অনন্ত মাহফুজ
ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের, অল্প যে কয়েকটি বিনোদনের মাধ্যম ছিল তা সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। শহরকেন্দ্রিক বাঙালির সিনেমা হলে যাবার সামান্য গতি ছিল। গ্রাম থেকে শহরে এসে সিনেমা দেখা কালেভদ্রে হয়ে উঠত। কোনো কোনো পরিবারে এ জাতীয় ঘটনা ছিল অনেকটা উৎসবের মতো। অল্প কিছু সামর্থ্যবানদের বাড়িতে ছিল সাদাকালো টিভি। ফলত, বইপড়া ছিল একটি বড় বিনোদন-মাধ্যম। শরৎ, মানিক, তারাশঙ্কর এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ঘুরত। এ-রকম সময়ে কাজী আনোয়ার হোসন মাসুদ রানা নিয়ে ঢুকে পড়লেন মধ্যবিত্ত বাঙালির শোবার ঘরে। বাংলা সাহিত্যে ইতোপূর্বে সৃষ্ট গোয়েন্দাদের থেকে আলাদা ধরনের মাসুদ রানা তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করল। বলা যায়, এ-কারণে মধ্য ষাটের দশকে বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল।
এই যে মাসুদ রানা নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন হাজির হলেন পাঠকের সামনে, এটা তার ভিতরে হয়তো বহুদিন লালিত ছিল। দশ হাজার টাকায় প্রেস দিয়ে তিনি হয়তো দিব্যি ব্যবসাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, তার সৃষ্টির তাগিদ তাতে পূর্ণ হতো না। জানা যায়, বন্ধু মাহবুব আমীন ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা জেমস বন্ড সিরিজের ডক্টর নো বইটি তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি কুয়াশা সিরিজের জন্য নিয়মিত লিখছেন। নিজের প্রকাশনী থেকে কুয়াশার কয়েকটি বই ইতোমধ্যে বের হয়েছে। কাজী আনোয়ার ডক্টর নো পড়ে অভিভূত হলেন। মাসুদ রানাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে জেমস বন্ডের আদলে লিখলেন থ্রিলার গোয়েন্দা কাহিনি ধ্বংস-পাহাড় যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালের মে মাসে। আলোড়ন তোলা ধ্বংস-পাহাড়ের গল্পটা কেমন? প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী কাপ্তাই শহরের কাছে অতিশব্দ আর অ্যান্টিগ্রেভিটি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে বিশাল লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের শত্রু ভারতের সরবরাহ করা শক্তিশালী ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেবেন বাঁধটা। আর সেটা ঠেকানোর দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানার ওপর।
ধ্বংস-পাহাড় বের হবার পর বিভিন্ন কারণে বেশ সমালোচনা হলো। সমালোচনা যেমন হলো, তেমন বিক্রিও হতে লাগল। ধ্বংস-পাহাড় প্রকাশের পর দশ মাসের মাথায় প্রকাশিত হলো ভারতনাট্যম। মাসুদ রানা সিরিজের দ্বিতীয় বইটিও পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দিল প্রবলভাবে। মাসুদ রানা চরিত্র বাঙালিকে নাড়া দিল। একতদিন বাঙালির পাঠাভ্যাস অনেকটাই একটা নির্দিষ্ট রুচি ও ঘরানার মধ্যে আটকে ছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন তা ভাঙা শুরু করলেন। মাসুদ রানা পাঠকের বয়স-বিভাজনও ভেঙে দিতে শুরু করল। অনেকের মতে, আজও বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বি থ্রিলার নায়ক মাসুদ রানা। এখন পর্যন্ত এই সিরিজের ৪৫৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
মাসুদ রানা দিয়ে তোলপাড় করে ফেলা কাজী আনোয়ার হোসেন কুয়াশা সিরিজ লেখা শুরু করেন নিজের প্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। আমরা দেখি যে, ১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবা কিংবদন্তি পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেনের দেওয়া দশ হাজার টাকা আর মাত্র দুই জন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন গড়ে তোলেন সেগুনবাগান প্রকাশনী যার পরবর্তী নাম হয় সেবা প্রকাশনী। কুয়াশা সিরিজের প্রথম বইটি লেখা হয়েছিল জুন, ১৯৬৪ সালে। প্রথম বই কুয়াশা থেকে ৭৬তম বই গুপ্তধন পর্যন্ত লিখেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সিরিজের মোট ৭৮টি বইয়ের শেষ দুইটি শেখ আবদুল হাকিমের লেখা। কুয়াশা, আসল নাম ড. মনসুর আলি। বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকদের একজন। মেধাবী, শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের জন্য তার টাকার প্রয়োজন হয়। টাকা যোগাড়ের জন্য তাকে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হয়। অনৈতিক ও অসৎ পথে অর্থ যোগাড় করায় সে আইনের দৃষ্টিতে একজন দোষী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা গোয়েন্দা শহীদ খানের সাথে তার বিরোধ। কিন্তু তারা কেউ কারও শত্রু নয়। শহীদ খানের স্ত্রী মহুয়া কুয়াশার ছোটো বোন।
পেপারব্যাক, গোয়েন্দা, মিস্ট্রি, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইত্যাদি শব্দ আর আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন পথ চলতে শুরু করলেন। জনপ্রিয়তার বিচারে মাসুদ রানা সিরিজের তুলনা নেই বলা চলে। মাসুদ রানা গুপ্তচর কাহিনি সিরিজ। সিরিজের অধিকাংশ কাজী আনোয়ার হোসেনের রচনা। এই সিরিজের কিছু বই মৌলিক। তবে এর অধিকাংশই বিদেশি বিভিন্ন বইয়ের কাহিনির ছায়া অবলম্বনে। সরাসরি অনুবাদ নয়। তিন গোয়েন্দা সিরিজও সেবা থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ। ১৯৮৫ খিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে রকিব হাসানের রচনায় প্রকাশিত হলেও ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাজী আনোয়ার হোসেন এটি শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে লিখেছেন। এটিও বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে রচিত কিশোর সিরিজ। প্রথম বই ‘তিন গোয়েন্দা’। এই বইটি কিশোর থ্রিলার হিসেবে প্রকাশিত হয়। সেবার একটি বিরাট মাইলফলক এই সিরিজ। প্রথম দিকে বিখ্যাত ইংরেজি গোয়েন্দা সিরিজ ‘দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ অবলম্বনে রচিত হলেও পরে অন্যান্য বই থেকেও কাহিনি ধার নেওয়া হয়। এছাড়া, সেবা থেকে প্রকাশিত হয় ইসমাইল আরমান রচিত অয়ন-জিমি সিরিজ, টিপু কিবরিয়া রচিত কিশোর হরর সিরিজ, সেবা ওয়েস্টার্ন সিরিজসহ আরও কয়েকটি সিরিজ।
এ কথা স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে একসময় গোয়েন্দা, কিংবা রহস্য উপন্যাস ছিল হাতেগোনা। বই প্রকাশে নানাবিধ সংকট, বিপণন ব্যবস্থায় নানবিধ সমস্যাসহ অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বইপড়া-কেন্দ্রিক বিনোদনের সেই জায়গাটিই দখল করে নিয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের বাংলার প্রথম স্পাই থ্রিলারধর্মী সুপারহিরো চরিত্র মাসুদ রানা। এটাও ঠিক, গুপ্তচর বা গোয়েন্দা মাসুদ রানা শ্রীকান্ত কিংবা ইন্দ্রনাথের মতো অনেক চরিত্রকে হটিয়ে বাংলার কৈশোরের ও যৌবনের স্বাপ্নিক চরিত্র হয়ে উঠেছিল। জানা যায়, জনপ্রিয় চরিত্র মাসুদ রানার নামকরণ করা হয়েছিল দুইজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেছিলেন। তাদের দুইজনেরই বন্ধু ছিলেন গীতিকার মাসুদ করিম। মাসুদ করিমের নাম থেকে ‘মাসুদ’ আর মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে ‘রানা’ নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন তার চরিত্রের নামকরণ করেছিলেন মাসুদ রানা। ভারত বিরোধিতা মাসুদ রানার কাহিনিগুলোর অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল। হয়তো এ কারণে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তরা মাসুদ রানাকে অধিকতর আপন করে নিয়েছিল। তুমুল ভারত বিরোধিতাসহ নানা কারণে বেশ কয়েকবার মাসুদ রানার প্রকাশনায় বিঘœ ঘটেছিল।
কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রকৃত নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। তার ডাকনাম ছিল নবাব। বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে এই সিরিজের বেশকিছু বই লিখেছেন। অন্য নামে মাসুদ রানা প্রকাশিত হলেও মাসুদ রানার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, “এর মূল কারণ, আমার অভিজ্ঞতার অভাব। মাসুদ রানা বইয়ে যেসব দেশের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, ঘটনার কথা, জটিল পরিস্থিতির কথা থাকে, সেসব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিদেশি কাহিনির সাহায্য আমাকে নিতেই হয়েছে। কিন্তু বিদেশি সবকিছু আমাদের এখানে মানায়ও না।”
সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত এবং সিরিজ লেখকদের কয়েকজনের মতামত প্রণিধানযোগ্য। সেবার জনপ্রিয় লেখক রওশন জামিল বলেন, “শুধু মাসুদ রানা সিরিজই নয়, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্লাসিকে একটা ‘স্মার্ট প্রজন্ম’ গড়ে দিয়েছে, আজও দিচ্ছে। বিনোদনের ভার্সেটাইল আবেদন ছাপিয়ে আজও সেবা তারুণ্যের প্রতীক। শুধু ওয়েস্টার্ন না, মাসুদ রানাই হোক, তিন গোয়েন্দা হোক, কিশোর ক্লাসিক হোক- পুরো বিষয়টাই ছিল পাঠকমুখী? বাঙালি পাঠক কী পছন্দ করবে? যেহেতু আমরা নিজেরাও পাঠক ছিলাম। ঐ বয়সটা পার হয়ে এসেছি। আমরা কী পছন্দ করতাম? ওরা কী পছন্দ করে? আলোচনা বিভাগ থেকেও পাওয়া যেত নানা চাহিদা। সেটাই ছিল আমাদের মূল রেসিপি। আমরা চেয়েছি এমন কিছু নিয়ে আসতে যে, পাঠক মজা পাবে, সে নিজেকে ওখানে দেখবে। এবং আমরা নায়ককে অতিমানব বানানোর চেষ্টা করিনি, কারণ, অতিমানব হলে পাঠক রিলেট করতে পারবে না”। রওশন জামিল ও শওকত হোসেনের ভাষ্যমতে, তারা জানতেন তাদের পাঠক কারা। তারা মনে করেন, বাঙালি পাঠকের ভেতরে যে লুকোচুরি খেলা করে তা-ও ভেঙে দিতে চেয়েছে সেবা। এজন্য প্রচ্ছদ কিংবা লেখায় একটা অগ্রসর ভাবনাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে। বই নির্বাচনেও পাঠকের পছন্দ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
তাদের বক্তব্যে ‘স্মার্ট প্রজন্ম’ ও ‘বিনোদনের ভার্সেটাইল আবেদন’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কী কী গুণ থাকলে একটি প্রজন্ম স্মার্ট হয় তা নির্ধারণ করার কোনো মাপকাঠি নেই। বইপড়া কেবল একটি বিনোদন হতে পারে কি না, সে প্রশ্ন উত্থাপনের তাগিদ থেকেই এ লেখার শুরুটা হয়েছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির বিনোদনের কথা দিয়ে। বিনোদনের সঙ্গে শিল্পের যোগসূত্র থাকতে পারে। জনপ্রিয়তার নিরিখে শিল্প-বিচার কোনো যৌক্তিক বিবেচনা নয়। জনপ্রিয় হলে তা শিল্পমানসম্পন্ন হবে না, এমন কোনো সীমানা টানাও সমীচীন নয়। অবিক্রিত বইয়ের তালিকার শীর্ষে থাকা বইও ক্লাসিকসের তকমা পেয়েছে। আবার এ-ও দেখা যায় যে, সারা বিশে^ এমন অনেক উপন্যাস ও নাটক আছে যা জনপ্রিয় হয়েছে এবং ধ্রুপদ সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কির মা, মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউট বা পাওলো কোয়েলহোর দ্য আলকেমিস্ট কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এ তালিকাটা নেহাত কম দীর্ঘ নয়। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট কিংবা রোমিও ও জুলিয়েট, ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি-এর মতো হাজারো উপন্যাস, নাটক বা গল্পগ্রন্থ আছে যা একইসাথে জনপ্রিয় ও ধ্রুপদী সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যেও এ-রকম শত বইয়ের উদাহরণ টানা যায় যা জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের আনোয়ারা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, তারাশঙ্করের কবি, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখিসহ হাজারো উপন্যাস, নাটক ও গল্পগ্রন্থ আছে যা জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মাসুদ রানা বা কুয়াশা সিরিজসহ সেবার অন্যান্য সিরিজের বইগুলো বিনোদনহীন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রায় সকল বই বিদেশি কোনো বইয়ের ছায়া অবলম্বনে রচিত। তবে এই ধারার সাহিত্যের শিল্পগুণ মূল্যায়ন একটু জটিলই বটে।
জনপ্রিয় সাহিত্য দিয়ে পাঠক সৃষ্টি বা পাঠাভ্যাস সৃষ্টির সন্তুষ্টি লাভের কোনো জায়গা আছে কি না তা-ও বিবেচনায় রাখা জরুরি। যে পাঠ থেকে পাঠকের মূলত কোনো প্রাপ্তি নেই, পাঠককে সে পাঠে নিমগ্ন করে রাখা প্রকারান্তরে একধরনের ক্ষতিই- অনেকে এ-রকম মত পোষণ করেন। এত এত পাঠক তৈরি করা হলো, বাঙালিকে বই পড়া শেখানো হলো, অথচ আমাদের প্রকাশনা শিল্প কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না। আন্তর্জাতিক মানের সাথে তুলনা করলে আমাদের বই পড়ে থাকে অনেক পিছনে। শুধু পাঠক সৃষ্টির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা দরকার।
সাহিত্যের শিল্পমানে জনপ্রিয়তা সাধারণত কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। কন্টেন্টের পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থার নানা কৌশল প্রয়োগসহ নানা কৌশলে একটি গ্রন্থ জনপ্রিয় করে তোলা যায়। শুধু জনপ্রিয় সাহিত্য তৈরি করে পাঠক সৃষ্টির আনন্দে আত্মহারা হবার মধ্যে বিরাট ক্ষতি লুকিয়ে থাকতে পারে। কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের সব মানুষ সিরিয়াস পাঠক হয়ে যাবে, শিল্পবোদ্ধা হয়ে গড়ে উঠবে এমন প্রত্যাশাও যৌক্তিক নয়। বিদগ্ধ পাঠক সৃষ্টিতে শিল্পমানসম্পন্ন বই প্রয়োজন। আর এই পন্থায় তৈরি হওয়া পাঠাভ্যাস পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে পাঠক তৈরি করে যেতে থাকে। এইসব বিষয় প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনদের ভাবনায় রাখা প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২ , ১৩ মাঘ ১৪২৮, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩
অনন্ত মাহফুজ
ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের, অল্প যে কয়েকটি বিনোদনের মাধ্যম ছিল তা সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। শহরকেন্দ্রিক বাঙালির সিনেমা হলে যাবার সামান্য গতি ছিল। গ্রাম থেকে শহরে এসে সিনেমা দেখা কালেভদ্রে হয়ে উঠত। কোনো কোনো পরিবারে এ জাতীয় ঘটনা ছিল অনেকটা উৎসবের মতো। অল্প কিছু সামর্থ্যবানদের বাড়িতে ছিল সাদাকালো টিভি। ফলত, বইপড়া ছিল একটি বড় বিনোদন-মাধ্যম। শরৎ, মানিক, তারাশঙ্কর এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে ঘুরত। এ-রকম সময়ে কাজী আনোয়ার হোসন মাসুদ রানা নিয়ে ঢুকে পড়লেন মধ্যবিত্ত বাঙালির শোবার ঘরে। বাংলা সাহিত্যে ইতোপূর্বে সৃষ্ট গোয়েন্দাদের থেকে আলাদা ধরনের মাসুদ রানা তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করল। বলা যায়, এ-কারণে মধ্য ষাটের দশকে বিনোদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল।
এই যে মাসুদ রানা নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন হাজির হলেন পাঠকের সামনে, এটা তার ভিতরে হয়তো বহুদিন লালিত ছিল। দশ হাজার টাকায় প্রেস দিয়ে তিনি হয়তো দিব্যি ব্যবসাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, তার সৃষ্টির তাগিদ তাতে পূর্ণ হতো না। জানা যায়, বন্ধু মাহবুব আমীন ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো সময়ে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা জেমস বন্ড সিরিজের ডক্টর নো বইটি তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি কুয়াশা সিরিজের জন্য নিয়মিত লিখছেন। নিজের প্রকাশনী থেকে কুয়াশার কয়েকটি বই ইতোমধ্যে বের হয়েছে। কাজী আনোয়ার ডক্টর নো পড়ে অভিভূত হলেন। মাসুদ রানাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে জেমস বন্ডের আদলে লিখলেন থ্রিলার গোয়েন্দা কাহিনি ধ্বংস-পাহাড় যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালের মে মাসে। আলোড়ন তোলা ধ্বংস-পাহাড়ের গল্পটা কেমন? প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কবির চৌধুরী কাপ্তাই শহরের কাছে অতিশব্দ আর অ্যান্টিগ্রেভিটি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির ফলে বিশাল লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের শত্রু ভারতের সরবরাহ করা শক্তিশালী ডিনামাইট ফাটিয়ে উড়িয়ে দেবেন বাঁধটা। আর সেটা ঠেকানোর দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানার ওপর।
ধ্বংস-পাহাড় বের হবার পর বিভিন্ন কারণে বেশ সমালোচনা হলো। সমালোচনা যেমন হলো, তেমন বিক্রিও হতে লাগল। ধ্বংস-পাহাড় প্রকাশের পর দশ মাসের মাথায় প্রকাশিত হলো ভারতনাট্যম। মাসুদ রানা সিরিজের দ্বিতীয় বইটিও পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দিল প্রবলভাবে। মাসুদ রানা চরিত্র বাঙালিকে নাড়া দিল। একতদিন বাঙালির পাঠাভ্যাস অনেকটাই একটা নির্দিষ্ট রুচি ও ঘরানার মধ্যে আটকে ছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন তা ভাঙা শুরু করলেন। মাসুদ রানা পাঠকের বয়স-বিভাজনও ভেঙে দিতে শুরু করল। অনেকের মতে, আজও বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বি থ্রিলার নায়ক মাসুদ রানা। এখন পর্যন্ত এই সিরিজের ৪৫৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
মাসুদ রানা দিয়ে তোলপাড় করে ফেলা কাজী আনোয়ার হোসেন কুয়াশা সিরিজ লেখা শুরু করেন নিজের প্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। আমরা দেখি যে, ১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবা কিংবদন্তি পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেনের দেওয়া দশ হাজার টাকা আর মাত্র দুই জন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন গড়ে তোলেন সেগুনবাগান প্রকাশনী যার পরবর্তী নাম হয় সেবা প্রকাশনী। কুয়াশা সিরিজের প্রথম বইটি লেখা হয়েছিল জুন, ১৯৬৪ সালে। প্রথম বই কুয়াশা থেকে ৭৬তম বই গুপ্তধন পর্যন্ত লিখেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সিরিজের মোট ৭৮টি বইয়ের শেষ দুইটি শেখ আবদুল হাকিমের লেখা। কুয়াশা, আসল নাম ড. মনসুর আলি। বাংলাদেশের তথা পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকদের একজন। মেধাবী, শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টের জন্য তার টাকার প্রয়োজন হয়। টাকা যোগাড়ের জন্য তাকে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে হয়। অনৈতিক ও অসৎ পথে অর্থ যোগাড় করায় সে আইনের দৃষ্টিতে একজন দোষী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা গোয়েন্দা শহীদ খানের সাথে তার বিরোধ। কিন্তু তারা কেউ কারও শত্রু নয়। শহীদ খানের স্ত্রী মহুয়া কুয়াশার ছোটো বোন।
পেপারব্যাক, গোয়েন্দা, মিস্ট্রি, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইত্যাদি শব্দ আর আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন পথ চলতে শুরু করলেন। জনপ্রিয়তার বিচারে মাসুদ রানা সিরিজের তুলনা নেই বলা চলে। মাসুদ রানা গুপ্তচর কাহিনি সিরিজ। সিরিজের অধিকাংশ কাজী আনোয়ার হোসেনের রচনা। এই সিরিজের কিছু বই মৌলিক। তবে এর অধিকাংশই বিদেশি বিভিন্ন বইয়ের কাহিনির ছায়া অবলম্বনে। সরাসরি অনুবাদ নয়। তিন গোয়েন্দা সিরিজও সেবা থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিজ। ১৯৮৫ খিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে রকিব হাসানের রচনায় প্রকাশিত হলেও ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাজী আনোয়ার হোসেন এটি শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে লিখেছেন। এটিও বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে রচিত কিশোর সিরিজ। প্রথম বই ‘তিন গোয়েন্দা’। এই বইটি কিশোর থ্রিলার হিসেবে প্রকাশিত হয়। সেবার একটি বিরাট মাইলফলক এই সিরিজ। প্রথম দিকে বিখ্যাত ইংরেজি গোয়েন্দা সিরিজ ‘দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ অবলম্বনে রচিত হলেও পরে অন্যান্য বই থেকেও কাহিনি ধার নেওয়া হয়। এছাড়া, সেবা থেকে প্রকাশিত হয় ইসমাইল আরমান রচিত অয়ন-জিমি সিরিজ, টিপু কিবরিয়া রচিত কিশোর হরর সিরিজ, সেবা ওয়েস্টার্ন সিরিজসহ আরও কয়েকটি সিরিজ।
এ কথা স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে একসময় গোয়েন্দা, কিংবা রহস্য উপন্যাস ছিল হাতেগোনা। বই প্রকাশে নানাবিধ সংকট, বিপণন ব্যবস্থায় নানবিধ সমস্যাসহ অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বইপড়া-কেন্দ্রিক বিনোদনের সেই জায়গাটিই দখল করে নিয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের বাংলার প্রথম স্পাই থ্রিলারধর্মী সুপারহিরো চরিত্র মাসুদ রানা। এটাও ঠিক, গুপ্তচর বা গোয়েন্দা মাসুদ রানা শ্রীকান্ত কিংবা ইন্দ্রনাথের মতো অনেক চরিত্রকে হটিয়ে বাংলার কৈশোরের ও যৌবনের স্বাপ্নিক চরিত্র হয়ে উঠেছিল। জানা যায়, জনপ্রিয় চরিত্র মাসুদ রানার নামকরণ করা হয়েছিল দুইজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেছিলেন। তাদের দুইজনেরই বন্ধু ছিলেন গীতিকার মাসুদ করিম। মাসুদ করিমের নাম থেকে ‘মাসুদ’ আর মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে ‘রানা’ নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন তার চরিত্রের নামকরণ করেছিলেন মাসুদ রানা। ভারত বিরোধিতা মাসুদ রানার কাহিনিগুলোর অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল। হয়তো এ কারণে বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তরা মাসুদ রানাকে অধিকতর আপন করে নিয়েছিল। তুমুল ভারত বিরোধিতাসহ নানা কারণে বেশ কয়েকবার মাসুদ রানার প্রকাশনায় বিঘœ ঘটেছিল।
কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রকৃত নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। তার ডাকনাম ছিল নবাব। বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে এই সিরিজের বেশকিছু বই লিখেছেন। অন্য নামে মাসুদ রানা প্রকাশিত হলেও মাসুদ রানার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, “এর মূল কারণ, আমার অভিজ্ঞতার অভাব। মাসুদ রানা বইয়ে যেসব দেশের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, ঘটনার কথা, জটিল পরিস্থিতির কথা থাকে, সেসব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিদেশি কাহিনির সাহায্য আমাকে নিতেই হয়েছে। কিন্তু বিদেশি সবকিছু আমাদের এখানে মানায়ও না।”
সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত এবং সিরিজ লেখকদের কয়েকজনের মতামত প্রণিধানযোগ্য। সেবার জনপ্রিয় লেখক রওশন জামিল বলেন, “শুধু মাসুদ রানা সিরিজই নয়, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্লাসিকে একটা ‘স্মার্ট প্রজন্ম’ গড়ে দিয়েছে, আজও দিচ্ছে। বিনোদনের ভার্সেটাইল আবেদন ছাপিয়ে আজও সেবা তারুণ্যের প্রতীক। শুধু ওয়েস্টার্ন না, মাসুদ রানাই হোক, তিন গোয়েন্দা হোক, কিশোর ক্লাসিক হোক- পুরো বিষয়টাই ছিল পাঠকমুখী? বাঙালি পাঠক কী পছন্দ করবে? যেহেতু আমরা নিজেরাও পাঠক ছিলাম। ঐ বয়সটা পার হয়ে এসেছি। আমরা কী পছন্দ করতাম? ওরা কী পছন্দ করে? আলোচনা বিভাগ থেকেও পাওয়া যেত নানা চাহিদা। সেটাই ছিল আমাদের মূল রেসিপি। আমরা চেয়েছি এমন কিছু নিয়ে আসতে যে, পাঠক মজা পাবে, সে নিজেকে ওখানে দেখবে। এবং আমরা নায়ককে অতিমানব বানানোর চেষ্টা করিনি, কারণ, অতিমানব হলে পাঠক রিলেট করতে পারবে না”। রওশন জামিল ও শওকত হোসেনের ভাষ্যমতে, তারা জানতেন তাদের পাঠক কারা। তারা মনে করেন, বাঙালি পাঠকের ভেতরে যে লুকোচুরি খেলা করে তা-ও ভেঙে দিতে চেয়েছে সেবা। এজন্য প্রচ্ছদ কিংবা লেখায় একটা অগ্রসর ভাবনাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে। বই নির্বাচনেও পাঠকের পছন্দ বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
তাদের বক্তব্যে ‘স্মার্ট প্রজন্ম’ ও ‘বিনোদনের ভার্সেটাইল আবেদন’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কী কী গুণ থাকলে একটি প্রজন্ম স্মার্ট হয় তা নির্ধারণ করার কোনো মাপকাঠি নেই। বইপড়া কেবল একটি বিনোদন হতে পারে কি না, সে প্রশ্ন উত্থাপনের তাগিদ থেকেই এ লেখার শুরুটা হয়েছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির বিনোদনের কথা দিয়ে। বিনোদনের সঙ্গে শিল্পের যোগসূত্র থাকতে পারে। জনপ্রিয়তার নিরিখে শিল্প-বিচার কোনো যৌক্তিক বিবেচনা নয়। জনপ্রিয় হলে তা শিল্পমানসম্পন্ন হবে না, এমন কোনো সীমানা টানাও সমীচীন নয়। অবিক্রিত বইয়ের তালিকার শীর্ষে থাকা বইও ক্লাসিকসের তকমা পেয়েছে। আবার এ-ও দেখা যায় যে, সারা বিশে^ এমন অনেক উপন্যাস ও নাটক আছে যা জনপ্রিয় হয়েছে এবং ধ্রুপদ সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কির মা, মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউট বা পাওলো কোয়েলহোর দ্য আলকেমিস্ট কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এ তালিকাটা নেহাত কম দীর্ঘ নয়। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট কিংবা রোমিও ও জুলিয়েট, ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি-এর মতো হাজারো উপন্যাস, নাটক বা গল্পগ্রন্থ আছে যা একইসাথে জনপ্রিয় ও ধ্রুপদী সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যেও এ-রকম শত বইয়ের উদাহরণ টানা যায় যা জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের আনোয়ারা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, তারাশঙ্করের কবি, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখিসহ হাজারো উপন্যাস, নাটক ও গল্পগ্রন্থ আছে যা জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মাসুদ রানা বা কুয়াশা সিরিজসহ সেবার অন্যান্য সিরিজের বইগুলো বিনোদনহীন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। প্রায় সকল বই বিদেশি কোনো বইয়ের ছায়া অবলম্বনে রচিত। তবে এই ধারার সাহিত্যের শিল্পগুণ মূল্যায়ন একটু জটিলই বটে।
জনপ্রিয় সাহিত্য দিয়ে পাঠক সৃষ্টি বা পাঠাভ্যাস সৃষ্টির সন্তুষ্টি লাভের কোনো জায়গা আছে কি না তা-ও বিবেচনায় রাখা জরুরি। যে পাঠ থেকে পাঠকের মূলত কোনো প্রাপ্তি নেই, পাঠককে সে পাঠে নিমগ্ন করে রাখা প্রকারান্তরে একধরনের ক্ষতিই- অনেকে এ-রকম মত পোষণ করেন। এত এত পাঠক তৈরি করা হলো, বাঙালিকে বই পড়া শেখানো হলো, অথচ আমাদের প্রকাশনা শিল্প কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না। আন্তর্জাতিক মানের সাথে তুলনা করলে আমাদের বই পড়ে থাকে অনেক পিছনে। শুধু পাঠক সৃষ্টির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা দরকার।
সাহিত্যের শিল্পমানে জনপ্রিয়তা সাধারণত কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। কন্টেন্টের পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থার নানা কৌশল প্রয়োগসহ নানা কৌশলে একটি গ্রন্থ জনপ্রিয় করে তোলা যায়। শুধু জনপ্রিয় সাহিত্য তৈরি করে পাঠক সৃষ্টির আনন্দে আত্মহারা হবার মধ্যে বিরাট ক্ষতি লুকিয়ে থাকতে পারে। কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের সব মানুষ সিরিয়াস পাঠক হয়ে যাবে, শিল্পবোদ্ধা হয়ে গড়ে উঠবে এমন প্রত্যাশাও যৌক্তিক নয়। বিদগ্ধ পাঠক সৃষ্টিতে শিল্পমানসম্পন্ন বই প্রয়োজন। আর এই পন্থায় তৈরি হওয়া পাঠাভ্যাস পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে পাঠক তৈরি করে যেতে থাকে। এইসব বিষয় প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনদের ভাবনায় রাখা প্রয়োজন।