ধারাবাহিক উপন্যাস : একত্রিশ

শিকিবু

আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ছাপ্পান্ন

ইঝোমিকে নিয়ে এসে নতুন একটি বাড়িতে তোলা হলো। তার ঘরটি সুন্দরভাবে সজ্জিত। সঙ্গে একজন পরিচারিকাকে নিয়ে আসেন ইঝোমি। এখানে তাদেরকে কেউ স্বাগত জানায়নি। ভালোবাসার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়।

এখানে কাজের লোক, সেবক সবাই আসবে। বললেন অতসুমিচি। ইঝোমির এসবের এখন প্রয়োজন নেই। প্রিন্স যে তাকে বুঝতে পেরেছেন এবং এভাবে গোপনে তার সঙ্গে আসতে পেরেছেন, তাতেই খুশি।

সকাল বেলায় প্রিন্স বের হয়ে গেলেন। শাটারগুলো তখনও বন্ধ। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর হলেও নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য যথেষ্ট। সকালে যাবার আগে প্রিন্স বলেছিলেন, তুমি উত্তর-ভবনে থাকবে। বাইরে থেকে এ কক্ষের কথা শুনতে পাওয়া যায়। কেউ কথা শুনে আবিষ্কার করে ফেলতে পারে। তা হবে ক্ষতিকর।

তিন দিন পর উত্তর ভবনে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রিন্সের গৃহকর্মী রয়েছে। কোনো দর্শনার্থী নেই; কিন্তু লোকেরা কীভাবে যেন জেনে গেল। এরা দৌড়ে গিয়ে অতসুমিচির স্ত্রী প্রন্সেসকে জানিয়ে দিল। তিনি বললেন, এ ঘটনা না ঘটলেও আমার সঙ্গে যথাযথ আচরণ করা হচ্ছে না। যাকে নিয়ে আসা হয়েছে সে কোনো উচ্চবংশের কেউ নয়। এটি খুব বেশি হয়ে গেল।

প্রিন্স তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। প্রিন্সেস রেগেমেগে আগুন। বললেন, আমি গুজব শুনে শুনে অসুস্থ হয়ে গেছি। মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি। আপনি কেন আগে বলেননি? আপনার কোনো মহিলার মতো আচরণ করা আমি সহ্য করতে পারি না। কেন লোক হাসালেন? লোকজন আমাকে দেখে হাসছে। বলে প্রিন্সেস কাঁদতে শুরু করে দিলেন।

প্রিন্স মিথ্যে করে বললেন, আমি তাকে আমার কাজের মেয়েটির জন্য এনেছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি তাতে সায় দেবে। তুমি রাগান্বিত হলে, লেফটেন্যান্ট জেনারেলও খুব রেগেছেন। বলেছেন, আমাকে ঘৃণা করেন। সে তোমারও সেবা করবে।

এসব কথায় প্রিন্সেস নরম হলেন না। চুপ করে থাকলেন। এভাবে দিন যাচ্ছে। ইঝোমির সঙ্গে প্রিন্সেসের সাক্ষাৎ হয় না। প্রিন্সেসের বড় বোন ক্রাউন প্রিন্সের স্ত্রী। তিনি প্রিন্সেসকে লিখলেন, তুমি কেমন আছো? আজকাল লোকজন কীসব বলাবলি করছে। তা কি সত্য। আমি নিজেও অপমানিত বোধ করছি। রাতে আমাদের এখানে আসো একবার।

প্রিন্সেস উত্তর দিলেন, আপনার পত্র আমি পেয়েছি। এ সংসারে আমি কখনই সুখী হতে পারিনি। এখন আরো বেদনাদায়ক অবস্থা। আমি চলেই যাব। আপনাকে দেখে সান্ত¡না পাব। আমাকে নিয়ে যাবার জন্য কাউকে পাঠান। আমি চাইলেই যেতে পারি না, অনুমতির প্রয়োজন হয়। তিনি অনুমতি দেবেন না।

প্রিন্সেস সবকিছু গোছগাছ করতে শুরু করে দিলেন। নিজের লোকদের বললেন, আমি কিছু সময়ের জন্য যাচ্ছি। কারণ আমি এখানে থাকলে আমার স্বামী আমার কাছে আসতে অস্বস্তিবোধ করবেন। তা আমাদের দুজনের জন্যই বেদনাদায়ক।

তারা বলল, লোকেরা ভাবছে একটি বোঝাপড়া করেই প্রিন্স তাকে নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছেন। এই মহিলা এখন দরবারের মহিলা কক্ষে থাকেন। দিনে তিন-চারবার প্রিন্সের দরবারকক্ষে যান। এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করে লোকজন।

ইঝোমিকে এখানকার লোকজন ঘৃণাই করে। তার জন্য তার মনেও সুখ নেই। তারা নানান দুর্নামও রটিয়ে দিয়েছে তার।

প্রিন্স আন্দাজ করতে পারছিলেন তার স্ত্রী কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছেন। তিনি তার শ্যালকের পুত্রকে দেখে নিশ্চিত হলেন। এক ভদ্রমহিলা গৃহকর্মীকে বললেন, প্রিন্সের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছেন। গৃহকর্মী প্রিন্সকে বললেন, প্রিন্সেস চলে যাচ্ছেন। ক্রাউন প্রিন্স কী মনে করবেন, আপনি তাকে সান্ত¡না দিয়ে থামান।

প্রিন্স প্রিন্সেসের সামনে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়ালেন যেন কিছুই হয়নি। বললেন, তুমি কি তোমার বড় বোনের প্রাসাদে যাচ্ছ? আমাকে পালকির জন্য বলোনি কেন?

কিছু তো ঘটে চলেছে, যার জন্য যাওয়াটাই অবধারিত। ওরা আমার জন্য বাহন নিয়ে এসেছে। আর কিছু না বলেই প্রিন্সেস রাজকীয় শকটে গিয়ে উঠলেন।

ইঝোমি জানালা দিয়ে এসব দৃশ্য দেখলেন। বেদনায় তার বুক ভরে গেল। অথচ কিছুই বলতে পারছেন না। সবই ঘটছে তাকে কেন্দ্র করে। তিনি চুপ করে রইলেন। চুপ করে থেকে ভাবলেন এর শেষ কোথায়? তিনি কি চলে যাবেন এখান থেকে? থাকলে তাকে নানা ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু যাবেন কোথায়? যা পেছনে ফেলে এসেছেন সেখানে? কিন্তু তার প্রেম? তার প্রিন্স? যেতে দেবেন তো? দিলেও কী সন্ন্যাসের পথ কিংবা মৃত্যু বেছে নেবেন প্রিন্স? মানুষটিকে কী এভাবে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়?

অতীতের কথা মনে হলো তার। এই প্রেম তাকে স্বামী-সন্তান, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ত্যাগ করে একদিন প্রিন্স তামেতাকার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তার ভাগ্য খারাপ। প্রিন্স অল্প দিনের মধ্যে মারা গেলেন। আবার প্রিন্সঅতসুমিচির প্রেমে জড়ালেন। এবারেও কী ঘটতে যাচ্ছে তিনি কিছুই জানেন না। তার জন্য কত জনের কষ্ট; কিন্তু তার সুখই বা কোথায়? তাকে নিয়ে কী ভাগ্য বারবার খেলছে?

ততক্ষণে প্রিন্স প্রিন্সেসকে অযাচিত বিদায় দিয়ে ফিরে এসেছেন। ইঝোমির ভাবনায় ছেদ পড়লো।

এদিকে আজ মুরাসাকি বেশ খুশি। প্রিয় লেডি হায়ো তার কাছে এসে বললেন, লর্ড প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী তোমার জন্য ক্রিসানথ্যমম ফুলের নির্ঝাস মিশ্রিত এই রেশমি জিনিসটি পাঠিয়েছেন। তিনি চান তুমি এটি ব্যবহার করে বয়সকে কলা দেখাও। তোমার সৌন্দর্য তার আকাক্সক্ষার বিষয়। তবে সাবধান, সতর্কতার সঙ্গে লাগাবে এবং পরে তা ফেলে দেবে।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

তোমার সৌন্দর্য তার আকাক্সক্ষার বিষয়। তবে সাবধান, সতর্কতার সঙ্গে লাগাবে এবং পরে তা ফেলে দেবে।

সম্রাজ্ঞীর মাতা তাকে এতটা পছন্দ করেন তা তিনি জানতেন না। বিদগ্ধ লেডি বলে খ্যাত সম্রাটের মাতা সেনশি তাকে পছন্দ করেন, তিনি জানেন। রিনশি সরল-সহজ প্রকৃতির একজন ভদ্রমহিলা। মিচিনাগার ঠিক বিপরীত। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে তাই মতবিরোধ দেখা দেয়। রিনশি সর্বদাই ন্যায়-নিষ্ঠা এবং উৎপীড়িতের পক্ষে কথা বলেন।

মুরাসাকি উপহার পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। একটা সৃষ্টিশীল আবেগ এসে তার মনের ওপর ভর করল। তিনি কবিতায় লিখলেন- সেই ভদ্রমহিলা এক সহস্র বছর বেঁচে থাকুন/যিনি ফুল রক্ষা করেন/আমার হাতগুলো কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে সিক্ত/যেন বহুকাল হাঁটছি আমি আনন্দে, পুলকিত/শিশির সিক্ত/ক্রাইসানথ্যমম ফুলের উদ্যানে।

ভেবেছিলেন ফেরত দেবেন। বলবেন, পেয়েই ধন্য হয়েছেন। কবিতাটিও সঙ্গে যাবে; কিন্তু লেডি হায়ো চলে গেছেন।

বন্ধু সাইশো বললেন, ফেরত না পাঠাতে পেরে ভালো হয়েছে, ভুল বুঝতে পারতেন। কবিতা পাঠালে তা ঠিক ছিল।

মনে হয় খবর হয়েছে। সন্তানসম্ভবা সম্রাজ্ঞীর কক্ষের সাজ-সজ্জা পরিবর্তনের কাজ শুরু করা হল ভোর বেলায়। একটি সাদা ধবধবে বিছানায় স্থানান্তর করা হলো তাকে। প্রধানমন্ত্রী, তার ছেলেরা এবং অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিরা পর্দা, বিছানার আবরণ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পরিবর্তন করতে তাড়াহুড়ো শুরু করে দিয়েছেন।

সম্ভাব্য একটা তারিখের কথা ভেবে এ মাসের শুরু থেকেই পুরোহিতদের ডেকে আনা হয়েছিল। প্রতিটি মন্দির ও প্যাগোডা থেকে ভ্রমণপুষ্ট ও ভোজনতুষ্ট ভিক্ষুদের একত্রিত করা হয়েছিল। কারণ অশুভ আত্মাদের ভয় দেখাতে সজোরে চিৎকার করে মন্ত্র ও সূত্র পড়ে গলা ফাটাতে হবে। রাজন্যবর্গদেরও বিশ্বাস অশুভ আত্মারা গর্ভের শিশু এবং সন্তানসম্ভবা মায়ের ওপর আছর করে ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে। মন্ত্র ও সূত্র উচ্চারণে তাদের তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব।

তাদের প্রার্থনা তিন জগতের বুদ্ধের কাছে পৌঁছে গেছে। সারাবিশ্বের সূর্যকণ্ঠকে ডেকে আনা হয়েছে। আশি লক্ষ দেবতা বুঝি শিন্টু মন্ত্র উচ্চারণে হাজির হয়ে গেছেন। তবুও প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্ট নন, হাজার রাজার ধন, কন্যার সন্তানকে তিনি হারাতে চান না। তাই হেইয়ান কিয়োর পাহাড়-পর্বত, দ্বীপ-উপদ্বীপ সর্বত্র মন্দির ও প্যাগোডায় আদেশ পাঠালেন প্রার্থনা করার জন্য- যারা সেখানে রয়ে গেছেন প্রার্থনা করে অশুভ শক্তিকে রাজ্য ছাড়া করবেন। রাতের অন্ধকারে বার্তা বাহকেরা পড়ি কী মরি ছুটছেই ছুটছে।

রাতটা এভাবে কেটে গেল। সম্রাজ্ঞী প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। লেডি চিকিৎসকরা যেন অতন্ত্র প্রহরী। মন্ত্রপাঠের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ; কিন্তু কিচ্ছুটি বলার উপায় নেই। পর্দার পূর্বদিকে দরবারের মহিলাদের একত্রিত করা হয়েছে। পশ্চিম দিকে যেসব মহিলা আছেন এরা সম্রাজ্ঞী এবং প্রসবসম্ভব শিশুর বিকল্প। তাদের মধ্যে মন্দ আত্মাদের বন্দী করা হয়েছে। তাদের পাশেই পুরোহিতরা জোরেশোরে মন্ত্রোচ্চারণে অশুভ বা মন্দ আত্মাকে ভয় দেখাচ্ছেন।

দক্ষিণ দিকেও পুরোহিতরা বসে আছেন। সেদিক থেকে আক্রমণের ভয় নেই। তবুও সাবধানের বিকল্প নেই। তারাও মন্ত্র এবং সূত্র পাঠ করছেন। উত্তর দিকটায় বিছানার পর্দার ওপাশে সংকীর্ণ একটা জায়গায় চল্লিশজন লোক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নড়বার কোনো সুযোগ নেই। কেন এরা এখানে জড় হয়েছে, বলা শক্ত। তাতে কি মিচিনাগা খুশি হবেন?

যাদের এখানে দরকার দাসী, সেবিকা, কিংবা সম্রাজ্ঞীর আপন বা চেনাজানা কেউ ভেতরে প্রবেশ করতেই পারছে না। বাইরের চিত্র আরো ভয়াবহ। প্রাসাদে প্রবেশের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রাসাদ এবং দরবারে কাজ করেছেন এমন বয়স্ক নারী-পুরুষে সমস্ত অঙ্গন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাদের প্রবাহিত কিমোনো এবং দীর্ঘহাতা সকল স্থান অধিকার করে বসে আছে। কিছু বয়স্ক মহিলা অশ্রু গোপন করছেন, কেউবা বিলাপ করছেন। বিলাপ করাটা, এমনকি গোপনে অশ্রুপাতও এ সময় অশুভ, তা জেনেও তা তারা করছেন।

দিনের পর রাত কখন পার হয়ে গেছে কেউ জানে না, বড় শঙ্কার বিষয়। লোকজনের প্রচ- ভিড়। সম্রাজ্ঞীর কক্ষে গাদাগাদি অবস্থা। প্রসূতির শক্তিক্রমে কমে আসছে, নিঃশ্বাসে সমস্যা। এতক্ষণে মিচিনাগা বুঝলেন অনাবশ্যক লোকদের সরানো দরকার। মন্ত্রপাঠ করে করে তার কষ্ঠ শুকিয়ে গেছে। এই শক্ত কণ্ঠেই বললেন, তোমরা কক্ষ থেকে বের হয়ে যাও। বারান্দা কিংবা নিচে; কিন্তু লোকজন তার কথার চাইতে সন্তানটা কন্যা না পুত্র তা জানতে আগ্রহী বেশি। বেঁচে আছে না মারা গেছে এ সংবাদও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা নড়তে গিয়েও যেন থেমে যাচ্ছে। তবুও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের সরিয়ে দেয়া হলো।

সাতান্ন

ইমনকে কক্ষ কিংবা বাইরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ তারই বেশি ব্যস্ত থাকার কথা। মুরাসাকি আছেন। তবে সমস্যা হলো ভিড় ঠেলে তার পক্ষেও চলাচল অসম্ভব। মিচিনাগার কথায় কিছু লোক সরে গেলে কক্ষের দিকে যাওয়ার জন্য সুযোগ হলো। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন পুরোহিতরা মন্ত্রপাঠের সঙ্গে আগুন জ্বালাচ্ছেন। তাতে ধোঁয়া হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস এ আগুন এবং ধোঁয়া অশুভ শক্তিকে তাড়াবে। তার মনে হলো, তাহলে মন্ত্রের কী কাজ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইনজেন (পুরোহিত) আগের দিন প্রভু প্রধানমন্ত্রী লিখিত প্রার্থনাটি খুব জোরে পাঠ করছেন। তার নিজেরও গুরুতর কিছু মানত এতে যুক্ত করে উপস্থিত সবাইকে আশাবাদী করে তুললেন।

এ আশাবাদে প্রধানমন্ত্রী সর্বান্তকরণে যুক্ত। বহু কাক্সিক্ষত এ কন্যার সন্তান যেন পুত্র হয় গত দশ মাস সে আশায় সারা দেশে মন্দির প্যাগোডায় ছুটে বেড়িয়েছেন। চিকিৎসক, বদ্যি, ওঝাঁ-শাস্ত্রী সবাইকে এক করে ছেড়েছেন। সম্রাট সম্রাজ্ঞীর চেয়ে যেন তার কন্যার একটি পুত্র সন্তানের প্রয়োজন তারই বেশি। সে আকুতিটা এখানেও ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। প্রধান পুরোহিত এবং ভান্তেরা তাকে আশ্বস্ত করছেন। ভাগ্যবান পুত্র প্রসবের প্রতি তাদের আশ্বাসবাণী জোরে শোরে উচ্চারিত। তাতে উপস্থিত সবার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এখানে যে সবাই মিচিনাগার দলের তা মনে করার কারণ নেই। সানজু এখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। সম্রাট এখনো মনে করেন তেইশিপুত্রই সানজুর পরের সম্রাট। কাজেই মিচিনাগার দুষ্টবুদ্ধির কাছে অনেকেই পরাজিত হতে চান না। তারা চান নবাগত কন্যা হোক। অর্থাৎ তারা কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চান না।

মুরাসাকি ভাবছেন অন্য কথা। তারও একটি বাচ্চা আছে। সন্তান প্রসবের কী কষ্ট তা তিনি জানেন। তার জন্য সন্তান প্রসবকালে এত মন্ত্র এবং এত সূত্র পাঠ ছিল না। তার স্বামী নোবুতাকা একজন নৃত্যশিল্পী এবং পোশাক সচেতন ভোগবাদী মানুষ ছিলেন। দুনিয়াবী সমস্যা দেখার তার সময় ছিল না। আর রীতি তো এই যে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে বাবার বাড়ি নয়, নানাবাড়ি, তাই তার একটা গাছাড়া ভাব ছিল সব কাজেই। ফলে মুরাসাকির সন্তান প্রসবের জন্য চিকিৎসক এবং নার্সরাই অবলম্বন ছিলেন। তার পরিবারটা উদার ধর্মবিশ্বাসী কবি ও সৃজনশীল পরিবার। বাবা যথেষ্ট বাস্তববাদী মানুষ। তার বাবা কবিতা আকাশে উড়ালেও, কবি হয়ে তিনি মাটিতে পা রেখে চলেন। তার মেয়ে হয়ে মুরাসাকি ভূত, প্রেত ও অশুভ শক্তির বিশ্বাসে ডুবে থাকবেন তা হয় না। এটা সম্রাট পরিবারের কাজ। কত কিছুতে তাদের হিসাব মেলাতে হয়।

প্রসবকালে মুরাসাকির খুব কষ্ট হয়েছে। সেখানে কন্যা-পুত্রের সমীকরণ ছিল না। পুত্র জন্মালে যা, কন্যা জন্মালেও তা। সম্রাট তো হবে না। যোগ্যতা নিয়ে প্রাসাদে একটি অবস্থান তৈরি করতে পারলেই হয়। তাই কন্যা হয়েছে বলে মুরাসাকি খুশিই হয়েছেন। নোবুতাকা পুত্রের প্রত্যাশি ছিলেন। তবে তেমন অখুশিও হননি। কারণ মেয়েরাও এখন সামুরাই আর্মিতে অফিসার হতে শুরু করেছে।

এদিকে বেলা বাড়ছে। প্রসূতির বেহাল অবস্থা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে বিলম্ব হচ্ছে। শঙ্কা, ভয়, আতঙ্ক। কারো কারো চোখে জল। মুরাসাকি দেখতে পাচ্ছেন লোকজনের মধ্যে উৎকণ্ঠা। প্রধানমন্ত্রী, লেডি সানুকি এবং লেডি সাইশো পর্দার মধ্যে সম্রাজ্ঞীর কাছে। এখানে সম্রাজ্ঞীর মাতা রিনশি অর্থাৎ মিচিনাগার স্ত্রীর থাকার কথা। তিনি নেই। অতিউৎসাহী মিচিনাগা আছেন। কারণ তিনি চিকিৎসক-নার্স এবং এখানকার লেডিদের বিশ্বাস করছেন না, পাছে এরা পুত্রসন্তান হলে তাকে হত্যা করে সে আশঙ্কায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে নিজেই আছেন।

রিনশি এবং সেইশি দুই বেয়াইন আছেন পাশের কক্ষে। সেখানে তারা সুখবরের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখানকার নার্স-চিকিৎসক ও লেডিদের ওপর তাদের আস্থা আছে। সম্রাটমাতা সেনশি সর্ব বিষয়েই একজন পরিপক্ব মানুষ। মুহূর্তে মুহূর্তে খবর নিচ্ছেন। সেখানে ভাই মিচিনাগার উপস্থিতিটা তার কাছে, বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, বাচ্চার কান্না শুনেই তবে আমাদের যাওয়া উচিত, তার আগে নয়। আর পুরোহিত ভান্তেরা গলা ফাটাচ্ছে কেন, মন্ত্রের জোর কি উচ্চশব্দে, না অন্তরের বিশ্বাসে? প্রসূতির বারটা বাজাচ্ছে এরা।

রিনশি সরল সহজ মানুষ। বেয়াইন এবং স্বামীর বড় বোনের কথায় সায় দিলেন বটে, কিন্তু অন্তরে মেয়ের জন্য অন্য কিছু ঘটে চলেছে। ইমন এখানে। তাদের সঙ্গে আছেন তাদের ইচ্ছায়। মাঝে মধ্যে উঠে গিয়ে সংবাদ এনে দিচ্ছেন। এরকম একসময় মুরাসাকির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নিন্না মন্দিরের পুরোহিত, মিয়া দরবারের ভান্তেকে তখন মিচিনাগা পর্দার ভেতরে ডেকেছেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে তাদের ওপর নির্দেশনা জারি করলেন। পর্দার আশপাশে লেডি ডেইগন, কোশোশো, নাইশি, কিমি, মায়েবো ও মোতো এবং সেনজিরা ভয়ে ভয়ে আছেন। কারণ মিচিনাগা ভয়ঙ্কর রকম উত্তেজিত।

ইমন বললেন, তাকাকু কী অবস্থা বল?

তাদের মুখের দিকে দেখুন। এরা সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তাদের এই হাল হলে আমি তো এখনো একজন শিক্ষানবিশ। আমার কাছেও মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ গুরুতর।

ভয় পেয়ো না। সব ব্যবস্থাই আছে।

কিন্তু প্রভু প্রধানমন্ত্রী?

তার তো উত্তেজনা আছেই। ওখানে দেখছি সম্রাজ্ঞীর বোনেরা রয়েছেন।

তাদের ব্যক্তিগত নার্সদের নিয়ে আছেন।

জানি না এদের কাজ কী?

ইমন বললেন, নিশ্চয়ই আছে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সম্রাজ্ঞীর ভ্রাতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইশো, ফোর্থ রেঙ্কের মেজর জেনারেল মাসামিচি, বাম দেহরক্ষী লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুনি উফুসা তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুরাসাকি বললেন, এখানে তাদের কাজ কী? তাদের চাইতে প্রভুর কনিষ্ঠপুত্র এখানে থাকার বেশি যোগ্য।

কেন?

বয়েসের চেয়ে সে অনেক পাকা।

তুমি এ সময়ও হাসালে। মিয়া-নো-তৈয়ুর চোখ ফোলা কেন? সে কি কাঁদছে?

তার মধ্যে একটা অশরীরি অশুভ শক্তিকে বন্দি করা হয়েছে। তিনি সম্রাজ্ঞীর বিকল্প দেখছেন না, সম্রাজ্ঞীরমতো তারও চুল কেটে দেয়া হয়েছে। মুখে লাগানো হয়েছে সম্রাজ্ঞীর মুখোশ। মাথায় সাদা ভাত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

জানতাম মন্ত্রপড়া চালে তাদের ভয়।

আমি বিশ্বাস না করলেও তা ঠিক আছে।

দেখছেন না তার চারদিকে চাল ছিটানো আছে।

আর বের হতে পারবে না অশুভ শক্তি।

যেন তাই হয়। চাপা কণ্ঠে বললেন, মুরাসাকি।

তার জামা কাপড়ের এই হাল কেন?

অপশক্তিরা নিশ্চয়ই জামা কাপড় ছাড়া থাকতে পছন্দ করে।

তাই বলে সকলের সামনে?

হঠাৎ বাচ্চার চিৎকার শোনা গেল। নবজাতকের চিৎকার। ছেলে, না মেয়ে। হুমড়ে পড়লেন মিচিনাগা। ছেলে, প্রিন্স। বলে উল্লাসে চেচিয়ে উঠলেন তিনি। পর্দার বাইরে থেকেও উচ্চকণ্ঠস্বর শোনা গেল। ছুটলেন ইমন এবং মুরাসাকি। না, বাচ্চা দেখার জন্য নয়, রিনশি এবং সেনশিকে জানাবার জন্য। এটা সুসংবাদ। দেখার চাইতে সংবাদ দেয়ায় আনন্দ বেশি।

রিনশি এবং সেনশির কক্ষ থেকে আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে গেল। ইমন এবং মুরাসাকিকে জড়িয়ে ধরলেন দু’জন। এখন সম্রাটের কাছে এ সংবাদ পৌঁছাতে হবে। সম্রাটের দরবারে যাওয়া-আসা আছে এমন একজনকে পাঠানো হলো। ঘরে বাইরে সর্বত্র উৎসবের ঢেউ।

মিচিনাগা নিজে এবার নবজাতকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন। তার প্রথম কাজ হল পুরোহিতদের প্রধানকে ডেকে বলা মন্ত্র ও সূত্র পাঠ বন্ধ হবে না। বন্দি অশুভ আত্মা, বিশেষ করে নবজাতকের দিকে দৃষ্টি দেয়া আত্মাকে বন্দি করা লেডিদের ওপর নজর রাখতে হবে। তাদের চারদিকে চালের চক্কর তৈরি করা আছে। তবে এখানকার অশুভ আত্মা এতটা হিংস্র নয়। লেডিদের কিমোনো ঠিকঠাক আছে।

তারপরও প্রধান পুরোহিত অধিকতর নিরাপত্তার কথা ভেবে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য কিনা বলা শক্ত, অশুভ শক্তি অশুভ শক্তি বলে চেঁচামেচি করলেন। বললেন, এখন নবজাতকের ওপর দৃষ্টি তাদের। এক কাজ করতে হবে। বিকল্প কোনো পুরোহিতকে দায়িত্ব নিতে হবে। তাই সঙ্গে সঙ্গে শিনজু আঝারি কুরোডোর দায়িত্ব এবং চিজো আঝারি লেডি নাইশির দায়িত্ব নিলেন। চিজো পুরোহিত হিসেবে লেডিদের থেকে অশুভ শক্তির ওপর অতিমাত্রায় ক্ষমতাশালী। সম্ভবত এসব আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখা ছিল।

মুরাসাকির মনে প্রশ্ন জাগলো, তার বন্ধু লেডি সাইশোর কী হবে? তার ভাগ্য ভালো। পুরোহিত ইকো তার দায়িত্ব নিলেন। তিনি সম্রাজ্ঞীর স্থলবর্তী। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার পরও তাদের ভয় কাটছে না। প্রধান পুরোহিত এদের সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন সম্রাজ্ঞী এবং নবজাতককে কাবু করতে না পেরে তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু করবে প্রতিশোধপ্রবণ অশুভ আত্মারা।

প্রসবের কাজটা শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। সম্রাজ্ঞীও শান্তিতে আছেন। তার আনন্দ সীমাহীন, প্রিন্সের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বিশ্বজগৎ জয় করবার মতই এক ঘটনা। দীর্ঘদিন সন্তান হচ্ছে না। প্রাসাদ, প্রাসাদের বাইরে কত কথা, কত গঞ্জনা। এক সময় বাবাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, হাজারও চেষ্টা তদ্বির শেষে আজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে এলো। সোনায় সোহাগা।

উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন মিচিনাগা। তাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, তার নাম রাখা হবে যথাসময়ে। এখন থেকে তাকে বলতে হবে ক্রাউন প্রিন্স।

ক্রাউন প্রিন্স! কারো কারো মুখ থেকে বিশ্ময়ভরা প্রতিধ্বনি শোনা গেল। কারণ তারা জানেন সম্প্রতি প্রকাশিত এক দলিলে রেইঝেই পুত্র সানজুকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করা আছে। ক্রাউন প্রিন্সই হন পরবর্তী সম্রাট।

সারারাত জেগে থাকা লেডি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন চলে যাচ্ছেন গোসল ও পোষাক বদলাবার জন্য।

মিচিনাগা এবং তার স্ত্রী রিনশি এত খুশি যে, পুরোহিতদের ঘাম শুকোবার আগেই দক্ষিনা দিতে শুরু করলেন। আজ হিসেবি মিচিনাগাও গুনে পয়সা দিচ্ছেন না। অবিশ্বাস্য রকম অর্থকড়ি লাভ করলেন পুরোহিতবৃন্দ। সংশ্লিষ্ট অন্য সবাইকেও ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত করা হলো অর্থকড়ি দিয়ে।

প্রিন্সের আগমনের কথা শুনে যেন বাড়িতে মানুষের ঢল নামল। সারা হেইয়ানকিয়ো কী হুমড়ি খেয়ে পড়ল? মিচিনাগার নির্দেশে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং প্রথম সচিব ইউরিসদা নতুন যুবরাজের জন্য সম্রাটের দরবার থেকে কারুকাজ খচিত সোনার তারবারি নিয়ে হাজির হলেন। পুরস্কার দেয়ার কাজ শেষ করে মিচিনাগা ছুটে এলেন। যুবরাজকে উদ্দেশ করে তা তুলে দিলেন সম্রাটমাতা সেনশির হাতে। তিনি যে লেডিকে পছন্দ করবেন তার হাতেই তুলে দেবেন যুবরাজের প্রতিরক্ষার এই তরবারি। (ক্রমশ...)

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২ , ১৩ মাঘ ১৪২৮, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : একত্রিশ

শিকিবু

আবুল কাসেম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ছাপ্পান্ন

ইঝোমিকে নিয়ে এসে নতুন একটি বাড়িতে তোলা হলো। তার ঘরটি সুন্দরভাবে সজ্জিত। সঙ্গে একজন পরিচারিকাকে নিয়ে আসেন ইঝোমি। এখানে তাদেরকে কেউ স্বাগত জানায়নি। ভালোবাসার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়।

এখানে কাজের লোক, সেবক সবাই আসবে। বললেন অতসুমিচি। ইঝোমির এসবের এখন প্রয়োজন নেই। প্রিন্স যে তাকে বুঝতে পেরেছেন এবং এভাবে গোপনে তার সঙ্গে আসতে পেরেছেন, তাতেই খুশি।

সকাল বেলায় প্রিন্স বের হয়ে গেলেন। শাটারগুলো তখনও বন্ধ। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর হলেও নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য যথেষ্ট। সকালে যাবার আগে প্রিন্স বলেছিলেন, তুমি উত্তর-ভবনে থাকবে। বাইরে থেকে এ কক্ষের কথা শুনতে পাওয়া যায়। কেউ কথা শুনে আবিষ্কার করে ফেলতে পারে। তা হবে ক্ষতিকর।

তিন দিন পর উত্তর ভবনে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রিন্সের গৃহকর্মী রয়েছে। কোনো দর্শনার্থী নেই; কিন্তু লোকেরা কীভাবে যেন জেনে গেল। এরা দৌড়ে গিয়ে অতসুমিচির স্ত্রী প্রন্সেসকে জানিয়ে দিল। তিনি বললেন, এ ঘটনা না ঘটলেও আমার সঙ্গে যথাযথ আচরণ করা হচ্ছে না। যাকে নিয়ে আসা হয়েছে সে কোনো উচ্চবংশের কেউ নয়। এটি খুব বেশি হয়ে গেল।

প্রিন্স তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। প্রিন্সেস রেগেমেগে আগুন। বললেন, আমি গুজব শুনে শুনে অসুস্থ হয়ে গেছি। মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি। আপনি কেন আগে বলেননি? আপনার কোনো মহিলার মতো আচরণ করা আমি সহ্য করতে পারি না। কেন লোক হাসালেন? লোকজন আমাকে দেখে হাসছে। বলে প্রিন্সেস কাঁদতে শুরু করে দিলেন।

প্রিন্স মিথ্যে করে বললেন, আমি তাকে আমার কাজের মেয়েটির জন্য এনেছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি তাতে সায় দেবে। তুমি রাগান্বিত হলে, লেফটেন্যান্ট জেনারেলও খুব রেগেছেন। বলেছেন, আমাকে ঘৃণা করেন। সে তোমারও সেবা করবে।

এসব কথায় প্রিন্সেস নরম হলেন না। চুপ করে থাকলেন। এভাবে দিন যাচ্ছে। ইঝোমির সঙ্গে প্রিন্সেসের সাক্ষাৎ হয় না। প্রিন্সেসের বড় বোন ক্রাউন প্রিন্সের স্ত্রী। তিনি প্রিন্সেসকে লিখলেন, তুমি কেমন আছো? আজকাল লোকজন কীসব বলাবলি করছে। তা কি সত্য। আমি নিজেও অপমানিত বোধ করছি। রাতে আমাদের এখানে আসো একবার।

প্রিন্সেস উত্তর দিলেন, আপনার পত্র আমি পেয়েছি। এ সংসারে আমি কখনই সুখী হতে পারিনি। এখন আরো বেদনাদায়ক অবস্থা। আমি চলেই যাব। আপনাকে দেখে সান্ত¡না পাব। আমাকে নিয়ে যাবার জন্য কাউকে পাঠান। আমি চাইলেই যেতে পারি না, অনুমতির প্রয়োজন হয়। তিনি অনুমতি দেবেন না।

প্রিন্সেস সবকিছু গোছগাছ করতে শুরু করে দিলেন। নিজের লোকদের বললেন, আমি কিছু সময়ের জন্য যাচ্ছি। কারণ আমি এখানে থাকলে আমার স্বামী আমার কাছে আসতে অস্বস্তিবোধ করবেন। তা আমাদের দুজনের জন্যই বেদনাদায়ক।

তারা বলল, লোকেরা ভাবছে একটি বোঝাপড়া করেই প্রিন্স তাকে নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছেন। এই মহিলা এখন দরবারের মহিলা কক্ষে থাকেন। দিনে তিন-চারবার প্রিন্সের দরবারকক্ষে যান। এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করে লোকজন।

ইঝোমিকে এখানকার লোকজন ঘৃণাই করে। তার জন্য তার মনেও সুখ নেই। তারা নানান দুর্নামও রটিয়ে দিয়েছে তার।

প্রিন্স আন্দাজ করতে পারছিলেন তার স্ত্রী কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছেন। তিনি তার শ্যালকের পুত্রকে দেখে নিশ্চিত হলেন। এক ভদ্রমহিলা গৃহকর্মীকে বললেন, প্রিন্সের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছেন। গৃহকর্মী প্রিন্সকে বললেন, প্রিন্সেস চলে যাচ্ছেন। ক্রাউন প্রিন্স কী মনে করবেন, আপনি তাকে সান্ত¡না দিয়ে থামান।

প্রিন্স প্রিন্সেসের সামনে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়ালেন যেন কিছুই হয়নি। বললেন, তুমি কি তোমার বড় বোনের প্রাসাদে যাচ্ছ? আমাকে পালকির জন্য বলোনি কেন?

কিছু তো ঘটে চলেছে, যার জন্য যাওয়াটাই অবধারিত। ওরা আমার জন্য বাহন নিয়ে এসেছে। আর কিছু না বলেই প্রিন্সেস রাজকীয় শকটে গিয়ে উঠলেন।

ইঝোমি জানালা দিয়ে এসব দৃশ্য দেখলেন। বেদনায় তার বুক ভরে গেল। অথচ কিছুই বলতে পারছেন না। সবই ঘটছে তাকে কেন্দ্র করে। তিনি চুপ করে রইলেন। চুপ করে থেকে ভাবলেন এর শেষ কোথায়? তিনি কি চলে যাবেন এখান থেকে? থাকলে তাকে নানা ঝামেলা পোহাতে হবে। কিন্তু যাবেন কোথায়? যা পেছনে ফেলে এসেছেন সেখানে? কিন্তু তার প্রেম? তার প্রিন্স? যেতে দেবেন তো? দিলেও কী সন্ন্যাসের পথ কিংবা মৃত্যু বেছে নেবেন প্রিন্স? মানুষটিকে কী এভাবে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়?

অতীতের কথা মনে হলো তার। এই প্রেম তাকে স্বামী-সন্তান, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ত্যাগ করে একদিন প্রিন্স তামেতাকার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তার ভাগ্য খারাপ। প্রিন্স অল্প দিনের মধ্যে মারা গেলেন। আবার প্রিন্সঅতসুমিচির প্রেমে জড়ালেন। এবারেও কী ঘটতে যাচ্ছে তিনি কিছুই জানেন না। তার জন্য কত জনের কষ্ট; কিন্তু তার সুখই বা কোথায়? তাকে নিয়ে কী ভাগ্য বারবার খেলছে?

ততক্ষণে প্রিন্স প্রিন্সেসকে অযাচিত বিদায় দিয়ে ফিরে এসেছেন। ইঝোমির ভাবনায় ছেদ পড়লো।

এদিকে আজ মুরাসাকি বেশ খুশি। প্রিয় লেডি হায়ো তার কাছে এসে বললেন, লর্ড প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী তোমার জন্য ক্রিসানথ্যমম ফুলের নির্ঝাস মিশ্রিত এই রেশমি জিনিসটি পাঠিয়েছেন। তিনি চান তুমি এটি ব্যবহার করে বয়সকে কলা দেখাও। তোমার সৌন্দর্য তার আকাক্সক্ষার বিষয়। তবে সাবধান, সতর্কতার সঙ্গে লাগাবে এবং পরে তা ফেলে দেবে।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একাদশ শতকের জাপানের গৌরবময় সাহিত্য-সমৃদ্ধির পটভূমিতে চারজন বিখ্যাত নারী কবি ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে রচিত। বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু আছেন এর কেন্দ্রে। আরও আছেন কবি আকাঝুমি ইমন, কবি ইঝোমি শিকিবু এবং বিখ্যাত “দ্য পিলুবুক” রচয়িতা সেইসোনাগান

তোমার সৌন্দর্য তার আকাক্সক্ষার বিষয়। তবে সাবধান, সতর্কতার সঙ্গে লাগাবে এবং পরে তা ফেলে দেবে।

সম্রাজ্ঞীর মাতা তাকে এতটা পছন্দ করেন তা তিনি জানতেন না। বিদগ্ধ লেডি বলে খ্যাত সম্রাটের মাতা সেনশি তাকে পছন্দ করেন, তিনি জানেন। রিনশি সরল-সহজ প্রকৃতির একজন ভদ্রমহিলা। মিচিনাগার ঠিক বিপরীত। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে তাই মতবিরোধ দেখা দেয়। রিনশি সর্বদাই ন্যায়-নিষ্ঠা এবং উৎপীড়িতের পক্ষে কথা বলেন।

মুরাসাকি উপহার পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। একটা সৃষ্টিশীল আবেগ এসে তার মনের ওপর ভর করল। তিনি কবিতায় লিখলেন- সেই ভদ্রমহিলা এক সহস্র বছর বেঁচে থাকুন/যিনি ফুল রক্ষা করেন/আমার হাতগুলো কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে সিক্ত/যেন বহুকাল হাঁটছি আমি আনন্দে, পুলকিত/শিশির সিক্ত/ক্রাইসানথ্যমম ফুলের উদ্যানে।

ভেবেছিলেন ফেরত দেবেন। বলবেন, পেয়েই ধন্য হয়েছেন। কবিতাটিও সঙ্গে যাবে; কিন্তু লেডি হায়ো চলে গেছেন।

বন্ধু সাইশো বললেন, ফেরত না পাঠাতে পেরে ভালো হয়েছে, ভুল বুঝতে পারতেন। কবিতা পাঠালে তা ঠিক ছিল।

মনে হয় খবর হয়েছে। সন্তানসম্ভবা সম্রাজ্ঞীর কক্ষের সাজ-সজ্জা পরিবর্তনের কাজ শুরু করা হল ভোর বেলায়। একটি সাদা ধবধবে বিছানায় স্থানান্তর করা হলো তাকে। প্রধানমন্ত্রী, তার ছেলেরা এবং অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিরা পর্দা, বিছানার আবরণ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পরিবর্তন করতে তাড়াহুড়ো শুরু করে দিয়েছেন।

সম্ভাব্য একটা তারিখের কথা ভেবে এ মাসের শুরু থেকেই পুরোহিতদের ডেকে আনা হয়েছিল। প্রতিটি মন্দির ও প্যাগোডা থেকে ভ্রমণপুষ্ট ও ভোজনতুষ্ট ভিক্ষুদের একত্রিত করা হয়েছিল। কারণ অশুভ আত্মাদের ভয় দেখাতে সজোরে চিৎকার করে মন্ত্র ও সূত্র পড়ে গলা ফাটাতে হবে। রাজন্যবর্গদেরও বিশ্বাস অশুভ আত্মারা গর্ভের শিশু এবং সন্তানসম্ভবা মায়ের ওপর আছর করে ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে। মন্ত্র ও সূত্র উচ্চারণে তাদের তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব।

তাদের প্রার্থনা তিন জগতের বুদ্ধের কাছে পৌঁছে গেছে। সারাবিশ্বের সূর্যকণ্ঠকে ডেকে আনা হয়েছে। আশি লক্ষ দেবতা বুঝি শিন্টু মন্ত্র উচ্চারণে হাজির হয়ে গেছেন। তবুও প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্ট নন, হাজার রাজার ধন, কন্যার সন্তানকে তিনি হারাতে চান না। তাই হেইয়ান কিয়োর পাহাড়-পর্বত, দ্বীপ-উপদ্বীপ সর্বত্র মন্দির ও প্যাগোডায় আদেশ পাঠালেন প্রার্থনা করার জন্য- যারা সেখানে রয়ে গেছেন প্রার্থনা করে অশুভ শক্তিকে রাজ্য ছাড়া করবেন। রাতের অন্ধকারে বার্তা বাহকেরা পড়ি কী মরি ছুটছেই ছুটছে।

রাতটা এভাবে কেটে গেল। সম্রাজ্ঞী প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। লেডি চিকিৎসকরা যেন অতন্ত্র প্রহরী। মন্ত্রপাঠের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ; কিন্তু কিচ্ছুটি বলার উপায় নেই। পর্দার পূর্বদিকে দরবারের মহিলাদের একত্রিত করা হয়েছে। পশ্চিম দিকে যেসব মহিলা আছেন এরা সম্রাজ্ঞী এবং প্রসবসম্ভব শিশুর বিকল্প। তাদের মধ্যে মন্দ আত্মাদের বন্দী করা হয়েছে। তাদের পাশেই পুরোহিতরা জোরেশোরে মন্ত্রোচ্চারণে অশুভ বা মন্দ আত্মাকে ভয় দেখাচ্ছেন।

দক্ষিণ দিকেও পুরোহিতরা বসে আছেন। সেদিক থেকে আক্রমণের ভয় নেই। তবুও সাবধানের বিকল্প নেই। তারাও মন্ত্র এবং সূত্র পাঠ করছেন। উত্তর দিকটায় বিছানার পর্দার ওপাশে সংকীর্ণ একটা জায়গায় চল্লিশজন লোক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নড়বার কোনো সুযোগ নেই। কেন এরা এখানে জড় হয়েছে, বলা শক্ত। তাতে কি মিচিনাগা খুশি হবেন?

যাদের এখানে দরকার দাসী, সেবিকা, কিংবা সম্রাজ্ঞীর আপন বা চেনাজানা কেউ ভেতরে প্রবেশ করতেই পারছে না। বাইরের চিত্র আরো ভয়াবহ। প্রাসাদে প্রবেশের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রাসাদ এবং দরবারে কাজ করেছেন এমন বয়স্ক নারী-পুরুষে সমস্ত অঙ্গন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাদের প্রবাহিত কিমোনো এবং দীর্ঘহাতা সকল স্থান অধিকার করে বসে আছে। কিছু বয়স্ক মহিলা অশ্রু গোপন করছেন, কেউবা বিলাপ করছেন। বিলাপ করাটা, এমনকি গোপনে অশ্রুপাতও এ সময় অশুভ, তা জেনেও তা তারা করছেন।

দিনের পর রাত কখন পার হয়ে গেছে কেউ জানে না, বড় শঙ্কার বিষয়। লোকজনের প্রচ- ভিড়। সম্রাজ্ঞীর কক্ষে গাদাগাদি অবস্থা। প্রসূতির শক্তিক্রমে কমে আসছে, নিঃশ্বাসে সমস্যা। এতক্ষণে মিচিনাগা বুঝলেন অনাবশ্যক লোকদের সরানো দরকার। মন্ত্রপাঠ করে করে তার কষ্ঠ শুকিয়ে গেছে। এই শক্ত কণ্ঠেই বললেন, তোমরা কক্ষ থেকে বের হয়ে যাও। বারান্দা কিংবা নিচে; কিন্তু লোকজন তার কথার চাইতে সন্তানটা কন্যা না পুত্র তা জানতে আগ্রহী বেশি। বেঁচে আছে না মারা গেছে এ সংবাদও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা নড়তে গিয়েও যেন থেমে যাচ্ছে। তবুও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের সরিয়ে দেয়া হলো।

সাতান্ন

ইমনকে কক্ষ কিংবা বাইরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অথচ তারই বেশি ব্যস্ত থাকার কথা। মুরাসাকি আছেন। তবে সমস্যা হলো ভিড় ঠেলে তার পক্ষেও চলাচল অসম্ভব। মিচিনাগার কথায় কিছু লোক সরে গেলে কক্ষের দিকে যাওয়ার জন্য সুযোগ হলো। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন পুরোহিতরা মন্ত্রপাঠের সঙ্গে আগুন জ্বালাচ্ছেন। তাতে ধোঁয়া হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস এ আগুন এবং ধোঁয়া অশুভ শক্তিকে তাড়াবে। তার মনে হলো, তাহলে মন্ত্রের কী কাজ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইনজেন (পুরোহিত) আগের দিন প্রভু প্রধানমন্ত্রী লিখিত প্রার্থনাটি খুব জোরে পাঠ করছেন। তার নিজেরও গুরুতর কিছু মানত এতে যুক্ত করে উপস্থিত সবাইকে আশাবাদী করে তুললেন।

এ আশাবাদে প্রধানমন্ত্রী সর্বান্তকরণে যুক্ত। বহু কাক্সিক্ষত এ কন্যার সন্তান যেন পুত্র হয় গত দশ মাস সে আশায় সারা দেশে মন্দির প্যাগোডায় ছুটে বেড়িয়েছেন। চিকিৎসক, বদ্যি, ওঝাঁ-শাস্ত্রী সবাইকে এক করে ছেড়েছেন। সম্রাট সম্রাজ্ঞীর চেয়ে যেন তার কন্যার একটি পুত্র সন্তানের প্রয়োজন তারই বেশি। সে আকুতিটা এখানেও ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। প্রধান পুরোহিত এবং ভান্তেরা তাকে আশ্বস্ত করছেন। ভাগ্যবান পুত্র প্রসবের প্রতি তাদের আশ্বাসবাণী জোরে শোরে উচ্চারিত। তাতে উপস্থিত সবার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এখানে যে সবাই মিচিনাগার দলের তা মনে করার কারণ নেই। সানজু এখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে। সম্রাট এখনো মনে করেন তেইশিপুত্রই সানজুর পরের সম্রাট। কাজেই মিচিনাগার দুষ্টবুদ্ধির কাছে অনেকেই পরাজিত হতে চান না। তারা চান নবাগত কন্যা হোক। অর্থাৎ তারা কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চান না।

মুরাসাকি ভাবছেন অন্য কথা। তারও একটি বাচ্চা আছে। সন্তান প্রসবের কী কষ্ট তা তিনি জানেন। তার জন্য সন্তান প্রসবকালে এত মন্ত্র এবং এত সূত্র পাঠ ছিল না। তার স্বামী নোবুতাকা একজন নৃত্যশিল্পী এবং পোশাক সচেতন ভোগবাদী মানুষ ছিলেন। দুনিয়াবী সমস্যা দেখার তার সময় ছিল না। আর রীতি তো এই যে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে বাবার বাড়ি নয়, নানাবাড়ি, তাই তার একটা গাছাড়া ভাব ছিল সব কাজেই। ফলে মুরাসাকির সন্তান প্রসবের জন্য চিকিৎসক এবং নার্সরাই অবলম্বন ছিলেন। তার পরিবারটা উদার ধর্মবিশ্বাসী কবি ও সৃজনশীল পরিবার। বাবা যথেষ্ট বাস্তববাদী মানুষ। তার বাবা কবিতা আকাশে উড়ালেও, কবি হয়ে তিনি মাটিতে পা রেখে চলেন। তার মেয়ে হয়ে মুরাসাকি ভূত, প্রেত ও অশুভ শক্তির বিশ্বাসে ডুবে থাকবেন তা হয় না। এটা সম্রাট পরিবারের কাজ। কত কিছুতে তাদের হিসাব মেলাতে হয়।

প্রসবকালে মুরাসাকির খুব কষ্ট হয়েছে। সেখানে কন্যা-পুত্রের সমীকরণ ছিল না। পুত্র জন্মালে যা, কন্যা জন্মালেও তা। সম্রাট তো হবে না। যোগ্যতা নিয়ে প্রাসাদে একটি অবস্থান তৈরি করতে পারলেই হয়। তাই কন্যা হয়েছে বলে মুরাসাকি খুশিই হয়েছেন। নোবুতাকা পুত্রের প্রত্যাশি ছিলেন। তবে তেমন অখুশিও হননি। কারণ মেয়েরাও এখন সামুরাই আর্মিতে অফিসার হতে শুরু করেছে।

এদিকে বেলা বাড়ছে। প্রসূতির বেহাল অবস্থা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে বিলম্ব হচ্ছে। শঙ্কা, ভয়, আতঙ্ক। কারো কারো চোখে জল। মুরাসাকি দেখতে পাচ্ছেন লোকজনের মধ্যে উৎকণ্ঠা। প্রধানমন্ত্রী, লেডি সানুকি এবং লেডি সাইশো পর্দার মধ্যে সম্রাজ্ঞীর কাছে। এখানে সম্রাজ্ঞীর মাতা রিনশি অর্থাৎ মিচিনাগার স্ত্রীর থাকার কথা। তিনি নেই। অতিউৎসাহী মিচিনাগা আছেন। কারণ তিনি চিকিৎসক-নার্স এবং এখানকার লেডিদের বিশ্বাস করছেন না, পাছে এরা পুত্রসন্তান হলে তাকে হত্যা করে সে আশঙ্কায় অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে নিজেই আছেন।

রিনশি এবং সেইশি দুই বেয়াইন আছেন পাশের কক্ষে। সেখানে তারা সুখবরের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখানকার নার্স-চিকিৎসক ও লেডিদের ওপর তাদের আস্থা আছে। সম্রাটমাতা সেনশি সর্ব বিষয়েই একজন পরিপক্ব মানুষ। মুহূর্তে মুহূর্তে খবর নিচ্ছেন। সেখানে ভাই মিচিনাগার উপস্থিতিটা তার কাছে, বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, বাচ্চার কান্না শুনেই তবে আমাদের যাওয়া উচিত, তার আগে নয়। আর পুরোহিত ভান্তেরা গলা ফাটাচ্ছে কেন, মন্ত্রের জোর কি উচ্চশব্দে, না অন্তরের বিশ্বাসে? প্রসূতির বারটা বাজাচ্ছে এরা।

রিনশি সরল সহজ মানুষ। বেয়াইন এবং স্বামীর বড় বোনের কথায় সায় দিলেন বটে, কিন্তু অন্তরে মেয়ের জন্য অন্য কিছু ঘটে চলেছে। ইমন এখানে। তাদের সঙ্গে আছেন তাদের ইচ্ছায়। মাঝে মধ্যে উঠে গিয়ে সংবাদ এনে দিচ্ছেন। এরকম একসময় মুরাসাকির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নিন্না মন্দিরের পুরোহিত, মিয়া দরবারের ভান্তেকে তখন মিচিনাগা পর্দার ভেতরে ডেকেছেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে তাদের ওপর নির্দেশনা জারি করলেন। পর্দার আশপাশে লেডি ডেইগন, কোশোশো, নাইশি, কিমি, মায়েবো ও মোতো এবং সেনজিরা ভয়ে ভয়ে আছেন। কারণ মিচিনাগা ভয়ঙ্কর রকম উত্তেজিত।

ইমন বললেন, তাকাকু কী অবস্থা বল?

তাদের মুখের দিকে দেখুন। এরা সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তাদের এই হাল হলে আমি তো এখনো একজন শিক্ষানবিশ। আমার কাছেও মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ গুরুতর।

ভয় পেয়ো না। সব ব্যবস্থাই আছে।

কিন্তু প্রভু প্রধানমন্ত্রী?

তার তো উত্তেজনা আছেই। ওখানে দেখছি সম্রাজ্ঞীর বোনেরা রয়েছেন।

তাদের ব্যক্তিগত নার্সদের নিয়ে আছেন।

জানি না এদের কাজ কী?

ইমন বললেন, নিশ্চয়ই আছে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সম্রাজ্ঞীর ভ্রাতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাইশো, ফোর্থ রেঙ্কের মেজর জেনারেল মাসামিচি, বাম দেহরক্ষী লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুনি উফুসা তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। মুরাসাকি বললেন, এখানে তাদের কাজ কী? তাদের চাইতে প্রভুর কনিষ্ঠপুত্র এখানে থাকার বেশি যোগ্য।

কেন?

বয়েসের চেয়ে সে অনেক পাকা।

তুমি এ সময়ও হাসালে। মিয়া-নো-তৈয়ুর চোখ ফোলা কেন? সে কি কাঁদছে?

তার মধ্যে একটা অশরীরি অশুভ শক্তিকে বন্দি করা হয়েছে। তিনি সম্রাজ্ঞীর বিকল্প দেখছেন না, সম্রাজ্ঞীরমতো তারও চুল কেটে দেয়া হয়েছে। মুখে লাগানো হয়েছে সম্রাজ্ঞীর মুখোশ। মাথায় সাদা ভাত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

জানতাম মন্ত্রপড়া চালে তাদের ভয়।

আমি বিশ্বাস না করলেও তা ঠিক আছে।

দেখছেন না তার চারদিকে চাল ছিটানো আছে।

আর বের হতে পারবে না অশুভ শক্তি।

যেন তাই হয়। চাপা কণ্ঠে বললেন, মুরাসাকি।

তার জামা কাপড়ের এই হাল কেন?

অপশক্তিরা নিশ্চয়ই জামা কাপড় ছাড়া থাকতে পছন্দ করে।

তাই বলে সকলের সামনে?

হঠাৎ বাচ্চার চিৎকার শোনা গেল। নবজাতকের চিৎকার। ছেলে, না মেয়ে। হুমড়ে পড়লেন মিচিনাগা। ছেলে, প্রিন্স। বলে উল্লাসে চেচিয়ে উঠলেন তিনি। পর্দার বাইরে থেকেও উচ্চকণ্ঠস্বর শোনা গেল। ছুটলেন ইমন এবং মুরাসাকি। না, বাচ্চা দেখার জন্য নয়, রিনশি এবং সেনশিকে জানাবার জন্য। এটা সুসংবাদ। দেখার চাইতে সংবাদ দেয়ায় আনন্দ বেশি।

রিনশি এবং সেনশির কক্ষ থেকে আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে গেল। ইমন এবং মুরাসাকিকে জড়িয়ে ধরলেন দু’জন। এখন সম্রাটের কাছে এ সংবাদ পৌঁছাতে হবে। সম্রাটের দরবারে যাওয়া-আসা আছে এমন একজনকে পাঠানো হলো। ঘরে বাইরে সর্বত্র উৎসবের ঢেউ।

মিচিনাগা নিজে এবার নবজাতকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন। তার প্রথম কাজ হল পুরোহিতদের প্রধানকে ডেকে বলা মন্ত্র ও সূত্র পাঠ বন্ধ হবে না। বন্দি অশুভ আত্মা, বিশেষ করে নবজাতকের দিকে দৃষ্টি দেয়া আত্মাকে বন্দি করা লেডিদের ওপর নজর রাখতে হবে। তাদের চারদিকে চালের চক্কর তৈরি করা আছে। তবে এখানকার অশুভ আত্মা এতটা হিংস্র নয়। লেডিদের কিমোনো ঠিকঠাক আছে।

তারপরও প্রধান পুরোহিত অধিকতর নিরাপত্তার কথা ভেবে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য কিনা বলা শক্ত, অশুভ শক্তি অশুভ শক্তি বলে চেঁচামেচি করলেন। বললেন, এখন নবজাতকের ওপর দৃষ্টি তাদের। এক কাজ করতে হবে। বিকল্প কোনো পুরোহিতকে দায়িত্ব নিতে হবে। তাই সঙ্গে সঙ্গে শিনজু আঝারি কুরোডোর দায়িত্ব এবং চিজো আঝারি লেডি নাইশির দায়িত্ব নিলেন। চিজো পুরোহিত হিসেবে লেডিদের থেকে অশুভ শক্তির ওপর অতিমাত্রায় ক্ষমতাশালী। সম্ভবত এসব আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখা ছিল।

মুরাসাকির মনে প্রশ্ন জাগলো, তার বন্ধু লেডি সাইশোর কী হবে? তার ভাগ্য ভালো। পুরোহিত ইকো তার দায়িত্ব নিলেন। তিনি সম্রাজ্ঞীর স্থলবর্তী। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার পরও তাদের ভয় কাটছে না। প্রধান পুরোহিত এদের সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন সম্রাজ্ঞী এবং নবজাতককে কাবু করতে না পেরে তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু করবে প্রতিশোধপ্রবণ অশুভ আত্মারা।

প্রসবের কাজটা শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। সম্রাজ্ঞীও শান্তিতে আছেন। তার আনন্দ সীমাহীন, প্রিন্সের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বিশ্বজগৎ জয় করবার মতই এক ঘটনা। দীর্ঘদিন সন্তান হচ্ছে না। প্রাসাদ, প্রাসাদের বাইরে কত কথা, কত গঞ্জনা। এক সময় বাবাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, হাজারও চেষ্টা তদ্বির শেষে আজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে এলো। সোনায় সোহাগা।

উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন মিচিনাগা। তাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, তার নাম রাখা হবে যথাসময়ে। এখন থেকে তাকে বলতে হবে ক্রাউন প্রিন্স।

ক্রাউন প্রিন্স! কারো কারো মুখ থেকে বিশ্ময়ভরা প্রতিধ্বনি শোনা গেল। কারণ তারা জানেন সম্প্রতি প্রকাশিত এক দলিলে রেইঝেই পুত্র সানজুকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করা আছে। ক্রাউন প্রিন্সই হন পরবর্তী সম্রাট।

সারারাত জেগে থাকা লেডি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন চলে যাচ্ছেন গোসল ও পোষাক বদলাবার জন্য।

মিচিনাগা এবং তার স্ত্রী রিনশি এত খুশি যে, পুরোহিতদের ঘাম শুকোবার আগেই দক্ষিনা দিতে শুরু করলেন। আজ হিসেবি মিচিনাগাও গুনে পয়সা দিচ্ছেন না। অবিশ্বাস্য রকম অর্থকড়ি লাভ করলেন পুরোহিতবৃন্দ। সংশ্লিষ্ট অন্য সবাইকেও ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত করা হলো অর্থকড়ি দিয়ে।

প্রিন্সের আগমনের কথা শুনে যেন বাড়িতে মানুষের ঢল নামল। সারা হেইয়ানকিয়ো কী হুমড়ি খেয়ে পড়ল? মিচিনাগার নির্দেশে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং প্রথম সচিব ইউরিসদা নতুন যুবরাজের জন্য সম্রাটের দরবার থেকে কারুকাজ খচিত সোনার তারবারি নিয়ে হাজির হলেন। পুরস্কার দেয়ার কাজ শেষ করে মিচিনাগা ছুটে এলেন। যুবরাজকে উদ্দেশ করে তা তুলে দিলেন সম্রাটমাতা সেনশির হাতে। তিনি যে লেডিকে পছন্দ করবেন তার হাতেই তুলে দেবেন যুবরাজের প্রতিরক্ষার এই তরবারি। (ক্রমশ...)