ভোটের মাঠে জটিল সমীকরণে আইভী-তৈমুর

বিপুল ভোটের ব্যবধানে গত দুই মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি এবারও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। তবে এবার শুরুতে যেমনটা মনে হয়েছিল শেষ মুহূর্তে তার পথটা তেমন সহজ মনে হচ্ছে না খোদ আইভী সমর্থকদেরও। কেননা বিগত কয়েকদিনে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা আইভীকে কিছুটা হলেও বেকায়দায় ফেলেছে। ভোটের মাঠের তথ্য এমনটাই বলছে।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পাশাপাশি আইভীকে লড়তে হচ্ছে পুরোনো ‘ছায়া শত্রুদের’ সঙ্গেও। আইভীর এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকার। ২০১১ সালে ভোট গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা আগে সরে দাঁড়ালেও এইবার ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ অবস্থানে আছেন তৈমুর। তবে তার সামনেও রয়েছে জটিল সমীকরণ।

আইভীর দুর্বলতা তৈমুর আলম খন্দকারের শক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হলেও তার পথও সহজ নয়। কেননা তিনি তার দলীয় নেতাদের একটি বড় অংশের সমর্থন পাচ্ছেন না। এমনকি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতা আইভীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তার ওপর দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ক্ষুব্ধবি এনপির কেন্দ্র তাকে তিনটি পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এটিও নেতা-কর্মীদের কাছে তৈমুর সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে বলে বলছেন তার দলের নেতারা।

আইভীর ‘সুবিধা’

গত দুই মেয়াদে নগরীর উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্যই নয় আইভী এই শহরে জনপ্রিয় আরও কয়েকটি কারণে। শহরের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, শুধু নারায়ণগঞ্জে নয় সারা বাংলাদেশেই সেলিনা হায়াৎ আইভী ‘প্রতিবাদী’ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন, মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাসহ বিভিন্ন গুম-খুনের ঘটনায় সোচ্চার ছিলেন আইভী। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে সব সময়ই জোরালো আওয়াজ ছিল তার। তার পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কোন কর্মকান্ডের অভিযোগ নেই।

২০১১ সালে লক্ষাধিক এবং ২০১৬ সালে প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি, সাংস্কৃতিক জোটসহ সমমনা বিভিন্ন সংগঠন। ‘মানুষ আইভীকে কেন ভোট দেবে’ এই প্রশ্নের জবাবে নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি রফিউর রাব্বি সংবাদকে বলেন, ‘আইভী এই নগরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ের অনুন্নত অংশটির চেহারাই বদলে দিয়েছেন তিনি। সারা দেশে নৌকা প্রতীক নিয়ে অনীহা থাকলেও আইভীর অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহরে ভিন্ন। এবারও বড় ব্যবধানে বিজয়ী হবেন আইভী।’

তবে ভোটের মাঠে সমীকরণটা তত সহজ নয়। এবার সমীকরণ কিছুটা জটিল হতে পারে বলেও বলছেন অনেকে। আলোচনা রয়েছে, দলীয় পরিচয়ে আওয়ামী লীগ হলেও নির্বাচনে বিএনপিরও ভোট পান আইভী। ২০১১ সালে বিএনপির বড় একটি অংশ ভোট দিয়ে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আইভীকে নির্বাচিত করেছিল। ২০১৬ সালেও ধানের শীষের প্রার্থী থাকলেও প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয় পান আইভী। বিএনপি ঘরানার মানুষের ভোট না পেলে ব্যবধান এত বাড়তো না বলেই বিশ্লেষক মহলের মত।

তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হলেও তৈমুর আলমের পক্ষে বিএনপির একটি অংশ আছেন। তাছাড়া সরকারদলীয় কিছু নেতার বক্তব্যও নির্বাচনের মাঠ উত্তপ্ত করেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে দলীয় প্রার্থী আইভীরই। সিটি নির্বাচনকে ঘিরে সরকারদলীয় নেতাদের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ বিএনপি সমর্থকরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, নগরবাসী আইভীকে তাদের নিজেদের লোক মনে করেন। এই অবস্থান তিনি তৈরি করেছেন দল-মতের ঊর্ধ্বে অবস্থান নেয়ার মধ্য দিয়ে। তবে তার দলেরই নেতা-কর্মীদের কিছু বক্তব্য ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ভুল বার্তা দিচ্ছে।

শামীম ওসমানে আইভীর ‘উভয় সংকট’

শামীম ওসমান প্রসঙ্গ এই শহরে আইভীর জন্য উভয় সংকট। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই দলের হলেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। তাদের মতবিরোধ সংঘাতেও রূপ নেয়। সেই শামীম ওসমান এই নির্বাচনে শুরু থেকেই তৈমুর আলমের পক্ষে ‘ছায়া’ হিসেবে ছিলেন। ‘চাপে কিংবা রাজনৈতিক কৌশলেই’ হোক শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে আইভীর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তার কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে মাঠে নেই। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখির পর গত দুইদিন অনুসারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা শহরে মিছিল করলেও তাতে প্রার্থীর প্রতি অনীহা ছিল স্পষ্ট। তারা শামীম ওসমানের নামে শ্লোগান দিলেও কদাচিৎ শ্লোগান দিয়েছেন আইভীর নামে।

মিছিল ছাড়া দলীয় প্রার্থীর প্রচারণায় কিংবা তার পক্ষে গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ করতে শামীম ওসমান অনুসারী কাউকে দেখা যায়নি। এতেই বিরোধ যে মেটেনি তা স্পষ্ট। আইভী শিবিরের অভিযোগ, শামীম ওসমানের অনুসারীরা গোপনে আইভীবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তারা তৈমুর আলমের পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ অর্থও ব্যয় করছেন।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল বলছে, শামীম ওসমান আইভীর পক্ষে আছেন এই প্রচারণাও আইভীর জন্য নেতিবাচক। কেননা এই শহরের মানুষ আইভীকে শামীম ওসমানের পাল্টা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। নানা কারণে নেতিবাচকভাবে আলোচিত শামীম ওসমানকে অপছন্দের কারণেই আইভীকে বারবার বেছে নেয় তারা। সেক্ষেত্রে শামীম ওসমানের সমর্থনও আইভীর জন্য ভোটের মাঠে নেতিবাচক বলে করেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।

গত দেড় বছর যাবৎ শামীম ওসমান অনুসারীদের মসজিদ, মন্দির ইস্যুতে একের পর এক আইভীবিরোধী প্রচারও ভোটের মাঠে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতমুক্ত রাখাকে কেন্দ্র করে সাধারণ হকারদের রাজনৈতিক স্বার্থে আইভীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার বিষয়টিও এই নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে।

চ্যালেঞ্জে তৈমুরও

দলীয় নেতাদের একটি বড় অংশের সমর্থন পাচ্ছেন না তৈমুর আলম খন্দকার। এমনকি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতা আইভীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাছাড়া দলীয় প্রতীকের বাইরে গিয়ে ব্যক্তি তৈমুর আলম কতোটা সফলতা পাবেন তা নিয়েও সন্দিহান তার দলেরই একাধিক নেতা।

বিরোধী দলের রাজনীতি করলেও সরকারবিরোধী মনোভাবের যেই সুবিধা পাওয়ার কথা সেটা তৈমুর পাবেন কিনা টা নিয়ে সন্দিহান তার দলের নেতারাই।

মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান সংবাদকে বলেন, ‘বিএনপির ৯০ শতাংশ নেতাই তৈমুর আলমের সঙ্গে নেই। সেক্ষেত্রে কর্মীরাও নীরব। ব্যক্তিগতভাবে তৈমুর আলম খন্দকারের ভোটব্যাংক তেমন একটা নেই।’

অন্যদিকে শামীম ওসমান তাকে সমর্থন দিয়েছে এই আলোচনা তার জন্য ইতিবাচক কিছু না। তিনি এ বিষয়ে শুরু থেকেই মানুষকে ধোঁয়াশায় রেখেছেন। এই ধোঁয়াশা তার জন্য নেতিবাচক হতে পারে। অনেকের মত, তৈমুর আলমকে নির্বাচিত করে শামীম ওসমানের হাতে এই শহরের দায়িত্বে দিতে চাইবেন না সাধারণ ভোটাররা।

অনেক নগরবাসী বলছেন, এ শহরের নাগরিক সমস্যা নিয়ে কখনও কথা বলতে দেখা যায়নি তৈমুর আলম খন্দকারকে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি মূলত রাজধানীবাসী। দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা হলেও গত দুই বছর করোনার সংকটকালীন সময়ে তাকে কাছে পায়নি এই নগরীর মানুষ। শহরের মানুষের খোঁজখবর তিনি নেননি। এমনকি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এক মাস আগেও শহরের মানুষ তৈমুর আলমের প্রার্থিতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। নির্বাচনের কোন পরিকল্পনা ছিল না তৈমুরের নিজেরও।

আশাবাদী দুইজনই

তবে যতই সমীকরণ থাকুক না কেন নির্বাচনী বিজয় নিয়ে মোটেও সন্দিহান নন দুই মেয়র প্রার্থীর কেউই। সেলিনা হায়াৎ আইভী সংবাদকে বলেন, ‘জনতা তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এই শহরের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করেছি। কখনও কারো সঙ্গে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম করিনি। সততার সঙ্গে কাজ করেছি। এর প্রতিদান আগে যেমন নগরবাসী দিয়েছে, আবারও দেবে।’

আর তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘এ শহরের মানুষ বিকল্প চায়। বিকল্প হিসেবে তাকেই বেছে নিবে মানুষ। জনগণের রায়ই হবে চূড়ান্ত।’

শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২২ , ৩০ পৌষ ১৪২৮ ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

ভোটের মাঠে জটিল সমীকরণে আইভী-তৈমুর

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

image

নাসিক নির্বাচন : ভোটের আর একদিন বাকি। গতকালের প্রচারে আইভী ও তৈমুর

বিপুল ভোটের ব্যবধানে গত দুই মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি এবারও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। তবে এবার শুরুতে যেমনটা মনে হয়েছিল শেষ মুহূর্তে তার পথটা তেমন সহজ মনে হচ্ছে না খোদ আইভী সমর্থকদেরও। কেননা বিগত কয়েকদিনে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা আইভীকে কিছুটা হলেও বেকায়দায় ফেলেছে। ভোটের মাঠের তথ্য এমনটাই বলছে।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পাশাপাশি আইভীকে লড়তে হচ্ছে পুরোনো ‘ছায়া শত্রুদের’ সঙ্গেও। আইভীর এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকার। ২০১১ সালে ভোট গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা আগে সরে দাঁড়ালেও এইবার ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ অবস্থানে আছেন তৈমুর। তবে তার সামনেও রয়েছে জটিল সমীকরণ।

আইভীর দুর্বলতা তৈমুর আলম খন্দকারের শক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হলেও তার পথও সহজ নয়। কেননা তিনি তার দলীয় নেতাদের একটি বড় অংশের সমর্থন পাচ্ছেন না। এমনকি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতা আইভীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তার ওপর দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ক্ষুব্ধবি এনপির কেন্দ্র তাকে তিনটি পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এটিও নেতা-কর্মীদের কাছে তৈমুর সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে বলে বলছেন তার দলের নেতারা।

আইভীর ‘সুবিধা’

গত দুই মেয়াদে নগরীর উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্যই নয় আইভী এই শহরে জনপ্রিয় আরও কয়েকটি কারণে। শহরের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, শুধু নারায়ণগঞ্জে নয় সারা বাংলাদেশেই সেলিনা হায়াৎ আইভী ‘প্রতিবাদী’ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন, মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাসহ বিভিন্ন গুম-খুনের ঘটনায় সোচ্চার ছিলেন আইভী। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে সব সময়ই জোরালো আওয়াজ ছিল তার। তার পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কোন কর্মকান্ডের অভিযোগ নেই।

২০১১ সালে লক্ষাধিক এবং ২০১৬ সালে প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি, সাংস্কৃতিক জোটসহ সমমনা বিভিন্ন সংগঠন। ‘মানুষ আইভীকে কেন ভোট দেবে’ এই প্রশ্নের জবাবে নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি রফিউর রাব্বি সংবাদকে বলেন, ‘আইভী এই নগরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ের অনুন্নত অংশটির চেহারাই বদলে দিয়েছেন তিনি। সারা দেশে নৌকা প্রতীক নিয়ে অনীহা থাকলেও আইভীর অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহরে ভিন্ন। এবারও বড় ব্যবধানে বিজয়ী হবেন আইভী।’

তবে ভোটের মাঠে সমীকরণটা তত সহজ নয়। এবার সমীকরণ কিছুটা জটিল হতে পারে বলেও বলছেন অনেকে। আলোচনা রয়েছে, দলীয় পরিচয়ে আওয়ামী লীগ হলেও নির্বাচনে বিএনপিরও ভোট পান আইভী। ২০১১ সালে বিএনপির বড় একটি অংশ ভোট দিয়ে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আইভীকে নির্বাচিত করেছিল। ২০১৬ সালেও ধানের শীষের প্রার্থী থাকলেও প্রায় ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয় পান আইভী। বিএনপি ঘরানার মানুষের ভোট না পেলে ব্যবধান এত বাড়তো না বলেই বিশ্লেষক মহলের মত।

তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হলেও তৈমুর আলমের পক্ষে বিএনপির একটি অংশ আছেন। তাছাড়া সরকারদলীয় কিছু নেতার বক্তব্যও নির্বাচনের মাঠ উত্তপ্ত করেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে দলীয় প্রার্থী আইভীরই। সিটি নির্বাচনকে ঘিরে সরকারদলীয় নেতাদের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ বিএনপি সমর্থকরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, নগরবাসী আইভীকে তাদের নিজেদের লোক মনে করেন। এই অবস্থান তিনি তৈরি করেছেন দল-মতের ঊর্ধ্বে অবস্থান নেয়ার মধ্য দিয়ে। তবে তার দলেরই নেতা-কর্মীদের কিছু বক্তব্য ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ভুল বার্তা দিচ্ছে।

শামীম ওসমানে আইভীর ‘উভয় সংকট’

শামীম ওসমান প্রসঙ্গ এই শহরে আইভীর জন্য উভয় সংকট। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই দলের হলেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। তাদের মতবিরোধ সংঘাতেও রূপ নেয়। সেই শামীম ওসমান এই নির্বাচনে শুরু থেকেই তৈমুর আলমের পক্ষে ‘ছায়া’ হিসেবে ছিলেন। ‘চাপে কিংবা রাজনৈতিক কৌশলেই’ হোক শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে আইভীর পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তার কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে মাঠে নেই। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখির পর গত দুইদিন অনুসারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা শহরে মিছিল করলেও তাতে প্রার্থীর প্রতি অনীহা ছিল স্পষ্ট। তারা শামীম ওসমানের নামে শ্লোগান দিলেও কদাচিৎ শ্লোগান দিয়েছেন আইভীর নামে।

মিছিল ছাড়া দলীয় প্রার্থীর প্রচারণায় কিংবা তার পক্ষে গণসংযোগ, লিফলেট বিতরণ করতে শামীম ওসমান অনুসারী কাউকে দেখা যায়নি। এতেই বিরোধ যে মেটেনি তা স্পষ্ট। আইভী শিবিরের অভিযোগ, শামীম ওসমানের অনুসারীরা গোপনে আইভীবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তারা তৈমুর আলমের পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ অর্থও ব্যয় করছেন।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল বলছে, শামীম ওসমান আইভীর পক্ষে আছেন এই প্রচারণাও আইভীর জন্য নেতিবাচক। কেননা এই শহরের মানুষ আইভীকে শামীম ওসমানের পাল্টা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। নানা কারণে নেতিবাচকভাবে আলোচিত শামীম ওসমানকে অপছন্দের কারণেই আইভীকে বারবার বেছে নেয় তারা। সেক্ষেত্রে শামীম ওসমানের সমর্থনও আইভীর জন্য ভোটের মাঠে নেতিবাচক বলে করেন তার ঘনিষ্ঠজনরা।

গত দেড় বছর যাবৎ শামীম ওসমান অনুসারীদের মসজিদ, মন্দির ইস্যুতে একের পর এক আইভীবিরোধী প্রচারও ভোটের মাঠে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতমুক্ত রাখাকে কেন্দ্র করে সাধারণ হকারদের রাজনৈতিক স্বার্থে আইভীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার বিষয়টিও এই নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে।

চ্যালেঞ্জে তৈমুরও

দলীয় নেতাদের একটি বড় অংশের সমর্থন পাচ্ছেন না তৈমুর আলম খন্দকার। এমনকি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিএনপি নেতা আইভীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাছাড়া দলীয় প্রতীকের বাইরে গিয়ে ব্যক্তি তৈমুর আলম কতোটা সফলতা পাবেন তা নিয়েও সন্দিহান তার দলেরই একাধিক নেতা।

বিরোধী দলের রাজনীতি করলেও সরকারবিরোধী মনোভাবের যেই সুবিধা পাওয়ার কথা সেটা তৈমুর পাবেন কিনা টা নিয়ে সন্দিহান তার দলের নেতারাই।

মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান সংবাদকে বলেন, ‘বিএনপির ৯০ শতাংশ নেতাই তৈমুর আলমের সঙ্গে নেই। সেক্ষেত্রে কর্মীরাও নীরব। ব্যক্তিগতভাবে তৈমুর আলম খন্দকারের ভোটব্যাংক তেমন একটা নেই।’

অন্যদিকে শামীম ওসমান তাকে সমর্থন দিয়েছে এই আলোচনা তার জন্য ইতিবাচক কিছু না। তিনি এ বিষয়ে শুরু থেকেই মানুষকে ধোঁয়াশায় রেখেছেন। এই ধোঁয়াশা তার জন্য নেতিবাচক হতে পারে। অনেকের মত, তৈমুর আলমকে নির্বাচিত করে শামীম ওসমানের হাতে এই শহরের দায়িত্বে দিতে চাইবেন না সাধারণ ভোটাররা।

অনেক নগরবাসী বলছেন, এ শহরের নাগরিক সমস্যা নিয়ে কখনও কথা বলতে দেখা যায়নি তৈমুর আলম খন্দকারকে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি মূলত রাজধানীবাসী। দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা হলেও গত দুই বছর করোনার সংকটকালীন সময়ে তাকে কাছে পায়নি এই নগরীর মানুষ। শহরের মানুষের খোঁজখবর তিনি নেননি। এমনকি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এক মাস আগেও শহরের মানুষ তৈমুর আলমের প্রার্থিতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। নির্বাচনের কোন পরিকল্পনা ছিল না তৈমুরের নিজেরও।

আশাবাদী দুইজনই

তবে যতই সমীকরণ থাকুক না কেন নির্বাচনী বিজয় নিয়ে মোটেও সন্দিহান নন দুই মেয়র প্রার্থীর কেউই। সেলিনা হায়াৎ আইভী সংবাদকে বলেন, ‘জনতা তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এই শহরের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করেছি। কখনও কারো সঙ্গে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম করিনি। সততার সঙ্গে কাজ করেছি। এর প্রতিদান আগে যেমন নগরবাসী দিয়েছে, আবারও দেবে।’

আর তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘এ শহরের মানুষ বিকল্প চায়। বিকল্প হিসেবে তাকেই বেছে নিবে মানুষ। জনগণের রায়ই হবে চূড়ান্ত।’