অর্ণব আশিক
“কিছু প্রশ্নের জবাব কখনো মেলে না, শুধুই অকারণে ব্যথা বাড়ায়।”
পিওনা আফরোজের ‘কাছের মানুষ দূরের মানুষ’ উপন্যাসের একটি লাইন। আমাকে চমকে দিলো।
একজন লেখকের কাছে সাধারণ পাঠকদের আকাক্সক্ষা হলো- মাটি ও মানুষে নমিত হোক তার লেখা, ইতিবাচক জীবনচেতনায় জারিত হোক তার গল্পের আখ্যান। উপন্যাসের প্রতিটি লাইনে, সিকোয়েন্সে পাঠক খুঁজে পাক নিজেকে, নিজের অনুভূতিগুলোর সমান্তরালে বয়ে যাক উপন্যাসের চরিত্রগুলো। সমাজের অবিমিশ্র ঘটনা, সামাজিক জটিলতার প্রকৃত চিত্র উঠে আসুক লেখকের লেখায়। শুধু কি তাই? ঘটনার মাঝেকার চিত্র- শ্রুতিকল্প অর্থময়তাকে ছাপিয়ে পাঠকের অন্তরে এক অনির্বচনীয় আবেশ ছড়িয়ে দিক। এ কারণে অধিকাংশ পাঠক জীবনঘনিষ্ঠ লেখাকে তার পাঠ্য করে নেয়। আমাদের সৌভাগ্য যে, পাঠকদের এই চাহিদাকে আমল দিয়ে কথাসাহিত্য চর্চায় ব্যাপৃত লেখকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। পিওনা আফরোজ নবীন কথাসাহিত্যিক, কিন্তু তার ‘দূরের মানুষ, কাছের মানুষ’ পড়লে বোঝা যায় না তিনি নবীন। লেখার গভীরতা চমৎকার, কাহিনী বর্ণনা প্রাঞ্জল।
লেখক জীবন ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভর করে, প্রেমকে আশ্রয় করে তাঁর ‘কাছের মানুষ দূরের মানুষ’ উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়েছেন।
একটি সুন্দর মুগ্ধতা ছড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশ ও একটি দাম্পত্য সুখের আবহ দিয়ে উপন্যাসের আখ্যান শুরু। তারপরই কিছু প্রশ্ন জমাট বাঁধে, মিনারার মনে যেমন, মাহমুদের মনেও। আর এই অমীমাংসিত প্রশ্নের ঘুরপাকই সমগ্র উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে কখনো ফুল বিছানো পথে কখনও কষ্টকর অমানিশার পথ ধরে এগিয়েছে।
একটি সরল রৈখিক পরিম-লে উপন্যাসের শুরু হলেও বারবার বাঁক বদলেছে এ উপন্যাস, আবার উপন্যাসের চরিত্রগুলোও। মিনারা আপাত সরল নারী। কিন্তু তার স্যাক্রিফাইস, নারীর সন্তান আকক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও স্বামীর প্রতি অনাবিল ভালোবাসা তাকে এক প্রকার দেবীতুল্য করে তোলে। কিন্তু একটি সময় স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তি তাকে মর্মযাতনা দেয়। শরীর থাকে কিন্তু মন তার মরে যায় ধীরে। মিনারা অসুস্থ হয়, হাসপাতালে যায়। বাড়ি আসে, কিন্তু সেই মিনারাকে আর মাহমুদ খুঁজে পায় না। “আগের মতো কোন কিছুতে আর কোন অধিকার দেখান না। তেমনভাবে অন্য কারো সাথেও কথা বলেন না। সব সময় নিজের মতো একা চুপচাপ থাকেন। এমনকি সংসারের জন্য নিজেকে আর ততটা প্রয়োজন বলেও মনে করেন না।” ভাবেন সংসার ও সম্পর্ক হলো বিশ্বাসের উপর নির্ভর করা একটি সাঁকো। যখন মিনারা জানলো দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে যে নির্ভরতা তাতেও চিড় ধরা, তখনই তাকে স্বামী থাকা সত্ত্বেও একাকীত্ব বিশাল পাথরের মতো চেপে ধরে।
এ বিষয়টি শুধু মিনারা, মাহমুদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, মামুনের জীবনেও ঘটে। আসলে মানুষের এই যে হৃদয় ঘটিত জটিলতা, টানাপোড়েন- এটাই অমীমাংসিত সত্য ও প্রশ্ন। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেদনাই বাড়ে।
১৩৮ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে জীবনের সবচাইতে কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপারগুলো লেখক সাবলীলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মনুষ্য জীবন সব সময়ই জটিল। এই জটিল বিষয়গুলোকে ঔপন্যাসিক সরল রেখার মতো বা প্লাবনের জোয়ারের মতো উপন্যাসের শেষ হওয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। যা পাঠককে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁধে রাখে।
উপন্যাসের কাহিনির বিন্যাস মাহমুদ ও মিনারার দাম্পত্য জীবন দিয়ে যেভাবে শুরু হয়, মিনারার সন্তান ধারণ ক্ষমতা না থাকায় তা অন্য দিকে পরিবর্তিত হয়। এখানে লেখক চিরায়ত সেই রূপটিকেই তুলে ধরেছেন যে, দাম্পত্য জীবনে সন্তান জন্মদানের ব্যর্থতার প্রথম ভিকটিক হয় নারীরাই। আর নারীকেও তা মানতে বাধ্য করা হয়। এ উপন্যাসে লেখক এই চিরায়ত ধারণায় প্রবল আঘাত করেছেন।
আমাদের সমাজের মানুষের সংকীর্ণতা এ উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে মিনারার দিনযাপনের মধ্যেই একদিন চিকিৎসার মাধ্যমে মাহমুদ জানতে পারে, সমস্যাটা মিনারার মধ্যে নয়, সমস্যাটা মাহমুদের।
প্রেম, দাম্পত্য জটিলতা, অর্থ, প্রতারণা, কুসংস্কার, প্রচলিত ধারণায় বিশ^াস- এ জায়গাগুলো লেখকের গভীরে প্রবলভাবে রেখাপাত করেছে। এবং বর্তমান উপন্যাসে তিনি এসবের স্বরূপ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। গণমানুষের ভাবনায় লেখকহৃদয় ব্যাকুল হয়েছে। তিনি আহত হয়েছেন। আর সেই ক্ষত লেখক পিওনা আফরোজকে দিয়ে উপন্যাসটি লিখিয়ে নিয়েছে।
কাছের মানুষ দূরের মানুষ। পিওনা আফরোজ। প্রকাশক: চন্দ্রভুক। প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ। পৃষ্ঠা ১৩৮। মূল্য: ২৮৫ টাকা।
বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী ২০২২ , ০৬ মাঘ ১৪২৮ ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৩
অর্ণব আশিক
“কিছু প্রশ্নের জবাব কখনো মেলে না, শুধুই অকারণে ব্যথা বাড়ায়।”
পিওনা আফরোজের ‘কাছের মানুষ দূরের মানুষ’ উপন্যাসের একটি লাইন। আমাকে চমকে দিলো।
একজন লেখকের কাছে সাধারণ পাঠকদের আকাক্সক্ষা হলো- মাটি ও মানুষে নমিত হোক তার লেখা, ইতিবাচক জীবনচেতনায় জারিত হোক তার গল্পের আখ্যান। উপন্যাসের প্রতিটি লাইনে, সিকোয়েন্সে পাঠক খুঁজে পাক নিজেকে, নিজের অনুভূতিগুলোর সমান্তরালে বয়ে যাক উপন্যাসের চরিত্রগুলো। সমাজের অবিমিশ্র ঘটনা, সামাজিক জটিলতার প্রকৃত চিত্র উঠে আসুক লেখকের লেখায়। শুধু কি তাই? ঘটনার মাঝেকার চিত্র- শ্রুতিকল্প অর্থময়তাকে ছাপিয়ে পাঠকের অন্তরে এক অনির্বচনীয় আবেশ ছড়িয়ে দিক। এ কারণে অধিকাংশ পাঠক জীবনঘনিষ্ঠ লেখাকে তার পাঠ্য করে নেয়। আমাদের সৌভাগ্য যে, পাঠকদের এই চাহিদাকে আমল দিয়ে কথাসাহিত্য চর্চায় ব্যাপৃত লেখকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। পিওনা আফরোজ নবীন কথাসাহিত্যিক, কিন্তু তার ‘দূরের মানুষ, কাছের মানুষ’ পড়লে বোঝা যায় না তিনি নবীন। লেখার গভীরতা চমৎকার, কাহিনী বর্ণনা প্রাঞ্জল।
লেখক জীবন ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভর করে, প্রেমকে আশ্রয় করে তাঁর ‘কাছের মানুষ দূরের মানুষ’ উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়েছেন।
একটি সুন্দর মুগ্ধতা ছড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশ ও একটি দাম্পত্য সুখের আবহ দিয়ে উপন্যাসের আখ্যান শুরু। তারপরই কিছু প্রশ্ন জমাট বাঁধে, মিনারার মনে যেমন, মাহমুদের মনেও। আর এই অমীমাংসিত প্রশ্নের ঘুরপাকই সমগ্র উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে কখনো ফুল বিছানো পথে কখনও কষ্টকর অমানিশার পথ ধরে এগিয়েছে।
একটি সরল রৈখিক পরিম-লে উপন্যাসের শুরু হলেও বারবার বাঁক বদলেছে এ উপন্যাস, আবার উপন্যাসের চরিত্রগুলোও। মিনারা আপাত সরল নারী। কিন্তু তার স্যাক্রিফাইস, নারীর সন্তান আকক্সক্ষা থাকা সত্ত্বেও স্বামীর প্রতি অনাবিল ভালোবাসা তাকে এক প্রকার দেবীতুল্য করে তোলে। কিন্তু একটি সময় স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তি তাকে মর্মযাতনা দেয়। শরীর থাকে কিন্তু মন তার মরে যায় ধীরে। মিনারা অসুস্থ হয়, হাসপাতালে যায়। বাড়ি আসে, কিন্তু সেই মিনারাকে আর মাহমুদ খুঁজে পায় না। “আগের মতো কোন কিছুতে আর কোন অধিকার দেখান না। তেমনভাবে অন্য কারো সাথেও কথা বলেন না। সব সময় নিজের মতো একা চুপচাপ থাকেন। এমনকি সংসারের জন্য নিজেকে আর ততটা প্রয়োজন বলেও মনে করেন না।” ভাবেন সংসার ও সম্পর্ক হলো বিশ্বাসের উপর নির্ভর করা একটি সাঁকো। যখন মিনারা জানলো দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে যে নির্ভরতা তাতেও চিড় ধরা, তখনই তাকে স্বামী থাকা সত্ত্বেও একাকীত্ব বিশাল পাথরের মতো চেপে ধরে।
এ বিষয়টি শুধু মিনারা, মাহমুদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি, মামুনের জীবনেও ঘটে। আসলে মানুষের এই যে হৃদয় ঘটিত জটিলতা, টানাপোড়েন- এটাই অমীমাংসিত সত্য ও প্রশ্ন। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেদনাই বাড়ে।
১৩৮ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে জীবনের সবচাইতে কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপারগুলো লেখক সাবলীলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মনুষ্য জীবন সব সময়ই জটিল। এই জটিল বিষয়গুলোকে ঔপন্যাসিক সরল রেখার মতো বা প্লাবনের জোয়ারের মতো উপন্যাসের শেষ হওয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। যা পাঠককে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁধে রাখে।
উপন্যাসের কাহিনির বিন্যাস মাহমুদ ও মিনারার দাম্পত্য জীবন দিয়ে যেভাবে শুরু হয়, মিনারার সন্তান ধারণ ক্ষমতা না থাকায় তা অন্য দিকে পরিবর্তিত হয়। এখানে লেখক চিরায়ত সেই রূপটিকেই তুলে ধরেছেন যে, দাম্পত্য জীবনে সন্তান জন্মদানের ব্যর্থতার প্রথম ভিকটিক হয় নারীরাই। আর নারীকেও তা মানতে বাধ্য করা হয়। এ উপন্যাসে লেখক এই চিরায়ত ধারণায় প্রবল আঘাত করেছেন।
আমাদের সমাজের মানুষের সংকীর্ণতা এ উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে মিনারার দিনযাপনের মধ্যেই একদিন চিকিৎসার মাধ্যমে মাহমুদ জানতে পারে, সমস্যাটা মিনারার মধ্যে নয়, সমস্যাটা মাহমুদের।
প্রেম, দাম্পত্য জটিলতা, অর্থ, প্রতারণা, কুসংস্কার, প্রচলিত ধারণায় বিশ^াস- এ জায়গাগুলো লেখকের গভীরে প্রবলভাবে রেখাপাত করেছে। এবং বর্তমান উপন্যাসে তিনি এসবের স্বরূপ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। গণমানুষের ভাবনায় লেখকহৃদয় ব্যাকুল হয়েছে। তিনি আহত হয়েছেন। আর সেই ক্ষত লেখক পিওনা আফরোজকে দিয়ে উপন্যাসটি লিখিয়ে নিয়েছে।
কাছের মানুষ দূরের মানুষ। পিওনা আফরোজ। প্রকাশক: চন্দ্রভুক। প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ। পৃষ্ঠা ১৩৮। মূল্য: ২৮৫ টাকা।