মিহির সেনগুপ্ত : অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার একনিষ্ঠ পূজারি

গৌতম রায়

কাল নিরূপণের ক্ষেত্রে যিনি দিকদর্শী হতে পারেন, কথাসাহিত্যের ছকেবাঁধা গণ্ডিকে অতিক্রম করে সেই কালদর্শী খুব সহজেই হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ। আস্তিক্যবাদে তিনি বিশ্বাসী, কি অবিশ্বাসী- এইসব মাইক্রোস্তরের প্রশ্ন তখন হয়ে পড়ে অবান্তর। কারণ, উপনিষদের সেই শাশ্বত জিজ্ঞাসা; তা দিয়ে আমি কি করব, যা আমাকে অমৃত না করবে- জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতভাবেই হোক অমন অমৃতত্বে যিনি স্থিত হয়ে ওঠেন তিনিই তো বিষাদের বেহাগকে, ‘বৃক্ষ ইব চতুর্ধারে’ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

মিহির সেনগুপ্ত। বেস্ট সেলার কোনো বইয়ের লেখক নন। খুব পরিণত, পরিশীলিত পাঠকমণ্ডলীর বাইরে সাধারণ মানের পাঠক তাঁর লেখা খুব একটা পড়েছেন বলে মনে হয় না। তেমন মানুষেরই নাম কিন্তু বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। বাঙালি জীবনের ক্রান্তিকালের মহাভারতের বেদব্যাস হলেন মিহির সেনগুপ্ত। মুসলিম জাতীয়তাকে পণ্য করে দেশভাগের পর সেই আত্মবিধ্বংসী মতবাদের লালনপালনকারীরা যখন হাজার বছরের ঋদ্ধ, সমন্বয়ী, বহুত্ববাদী বাঙালি সংস্কৃতিকে একটা কৌণিক অবস্থানে ঠেলে দিতে তৎপর হলো, তখন সেই খাদের কিনারায় দাঁড?ানো সময় কিন্তু কেবলমাত্র সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্থানের বিপদ ডেকে আনলো না। দেশকালের বেড়াজাল ভেদে বাঙালির জীবনেই শুধুমাত্র সঙ্কটের ঘন আবর্ত সৃষ্টি করলো না। গোটা মানব জাতিকেই যেন তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ী করে তুললো। মিহির সেনগুপ্ত বিভাজিত বাঙালি, বিভাগপূর্ব এবং উত্তর বরিশাল, মহাভারত কেন্দ্রিক ইরাবতী কার্বের ধারার নতুন আঙ্গিকের জীবনাখ্যান- প্রত্যেকটি সৃষ্টিতেই মনুষ্যত্বের সঙ্কটের নানা আঙ্গিকের সার্থক রূপকার। মহাভারতের যুগের মানবতার সঙ্কট মানবজাতিকে আগামী প্রজন্মের কাছে কতোটা অপরাধী করেছে, নাকি নন্দিত করেছে- এই চিরন্তন প্রশ্নকেই মিহির সেনগুপ্ত তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির ভিতরে জীবন্ত করে রেখেছেন।

আইয়ুব খানের সামরিক জান্তা তথাকথিত প্রগতিশীলতার ধ্বজা উড়িয়ে ‘মধ্যস্বত্ত্ব’ প্রথা কোনোরকম ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন ছাড়া রদ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে কেমন সঙ্কট তৈরি করে, সেই সঙ্কটকে ক্রমে মনুষ্যত্বের আর্ত-বেদনার অশ্রুতে পরিণত করেছিল, তা নিয়েই মিহির সেনগুপ্তের গল্প, ‘নয়াবাড়ি’। তাঁর বহুল পরিচিত সৃষ্টি ‘বিষাদবৃক্ষ’-এর নামযোজনাতে যেমন বিষণ্ণ রাগিনীর মূর্ছনার আভাস রয়েছে, এই গল্পের নামকরণটিও যেন তেমনই একটা ঝড়ের ঝাপটানির আভাস দিচ্ছে। বাড়ি বদল ঘটবে, কি ঘটবে না- এই দ্বন্দ্বের এক চিরন্তন টানাপোড়েনের বিনিসুতোর মালা গাঁথা- এটাই যেন মিহির সেনগুপ্তের যেকোনো লেখার একটা সার্বজনীন সুর হয়ে বেজে উঠেছে বারবার। সেই সুর ভাঁজতে গিয়ে মিহির নিজে মজেছেন। মজে কেঁদে নিজের মতো করেই নিজের বুক ভাসিয়েছন। আর রসিক পাঠকের অন্তরে একটা হু হু করা আর্তি জাগিয়েছেন। তেমনিই বেসরিক পাঠকের মনে তৈরি করেছেন বিরক্তি। কারণ, বেরসিক পাঠক যে মিহির সেনগুপ্ত পড়বার ভান করে, তাঁকে, ‘পড়েছি’ বলে আত্মম্বরী চাল চালবে, ইন্টেলেকচুয়াল পাঠক হিসেবে নিজেকে ‘পণ্য’ করে তুলবার ব্যর্থ চেষ্টা করবে, মিহির সেনগুপ্ত কখনোই তেমন বইয়ের ব্লার্ব পড়ে পল্লবগ্রাহী পাঠকের ধারণা তৈরি করার মতো এলেমদার লেখক ছিলেন না। মিহির সেনগুপ্তের লেখাকে পড়তে গেলে, পড়ে বুঝতে গেলে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তাকে বুকে ধারণ করতে হয়। শামসুর রাহমানের ভাষা ধার করে বলতে হয়, পাঠকের বুককে হয়ে উঠতে হয় বাংলাদেশের হৃদয়। সর্বোপরি হয়ে উঠতে হয় মানুষের সাধক। মানবতার পূজারী। মনুষ্যত্বের উপাসক।

জন্মসূত্রে হিন্দু বাঙালি বেশ কিছু বাজার সফল লেখক দেশভাগকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সাবান সাহিত্য লিখেছেন। সেইসব থান ইঁটের মতো বইতে গদগদ আবেগের সুড়সুড়ির ভিতরে কোথাও না কোথাও, ‘মুসলমানদের জন্যে দেশত্যাগ’-এর অনৈতিহাসিক অবসেশন বেশ সচেতনভাবেই, কিছু জানি না, কিছু বুঝি না ভঙ্গিতে রেখে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে সেইসব সাবান সাহিত্যের বাজার সাফল্য ও যেকোনো স্তরের লেখকের কাছেই ঈর্ষণীয়। কিন্তু এইসব সাবান সাহিত্যকারদের ভিতরে একজনও শওকত আলীর ‘বসত’-এর মতো কিছু লেখার সৎ সাহস দেখাতে পারেন নি। দেশভাগের পর ভারত থেকে বাঙালি, অবাঙালি নির্বিশেষে ছিন্নমূল মুসলমানের ভারত ছেড়ে আসার সময়ে ‘কাস্টমস’-এর আড়ালে ভারতরাষ্ট্রের মুসলমানদের ধনদৌলত কেড়ে নেওয়ার কথা একজনও ভারতীয় বাঙালি লেখকের লেখবার হিম্মত হয়নি কেন?

আর সেখানেই মনে হয় ব্যতিক্রম মিহির সেনগুপ্তকে। তিনি লিখছেন:

“গ্রাম এখনও একেবারে হিন্দুশূন্য নয়। সুতরাং একটি মুসলমান পরিবার হিন্দুপ্রধান গ্রামে এসে গেরস্তালি পাতবে- এতটা উদারতা হিন্দু সমাজের কাছ থেকে হিন্দুরাও আশা করত না। গ্রামের অনেক ছাড়া ভিটের দখলদারি অনেক মুসলমান সম্পন্ন পরিবারের হাতে চলে গিয়েছিল। তার খুব কমই অবশ্য জফরদখলি সূত্রে। বিক্রিবাট্টা সূত্রেই বেশি। এ অঞ্চলে দাঙ্গা বা লুটের

ঘটনা কোনোদিনই ঘটেনি। আতঙ্কটাই ছিল। জমি, বাড়ি ইত্যাদির দখলদারির পেছনে নানা কারণই ছিল। কিন্তু তার বিশদে না গিয়ে ভাবির মানসিকতার কথাই বলি। ভাবির সঙ্গে এ নিয়ে আমার প্রায়ই আলোচনা হতো। তিনি জানতেন যে নিঃশব্দে গ্রামগুরোর শূন্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে একটা গভীর বেদনার ব্যাপার। দেশভাগ এবং দাঙ্গা বা উচ্ছেদের আতঙ্ক অবশ্যই এই সব গ্রামগুলোর জনশূন্য হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ।” (নয়াবাড়ি, দশটি গল্প, মিহির সেনগুপ্ত, পরশপাথর, পৃ: ১৩)।

সত্য উচ্চারণের জন্যে যে প্রকৃতবোধই যথেষ্ট, সত্য বলতে গেলে যে ইতিহাসবিদ হতে হয় না, পণ্ডিত হতে হয় না, তা এই ‘নয়াবাড়ি’ গল্পে মিহির সেনগুপ্তের উচ্চারণের ভিতর দিয়েই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এমন লেখার সাহস পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি লেখকদের ভিতরে অন্নদাশঙ্কর, গৌরকিশোরের মতো হাতেগোনা মানুষদেরই ছিল। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো মানুষের ও ছিল। কিন্তু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরে, সিরাজের ভাবনাকে কেবলমাত্র, ‘মুসলমানের ভাবনা’ বলে চিহ্নিত করবার লোকই হয়ত বেশি দেখা যেত। হয়ত মোহিত রায়দের মতো নিরলস আর এস এস কর্মী কলকাতার সর্বাধিক প্রচলিত খবরের কাগজে এই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ সন্দর্ভও লিখে ফেলতেন।

দোষারোপ নয়, কারণ অনুসন্ধানের অন্তহীন জাগর। এই বোধকে নিজের যাপনচিত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে পেরেছিলেন মিহির সেনগুপ্ত। সাবান সাহিত্যিকেরা যেখানে দেশভাগের কারণে দেশত্যাগের প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে মুসলমানদের অত্যাচার, লুটতরাজ, আর এস এস পন্থীদের প্রিয় লব্জ ‘নারী ধর্ষণ’-এর মতো বাজার খাওয়া বিষয়গুলিকে মিনমিন করে নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছেন, তখন কিন্তু তারা একই সঙ্গে বর্ণহিন্দুদের অভিসন্ধি, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়ধ্বনি দিতেও কসুর করছেন না। সেখানে মিহির সেনগুপ্ত লিখছেন;

“কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়, হিন্দুরা যেমন কথায় কথায় বলে যে মুসলমানেরা আমাদের দেশছাড়া করেছে, চৌদ্দপুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনি একমাত্রিক নয়। এর পেছনে অন্য সুদীর্ঘ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ আছে। যেসব অনেক পরে বুঝেছি। অনেক মানুষ এতকাল পরে আজও যে বুঝেছে এমনও নয়। ভাবি বা আমিও সেই সময় যে পরিষ্কার করে বুঝেছিলাম এমনও নয়। আমাদের কারওরই সেই শিক্ষা ছিল না। কেউই তেমন করে সমস্যাটা আমাদের বোঝায়নি। তথাপি আমাদের দুইজনেরই একটা আকাক্সক্ষার জগৎ তৈরি হয়েছিল যে গ্রামগুলো আবার আগের মতো বসতীপূর্ণ হয়ে উঠুক। ভাবির সঙ্গে এখানেই আমার মিল।”

এই কনফেশনের সাহস কয়জনের থাকে? সময়ের ঘনঘটায়মান কালে আমার সবকিছু ঘিরে পরিষ্কার ধারণা ছিল না, সর্বপোরি, ‘আমাদের কারওরই সেই শিক্ষা ছিল না’ এই কথা বলবার মতো বুকের পাটা ভারতে চলে এসে কয়জন মানুষ দেখাতে পেরেছেন? দেশভাগের সময়কালে, বা তার আশেপাশের সময়ে পূর্ব পাকিস্থান থেকে মুসলমানের অত্যাচারে হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ফেলে চলে এসেছি- এই কথা বললে যখন কার্যত ইনাম মিলত, বামপন্থী রাজনীতিকেরা ও পর্যন্ত যখন বাস্তুহারাদের কান্নায় আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান তারি লাগি কাড়াকাড়ি করে, সেই বাস্তুহারাদের গরিষ্ঠ অংশ মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে স্বাধীন ভারতকে ধূলি ধূসরিত করে দিচ্ছে- এটা দেখেও দেখত না, শুনেও শুনত না, সেই উত্তেজনাময় কালপর্বে নিজেদের শিক্ষাহীনতার আত্মসমালোচনা- এই হিম্মত ‘খণ্ডিতা’তে সমরেশ বসু ছাড়া মিহির সেনগুপ্তের মতো আর একজনও দেখাতে পারেন নি।

ভাবির জবাণীতে মিহির লিখেছেন; “ভাইডি, য্যারা য্যারা ছ্যাড়া- ভিডা খায়, হ্যারগো লালস খালি দখলদারি নেবার। হেয়া যেভাবেই হোক।” এই দখলদারির একটা বড় অংশ যে দেশত্যাগী হিন্দুর ‘বিক্রিবাট্টা’র সুবাদেই শুরু হয়েছিল, পরে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার নিজেদের ফৌজি ধাসন টিকিয়ে রাখবার তাগিদে সাবেক পূর্বপাকিস্থানের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিমন্ডলকে ইসলামীকরণ করার তাগিদ বেড়েছিল- ইতিহাসের এই সত্যকে, চরম বাস্তবকে সাহিত্যের পরিমণ্ডলে এনেছিলেন মিহির সেনগুপ্ত। তাঁর নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চেতনা, বোধ- এইসবই যেমন সত্য উচ্চারণে সহায়ক হয়েছিল, তেমনটাই ছিল আর এক বরিশাইল্যা অধ্যাপক তপন রায়চৗধুরীর সঙ্গে মিহির সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সংযোগের ফলশ্রুতি হিসেবে। মিহির লিখছেন:

“কথাও সত্য। এখান থেকে তিন মাইর দূর গঞ্জে লোক থিকথিক করে। অথচ গ্রামের পর গ্রাম বিরান হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মানুষ নেই। মানুষ নেই শুধু হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে হিন্দুস্থান চলে যাচ্ছে বলে নয়। সেই সঙ্গে উঠে যাচ্ছে ষ্কুল পাঠশালা (এ যেন করোনাবিধৌত আজকের পশ্চিমবঙ্গ!- গৌরা)। খেলাধুলার মাঠ অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও জবরদখল করে পাবলিক ফিল্ডটাই ধানক্ষেত করা হচ্ছে। এসব হচ্ছে, কারণ খেলাধুলো করার ছেলেরা যারা হিন্দু, তারা হিন্দুস্থানে চলে যাচ্ছে। মুসলমান ছেলেরা, যারা মোটামুটি সম্পন্ন বা হিন্দুর ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তিতে উঠতি পয়সাওয়ালা, তারা গঞ্জে, শহরে চলে যাচ্ছে। কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউবা চাকরির খোঁজে। তা আগেও যেত। কিন্তু গ্রামের বাস তুলে দিয়ে নয়। মূল বসতটা গ্রামে থাকতই। এখন ক্রমশ তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জীবনের বিনোদন গ্রামে কিছু নেই। সুতরাং আকর্ষণেরও কিছু নেই। ভাবি এই পরিবস্থা শুরু হওয়ার প্রক্কালেই চেয়েছিলেন তাকে রুখতে। কিন্তু তা বোধহয় হওয়ার ছিল না। দেশজুড়ে অসম এবং অবিবেচনাপ্রসূত বিকাশ- ক্রম, সরকারি কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব, গ্রামের প্রতি শিক্ষিতজনের অবহেলা, শহর এবং গ্রামের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অসদ্ভাব- সুতরাং গ্রামগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ অবস্থার মুখে এসে পড়েছিল। ভাবি তাঁর স্বাভাবিক সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাপারটার ভয়াবহকতা বুঝতে পারছিলেন। সে কারণেই তাঁর আকাক্সক্ষা ছিল, যদি অন্তত তাঁদের মতো গৃহস্থালি গড়ে মানুষ গ্রামটাকে ভরপুর রাখে। তাঁর সহজ হিসেব ছিল, মানুষ থাকলে সব শূন্যতা একদিন ভরাট হবে। কিন্তু তখন পাকিস্থানি আদর্শে নতুন নির্মাণের পদ্ধতিটা ভিন্ন ছিল। সেই পদ্ধতিটার সঙ্গে পরম্পরাকে শেকড়ের যোগ ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং কট্টর মৌলবাদী শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে গড়তে গিয়ে গ্রামীণ নতুন প্রজন্ম একসময় একঘেয়েমি কাটাতে শহরমুখী হয় বিকৃত ভোগবাদী হয়ে। গ্রামগুলো ধুঁকতে থাকে নিঃসঙ্গতার নৈরাশ্যে।” (ঐ, পৃষ্ঠা-১৫)

সাবেক পূর্বপাকিস্তানের আমজনতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সুফিয়া কামাল, তাজউদ্দিন, কলিম শরাফী, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, রণদাপ্রসাদ সাহা, রণেশ দাশগুপ্ত- এমন হাতেগোনা দুচারজন মানুষের বাইরে, এমনভাবে কি ভাবতে পেরেছিল? ভাবতে পারে নি বলেই সেকালের পশ্চিম পাকিস্থান অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে পেরেছিল বাংলাদেশের উপরে। বাঙালির উপরে। ইতিহাসের কথক ঠাকুর মিহির সেনগুপ্ত মন্ত্রবলে সব আবার আগের মতো করে দিতে পারবেন- এটা স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি। কিন্তু চেয়েছিলেন, ভুলের পাহাড় ডিঙিয়ে, ধর্মীয় পরিচয়, দেশের ভূগোলকে অতিক্রম করে, সংস্কৃতি-জাতিসত্তার প্রশ্নে অখণ্ড থাকুক বাঙালি।

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২২ , ০৬ মাঘ ১৪২৮ ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

মিহির সেনগুপ্ত : অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার একনিষ্ঠ পূজারি

গৌতম রায়

image

মিহির সেনগুপ্ত / জন্ম: ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭; মৃত্যু: ১৮ জানুয়ারি ২০২২

কাল নিরূপণের ক্ষেত্রে যিনি দিকদর্শী হতে পারেন, কথাসাহিত্যের ছকেবাঁধা গণ্ডিকে অতিক্রম করে সেই কালদর্শী খুব সহজেই হয়ে ওঠেন কালোত্তীর্ণ। আস্তিক্যবাদে তিনি বিশ্বাসী, কি অবিশ্বাসী- এইসব মাইক্রোস্তরের প্রশ্ন তখন হয়ে পড়ে অবান্তর। কারণ, উপনিষদের সেই শাশ্বত জিজ্ঞাসা; তা দিয়ে আমি কি করব, যা আমাকে অমৃত না করবে- জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতভাবেই হোক অমন অমৃতত্বে যিনি স্থিত হয়ে ওঠেন তিনিই তো বিষাদের বেহাগকে, ‘বৃক্ষ ইব চতুর্ধারে’ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

মিহির সেনগুপ্ত। বেস্ট সেলার কোনো বইয়ের লেখক নন। খুব পরিণত, পরিশীলিত পাঠকমণ্ডলীর বাইরে সাধারণ মানের পাঠক তাঁর লেখা খুব একটা পড়েছেন বলে মনে হয় না। তেমন মানুষেরই নাম কিন্তু বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। বাঙালি জীবনের ক্রান্তিকালের মহাভারতের বেদব্যাস হলেন মিহির সেনগুপ্ত। মুসলিম জাতীয়তাকে পণ্য করে দেশভাগের পর সেই আত্মবিধ্বংসী মতবাদের লালনপালনকারীরা যখন হাজার বছরের ঋদ্ধ, সমন্বয়ী, বহুত্ববাদী বাঙালি সংস্কৃতিকে একটা কৌণিক অবস্থানে ঠেলে দিতে তৎপর হলো, তখন সেই খাদের কিনারায় দাঁড?ানো সময় কিন্তু কেবলমাত্র সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্থানের বিপদ ডেকে আনলো না। দেশকালের বেড়াজাল ভেদে বাঙালির জীবনেই শুধুমাত্র সঙ্কটের ঘন আবর্ত সৃষ্টি করলো না। গোটা মানব জাতিকেই যেন তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ী করে তুললো। মিহির সেনগুপ্ত বিভাজিত বাঙালি, বিভাগপূর্ব এবং উত্তর বরিশাল, মহাভারত কেন্দ্রিক ইরাবতী কার্বের ধারার নতুন আঙ্গিকের জীবনাখ্যান- প্রত্যেকটি সৃষ্টিতেই মনুষ্যত্বের সঙ্কটের নানা আঙ্গিকের সার্থক রূপকার। মহাভারতের যুগের মানবতার সঙ্কট মানবজাতিকে আগামী প্রজন্মের কাছে কতোটা অপরাধী করেছে, নাকি নন্দিত করেছে- এই চিরন্তন প্রশ্নকেই মিহির সেনগুপ্ত তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির ভিতরে জীবন্ত করে রেখেছেন।

আইয়ুব খানের সামরিক জান্তা তথাকথিত প্রগতিশীলতার ধ্বজা উড়িয়ে ‘মধ্যস্বত্ত্ব’ প্রথা কোনোরকম ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন ছাড়া রদ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে কেমন সঙ্কট তৈরি করে, সেই সঙ্কটকে ক্রমে মনুষ্যত্বের আর্ত-বেদনার অশ্রুতে পরিণত করেছিল, তা নিয়েই মিহির সেনগুপ্তের গল্প, ‘নয়াবাড়ি’। তাঁর বহুল পরিচিত সৃষ্টি ‘বিষাদবৃক্ষ’-এর নামযোজনাতে যেমন বিষণ্ণ রাগিনীর মূর্ছনার আভাস রয়েছে, এই গল্পের নামকরণটিও যেন তেমনই একটা ঝড়ের ঝাপটানির আভাস দিচ্ছে। বাড়ি বদল ঘটবে, কি ঘটবে না- এই দ্বন্দ্বের এক চিরন্তন টানাপোড়েনের বিনিসুতোর মালা গাঁথা- এটাই যেন মিহির সেনগুপ্তের যেকোনো লেখার একটা সার্বজনীন সুর হয়ে বেজে উঠেছে বারবার। সেই সুর ভাঁজতে গিয়ে মিহির নিজে মজেছেন। মজে কেঁদে নিজের মতো করেই নিজের বুক ভাসিয়েছন। আর রসিক পাঠকের অন্তরে একটা হু হু করা আর্তি জাগিয়েছেন। তেমনিই বেসরিক পাঠকের মনে তৈরি করেছেন বিরক্তি। কারণ, বেরসিক পাঠক যে মিহির সেনগুপ্ত পড়বার ভান করে, তাঁকে, ‘পড়েছি’ বলে আত্মম্বরী চাল চালবে, ইন্টেলেকচুয়াল পাঠক হিসেবে নিজেকে ‘পণ্য’ করে তুলবার ব্যর্থ চেষ্টা করবে, মিহির সেনগুপ্ত কখনোই তেমন বইয়ের ব্লার্ব পড়ে পল্লবগ্রাহী পাঠকের ধারণা তৈরি করার মতো এলেমদার লেখক ছিলেন না। মিহির সেনগুপ্তের লেখাকে পড়তে গেলে, পড়ে বুঝতে গেলে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তাকে বুকে ধারণ করতে হয়। শামসুর রাহমানের ভাষা ধার করে বলতে হয়, পাঠকের বুককে হয়ে উঠতে হয় বাংলাদেশের হৃদয়। সর্বোপরি হয়ে উঠতে হয় মানুষের সাধক। মানবতার পূজারী। মনুষ্যত্বের উপাসক।

জন্মসূত্রে হিন্দু বাঙালি বেশ কিছু বাজার সফল লেখক দেশভাগকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সাবান সাহিত্য লিখেছেন। সেইসব থান ইঁটের মতো বইতে গদগদ আবেগের সুড়সুড়ির ভিতরে কোথাও না কোথাও, ‘মুসলমানদের জন্যে দেশত্যাগ’-এর অনৈতিহাসিক অবসেশন বেশ সচেতনভাবেই, কিছু জানি না, কিছু বুঝি না ভঙ্গিতে রেখে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে সেইসব সাবান সাহিত্যের বাজার সাফল্য ও যেকোনো স্তরের লেখকের কাছেই ঈর্ষণীয়। কিন্তু এইসব সাবান সাহিত্যকারদের ভিতরে একজনও শওকত আলীর ‘বসত’-এর মতো কিছু লেখার সৎ সাহস দেখাতে পারেন নি। দেশভাগের পর ভারত থেকে বাঙালি, অবাঙালি নির্বিশেষে ছিন্নমূল মুসলমানের ভারত ছেড়ে আসার সময়ে ‘কাস্টমস’-এর আড়ালে ভারতরাষ্ট্রের মুসলমানদের ধনদৌলত কেড়ে নেওয়ার কথা একজনও ভারতীয় বাঙালি লেখকের লেখবার হিম্মত হয়নি কেন?

আর সেখানেই মনে হয় ব্যতিক্রম মিহির সেনগুপ্তকে। তিনি লিখছেন:

“গ্রাম এখনও একেবারে হিন্দুশূন্য নয়। সুতরাং একটি মুসলমান পরিবার হিন্দুপ্রধান গ্রামে এসে গেরস্তালি পাতবে- এতটা উদারতা হিন্দু সমাজের কাছ থেকে হিন্দুরাও আশা করত না। গ্রামের অনেক ছাড়া ভিটের দখলদারি অনেক মুসলমান সম্পন্ন পরিবারের হাতে চলে গিয়েছিল। তার খুব কমই অবশ্য জফরদখলি সূত্রে। বিক্রিবাট্টা সূত্রেই বেশি। এ অঞ্চলে দাঙ্গা বা লুটের

ঘটনা কোনোদিনই ঘটেনি। আতঙ্কটাই ছিল। জমি, বাড়ি ইত্যাদির দখলদারির পেছনে নানা কারণই ছিল। কিন্তু তার বিশদে না গিয়ে ভাবির মানসিকতার কথাই বলি। ভাবির সঙ্গে এ নিয়ে আমার প্রায়ই আলোচনা হতো। তিনি জানতেন যে নিঃশব্দে গ্রামগুরোর শূন্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে একটা গভীর বেদনার ব্যাপার। দেশভাগ এবং দাঙ্গা বা উচ্ছেদের আতঙ্ক অবশ্যই এই সব গ্রামগুলোর জনশূন্য হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ।” (নয়াবাড়ি, দশটি গল্প, মিহির সেনগুপ্ত, পরশপাথর, পৃ: ১৩)।

সত্য উচ্চারণের জন্যে যে প্রকৃতবোধই যথেষ্ট, সত্য বলতে গেলে যে ইতিহাসবিদ হতে হয় না, পণ্ডিত হতে হয় না, তা এই ‘নয়াবাড়ি’ গল্পে মিহির সেনগুপ্তের উচ্চারণের ভিতর দিয়েই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এমন লেখার সাহস পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি লেখকদের ভিতরে অন্নদাশঙ্কর, গৌরকিশোরের মতো হাতেগোনা মানুষদেরই ছিল। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো মানুষের ও ছিল। কিন্তু তাঁর ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরে, সিরাজের ভাবনাকে কেবলমাত্র, ‘মুসলমানের ভাবনা’ বলে চিহ্নিত করবার লোকই হয়ত বেশি দেখা যেত। হয়ত মোহিত রায়দের মতো নিরলস আর এস এস কর্মী কলকাতার সর্বাধিক প্রচলিত খবরের কাগজে এই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ সন্দর্ভও লিখে ফেলতেন।

দোষারোপ নয়, কারণ অনুসন্ধানের অন্তহীন জাগর। এই বোধকে নিজের যাপনচিত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে পেরেছিলেন মিহির সেনগুপ্ত। সাবান সাহিত্যিকেরা যেখানে দেশভাগের কারণে দেশত্যাগের প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে মুসলমানদের অত্যাচার, লুটতরাজ, আর এস এস পন্থীদের প্রিয় লব্জ ‘নারী ধর্ষণ’-এর মতো বাজার খাওয়া বিষয়গুলিকে মিনমিন করে নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছেন, তখন কিন্তু তারা একই সঙ্গে বর্ণহিন্দুদের অভিসন্ধি, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়ধ্বনি দিতেও কসুর করছেন না। সেখানে মিহির সেনগুপ্ত লিখছেন;

“কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়, হিন্দুরা যেমন কথায় কথায় বলে যে মুসলমানেরা আমাদের দেশছাড়া করেছে, চৌদ্দপুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনি একমাত্রিক নয়। এর পেছনে অন্য সুদীর্ঘ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ আছে। যেসব অনেক পরে বুঝেছি। অনেক মানুষ এতকাল পরে আজও যে বুঝেছে এমনও নয়। ভাবি বা আমিও সেই সময় যে পরিষ্কার করে বুঝেছিলাম এমনও নয়। আমাদের কারওরই সেই শিক্ষা ছিল না। কেউই তেমন করে সমস্যাটা আমাদের বোঝায়নি। তথাপি আমাদের দুইজনেরই একটা আকাক্সক্ষার জগৎ তৈরি হয়েছিল যে গ্রামগুলো আবার আগের মতো বসতীপূর্ণ হয়ে উঠুক। ভাবির সঙ্গে এখানেই আমার মিল।”

এই কনফেশনের সাহস কয়জনের থাকে? সময়ের ঘনঘটায়মান কালে আমার সবকিছু ঘিরে পরিষ্কার ধারণা ছিল না, সর্বপোরি, ‘আমাদের কারওরই সেই শিক্ষা ছিল না’ এই কথা বলবার মতো বুকের পাটা ভারতে চলে এসে কয়জন মানুষ দেখাতে পেরেছেন? দেশভাগের সময়কালে, বা তার আশেপাশের সময়ে পূর্ব পাকিস্থান থেকে মুসলমানের অত্যাচারে হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ফেলে চলে এসেছি- এই কথা বললে যখন কার্যত ইনাম মিলত, বামপন্থী রাজনীতিকেরা ও পর্যন্ত যখন বাস্তুহারাদের কান্নায় আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান তারি লাগি কাড়াকাড়ি করে, সেই বাস্তুহারাদের গরিষ্ঠ অংশ মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে স্বাধীন ভারতকে ধূলি ধূসরিত করে দিচ্ছে- এটা দেখেও দেখত না, শুনেও শুনত না, সেই উত্তেজনাময় কালপর্বে নিজেদের শিক্ষাহীনতার আত্মসমালোচনা- এই হিম্মত ‘খণ্ডিতা’তে সমরেশ বসু ছাড়া মিহির সেনগুপ্তের মতো আর একজনও দেখাতে পারেন নি।

ভাবির জবাণীতে মিহির লিখেছেন; “ভাইডি, য্যারা য্যারা ছ্যাড়া- ভিডা খায়, হ্যারগো লালস খালি দখলদারি নেবার। হেয়া যেভাবেই হোক।” এই দখলদারির একটা বড় অংশ যে দেশত্যাগী হিন্দুর ‘বিক্রিবাট্টা’র সুবাদেই শুরু হয়েছিল, পরে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার নিজেদের ফৌজি ধাসন টিকিয়ে রাখবার তাগিদে সাবেক পূর্বপাকিস্থানের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিমন্ডলকে ইসলামীকরণ করার তাগিদ বেড়েছিল- ইতিহাসের এই সত্যকে, চরম বাস্তবকে সাহিত্যের পরিমণ্ডলে এনেছিলেন মিহির সেনগুপ্ত। তাঁর নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চেতনা, বোধ- এইসবই যেমন সত্য উচ্চারণে সহায়ক হয়েছিল, তেমনটাই ছিল আর এক বরিশাইল্যা অধ্যাপক তপন রায়চৗধুরীর সঙ্গে মিহির সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সংযোগের ফলশ্রুতি হিসেবে। মিহির লিখছেন:

“কথাও সত্য। এখান থেকে তিন মাইর দূর গঞ্জে লোক থিকথিক করে। অথচ গ্রামের পর গ্রাম বিরান হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মানুষ নেই। মানুষ নেই শুধু হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে হিন্দুস্থান চলে যাচ্ছে বলে নয়। সেই সঙ্গে উঠে যাচ্ছে ষ্কুল পাঠশালা (এ যেন করোনাবিধৌত আজকের পশ্চিমবঙ্গ!- গৌরা)। খেলাধুলার মাঠ অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও জবরদখল করে পাবলিক ফিল্ডটাই ধানক্ষেত করা হচ্ছে। এসব হচ্ছে, কারণ খেলাধুলো করার ছেলেরা যারা হিন্দু, তারা হিন্দুস্থানে চলে যাচ্ছে। মুসলমান ছেলেরা, যারা মোটামুটি সম্পন্ন বা হিন্দুর ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তিতে উঠতি পয়সাওয়ালা, তারা গঞ্জে, শহরে চলে যাচ্ছে। কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউবা চাকরির খোঁজে। তা আগেও যেত। কিন্তু গ্রামের বাস তুলে দিয়ে নয়। মূল বসতটা গ্রামে থাকতই। এখন ক্রমশ তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক জীবনের বিনোদন গ্রামে কিছু নেই। সুতরাং আকর্ষণেরও কিছু নেই। ভাবি এই পরিবস্থা শুরু হওয়ার প্রক্কালেই চেয়েছিলেন তাকে রুখতে। কিন্তু তা বোধহয় হওয়ার ছিল না। দেশজুড়ে অসম এবং অবিবেচনাপ্রসূত বিকাশ- ক্রম, সরকারি কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব, গ্রামের প্রতি শিক্ষিতজনের অবহেলা, শহর এবং গ্রামের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অসদ্ভাব- সুতরাং গ্রামগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ অবস্থার মুখে এসে পড়েছিল। ভাবি তাঁর স্বাভাবিক সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাপারটার ভয়াবহকতা বুঝতে পারছিলেন। সে কারণেই তাঁর আকাক্সক্ষা ছিল, যদি অন্তত তাঁদের মতো গৃহস্থালি গড়ে মানুষ গ্রামটাকে ভরপুর রাখে। তাঁর সহজ হিসেব ছিল, মানুষ থাকলে সব শূন্যতা একদিন ভরাট হবে। কিন্তু তখন পাকিস্থানি আদর্শে নতুন নির্মাণের পদ্ধতিটা ভিন্ন ছিল। সেই পদ্ধতিটার সঙ্গে পরম্পরাকে শেকড়ের যোগ ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং কট্টর মৌলবাদী শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে গড়তে গিয়ে গ্রামীণ নতুন প্রজন্ম একসময় একঘেয়েমি কাটাতে শহরমুখী হয় বিকৃত ভোগবাদী হয়ে। গ্রামগুলো ধুঁকতে থাকে নিঃসঙ্গতার নৈরাশ্যে।” (ঐ, পৃষ্ঠা-১৫)

সাবেক পূর্বপাকিস্তানের আমজনতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সুফিয়া কামাল, তাজউদ্দিন, কলিম শরাফী, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, রণদাপ্রসাদ সাহা, রণেশ দাশগুপ্ত- এমন হাতেগোনা দুচারজন মানুষের বাইরে, এমনভাবে কি ভাবতে পেরেছিল? ভাবতে পারে নি বলেই সেকালের পশ্চিম পাকিস্থান অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে পেরেছিল বাংলাদেশের উপরে। বাঙালির উপরে। ইতিহাসের কথক ঠাকুর মিহির সেনগুপ্ত মন্ত্রবলে সব আবার আগের মতো করে দিতে পারবেন- এটা স্বপ্নেও কখনো ভাবেননি। কিন্তু চেয়েছিলেন, ভুলের পাহাড় ডিঙিয়ে, ধর্মীয় পরিচয়, দেশের ভূগোলকে অতিক্রম করে, সংস্কৃতি-জাতিসত্তার প্রশ্নে অখণ্ড থাকুক বাঙালি।