আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চুয়ান্ন.
প্রিন্স অতসুমিচির পত্রে ইঝোমি এতটা আঘাত পেলেন যে, তার ইচ্ছে হল না সে পত্রের জবাব দেন। অতীতে কখনোই এরকমটি ঘটেনি। তার বদনাম এবং গুজব অনেক রটেছে। অন্য কুৎসাও আছে যে তিনি প্রিন্সের ইচ্ছাতেই প্রাসাদে বাস করতে যাচ্ছেন। তাই চুপ থাকাই ভালো মনে করলেন।
প্রিন্স যখন দেখলেন ইঝোমি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন না, তখন আবার লিখলেন, তুমি উত্তর দিচ্ছ না কেন?
আমি এখন গুজবে বিশ্বাস করছি। কত সহজে তোমরা বদলে যেতে পারো। আমি এমন কিছু শুনেছিলাম যা বিশ্বাস করিনি। আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার অন্তর থেকে অপ্রীতিকর ভাবনাগুলো মুছে দাও।
ইঝোমি লিখলেন, আপনি কি এখনই আমার কাছে আসতে পারেন? আমি যেতে পারি না, কারণ আমাকে অপবাদে কবর দেয়া হয়েছে।
প্রিন্স লিখলেন, তুমি অপবাদকে ভয় পাও জানি। আমি নিবিড়ভাবে তোমার মনকে পাঠ করেছি। তাই আমি ক্ষিপ্ত।
আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারি না। যে কোনোভাবেই হোক আসুন আপনি। লিখলেন ইঝোমি।
প্রিন্স প্রত্যুত্তরে লিখলেন, আমি নিজেকে বুঝাই কখনো সন্দেহ করব না, বিরক্ত করব না; আমার হৃদয় আমার ইচ্ছাকে অনুসরণ করে না। সে অন্য কিছু বলে।
ইঝোমি লিখলেন, আপনার শত্রুতা বন্ধ হবার নয়। অথচ আমি আপনার ওপরই নির্ভর করি। আপনি আমার বিশ্বস্ততায় সন্দেহ করেন। এটা দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
সন্ধ্যার দিকে প্রিন্স এলেন। বললেন, কেন আসতে বলেছ?
আমাকে নিয়ে যান যেখানে খুশি।
প্রিন্স ভোরবেলা একাকীই ফিরে গেলেন। তাতে ইঝোমির কষ্ট হল। রাতে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হল। প্রিন্স কোনো খবরই নিলেন না। ক্ষুব্ধ হলেন এতে ইঝোমি।
বুঝতে পেরে প্রিন্স পালকি পাঠিয়ে লিখলেন, চলে এসো। আমি গুপ্ত স্থানে আছি।
প্রিন্সের পত্রের জবাবে ইঝোমি লিখলেন, এখানে একে অপরকে দেখার উপায় আমার বাড়িতে আসা।
প্রিন্স সে রাতেই ইঝোমিকে দেখতে এলেন এবং হঠাৎ করেই বললেন, তুমি কি দুঃখ পাবে, আমি যদি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যাই?
এসব কী বলছেন এবং কেন বলছেন? আপনার সম্রাটের পদের জন্য আমি কি শুধু শুধুই আন্দোলন করে যাচ্ছি? সন্ন্যাসী আমিও হতাম যদি আপনার জন্য সম্মুখে কোনো স্বপ্ন না থাকতো।
সানজুই সম্রাট হবেন, তিনি যা চাইবেন সবই পাবেন। আমার সন্ন্যাসী হওয়াই উচিত।
তিনি আপনার বড় ভাই। আপনার সম্ভাবনা দু’বার, সুযোগও দু’বার।
আরে আমার মনের কষ্ট সিংহাসনের জন্য নয়, তোমার জন্য। তোমাকে যদি না পাই সিংহাসন দিয়ে কী হবে?
প্রিন্সেস অর্থাৎ আপনার স্ত্রী তো রয়েছেন, তিনি সম্রাজ্ঞী হবেন।
আমি তাকে সহ্য করতেই পারি না। আর তুমি বানাবে সম্রাট, সম্রাজ্ঞী হবে আরেকজন, তার চেয়ে আমার বনবাসে যাওয়াই শ্রেয়।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। তুষারপাতও আছে। এরা ঘনিষ্ট এবং পৃথিবীর সবকিছু ভুলে একে অন্যকে অনুভব করছেন। ইঝোমির মনে হল তার চেয়ে তার প্রতি প্রিন্সের ভালোবাসা প্রবল। তিনি নিজেও একসময়, সন্ন্যাসিনী হতে চেয়েছিলেন, সে কথা এখন আবার মনে হল। কিন্তু প্রিন্সকে কিছুই বললেন না, বিলাপ করে বসলেন।
প্রিন্সের তাতে হৃদয় বিদীর্ন হল। বললেন, প্রেমীদের মুহূর্তের অলিক কল্পনা আমাদের উভয়কে সারারাত আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ইঝোমি কবিতায় বললেন, তাদের চোখ জলে ভেসে গেছে। কোনো বৃষ্টিপাত ছাড়াই।
সকাল হতেই প্রিন্স চলে গেলেন। ইঝোমি ভাবলেন, রাতটা বাস্তব নয়, স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্নের ঘোর যেন এখনও কাটছে না। ক্রমে ক্রমে বাড়ছে দুঃখ কাতরতা।
প্রিন্সও একই অবস্থার শিকার। তার যেন আর ইঝোমিকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটছে না। ইঝোমিকে লিখে পাঠান একটি কবিতা: এক মুহূর্তের জন্যও আমি থাকব না/ এমন এক পৃথিবীতে যেখানে দুঃখ/ অনুসরণ করে একের পর এক/ বাঁশের জিংলার মতো।
প্রিন্স সত্যি সত্যিই উম্মাদের মতো হয়ে গেছেন। তার প্রতিদিনকার জীবন বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। থাকা-খাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পিতা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই-এর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। প্রকৃতই তিনি সন্ন্যাসী হতে চান, মাঝে-মধ্যে ভাবেন পৃথিবী থেকেই বিদায় নেবেন।
তার মামাত ভাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল তার ভাই ক্রাউন প্রিন্সকে সংবাদ দিয়ে নিয়ে এলেন। ক্রাউন প্রিন্স বললেন, তোমার এই অবস্থা আমাদের পারিবারিক সুনাম নষ্ট করছে। এটা তোমাকে মানায় না। তুমি ভেবে দেখো, বাবার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব শুধু আমারই না, তোমারও। তোমার যে স্ত্রী রয়েছে, সে উচ্চবংশীয়। তুমি পছন্দ করেই তাকে বিয়ে করেছ। তার বোন আমার স্ত্রী, পারিবারিক অশান্তি আর বাড়িয়ে দিও না। অনুগ্রহ কর।
প্রিন্স আজ একটু বেশি মাতাল। বললেন, তুমি ভবিষ্যত সম্রাট, আমি কী? আমি এভাবেই ভালো আছি। প্রিন্স তার লেখা কবিতাটি গান আকারে গাইলেন, ‘একমুহূর্তও থাকব না আমি পৃথিবীতে/ যেখানে দুঃখ আছে।
ক্রাউন প্রিন্স সানজু বললেন, তার নেশার ঘোর না কাটলে কথা বলে লাভ নেই। লেফটেনেন্ট জেনারেল বললেন, তাই ভালো।
এদিকে ইঝোমি গেছেন একটি কবিতার আসরে। সম্রাটের দরবারের বাইরে একটি অভিজাত প্রাসাদে এই আয়োজন। এখানে সব কবিরা কবিতা পড়ার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। ইমন আছেন, মুরাসাকি আছেন, আছেন আরো অনেকে। এখানে অতিথি হয়ে এলেন মিচিনাগা। মিচিনাগা প্রধানমন্ত্রী এবং কাম্পাকু হলেও নিজে একজন কবি।
ইদানীং ইঝোমিকে বাইরে কোথাও দেখা যায় না, তাকে দেখে মিচিনাগা খুশি হয়ে বললেন, আজ আমরা কবি ইঝোমি শিকিবুর কবিতা বেশি বেশি শুনব। প্রথমেই তাকে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করতে হবে।
ইঝোমি এখন আলাদাভাবে কিছু লিখছেন না; সে অবস্থা তার নেই। শুধু প্রিন্সের পত্রের উত্তরই দিচ্ছেন বিরহ-কাতর কবিতায়। এখানে তা-ই পাঠ করতে শুরুকরলেন:
এক.
যদি ভালোই বাসো
এসো এবং দেখো কেমন আছি
এমনকি সহস্র দ্রুতধাবমান দেবতারাও
রুখতে পারবে না তোমায়
যারা তোমার পথ অনুসরণ করে সর্বদা।
দুই.
তুমি আসবে না?
তাহলে আমি নিজেই সেখানে যাব
যেখানে তোমার বাস, আমার আরাধ্য স্থান
দেবপীঠ পূজার উপাচার
আর চাই বাড়তি একটি আসন।
তিন.
প্রতীক্ষা! এটাই কী সত্য হতে পারে?
শীতের রাত বরফে (অশ্রু) বন্ধ চোখ
নির্জন মধ্যরাত, হ্যাঁ নির্জন তো, নিষ্ঠুর!
আমি ভোরের জন্য ছটফট করি
এমন ভোরেও কী আনন্দ আছে? এ কী রকম ভোর?
এসময় নিচে থেকে খবর এল প্রিন্স শকট নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ইঝোমি কোনো হাততালি নয়, কোনো প্রশংসাও নয়, সবকিছু পেছনে ফেলে ছুটে গেলেন প্রিন্সের কাছে।
প্রিন্স বললেন, হ্যাঁ, চল। আর দেরি নয়, শঙ্কা নয়, জীবনের সত্য যেখানে, সেখানেই যাব। মুখে তার কবিতা:
বরইফুল ফুটে আছে/ তুষারপাত তারই শাখায়/ বসন্ত আসছে উড়ে/ দেবতাদের হিমেল পাখায়।
পঞ্চান্ন.
ইমনের কবিতায়ও দুঃখ।
এক.
ফেরা নয় এবং
শিনোদায় মাত্র কিছুক্ষণ
তোমার তাকিয়ে থাকা দেখছিল বন!
তুমি হয়তো প্রত্যাবর্তন করবে পুনরায়
মৃদুমন্দ বায়ু তীরমূল পাতাকে দোলায়।
দুই.
গেল বসন্তের
ঝরে যাওয়া ফুলগুলো
এবারেও ফুটেছে পুনরায়
আমাদের বিচ্ছেদ বেদনাময়
যদি এটিই নিয়তি হয়, তবে থাক।
তিন.
প্রত্যাখ্যানের জন্য
আমার কোনো অজুহাত নেই
এখনো শিকাসুগার ক্রসিং এ
তুমি আটকে আছো, আমি জানি।
আমি কী বস্তুতঃই সংসার বিরাগী!
সবাই ইমনের কবিতা শুনে হাততালি দিলেন। মিচিনাগা বললেন, ইমন কী যেন ফেলে এসেছে, প্রত্যাশার আকুতি তার কবিতায়।
এবার মুরাসাকির সময় হল। মুরাসাকি সম্পর্কে সবাই উচ্চধারণা পোষণ করে। শুধু জনপ্রিয় মনোগাতারি নয়, কবিতায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। পাঁচশর বেশি পত্রকবিতা ইতোমধ্যেই ‘গেঞ্জি’ উপন্যাসে এসে গেছে। আরো কত আসবে কে জানে। কিন্তু না, তিনি বললেন, ‘গেঞ্জি’র কবিতা প্রচারিত হয়ে গেছে। আমি মৌলিক কবিতা পাঠ করব।
মিচিনাগাও তাই চাইছিলেন। মুরাসাকির কবিতার কোথাও কি তিনি আছেন? পত্রে যা থাকে তা সব সত্য নয়, মৌলিক কবিতায়ই আসল সত্যের পরিচয় মেলে।
মুরাসাকির কবিতা:
এক.
তুমি এলে তা হলে?
আমি তো অবাক যদি তুমিই হও
তার আগে নিশ্চিত হতে দাও
মেঘের আড়ালে বুঝি লুকিয়ে ছিলে
এলে মধ্যরাতের জোৎস্নায়।
দুই.
যুগ যুগান্তরের দেবতা
কোথায় আছেন, আমি বিস্মিত!
চেরি ফোটার
এমন দিনে তার জন্য শিরোস্ত্রাণ
আমি বানিয়েছি, পালক ছড়ানো যেন।
তিন.
কুমারী সদৃশফুল সুবর্ণরঙ
সূক্ষ্মবর্ণেই বেশি সুন্দর
আমি তাকিয়ে দেখি
শিশির সিক্ত হলেই পার্থক্য সূচিত হয় আমাদের
আমি তা কত ভালোভাবেই না জানি।
সবাই হাততালি বাজাতেই থাকলেন। মিচিনাগা মিটি মিটি হাসছেন। প্রথম দুটি কবিতার তত্ত্বপ্রতীকে দূরবর্তী সংবাদ থাকলেও, শেষের কবিতাটির সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। একদিন মিচিনাগা একটি ফুল ছিঁড়ে তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এই ফুল দিয়ে একটি কবিতা লিখ।
মিচিনাগা বললেন, এতো দেখছি আশাবাদী কবিতা। বড় মধুর তার ভাব। হতাশা নেই। ধন্যবাদ।
সবাই এবারে মিচিনাগার কবিতা শুনতে চাইলেন।
মিচিনাগা বললেন, এত বড় বড় কবিদের আসরে আমার কবিতা কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? পাবে না।
তবুও আমরা শুনব। বললেন ইমন।
রূপালি শিশির কখনোই আংশিক নয়
তার হৃদয় থেকে
ফুলবালিকা অখন্ড সুন্দরী।
মিচিনাগার আবৃতি করা নিজের ছোট্ট কবিতাটির একটি পটভূমি আছে। সেদিন মুরাসাকি তার কক্ষে বসেছিলেন। কক্ষ থেকে বাগান দেখা যায় জানলা দিয়ে। সকাল বেলা। দুর্বল বাতাস, শিশির এখনো পাতায় ঝলমল করছে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে হাঁটছেন। হঠাৎই অমোনাইসি ফুলের একটি ডাটা ভেঙে ফেলেন। তিনি মুরাসাকির জানালার পর্দা সরিয়ে উকি মারলেন। তাতে বেশ বিব্রত মুরাসাকি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, দ্রুত একটি কবিতা লিখে দাও। দেরী হলে মজা থাকবে না। মুরাসাকি লিখলেন: ফুলের মধ্যে প্রথম ফুল/ শিশিরে সুন্দর, আরো উজ্জ্বল/ যা শুধু আংশিক/ আমার নয়, অন্য পাক্ষিক।
তুশিমিকাদো (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে সঙ্গে খাতা কলম চাইলেন এবং লিখেছিলেন কবিতাটি। আজকে সুযোগ পেয়ে এটিই পাঠ করলেন এবং প্রচুর হাততালি পেলেন।
প্রাসাদ মালিক সাহিত্যপ্রেমি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, কবিরা এসেছেন, তাতে খুবই আনন্দিত। ভুরিভোজের ব্যবস্থাসহ নানা আয়োজনে অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলেছেন।
যেতে খেতে মিচিনাগা সেই শোনাগনের কথা তুললেন। বললেন, সে লেখে ভালো কিন্তু কাজ করে বিতর্কিত। উচ্চাভিশাষী, প্রেম পিয়াসী। বলে হাসলেন। পরে বললেন, এখন ঝামেলা তৈরি করে নিজেই প্রদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এখানে থাকলে আজ তার কবিতা শুনতে পারতাম। পক্ষপাতমূলক কাজের জন্য তাকে কিয়োটো থেকে সরে যেতে হয়েছে। কবি- লেখকরা থাকবেন পক্ষপাতহীন। এ জন্যই আমি তাকাকুকে পছন্দ করি।
তাকাকুর (মুরাসাকি) দিকে সবাই তাকালেন, তাকাবু মাথা নিচু করে আছেন। ইঝোমিও এক প্রিন্সকে নিয়ে আন্দোলন করছে। কবিদের জগৎটা আলাদা থাকুক, এটি আমি চাই। বলে মিচিনাগা কথা শেষ করলেন।
খাচ্ছেন সবাই। হাততালির সুযোগ নেই। ইমন বললেন, আমরা যাঁদের সঙ্গে কাজ করি তাঁদের প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব এসে যায়।
তাই বলে এত ক্ষতিকর পক্ষপাতীত্ব? এটা কেউ মেনে নেবে না। বললেন মিচিনাগা। প্রাসাদ মালিক তা সমর্থন করলেন। বললেন, কর্ম যার যার, কবিরা সবার। মিচিনাগা বললেন, কবিদের আসর বসিয়ে তুমিও দেখছি কবি হয়ে গেছো।
তাঁর কথায় উচ্চস্বরে সবাই হাসলেন।
একে একে বিদায় নিলেন সবাই। মুরাসাকি এবং ইমন মিচিনাগার শকটে চড়ে সম্রাজ্ঞীর প্রাসাদে গেলেন। মুরাসাকি এবং মিচিনাগার অন্তরে কী ঘটছে ইমন তা জানতে পারলেন না।
পরদিন বৃষ্টি স্নাত নিস্তরঙ্গ বিকেলে মুরাসাকি লেডি সাইশোর সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় মিচিনাগাপুত্র এসে উপস্থিত হল। সে থার্ড র্যাঙ্কের পদ মর্যাদা ভোগ করে। বয়স খুবই কম কিন্তু বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পাকা। দেখতেও পরিপাটি। সে বলল, সুন্দর মুখের চেয়ে সুন্দর অন্তরটাই বেশি দুর্লভ। মুরাসাকিরা শুধু অবাকই হলেন না, ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। মনে মনে বললেন, বলে কী সে! একে ছোট বালক মনে করা তো ভুল। মহিলাদের মধ্যে সে নিজের মর্যাদা রক্ষা করে চলে। তবে অবাক করা ব্যাপার হল একজন রোমান্টিক নায়কের মতই সে তাদের সামনে দিয়ে আবৃত্তি করতে করতে গেলঃ ‘অবারিত মাঠ যেথায় ফুলকুমারীরা ফোটে/তোমার নাম নিষ্প্রভ হবে প্রণয়পূর্ণ নাগরালির গল্প টুটে গেলে।’
অনেক প্রত্যাশিত রোমান্টিক নায়কও এমনটি বলতে পারে না। তাদের বিস্ময়ের কারণও তা-ই। বাবাকে উৎরে যাবে এই ছেলে। তার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। এই চরিত্রের সঙ্গে আগে পরিচয় হলে গেঞ্জিতে চারশ ত্রিশটির সঙ্গে আরো একটি যুক্ত হত। বোনের সন্তান হবে এই আনন্দেও আছে সে এবং বোনের আশে পাশেই থাকছে।
অলস আরেকটি বিকেল। লিখতে পারছেন না তিনি (মুরাসাকি)। সুগন্ধি বানানোর কাজ শেষ করে তা বিতরণ করা হলো। পরে লেডিদের গোল হয়ে বসে আড্ডা। তার বন্ধু সাইশো আসেননি। কাছেই তাঁর কক্ষ। শুয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি। মুরাসাকি উঁকি মারলেন তার কক্ষে। হাগি এবং শিয়ন পরিধান করেছেন সাইশি। কড়া সুগন্ধি মেখেছেন। মুখ মণ্ডল ঢেকে রেখেছেন। মুরাসাকি মুখের থেকে কাপড়টা সরিয়ে নিয়ে বললেন, তোমাকে ঠিক একটা রোমান্টিক নায়িকার মতো লাগছে। তিনি উঠে চুল ব্রাশ করে একটু সাজলেন। তাঁর রূপ যেন উপচে পড়ছে। বললেন, ওদিককার কোনো খবর? ক্রমশ...
বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২২ , ০৬ মাঘ ১৪২৮ ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৩
আবুল কাসেম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
চুয়ান্ন.
প্রিন্স অতসুমিচির পত্রে ইঝোমি এতটা আঘাত পেলেন যে, তার ইচ্ছে হল না সে পত্রের জবাব দেন। অতীতে কখনোই এরকমটি ঘটেনি। তার বদনাম এবং গুজব অনেক রটেছে। অন্য কুৎসাও আছে যে তিনি প্রিন্সের ইচ্ছাতেই প্রাসাদে বাস করতে যাচ্ছেন। তাই চুপ থাকাই ভালো মনে করলেন।
প্রিন্স যখন দেখলেন ইঝোমি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন না, তখন আবার লিখলেন, তুমি উত্তর দিচ্ছ না কেন?
আমি এখন গুজবে বিশ্বাস করছি। কত সহজে তোমরা বদলে যেতে পারো। আমি এমন কিছু শুনেছিলাম যা বিশ্বাস করিনি। আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার অন্তর থেকে অপ্রীতিকর ভাবনাগুলো মুছে দাও।
ইঝোমি লিখলেন, আপনি কি এখনই আমার কাছে আসতে পারেন? আমি যেতে পারি না, কারণ আমাকে অপবাদে কবর দেয়া হয়েছে।
প্রিন্স লিখলেন, তুমি অপবাদকে ভয় পাও জানি। আমি নিবিড়ভাবে তোমার মনকে পাঠ করেছি। তাই আমি ক্ষিপ্ত।
আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারি না। যে কোনোভাবেই হোক আসুন আপনি। লিখলেন ইঝোমি।
প্রিন্স প্রত্যুত্তরে লিখলেন, আমি নিজেকে বুঝাই কখনো সন্দেহ করব না, বিরক্ত করব না; আমার হৃদয় আমার ইচ্ছাকে অনুসরণ করে না। সে অন্য কিছু বলে।
ইঝোমি লিখলেন, আপনার শত্রুতা বন্ধ হবার নয়। অথচ আমি আপনার ওপরই নির্ভর করি। আপনি আমার বিশ্বস্ততায় সন্দেহ করেন। এটা দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
সন্ধ্যার দিকে প্রিন্স এলেন। বললেন, কেন আসতে বলেছ?
আমাকে নিয়ে যান যেখানে খুশি।
প্রিন্স ভোরবেলা একাকীই ফিরে গেলেন। তাতে ইঝোমির কষ্ট হল। রাতে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হল। প্রিন্স কোনো খবরই নিলেন না। ক্ষুব্ধ হলেন এতে ইঝোমি।
বুঝতে পেরে প্রিন্স পালকি পাঠিয়ে লিখলেন, চলে এসো। আমি গুপ্ত স্থানে আছি।
প্রিন্সের পত্রের জবাবে ইঝোমি লিখলেন, এখানে একে অপরকে দেখার উপায় আমার বাড়িতে আসা।
প্রিন্স সে রাতেই ইঝোমিকে দেখতে এলেন এবং হঠাৎ করেই বললেন, তুমি কি দুঃখ পাবে, আমি যদি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যাই?
এসব কী বলছেন এবং কেন বলছেন? আপনার সম্রাটের পদের জন্য আমি কি শুধু শুধুই আন্দোলন করে যাচ্ছি? সন্ন্যাসী আমিও হতাম যদি আপনার জন্য সম্মুখে কোনো স্বপ্ন না থাকতো।
সানজুই সম্রাট হবেন, তিনি যা চাইবেন সবই পাবেন। আমার সন্ন্যাসী হওয়াই উচিত।
তিনি আপনার বড় ভাই। আপনার সম্ভাবনা দু’বার, সুযোগও দু’বার।
আরে আমার মনের কষ্ট সিংহাসনের জন্য নয়, তোমার জন্য। তোমাকে যদি না পাই সিংহাসন দিয়ে কী হবে?
প্রিন্সেস অর্থাৎ আপনার স্ত্রী তো রয়েছেন, তিনি সম্রাজ্ঞী হবেন।
আমি তাকে সহ্য করতেই পারি না। আর তুমি বানাবে সম্রাট, সম্রাজ্ঞী হবে আরেকজন, তার চেয়ে আমার বনবাসে যাওয়াই শ্রেয়।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। তুষারপাতও আছে। এরা ঘনিষ্ট এবং পৃথিবীর সবকিছু ভুলে একে অন্যকে অনুভব করছেন। ইঝোমির মনে হল তার চেয়ে তার প্রতি প্রিন্সের ভালোবাসা প্রবল। তিনি নিজেও একসময়, সন্ন্যাসিনী হতে চেয়েছিলেন, সে কথা এখন আবার মনে হল। কিন্তু প্রিন্সকে কিছুই বললেন না, বিলাপ করে বসলেন।
প্রিন্সের তাতে হৃদয় বিদীর্ন হল। বললেন, প্রেমীদের মুহূর্তের অলিক কল্পনা আমাদের উভয়কে সারারাত আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ইঝোমি কবিতায় বললেন, তাদের চোখ জলে ভেসে গেছে। কোনো বৃষ্টিপাত ছাড়াই।
সকাল হতেই প্রিন্স চলে গেলেন। ইঝোমি ভাবলেন, রাতটা বাস্তব নয়, স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্নের ঘোর যেন এখনও কাটছে না। ক্রমে ক্রমে বাড়ছে দুঃখ কাতরতা।
প্রিন্সও একই অবস্থার শিকার। তার যেন আর ইঝোমিকে ছাড়া এক মুহূর্তও কাটছে না। ইঝোমিকে লিখে পাঠান একটি কবিতা: এক মুহূর্তের জন্যও আমি থাকব না/ এমন এক পৃথিবীতে যেখানে দুঃখ/ অনুসরণ করে একের পর এক/ বাঁশের জিংলার মতো।
প্রিন্স সত্যি সত্যিই উম্মাদের মতো হয়ে গেছেন। তার প্রতিদিনকার জীবন বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। থাকা-খাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পিতা প্রাক্তন সম্রাট রেইঝেই-এর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। প্রকৃতই তিনি সন্ন্যাসী হতে চান, মাঝে-মধ্যে ভাবেন পৃথিবী থেকেই বিদায় নেবেন।
তার মামাত ভাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল তার ভাই ক্রাউন প্রিন্সকে সংবাদ দিয়ে নিয়ে এলেন। ক্রাউন প্রিন্স বললেন, তোমার এই অবস্থা আমাদের পারিবারিক সুনাম নষ্ট করছে। এটা তোমাকে মানায় না। তুমি ভেবে দেখো, বাবার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব শুধু আমারই না, তোমারও। তোমার যে স্ত্রী রয়েছে, সে উচ্চবংশীয়। তুমি পছন্দ করেই তাকে বিয়ে করেছ। তার বোন আমার স্ত্রী, পারিবারিক অশান্তি আর বাড়িয়ে দিও না। অনুগ্রহ কর।
প্রিন্স আজ একটু বেশি মাতাল। বললেন, তুমি ভবিষ্যত সম্রাট, আমি কী? আমি এভাবেই ভালো আছি। প্রিন্স তার লেখা কবিতাটি গান আকারে গাইলেন, ‘একমুহূর্তও থাকব না আমি পৃথিবীতে/ যেখানে দুঃখ আছে।
ক্রাউন প্রিন্স সানজু বললেন, তার নেশার ঘোর না কাটলে কথা বলে লাভ নেই। লেফটেনেন্ট জেনারেল বললেন, তাই ভালো।
এদিকে ইঝোমি গেছেন একটি কবিতার আসরে। সম্রাটের দরবারের বাইরে একটি অভিজাত প্রাসাদে এই আয়োজন। এখানে সব কবিরা কবিতা পড়ার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। ইমন আছেন, মুরাসাকি আছেন, আছেন আরো অনেকে। এখানে অতিথি হয়ে এলেন মিচিনাগা। মিচিনাগা প্রধানমন্ত্রী এবং কাম্পাকু হলেও নিজে একজন কবি।
ইদানীং ইঝোমিকে বাইরে কোথাও দেখা যায় না, তাকে দেখে মিচিনাগা খুশি হয়ে বললেন, আজ আমরা কবি ইঝোমি শিকিবুর কবিতা বেশি বেশি শুনব। প্রথমেই তাকে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করতে হবে।
ইঝোমি এখন আলাদাভাবে কিছু লিখছেন না; সে অবস্থা তার নেই। শুধু প্রিন্সের পত্রের উত্তরই দিচ্ছেন বিরহ-কাতর কবিতায়। এখানে তা-ই পাঠ করতে শুরুকরলেন:
এক.
যদি ভালোই বাসো
এসো এবং দেখো কেমন আছি
এমনকি সহস্র দ্রুতধাবমান দেবতারাও
রুখতে পারবে না তোমায়
যারা তোমার পথ অনুসরণ করে সর্বদা।
দুই.
তুমি আসবে না?
তাহলে আমি নিজেই সেখানে যাব
যেখানে তোমার বাস, আমার আরাধ্য স্থান
দেবপীঠ পূজার উপাচার
আর চাই বাড়তি একটি আসন।
তিন.
প্রতীক্ষা! এটাই কী সত্য হতে পারে?
শীতের রাত বরফে (অশ্রু) বন্ধ চোখ
নির্জন মধ্যরাত, হ্যাঁ নির্জন তো, নিষ্ঠুর!
আমি ভোরের জন্য ছটফট করি
এমন ভোরেও কী আনন্দ আছে? এ কী রকম ভোর?
এসময় নিচে থেকে খবর এল প্রিন্স শকট নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ইঝোমি কোনো হাততালি নয়, কোনো প্রশংসাও নয়, সবকিছু পেছনে ফেলে ছুটে গেলেন প্রিন্সের কাছে।
প্রিন্স বললেন, হ্যাঁ, চল। আর দেরি নয়, শঙ্কা নয়, জীবনের সত্য যেখানে, সেখানেই যাব। মুখে তার কবিতা:
বরইফুল ফুটে আছে/ তুষারপাত তারই শাখায়/ বসন্ত আসছে উড়ে/ দেবতাদের হিমেল পাখায়।
পঞ্চান্ন.
ইমনের কবিতায়ও দুঃখ।
এক.
ফেরা নয় এবং
শিনোদায় মাত্র কিছুক্ষণ
তোমার তাকিয়ে থাকা দেখছিল বন!
তুমি হয়তো প্রত্যাবর্তন করবে পুনরায়
মৃদুমন্দ বায়ু তীরমূল পাতাকে দোলায়।
দুই.
গেল বসন্তের
ঝরে যাওয়া ফুলগুলো
এবারেও ফুটেছে পুনরায়
আমাদের বিচ্ছেদ বেদনাময়
যদি এটিই নিয়তি হয়, তবে থাক।
তিন.
প্রত্যাখ্যানের জন্য
আমার কোনো অজুহাত নেই
এখনো শিকাসুগার ক্রসিং এ
তুমি আটকে আছো, আমি জানি।
আমি কী বস্তুতঃই সংসার বিরাগী!
সবাই ইমনের কবিতা শুনে হাততালি দিলেন। মিচিনাগা বললেন, ইমন কী যেন ফেলে এসেছে, প্রত্যাশার আকুতি তার কবিতায়।
এবার মুরাসাকির সময় হল। মুরাসাকি সম্পর্কে সবাই উচ্চধারণা পোষণ করে। শুধু জনপ্রিয় মনোগাতারি নয়, কবিতায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। পাঁচশর বেশি পত্রকবিতা ইতোমধ্যেই ‘গেঞ্জি’ উপন্যাসে এসে গেছে। আরো কত আসবে কে জানে। কিন্তু না, তিনি বললেন, ‘গেঞ্জি’র কবিতা প্রচারিত হয়ে গেছে। আমি মৌলিক কবিতা পাঠ করব।
মিচিনাগাও তাই চাইছিলেন। মুরাসাকির কবিতার কোথাও কি তিনি আছেন? পত্রে যা থাকে তা সব সত্য নয়, মৌলিক কবিতায়ই আসল সত্যের পরিচয় মেলে।
মুরাসাকির কবিতা:
এক.
তুমি এলে তা হলে?
আমি তো অবাক যদি তুমিই হও
তার আগে নিশ্চিত হতে দাও
মেঘের আড়ালে বুঝি লুকিয়ে ছিলে
এলে মধ্যরাতের জোৎস্নায়।
দুই.
যুগ যুগান্তরের দেবতা
কোথায় আছেন, আমি বিস্মিত!
চেরি ফোটার
এমন দিনে তার জন্য শিরোস্ত্রাণ
আমি বানিয়েছি, পালক ছড়ানো যেন।
তিন.
কুমারী সদৃশফুল সুবর্ণরঙ
সূক্ষ্মবর্ণেই বেশি সুন্দর
আমি তাকিয়ে দেখি
শিশির সিক্ত হলেই পার্থক্য সূচিত হয় আমাদের
আমি তা কত ভালোভাবেই না জানি।
সবাই হাততালি বাজাতেই থাকলেন। মিচিনাগা মিটি মিটি হাসছেন। প্রথম দুটি কবিতার তত্ত্বপ্রতীকে দূরবর্তী সংবাদ থাকলেও, শেষের কবিতাটির সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। একদিন মিচিনাগা একটি ফুল ছিঁড়ে তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এই ফুল দিয়ে একটি কবিতা লিখ।
মিচিনাগা বললেন, এতো দেখছি আশাবাদী কবিতা। বড় মধুর তার ভাব। হতাশা নেই। ধন্যবাদ।
সবাই এবারে মিচিনাগার কবিতা শুনতে চাইলেন।
মিচিনাগা বললেন, এত বড় বড় কবিদের আসরে আমার কবিতা কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? পাবে না।
তবুও আমরা শুনব। বললেন ইমন।
রূপালি শিশির কখনোই আংশিক নয়
তার হৃদয় থেকে
ফুলবালিকা অখন্ড সুন্দরী।
মিচিনাগার আবৃতি করা নিজের ছোট্ট কবিতাটির একটি পটভূমি আছে। সেদিন মুরাসাকি তার কক্ষে বসেছিলেন। কক্ষ থেকে বাগান দেখা যায় জানলা দিয়ে। সকাল বেলা। দুর্বল বাতাস, শিশির এখনো পাতায় ঝলমল করছে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে হাঁটছেন। হঠাৎই অমোনাইসি ফুলের একটি ডাটা ভেঙে ফেলেন। তিনি মুরাসাকির জানালার পর্দা সরিয়ে উকি মারলেন। তাতে বেশ বিব্রত মুরাসাকি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, দ্রুত একটি কবিতা লিখে দাও। দেরী হলে মজা থাকবে না। মুরাসাকি লিখলেন: ফুলের মধ্যে প্রথম ফুল/ শিশিরে সুন্দর, আরো উজ্জ্বল/ যা শুধু আংশিক/ আমার নয়, অন্য পাক্ষিক।
তুশিমিকাদো (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে সঙ্গে খাতা কলম চাইলেন এবং লিখেছিলেন কবিতাটি। আজকে সুযোগ পেয়ে এটিই পাঠ করলেন এবং প্রচুর হাততালি পেলেন।
প্রাসাদ মালিক সাহিত্যপ্রেমি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, কবিরা এসেছেন, তাতে খুবই আনন্দিত। ভুরিভোজের ব্যবস্থাসহ নানা আয়োজনে অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলেছেন।
যেতে খেতে মিচিনাগা সেই শোনাগনের কথা তুললেন। বললেন, সে লেখে ভালো কিন্তু কাজ করে বিতর্কিত। উচ্চাভিশাষী, প্রেম পিয়াসী। বলে হাসলেন। পরে বললেন, এখন ঝামেলা তৈরি করে নিজেই প্রদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এখানে থাকলে আজ তার কবিতা শুনতে পারতাম। পক্ষপাতমূলক কাজের জন্য তাকে কিয়োটো থেকে সরে যেতে হয়েছে। কবি- লেখকরা থাকবেন পক্ষপাতহীন। এ জন্যই আমি তাকাকুকে পছন্দ করি।
তাকাকুর (মুরাসাকি) দিকে সবাই তাকালেন, তাকাবু মাথা নিচু করে আছেন। ইঝোমিও এক প্রিন্সকে নিয়ে আন্দোলন করছে। কবিদের জগৎটা আলাদা থাকুক, এটি আমি চাই। বলে মিচিনাগা কথা শেষ করলেন।
খাচ্ছেন সবাই। হাততালির সুযোগ নেই। ইমন বললেন, আমরা যাঁদের সঙ্গে কাজ করি তাঁদের প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব এসে যায়।
তাই বলে এত ক্ষতিকর পক্ষপাতীত্ব? এটা কেউ মেনে নেবে না। বললেন মিচিনাগা। প্রাসাদ মালিক তা সমর্থন করলেন। বললেন, কর্ম যার যার, কবিরা সবার। মিচিনাগা বললেন, কবিদের আসর বসিয়ে তুমিও দেখছি কবি হয়ে গেছো।
তাঁর কথায় উচ্চস্বরে সবাই হাসলেন।
একে একে বিদায় নিলেন সবাই। মুরাসাকি এবং ইমন মিচিনাগার শকটে চড়ে সম্রাজ্ঞীর প্রাসাদে গেলেন। মুরাসাকি এবং মিচিনাগার অন্তরে কী ঘটছে ইমন তা জানতে পারলেন না।
পরদিন বৃষ্টি স্নাত নিস্তরঙ্গ বিকেলে মুরাসাকি লেডি সাইশোর সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় মিচিনাগাপুত্র এসে উপস্থিত হল। সে থার্ড র্যাঙ্কের পদ মর্যাদা ভোগ করে। বয়স খুবই কম কিন্তু বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পাকা। দেখতেও পরিপাটি। সে বলল, সুন্দর মুখের চেয়ে সুন্দর অন্তরটাই বেশি দুর্লভ। মুরাসাকিরা শুধু অবাকই হলেন না, ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। মনে মনে বললেন, বলে কী সে! একে ছোট বালক মনে করা তো ভুল। মহিলাদের মধ্যে সে নিজের মর্যাদা রক্ষা করে চলে। তবে অবাক করা ব্যাপার হল একজন রোমান্টিক নায়কের মতই সে তাদের সামনে দিয়ে আবৃত্তি করতে করতে গেলঃ ‘অবারিত মাঠ যেথায় ফুলকুমারীরা ফোটে/তোমার নাম নিষ্প্রভ হবে প্রণয়পূর্ণ নাগরালির গল্প টুটে গেলে।’
অনেক প্রত্যাশিত রোমান্টিক নায়কও এমনটি বলতে পারে না। তাদের বিস্ময়ের কারণও তা-ই। বাবাকে উৎরে যাবে এই ছেলে। তার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। এই চরিত্রের সঙ্গে আগে পরিচয় হলে গেঞ্জিতে চারশ ত্রিশটির সঙ্গে আরো একটি যুক্ত হত। বোনের সন্তান হবে এই আনন্দেও আছে সে এবং বোনের আশে পাশেই থাকছে।
অলস আরেকটি বিকেল। লিখতে পারছেন না তিনি (মুরাসাকি)। সুগন্ধি বানানোর কাজ শেষ করে তা বিতরণ করা হলো। পরে লেডিদের গোল হয়ে বসে আড্ডা। তার বন্ধু সাইশো আসেননি। কাছেই তাঁর কক্ষ। শুয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি। মুরাসাকি উঁকি মারলেন তার কক্ষে। হাগি এবং শিয়ন পরিধান করেছেন সাইশি। কড়া সুগন্ধি মেখেছেন। মুখ মণ্ডল ঢেকে রেখেছেন। মুরাসাকি মুখের থেকে কাপড়টা সরিয়ে নিয়ে বললেন, তোমাকে ঠিক একটা রোমান্টিক নায়িকার মতো লাগছে। তিনি উঠে চুল ব্রাশ করে একটু সাজলেন। তাঁর রূপ যেন উপচে পড়ছে। বললেন, ওদিককার কোনো খবর? ক্রমশ...