ মনে করছেন তা সম্রাজ্ঞীর নির্বুদ্ধিতাকে স্পষ্ট করছে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। অথচ এরাই সামনে তার প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।
প্রাসাদের লোকদের চরিত্রই এরকম, বুঝলে? ক্রমশ...