ইসি গঠনে আইনের খসড়া সংসদে : আপত্তি ভেতরে-বাইরে

অধিবেশনের ভেতরে-বাইরে রাজনীতিক এবং অংশীজনদের আপত্তির মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইনের খসড়া গতকাল জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলে সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠনের বিধান রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে করা সর্বশেষ দুটি কমিশন গঠনেরও বৈধতা দেয়া হয়েছে।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ শিরোনামে বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় অধিবেশনে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।

আইনটি উত্থাপনের বিরোধিতা করে সংসদে বিএনপির সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘যে বিল আইনমন্ত্রী এনেছেন, তা জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সুশীল সমাজের যে প্রত্যাশা, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন যাবত নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আজ আইনমন্ত্রী যে বিল উত্থাপন করেছেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয়েছে; ‘যাহা লাউ, তাহাই কদু।’

বিরোধী দলের এই সদস্য আরও বলেন, অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটির মাধ্যমে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনকে বৈধতা দেয়ার জন্য এই আইন আনা হয়েছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। এর আগে যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অনুরূপ বিল এখানে তোলা হয়েছে। তিনি বর্তমান কমিশনের সদস্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘এ আইন প্রশ্নবিদ্ধ। এ আইন দিয়ে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে না। সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আমি দাবি করব; আইনটি প্রত্যাহার করুন। আইনমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, এ রকম একটি আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ কথা বলার পর তিনি কী করে এ আইন আনেন?’

হারুনুর রশীদের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খসড়া আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যাখ্যা করার পাশপাশি রাজনীতির অতীত ইতিহাস তুলে ধরেন। এ সময় সামনের আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুল হককে বিভিন্ন বিষয় মনে করিয়ে দেন।

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে হবে। আমরা সেই আইন করেছি। ওনারা (বিএনপি নেতারা) বুঝে বলুন, না বুঝে বলুন, বলছেন এটা সার্চ কমিটির আইন। ওনারা বলছেন, আইনটা আমরা ঠিক করিনি। ওনাদের সঙ্গে আলোচনা করিনি।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে দু’বার সার্চ কমিটি করেছেন, সেটাও আইনসিদ্ধ ছিল। সেটাও আইনের আওতায় আনা হলো। ওনাদের (বিএনপি নেতাদের) কথা হচ্ছে, যা করেন করেন, তালগাছ আমার। তালগাছ ওনাদের না। তালগাছ জনগণের। ওনারা না বুঝে বলছেন। আইনটা যখন করে ফেললাম, পালের হাওয়া চলে গেছে। সেজন্য এখন কী বলবেন। এইটা নাই, ওইটা আছে। ওইটা নাই, এসব নাচগান শুরু করে দিয়েছেন।’

বিএনপির সমালোচনা করে আনিসুল হক বলেন, ‘ওনারা চান ওনাদের পকেটে যে নাম, সেই নাম দিয়ে ইসি গঠিত হবে। সেটা হবে না। এটা বাংলাদেশ। জনগণ ঠিক করবে। কোন দল অগ্রাধিকার পাবে না।’

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, নেপাল, ভুটান এবং বিভিন্ন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে প্রস্তাবিত আইন বেশি ভালো দাবি করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কোথাও এ রকম স্বচ্ছভাবে ইসি গঠন করার পদ্ধতি নেই। এই আইন হলে এবং এর মাধ্যমে ইসি গঠিত হলে বিএনপি চুরি করতে পারবে না, এজন্য তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপি নিজেরা নির্বাচনে জয়ী হতে এক কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল। নিজেদের পছন্দের মানুষকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিল। এগুলো কারও সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়নি। আলোচনার প্রয়োজনও মনে করেননি। কারচুপি করে ক্ষমতায় আসার জন্য এসব করেছিল বিএনপি।’

আইনমন্ত্রী সংসদে জানান, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ইসি গঠনে একটি আইনের খসড়া তাকে দিয়েছিল। দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি ওই সংস্থাটিকে তিনি তখন বলেছিলেন, অন্য কোন কারণ নেই, কোভিড সংক্রমণ পরিস্থতি বিবেচনায় এই সংসদে আইনটি পাস করা সম্ভব হবে না।

আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালেই বলেছিলেন, এই আইন করা প্রয়োজন। ওনারা বলেছিলেন, অরডিন্যান্স করে আইন করে দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, এই আইন সংসদে না এনে করা ঠিক হবে না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংসদে তার পরে করা উচিত।’

সার্চ কমিটি গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তখন একটা বিতর্ক হয়েছিল। তখন গেজেট হলো। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। পরের বার আবার একইভাবে হলো। এটা আইন ছিল না, কিন্তু এটা ছিল ফোর্স অব ল। কারণ, এটি রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে বড় কেউ না। তখন বিএনপির আপত্তি ছিল না।’

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় বিরোধী দলের আসন থেকে হারুনুর রশীদ কথা বলা শুরু করেন। তখন আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ওনারা (বিএনপি) না শুনলে শিখবেন কীভাবে। বুঝবেন না, শিখবেন কী?’

সার্চ কমিটির গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, কমিটির চারজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেও চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনিয়মের বিচারের দাবি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আগে আজিজ কমিশনের বিচার করতে হবে। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের বিচার করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় ওঠা যাবে না।’

পরে কণ্ঠভোটে বিএনপির সদস্য হারুনুরের আপত্তি নাকচ হলে বিলটি উত্থাপনের অনুমতি পান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার পর আলোচনা শেষে ভোটাভুটির মাধ্যমে বিলটি পাস করতে হবে।

রাজনীতিক ও অংশীজনদের মতামত

বিএনপিসহ অনেকগুলো দলের অভিযোগ, ইসি গঠনে প্রস্তাবিত আইনটি ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যাচ্ছে। জানতে চাইলে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুনুœ গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, ‘আইন সবাই চেয়েছিল। আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আমরা স্বাগত জানাই। তবে আমাদের আপত্তি ফরমেশন (গঠন প্রক্রিয়া) নিয়ে।’

পেশায় আইনজীবী সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে চিফ এক্সিকিউটিভের (প্রধানমন্ত্রীর) কর্তৃত্ব থেকেই যায়। যা একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের অন্তরায়।’ জাতীয় পার্টি সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব দেবে জানিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে পঞ্চম মেয়াদে নির্বাচিত এই আইন প্রণেতা বলেন, ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতিকে যাতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে না হয় এমন প্রস্তাব দেয়া হবে। যাতে একটি গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠন করা যায়।

প্রস্তাবিত আইনটি প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের। এ নিয়ে সংগ্রাম হয়েছে, সংগ্রাম চলছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই দেশে রাজনীতিবিদদের কোন দাম নেই। রাজনীতিবিদদের মতামত বাদ দিয়ে নিজেদের মতো একটি আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে; যা দেশ ও জাতির জন্য কণ্যাণকর হতে পারে না। ওয়ার্কার্স পার্টিও সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব দেবে জানিয়ে দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, ‘আমি মনে করি আইনটি অসম্পূর্ণ আছে। সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে করা হলে ভালো হতো। একটা মধ্যবর্তী স্তর রাখা প্রয়োজন ছিল। কোনটাই করা হয়নি। সার্চ কমিটি রেখেই আগানো হচ্ছে। এখনো সুযোগ আছে মন্তব্য করে ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য মেনন বলেন, বিল পাস হওয়ার আগে সংসদে আলোচনা হবে। আমরা কিছু সংশোধনী দেব। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই আইনটি প্রণয়নে তাড়াহুড়া করেছে উল্লেখ করে শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেন, তাড়াহুড়া করে ত্রুটিপূর্ণ আইন প্রণয়ন কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না। খসড়ায় অনেক অপূর্ণতা আছে। আইনটির অনেক সংশোধন করতে হবে। আইনটি সংসেদ উত্থপনের পর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এটিকে ‘সার্চ কমিটি’ গঠনের আইন বলে মন্তব্য করে সুজন। লিখিত বক্তব্যে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, খসড়া আইনটির সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনের পার্থক্য নেই বললেই চলে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা নির্দেশনাকে আইনি মোড়ক দেয়াই যেন এর উদ্দেশ্য।’ এটিএম শাসসুল হুদা কমিশনের সদস্য, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন তাদের (২০০৭-২০১২) আমলে ইসি নিয়োগের একটি খসড়া প্রস্তাবের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সুজনের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা কমিশনে থাকাকালীন যে খসড়াটি প্রস্তাব করেছিলাম সেখানে বলা ছিল, সুপারিশ করা নামগুলো প্রথমে সংসদের বিশেষ কমিটিতে যাবে, সেখানে আলোচনা হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। সংসদীয় কমিটিতে সব দলের সমানুপাতিক অংশগ্রহণ থাকে। তাহলে প্রধামন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কম থাকে।’

একাধিক নির্বাচনী বিশেষজ্ঞের মতে, খসড়া আইনটিতে নানা অপূর্ণতা রয়েছে যা সংশোধন করা জরুরি। তারা বলছেন, সার্চ কমিটি রেখেই যেহেতু আইন করা হচ্ছে, তাই সার্চ কমিটিতে সংসদের বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের যুক্ত করা উচিত। তারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন; সুশীল সমাজের এমন নাগরিক, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদেরও পরামর্শ গ্রহণ করা হলে একটি ভালো আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, ইসি গঠনে আইন মহান জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে আলোচনা এবং মতমত দেয়ার সুযোগ পাবে। সাংবিধানিক রীতিনীতি এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়েই বিলটি পাস হবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সুবিধামতো ধারা যুক্ত করে আইনটি পাস করতে আওয়ামী লীগের কোন অসুবিধা হবে না।

প্রস্তাবিত আইনে সার্চ কমিটির গঠন প্রক্রিয়া ও কার্যবলি

প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’জনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে।

নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যতা অযোগ্যতা

আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর হতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এসব যোগ্যতা থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।

আর এসব পদে নিয়োগে অযোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকা বা আনুগত্য প্রকাশ করা (তবে দ্বৈত নাগরিক হলে হওয়া যাবে), নৈতিক স্খলন হলে এবং ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত হলে বা প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে কোন ব্যক্তি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, এর আগে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি, তাদের কাজ এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

সংবিধানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হলেও তা হতে হবে আইনের বিধান অনুযায়ী। তবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও কোন সরকার এ সংক্রান্ত আইন করেনি। এই প্রেক্ষাপটে গত দুইবারের মতো এবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রপতি। বেশির ভাগ দল সংলাপে আইন প্রণয়নের পক্ষে মত দেয়। সার্চ কমিটির প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করে কয়েকটি দল।

গত ১৭ জানুয়ারি বিকেলে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিতে বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসি গঠন সংক্রান্ত আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়।

সোমবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২২ , ১০ মাঘ ১৪২৮ ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

ইসি গঠনে আইনের খসড়া সংসদে : আপত্তি ভেতরে-বাইরে

ফয়েজ আহমেদ তুষার

অধিবেশনের ভেতরে-বাইরে রাজনীতিক এবং অংশীজনদের আপত্তির মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইনের খসড়া গতকাল জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলে সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠনের বিধান রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে করা সর্বশেষ দুটি কমিশন গঠনেরও বৈধতা দেয়া হয়েছে।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ শিরোনামে বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় অধিবেশনে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।

আইনটি উত্থাপনের বিরোধিতা করে সংসদে বিএনপির সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘যে বিল আইনমন্ত্রী এনেছেন, তা জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সুশীল সমাজের যে প্রত্যাশা, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন যাবত নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আজ আইনমন্ত্রী যে বিল উত্থাপন করেছেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয়েছে; ‘যাহা লাউ, তাহাই কদু।’

বিরোধী দলের এই সদস্য আরও বলেন, অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটির মাধ্যমে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনকে বৈধতা দেয়ার জন্য এই আইন আনা হয়েছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। এর আগে যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অনুরূপ বিল এখানে তোলা হয়েছে। তিনি বর্তমান কমিশনের সদস্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘এ আইন প্রশ্নবিদ্ধ। এ আইন দিয়ে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে না। সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আমি দাবি করব; আইনটি প্রত্যাহার করুন। আইনমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, এ রকম একটি আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ কথা বলার পর তিনি কী করে এ আইন আনেন?’

হারুনুর রশীদের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খসড়া আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যাখ্যা করার পাশপাশি রাজনীতির অতীত ইতিহাস তুলে ধরেন। এ সময় সামনের আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুল হককে বিভিন্ন বিষয় মনে করিয়ে দেন।

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে হবে। আমরা সেই আইন করেছি। ওনারা (বিএনপি নেতারা) বুঝে বলুন, না বুঝে বলুন, বলছেন এটা সার্চ কমিটির আইন। ওনারা বলছেন, আইনটা আমরা ঠিক করিনি। ওনাদের সঙ্গে আলোচনা করিনি।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে দু’বার সার্চ কমিটি করেছেন, সেটাও আইনসিদ্ধ ছিল। সেটাও আইনের আওতায় আনা হলো। ওনাদের (বিএনপি নেতাদের) কথা হচ্ছে, যা করেন করেন, তালগাছ আমার। তালগাছ ওনাদের না। তালগাছ জনগণের। ওনারা না বুঝে বলছেন। আইনটা যখন করে ফেললাম, পালের হাওয়া চলে গেছে। সেজন্য এখন কী বলবেন। এইটা নাই, ওইটা আছে। ওইটা নাই, এসব নাচগান শুরু করে দিয়েছেন।’

বিএনপির সমালোচনা করে আনিসুল হক বলেন, ‘ওনারা চান ওনাদের পকেটে যে নাম, সেই নাম দিয়ে ইসি গঠিত হবে। সেটা হবে না। এটা বাংলাদেশ। জনগণ ঠিক করবে। কোন দল অগ্রাধিকার পাবে না।’

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, নেপাল, ভুটান এবং বিভিন্ন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে প্রস্তাবিত আইন বেশি ভালো দাবি করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কোথাও এ রকম স্বচ্ছভাবে ইসি গঠন করার পদ্ধতি নেই। এই আইন হলে এবং এর মাধ্যমে ইসি গঠিত হলে বিএনপি চুরি করতে পারবে না, এজন্য তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপি নিজেরা নির্বাচনে জয়ী হতে এক কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল। নিজেদের পছন্দের মানুষকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিল। এগুলো কারও সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়নি। আলোচনার প্রয়োজনও মনে করেননি। কারচুপি করে ক্ষমতায় আসার জন্য এসব করেছিল বিএনপি।’

আইনমন্ত্রী সংসদে জানান, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ইসি গঠনে একটি আইনের খসড়া তাকে দিয়েছিল। দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি ওই সংস্থাটিকে তিনি তখন বলেছিলেন, অন্য কোন কারণ নেই, কোভিড সংক্রমণ পরিস্থতি বিবেচনায় এই সংসদে আইনটি পাস করা সম্ভব হবে না।

আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালেই বলেছিলেন, এই আইন করা প্রয়োজন। ওনারা বলেছিলেন, অরডিন্যান্স করে আইন করে দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, এই আইন সংসদে না এনে করা ঠিক হবে না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংসদে তার পরে করা উচিত।’

সার্চ কমিটি গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তখন একটা বিতর্ক হয়েছিল। তখন গেজেট হলো। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। পরের বার আবার একইভাবে হলো। এটা আইন ছিল না, কিন্তু এটা ছিল ফোর্স অব ল। কারণ, এটি রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে বড় কেউ না। তখন বিএনপির আপত্তি ছিল না।’

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় বিরোধী দলের আসন থেকে হারুনুর রশীদ কথা বলা শুরু করেন। তখন আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ওনারা (বিএনপি) না শুনলে শিখবেন কীভাবে। বুঝবেন না, শিখবেন কী?’

সার্চ কমিটির গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, কমিটির চারজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেও চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনিয়মের বিচারের দাবি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আগে আজিজ কমিশনের বিচার করতে হবে। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের বিচার করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় ওঠা যাবে না।’

পরে কণ্ঠভোটে বিএনপির সদস্য হারুনুরের আপত্তি নাকচ হলে বিলটি উত্থাপনের অনুমতি পান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার পর আলোচনা শেষে ভোটাভুটির মাধ্যমে বিলটি পাস করতে হবে।

রাজনীতিক ও অংশীজনদের মতামত

বিএনপিসহ অনেকগুলো দলের অভিযোগ, ইসি গঠনে প্রস্তাবিত আইনটি ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যাচ্ছে। জানতে চাইলে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুনুœ গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, ‘আইন সবাই চেয়েছিল। আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আমরা স্বাগত জানাই। তবে আমাদের আপত্তি ফরমেশন (গঠন প্রক্রিয়া) নিয়ে।’

পেশায় আইনজীবী সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে চিফ এক্সিকিউটিভের (প্রধানমন্ত্রীর) কর্তৃত্ব থেকেই যায়। যা একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের অন্তরায়।’ জাতীয় পার্টি সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব দেবে জানিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে পঞ্চম মেয়াদে নির্বাচিত এই আইন প্রণেতা বলেন, ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতিকে যাতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে না হয় এমন প্রস্তাব দেয়া হবে। যাতে একটি গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠন করা যায়।

প্রস্তাবিত আইনটি প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের। এ নিয়ে সংগ্রাম হয়েছে, সংগ্রাম চলছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই দেশে রাজনীতিবিদদের কোন দাম নেই। রাজনীতিবিদদের মতামত বাদ দিয়ে নিজেদের মতো একটি আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে; যা দেশ ও জাতির জন্য কণ্যাণকর হতে পারে না। ওয়ার্কার্স পার্টিও সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব দেবে জানিয়ে দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন গতকাল রাতে সংবাদকে বলেন, ‘আমি মনে করি আইনটি অসম্পূর্ণ আছে। সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে করা হলে ভালো হতো। একটা মধ্যবর্তী স্তর রাখা প্রয়োজন ছিল। কোনটাই করা হয়নি। সার্চ কমিটি রেখেই আগানো হচ্ছে। এখনো সুযোগ আছে মন্তব্য করে ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য মেনন বলেন, বিল পাস হওয়ার আগে সংসদে আলোচনা হবে। আমরা কিছু সংশোধনী দেব। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই আইনটি প্রণয়নে তাড়াহুড়া করেছে উল্লেখ করে শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেন, তাড়াহুড়া করে ত্রুটিপূর্ণ আইন প্রণয়ন কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না। খসড়ায় অনেক অপূর্ণতা আছে। আইনটির অনেক সংশোধন করতে হবে। আইনটি সংসেদ উত্থপনের পর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এটিকে ‘সার্চ কমিটি’ গঠনের আইন বলে মন্তব্য করে সুজন। লিখিত বক্তব্যে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, খসড়া আইনটির সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনের পার্থক্য নেই বললেই চলে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা নির্দেশনাকে আইনি মোড়ক দেয়াই যেন এর উদ্দেশ্য।’ এটিএম শাসসুল হুদা কমিশনের সদস্য, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন তাদের (২০০৭-২০১২) আমলে ইসি নিয়োগের একটি খসড়া প্রস্তাবের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সুজনের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা কমিশনে থাকাকালীন যে খসড়াটি প্রস্তাব করেছিলাম সেখানে বলা ছিল, সুপারিশ করা নামগুলো প্রথমে সংসদের বিশেষ কমিটিতে যাবে, সেখানে আলোচনা হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। সংসদীয় কমিটিতে সব দলের সমানুপাতিক অংশগ্রহণ থাকে। তাহলে প্রধামন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কম থাকে।’

একাধিক নির্বাচনী বিশেষজ্ঞের মতে, খসড়া আইনটিতে নানা অপূর্ণতা রয়েছে যা সংশোধন করা জরুরি। তারা বলছেন, সার্চ কমিটি রেখেই যেহেতু আইন করা হচ্ছে, তাই সার্চ কমিটিতে সংসদের বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের যুক্ত করা উচিত। তারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন; সুশীল সমাজের এমন নাগরিক, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদেরও পরামর্শ গ্রহণ করা হলে একটি ভালো আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, ইসি গঠনে আইন মহান জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে আলোচনা এবং মতমত দেয়ার সুযোগ পাবে। সাংবিধানিক রীতিনীতি এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়েই বিলটি পাস হবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সুবিধামতো ধারা যুক্ত করে আইনটি পাস করতে আওয়ামী লীগের কোন অসুবিধা হবে না।

প্রস্তাবিত আইনে সার্চ কমিটির গঠন প্রক্রিয়া ও কার্যবলি

প্রস্তাবিত বিলে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’জনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে।

নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যতা অযোগ্যতা

আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর হতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এসব যোগ্যতা থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।

আর এসব পদে নিয়োগে অযোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকা বা আনুগত্য প্রকাশ করা (তবে দ্বৈত নাগরিক হলে হওয়া যাবে), নৈতিক স্খলন হলে এবং ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছরের কারাদ-ে দ-িত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত হলে বা প্রজাতন্ত্রের কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে কোন ব্যক্তি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, এর আগে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি, তাদের কাজ এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

সংবিধানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হলেও তা হতে হবে আইনের বিধান অনুযায়ী। তবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও কোন সরকার এ সংক্রান্ত আইন করেনি। এই প্রেক্ষাপটে গত দুইবারের মতো এবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রপতি। বেশির ভাগ দল সংলাপে আইন প্রণয়নের পক্ষে মত দেয়। সার্চ কমিটির প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করে কয়েকটি দল।

গত ১৭ জানুয়ারি বিকেলে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিতে বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসি গঠন সংক্রান্ত আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়।