ফেরিতে স্থাপিত ফগলাইট কারসাজি

দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি নৌপথ দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া। শীতের মৌসুম শুরু হলে ঘন কুয়াশার কারণে প্রায়ই এই দুই নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘন কুয়াশার মধ্যেও ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে প্রায় ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট লাগানো হয়। তবে ফেরিসংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উন্নত প্রযুক্তির ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট বসানোর কথা থাকলেও বসানো হয় শুধু সার্চলাইট। ফলে এসব লাইট ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে কোন কাজেই আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার মধ্যে নৌপথে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ২০১৫ সালের জুন মাসে নৌ মন্ত্রণালয় টেন্ডারের মাধ্যমে ১০টি ফেরিতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফগলাইট স্থাপন করে। সাড়ে সাত হাজার কিলোওয়াটের প্রতিটি ফগলাইট কিনতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় আমেরিকা থেকে এসব ফগলাইট স্থাপন করতে মোট খরচ হয় পাঁচ কোটি টাকা। অথচ ফেরিতে থাকা আগের সার্চ লাইটগুলোতে কুয়াশার মধ্যে নৌ চ্যানেলের মার্কার (বিকনবাতি) যতটুকু দেখা যেত, নতুন স্থাপন করা ফগলাইটে তাও দেখা যায় না। ফলে ঘন কুয়াশার সময় এসব ফগলাইট কোন কাজে না আসায় বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ফগলাইট স্থাপন করা ফেরিগুলো হচ্ছে, রো রো ফেরি খানজাহান আলী, শাহ আলী, কেরামত আলী, ভাষা শহীদ বরকত, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, শাহ আমানত, শাহ পরান ও কে-টাইপ ফেরি কপোতি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট। প্রতিদিন এই দুই নৌরুট দিয়ে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ হাজার হাজার বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ফেরিতে পদ্মা পারাপার হয়। অথচ এ নৌপথে শীত মৌসুমের বেশির ভাগ সময়ে ঘন কুয়াশার কারণে সারা রাত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা। দীর্ঘ সময় ঘাট এলাকায় আটকা পড়ে চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রী ও যানবাহন চালকরা। এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু চলাচলকারী ফেরিগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির কার্যকরি ফগলাইটের ব্যবস্থা নেই।

জানা যায়, ফেরিতে স্থাপন করা এসব ফগলাইট লাগানোর সময় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, নেভিগেশনাল এইড সংযোজনের মাধ্যমে এ লাইট দেশের ফেরিতে প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে শীত মৌসুমের ঘন কুয়াশার মধ্যেও ফেরি চলাচল করতে পারবে। এসব শুধু কথার কথাই থেকে গেল। ঘন কুয়াশায় ফেরি সার্ভিস সচল রাখতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আমেরিকা থেকে আমদানি করা উন্নতমানের ফগলাইট ফেরিগুলোতে স্থাপন করেও কুয়াশায় ঘণ্টার পর ঘণ্ট ফেরি সার্ভিস বন্ধ থাকছে। এতে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কুয়াশায় যদি ফেরিগুলো সচল না থাকে, তবে কেন এ ফগলাইট স্থাপন?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ফেরি মাস্টার (চালক) জানান, ফগলাইট স্থাপনের পরও প্রতিবছরই শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঝুঁকি বিবেচনা করে কুয়াশাকালে দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তিনি আরও জানান, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া চ্যানেলের দুই পাশে পর্যাপ্ত মার্কার বাতিও নেই। এ কারণে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়।

রো রো ফেরি খান জাহান আলীর মাস্টার (চালক) আমির হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে স্থাপিত ফগলাইট সম্পর্কে কথা বলতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বর্তমানে রো রো ফেরি শাহ মখদুমে আছি। ফগলাইট বিষেয়ে আমি কোন কথা বলতে পারব না।’

শাহ আলী নামের রো রো ফেরির সাবেক মাস্টার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তিনি বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান নামের রো রো ফেরি চালাচ্ছেন। যে উদ্দেশে ফগলাইট স্থাপন করা হয়েছিল তার কিছুই হচ্ছে না। রাজনৈতিক কারণে ওই সময় এই লাইটগুলো সংযোজন করা হয়েছিল। বরং কুয়াশাকালীন সময়ে ফগলাইটে কিছুই দেখা যায় না। হালকা কুয়াশায় আগের লাইটে মার্কিং পয়েন্ট যতটুকু দেখা যায় ফগলাইটে তাও দেখা যায় না।

ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট স্থাপনের স্থলে নিম্নমানের সার্চলাইট সরবরাহ করে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিআইডব্লিউটিসির তিন কর্মকর্তাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন বিআইডব্লিউটিসির সাবেক জিএম ক্যাপ্টেন শওকত সরদার, সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালক (কারিগরি) ড. জ্ঞানরঞ্জন শীল, মহাব্যবস্থাপক নুরুল হুদা, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব পঙ্কজ কুমার পাল, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. রহমতউল্লাহ, মহাব্যবস্থাপক (মেকানিক্যাল) ইঞ্জিনিয়ার নাসির উদ্দিন ও মেসার্স জনি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী অবসরপ্রাপ্ত লে. কমান্ডার ওমর আলী।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও পিএসআই কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের পরিবর্তে শুধু সার্চলাইটসহ সংশ্নিষ্ট মালপত্র কেনার মাধ্যমে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি করে এবং বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিন থেকে চার কোটি টাকা লোপাট করেছে বিআইডব্লিউটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে এই দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরিগুলোতে বাস্তবে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের কোন অস্তিত্বই নেই।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সংযোজিত ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটগুলো ঘন কুয়াশায় কাজ করছে না। দেখা গেছে, লাইটের গায়ে ও কন্ট্রোল সুইচে ‘সার্চলাইট’ লেখা। এসব ফগলাইট নয়। মূলত, এই সার্চলাইটগুলো সাত হাজার ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। যদিও বিআইডব্লিউটিসির ক্রয়-সংক্রান্ত নথিতে সার্চ অ্যান্ড ফগলাইট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও এরকম তথ্য মেলে। ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তৎকালীন সহব্যবস্থাপক (মেরিন) হারুনুর রশিদ, ব্যবস্থাপক (মেরিন) আবদুস সাত্তার ও আবদুস সোবহানের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। তাদের বক্তব্য ছিল সংযোজিত ফগ ও সার্চলাইটগুলো হালকা কুয়াশার মধ্যে কাজ করছে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় কাজ করছে না। ফলে ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল সম্ভব হয় না। যদিও ২০১৫ সালের ২৩ জুন তৎকালীন জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার, জিএম (হিসাব) মো. নুরুল হুদা, ডিজিএম শেখ মো. নাসিম, এজিএম (ইঞ্জিনিয়ার) মো. এনামুল হক এবং ম্যানেজার (মেরিন) মো. আবদুস সোবহানের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট স্থাপনের পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।

দুদক ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্র আরও জানা যায়, ফগলাইট কেনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও প্রকৌশলী ড. জ্ঞানরঞ্জন শীল, জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত আলী সরদারসহ সংশ্নিষ্টরা জড়িত ছিলেন। ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালে একটি নির্দেশনা দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। নানা অজুহাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিআইডব্লিউটিসি। সূত্র মতে, ২০১৪ সালে সাত হাজার ওয়াটের রিমোট কনট্রোল উচ্চ ক্ষমতার (১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখার) ছয়টি ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট লাইট পরীক্ষামূলকভাবে কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ টাকা। সেখানে স্থাপিত সাধারণ সার্চলাইটের দাম এক থেকে দুই লাখ টাকা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জনি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী ওমর আলী সাংবাদিকদের বলেন, জনি করপোরেশন ফার্মটি ব্যবহার করে সাবেক এক মন্ত্রীর ভাই এই লাইটগুলো কেনার টেন্ডার (দরপত্র) নেন। ওমর আলী বলেন, সাত হাজার কিলোওয়াটের প্রতিটি লাইটের দাম ছিল প্রায় ৫৩ লাখ টাকা করে। বাকি ৩০ লাখ টাকা চার কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ভিজিট এবং অন্যান্য খরচের জন্য ব্যয় করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই লাইটগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার আগেই চার কর্মকর্তাকে জানানো হয়, এটি মূলত ফগলাইট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজে ব্যবহারের জন্য ‘সার্চ ফগলাইট’, যা ৫০০ মিটার পর্যন্ত আলো বিস্তার করে জাহাজকে পথ দেখাতে সাহায্য করে। আমি এই লাইট কেনার জন্য অর্ডার ডিনাই করি। এরপরও এগুলো ক্রয় করা হয়।

ফগলাইট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সাবেক জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার সাংবাকিদের বলেন, ফগলাইট কাজ না করায় গত ৬ বছরে অনেক কথা হয়েছে। হেনস্তা হয়েছি। মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাডার দিয়ে ফেরি চলাচল করতে বলা হয়েছে। ফগলাইট কেনা ও স্থাপন পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত ছিল। তাই আংশিক সফলতা পাওয়া গেছে।

শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোতে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। কুয়াশার কারণে আকস্মিক নৌরুট ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকায় মহাসড়কে সারারাত আটকে থাকতে হচ্ছে হাজার হাজার যাত্রী ও যানবাহন সংশ্লিষ্টদের।

ফেরি সার্ভিস বন্ধ থাকায় ঘাট এলাকায় প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকছে। কিন্তু ঘন কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচল সচল রাখতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে কিছু ফেরিতে ফগলাইট (কুয়াশা বাতি) স্থাপন করে বিআইডাব্লিউটিসি। তবে কুয়াশায় ফেরি চলাচলে এই ফগলাইটগুলো কোন কাজেই আসছে না।

শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২ , ০১ মাঘ ১৪২৮ ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

ফেরিতে স্থাপিত ফগলাইট কারসাজি

শেখ রাজীব, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)

image

৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট লাগানো হয়। যা কোন কাজেই আসছে না -সংবাদ

দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি নৌপথ দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া। শীতের মৌসুম শুরু হলে ঘন কুয়াশার কারণে প্রায়ই এই দুই নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘন কুয়াশার মধ্যেও ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে প্রায় ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট লাগানো হয়। তবে ফেরিসংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উন্নত প্রযুক্তির ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট বসানোর কথা থাকলেও বসানো হয় শুধু সার্চলাইট। ফলে এসব লাইট ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচলের ক্ষেত্রে কোন কাজেই আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার মধ্যে নৌপথে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ২০১৫ সালের জুন মাসে নৌ মন্ত্রণালয় টেন্ডারের মাধ্যমে ১০টি ফেরিতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফগলাইট স্থাপন করে। সাড়ে সাত হাজার কিলোওয়াটের প্রতিটি ফগলাইট কিনতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় আমেরিকা থেকে এসব ফগলাইট স্থাপন করতে মোট খরচ হয় পাঁচ কোটি টাকা। অথচ ফেরিতে থাকা আগের সার্চ লাইটগুলোতে কুয়াশার মধ্যে নৌ চ্যানেলের মার্কার (বিকনবাতি) যতটুকু দেখা যেত, নতুন স্থাপন করা ফগলাইটে তাও দেখা যায় না। ফলে ঘন কুয়াশার সময় এসব ফগলাইট কোন কাজে না আসায় বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ফগলাইট স্থাপন করা ফেরিগুলো হচ্ছে, রো রো ফেরি খানজাহান আলী, শাহ আলী, কেরামত আলী, ভাষা শহীদ বরকত, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, শাহ আমানত, শাহ পরান ও কে-টাইপ ফেরি কপোতি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট। প্রতিদিন এই দুই নৌরুট দিয়ে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ হাজার হাজার বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ফেরিতে পদ্মা পারাপার হয়। অথচ এ নৌপথে শীত মৌসুমের বেশির ভাগ সময়ে ঘন কুয়াশার কারণে সারা রাত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা। দীর্ঘ সময় ঘাট এলাকায় আটকা পড়ে চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রী ও যানবাহন চালকরা। এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু চলাচলকারী ফেরিগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির কার্যকরি ফগলাইটের ব্যবস্থা নেই।

জানা যায়, ফেরিতে স্থাপন করা এসব ফগলাইট লাগানোর সময় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, নেভিগেশনাল এইড সংযোজনের মাধ্যমে এ লাইট দেশের ফেরিতে প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে শীত মৌসুমের ঘন কুয়াশার মধ্যেও ফেরি চলাচল করতে পারবে। এসব শুধু কথার কথাই থেকে গেল। ঘন কুয়াশায় ফেরি সার্ভিস সচল রাখতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আমেরিকা থেকে আমদানি করা উন্নতমানের ফগলাইট ফেরিগুলোতে স্থাপন করেও কুয়াশায় ঘণ্টার পর ঘণ্ট ফেরি সার্ভিস বন্ধ থাকছে। এতে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কুয়াশায় যদি ফেরিগুলো সচল না থাকে, তবে কেন এ ফগলাইট স্থাপন?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ফেরি মাস্টার (চালক) জানান, ফগলাইট স্থাপনের পরও প্রতিবছরই শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঝুঁকি বিবেচনা করে কুয়াশাকালে দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তিনি আরও জানান, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া চ্যানেলের দুই পাশে পর্যাপ্ত মার্কার বাতিও নেই। এ কারণে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়।

রো রো ফেরি খান জাহান আলীর মাস্টার (চালক) আমির হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে স্থাপিত ফগলাইট সম্পর্কে কথা বলতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বর্তমানে রো রো ফেরি শাহ মখদুমে আছি। ফগলাইট বিষেয়ে আমি কোন কথা বলতে পারব না।’

শাহ আলী নামের রো রো ফেরির সাবেক মাস্টার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তিনি বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান নামের রো রো ফেরি চালাচ্ছেন। যে উদ্দেশে ফগলাইট স্থাপন করা হয়েছিল তার কিছুই হচ্ছে না। রাজনৈতিক কারণে ওই সময় এই লাইটগুলো সংযোজন করা হয়েছিল। বরং কুয়াশাকালীন সময়ে ফগলাইটে কিছুই দেখা যায় না। হালকা কুয়াশায় আগের লাইটে মার্কিং পয়েন্ট যতটুকু দেখা যায় ফগলাইটে তাও দেখা যায় না।

ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট স্থাপনের স্থলে নিম্নমানের সার্চলাইট সরবরাহ করে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিআইডব্লিউটিসির তিন কর্মকর্তাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৫ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন বিআইডব্লিউটিসির সাবেক জিএম ক্যাপ্টেন শওকত সরদার, সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালক (কারিগরি) ড. জ্ঞানরঞ্জন শীল, মহাব্যবস্থাপক নুরুল হুদা, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব পঙ্কজ কুমার পাল, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. রহমতউল্লাহ, মহাব্যবস্থাপক (মেকানিক্যাল) ইঞ্জিনিয়ার নাসির উদ্দিন ও মেসার্স জনি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী অবসরপ্রাপ্ত লে. কমান্ডার ওমর আলী।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও পিএসআই কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের পরিবর্তে শুধু সার্চলাইটসহ সংশ্নিষ্ট মালপত্র কেনার মাধ্যমে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি করে এবং বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিন থেকে চার কোটি টাকা লোপাট করেছে বিআইডব্লিউটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে এই দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরিগুলোতে বাস্তবে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের কোন অস্তিত্বই নেই।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সংযোজিত ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটগুলো ঘন কুয়াশায় কাজ করছে না। দেখা গেছে, লাইটের গায়ে ও কন্ট্রোল সুইচে ‘সার্চলাইট’ লেখা। এসব ফগলাইট নয়। মূলত, এই সার্চলাইটগুলো সাত হাজার ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন। যদিও বিআইডব্লিউটিসির ক্রয়-সংক্রান্ত নথিতে সার্চ অ্যান্ড ফগলাইট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও এরকম তথ্য মেলে। ফগ অ্যান্ড সার্চলাইটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তৎকালীন সহব্যবস্থাপক (মেরিন) হারুনুর রশিদ, ব্যবস্থাপক (মেরিন) আবদুস সাত্তার ও আবদুস সোবহানের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। তাদের বক্তব্য ছিল সংযোজিত ফগ ও সার্চলাইটগুলো হালকা কুয়াশার মধ্যে কাজ করছে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় কাজ করছে না। ফলে ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল সম্ভব হয় না। যদিও ২০১৫ সালের ২৩ জুন তৎকালীন জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার, জিএম (হিসাব) মো. নুরুল হুদা, ডিজিএম শেখ মো. নাসিম, এজিএম (ইঞ্জিনিয়ার) মো. এনামুল হক এবং ম্যানেজার (মেরিন) মো. আবদুস সোবহানের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট স্থাপনের পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন।

দুদক ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্র আরও জানা যায়, ফগলাইট কেনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও প্রকৌশলী ড. জ্ঞানরঞ্জন শীল, জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত আলী সরদারসহ সংশ্নিষ্টরা জড়িত ছিলেন। ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালে একটি নির্দেশনা দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। নানা অজুহাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিআইডব্লিউটিসি। সূত্র মতে, ২০১৪ সালে সাত হাজার ওয়াটের রিমোট কনট্রোল উচ্চ ক্ষমতার (১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখার) ছয়টি ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট লাইট পরীক্ষামূলকভাবে কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রতিটির দাম ধরা হয়েছিল ৫৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ টাকা। সেখানে স্থাপিত সাধারণ সার্চলাইটের দাম এক থেকে দুই লাখ টাকা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জনি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী ওমর আলী সাংবাদিকদের বলেন, জনি করপোরেশন ফার্মটি ব্যবহার করে সাবেক এক মন্ত্রীর ভাই এই লাইটগুলো কেনার টেন্ডার (দরপত্র) নেন। ওমর আলী বলেন, সাত হাজার কিলোওয়াটের প্রতিটি লাইটের দাম ছিল প্রায় ৫৩ লাখ টাকা করে। বাকি ৩০ লাখ টাকা চার কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ভিজিট এবং অন্যান্য খরচের জন্য ব্যয় করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই লাইটগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার আগেই চার কর্মকর্তাকে জানানো হয়, এটি মূলত ফগলাইট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজে ব্যবহারের জন্য ‘সার্চ ফগলাইট’, যা ৫০০ মিটার পর্যন্ত আলো বিস্তার করে জাহাজকে পথ দেখাতে সাহায্য করে। আমি এই লাইট কেনার জন্য অর্ডার ডিনাই করি। এরপরও এগুলো ক্রয় করা হয়।

ফগলাইট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সাবেক জিএম (মেরিন) ক্যাপ্টেন শওকত সরদার সাংবাকিদের বলেন, ফগলাইট কাজ না করায় গত ৬ বছরে অনেক কথা হয়েছে। হেনস্তা হয়েছি। মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাডার দিয়ে ফেরি চলাচল করতে বলা হয়েছে। ফগলাইট কেনা ও স্থাপন পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত ছিল। তাই আংশিক সফলতা পাওয়া গেছে।

শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোতে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। কুয়াশার কারণে আকস্মিক নৌরুট ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকায় মহাসড়কে সারারাত আটকে থাকতে হচ্ছে হাজার হাজার যাত্রী ও যানবাহন সংশ্লিষ্টদের।

ফেরি সার্ভিস বন্ধ থাকায় ঘাট এলাকায় প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকছে। কিন্তু ঘন কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচল সচল রাখতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে কিছু ফেরিতে ফগলাইট (কুয়াশা বাতি) স্থাপন করে বিআইডাব্লিউটিসি। তবে কুয়াশায় ফেরি চলাচলে এই ফগলাইটগুলো কোন কাজেই আসছে না।