একের পর এক খুন, ‘বাউল বেশে’ ঘুরতেন হেলাল

কয়েক বছর আগে ইউটিউবে ‘ভাঙা তরী ছেড়া পাল’ শিরোনামে একটি মিউজিক ভিডিওতে ‘মডেল’ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছিলেন বাউলবেশী হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির। তবে সেই মিউজিক ভিডিওর সূত্র ধরেই র‌্যাবের নজরে আসেন তিনি। র‌্যাব বলছে, বাউল বেশধারী ওই ব্যক্তি এক সিরিয়াল কিলার। যে অন্তত তিনটি হত্যাকান্ডে সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হঠাৎ এত পুরোনো একটি মিউজিক ভিডিও কীভাবে এলো র‌্যাবের নজরে? র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলছেন, মাস ছয়েক আগে এক ব্যক্তি র‌্যাবকে জানায়, বগুড়ায় ২০০১ সালে চাঞ্চল্যকর বিদ্যুৎ হত্যাকান্ডের আসামি হেলাল হোসেনের চেহারার সঙ্গে ওই বাউল মডেলের চেহারার মিল রয়েছে। একটি হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছিল। তখন একটি চুরির মামলায় কারাগারে হেলাল। তবে ২০১৫ সালে যেদিন যাবজ্জীবন সাজা হয় সেদিনই চুরির মামলায় জামিন পেয়ে সে সুকৌশলে এলাকা ত্যাগ করে। এরপর ছদ্মবেশে ফেরারি জীবন শুরু।

অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে নিজ এলাকা বগুড়াতে একটি মুদির দোকান দেন হেলাল হোসেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন খুন, ঢ়তরি, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। র‌্যাব বলছে এলাকায় অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একে একে ডুইটি হত্যাকান্ডে অংশ নেন তিনি। হেলালের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাজার হাত থেকে বাঁচতে বাউলের ছদ্মবেশ ধারণ করেন তিনি। ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে। একপর্যায়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনে গিয়ে নিজের নাম পরিচয় পাল্টে ফেলে নতুন সংসার গড়েন।

এলাকাবাসীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সিরিয়াল কিলার খ্যাত ফেরার আসামি মো. হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৩)। গত বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশন এলাকা থেকে হেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাবের বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত হেলাল তিনটি হত্যাকান্ডসহ একটি চুরির মামলা এবং একটি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার আসামি বলে স্বীকার করেছেন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মঈন বলেন, ছয় মাস ধরে র‌্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশন এলাকা থেকে হেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, ২০০১ সালে অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের পরিবার বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় আদালত হেলালকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়।

তার বিরুদ্ধে আরও দুটি হত্যা মামলা রয়েছে। যার একটি ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা এবং ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলা। চাঞ্চল্যকর বিষ্ণু হত্যা মামলায় হেলাল ২১ বছর বয়সে আসামি ছিলেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছিল।

২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হন হেলাল ওরফে বাউল হেলাল। নারী নির্যাতন আইনেও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।

অপরাধ সংগঠনের সময় নিজেও জখম হয়েছেন হেলাল। ২০০০ সালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় দুইপক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় প্রতিপক্ষের ধারালো দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তার বাম হাতে মারাত্মক জখম হয় এবং বাম হাত পঙ্গু হয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকে সে ‘লুলা হেলাল’ নামে পরিচিতি পায়।

কমান্ডার মঈন বলেন, হেলালের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে চুরির মামলা এবং ২০১৫ সালে জামিন পাওয়ার দিনে বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হলে সে সুকৌশলে এলাকা ত্যাগ করে। এরপর ফেরারি জীবন শুরু করে।

প্রথমে সে বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে চলে যায়। সেখানে আমানত শাহ মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করার পর ট্রেনে করে সিলেটের শাহজালাল মাজারে যায়। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করে হেলাল। এভাবে সে বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করে কিশোরগঞ্জ ভৈরব রেলস্টেশনে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন রেখে সেলিম ফকির নাম ধারণ করে।

সাত বছরের ফেরারি জীবনে শেষের চার বছর কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনের পাশে একজন মহিলার সঙ্গে সংসার শুরু করেন। এ সময় রেলস্টেশনে বাউল গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত হেলাল।

পাঁচ বছর আগে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশের একটি গানের শুটিং চলাকালে রেললাইনের পাশে বাউল গান গাচ্ছিল। তখন শুটিংয়ের একজন ব্যক্তি তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে জনপ্রিয় ‘ভাঙা তরী ছেড়া পাল’ শিরোনামের বাউল গানের মডেল হিসেবে তাকে দেখা যায়। আর সেই সূত্রেই গত বুধবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে র?্যাব।

শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২২ , ৩০ পৌষ ১৪২৮ ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

একের পর এক খুন, ‘বাউল বেশে’ ঘুরতেন হেলাল

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

কয়েক বছর আগে ইউটিউবে ‘ভাঙা তরী ছেড়া পাল’ শিরোনামে একটি মিউজিক ভিডিওতে ‘মডেল’ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছিলেন বাউলবেশী হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির। তবে সেই মিউজিক ভিডিওর সূত্র ধরেই র‌্যাবের নজরে আসেন তিনি। র‌্যাব বলছে, বাউল বেশধারী ওই ব্যক্তি এক সিরিয়াল কিলার। যে অন্তত তিনটি হত্যাকান্ডে সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হঠাৎ এত পুরোনো একটি মিউজিক ভিডিও কীভাবে এলো র‌্যাবের নজরে? র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলছেন, মাস ছয়েক আগে এক ব্যক্তি র‌্যাবকে জানায়, বগুড়ায় ২০০১ সালে চাঞ্চল্যকর বিদ্যুৎ হত্যাকান্ডের আসামি হেলাল হোসেনের চেহারার সঙ্গে ওই বাউল মডেলের চেহারার মিল রয়েছে। একটি হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজাও হয়েছিল। তখন একটি চুরির মামলায় কারাগারে হেলাল। তবে ২০১৫ সালে যেদিন যাবজ্জীবন সাজা হয় সেদিনই চুরির মামলায় জামিন পেয়ে সে সুকৌশলে এলাকা ত্যাগ করে। এরপর ছদ্মবেশে ফেরারি জীবন শুরু।

অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে নিজ এলাকা বগুড়াতে একটি মুদির দোকান দেন হেলাল হোসেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন খুন, ঢ়তরি, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। র‌্যাব বলছে এলাকায় অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একে একে ডুইটি হত্যাকান্ডে অংশ নেন তিনি। হেলালের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাজার হাত থেকে বাঁচতে বাউলের ছদ্মবেশ ধারণ করেন তিনি। ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে। একপর্যায়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনে গিয়ে নিজের নাম পরিচয় পাল্টে ফেলে নতুন সংসার গড়েন।

এলাকাবাসীর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে সিরিয়াল কিলার খ্যাত ফেরার আসামি মো. হেলাল হোসেন ওরফে সেলিম ফকির ওরফে বাউল সেলিমকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৩)। গত বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশন এলাকা থেকে হেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাবের বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত হেলাল তিনটি হত্যাকান্ডসহ একটি চুরির মামলা এবং একটি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার আসামি বলে স্বীকার করেছেন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মঈন বলেন, ছয় মাস ধরে র‌্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশন এলাকা থেকে হেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, ২০০১ সালে অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের পরিবার বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় আদালত হেলালকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়।

তার বিরুদ্ধে আরও দুটি হত্যা মামলা রয়েছে। যার একটি ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলা এবং ২০০৬ সালে রবিউল হত্যা মামলা। চাঞ্চল্যকর বিষ্ণু হত্যা মামলায় হেলাল ২১ বছর বয়সে আসামি ছিলেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছিল।

২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার হন হেলাল ওরফে বাউল হেলাল। নারী নির্যাতন আইনেও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।

অপরাধ সংগঠনের সময় নিজেও জখম হয়েছেন হেলাল। ২০০০ সালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বগুড়ায় দুইপক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় প্রতিপক্ষের ধারালো দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তার বাম হাতে মারাত্মক জখম হয় এবং বাম হাত পঙ্গু হয়ে যায়। এই ঘটনার পর থেকে সে ‘লুলা হেলাল’ নামে পরিচিতি পায়।

কমান্ডার মঈন বলেন, হেলালের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে চুরির মামলা এবং ২০১৫ সালে জামিন পাওয়ার দিনে বিদ্যুৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হলে সে সুকৌশলে এলাকা ত্যাগ করে। এরপর ফেরারি জীবন শুরু করে।

প্রথমে সে বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে চলে যায়। সেখানে আমানত শাহ মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করার পর ট্রেনে করে সিলেটের শাহজালাল মাজারে যায়। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করে হেলাল। এভাবে সে বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করে কিশোরগঞ্জ ভৈরব রেলস্টেশনে নাম-ঠিকানা ও পরিচয় গোপন রেখে সেলিম ফকির নাম ধারণ করে।

সাত বছরের ফেরারি জীবনে শেষের চার বছর কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলস্টেশনের পাশে একজন মহিলার সঙ্গে সংসার শুরু করেন। এ সময় রেলস্টেশনে বাউল গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত হেলাল।

পাঁচ বছর আগে হেলাল নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে কিশোর পলাশ ওরফে গামছা পলাশের একটি গানের শুটিং চলাকালে রেললাইনের পাশে বাউল গান গাচ্ছিল। তখন শুটিংয়ের একজন ব্যক্তি তাকে গানের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে জনপ্রিয় ‘ভাঙা তরী ছেড়া পাল’ শিরোনামের বাউল গানের মডেল হিসেবে তাকে দেখা যায়। আর সেই সূত্রেই গত বুধবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে র?্যাব।