এক বিন্দু ভালোবাসার ছবি

শ্যামলী দাস

হরষিত বালা’র এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য কবিতা-সংকলন প্রেম-ভালোবাসা-পাওয়া-না-পাওয়া, সুখ-দুঃখ-বেদনা এবং ভালোবাসার নানাবিধ আবেগ-অনুভূতিতে আকীর্ণ। এ-কাব্যগ্রন্থের ৫০টি কবিতা নানা উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় উপস্থাপিত হয়েছে। বেশিরভাগ কবিতা আবেগ-শাসিত। তবে কবিতা বিশ্লেষণের আগে কবি সম্পর্কে খানিক বলা জরুরি। হরষিত বালা ’৮০ দশকের কবি। বাংলাদেশি সাহিত্যে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা রয়েছে, কেবল কবি হিসেবে নয়, গদ্যকার ও শিশুতোষ সাহিত্যিক হিসেবেও। তবে কবিতায় তিনি বেশি সচ্ছন্দ। তাঁর কবিতায় দুর্বোধ্যতা একেবারে অনুপস্থিত। সোজা-সাপ্টা কথাগুলোকে তিনি কবিতায় বেঁধেছেন।

এ-বইয়ের নামকরণ পাঠক-ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য নামটি শুনলেই বোঝা যায়, ভালোবাসার নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাসমূহের মূল উপজীব্য। নাম শুনলে যে-কোনো পাঠকেরই আগ্রহ জাগে এ-বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করার। আর প্রবেশ করা মাত্রই একেবারে শুরুর দিকের যে-কবিতা সবার মন কাড়বে তার শিরোনাম ‘কালো মেয়ে।’ এটি আবিষ্কার করা দুরুহ যে কবি কাকে ভেবে এ-কবিতার জন্ম দিয়েছেন। এর শুরুটায় আনন্দ থাকলেও শেষটা ভারী দুঃখের। এতে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার খানিকা এরূপ:

“ভুবন ভোলায় যেমন কালা’র বাঁকা বাঁশির সুর/কালো মেয়ের কালো হাসি হাসে সুমধুর/একটি হাসির উপমা এই একটি হাসির মাঝে/হাজার বীণার সুর যেন এই একটি তারেই বাজে”

কালো মেয়ের হাসির মাঝে কবি ‘হাজার বীণার সুর’ খোঁজে পান। নিশ্চয় তাঁর জীবনের বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে তিনি এ-কবিতাটি লিখেছেন। তবে যে মেয়েকে কেন্দ্র করে তিনি কবিতাটি লিখেছেন তার শেষ পরিণতি কষ্টের। শেষটি পাঠকের জন্য তুলে রাখলাম, বর্ণনা না করে। তারাই আবিষ্কার করবেন কবির মনের ব্যথা।

আবার বারটার ট্রেনে ভিড় হবে মনের মধ্যে এক অজানা অনুভূতির জন্ম দেয়। প্রথম পড়ায় মনে হবে যেন দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথন, কিন্তু আসলে কি তাই? এমন প্রশ্ন যে কারও মনেই আসতে পারে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ কবিতার চিত্রকল্প মনকাড়া।

“বারোটার ট্রেনে ভিড় হবে/ওতে যাব না আমরা...সবাই কি রোজ রোজ ঘরে ফেরে (?) ...এ’ ট্রেনে/ তোমাকে নিয়ে ওঠা যাবে না/অমর বাদুড় ঝুলে তুমি যাবে কী করে! ...বারোটার ট্রেনের জন্য মহড়া দিতে হবে অনেক আগে থেকেই.../উঠবে তো ওঠো/এ ট্রেনে আমি চাপবই/এক নিঃশ^াসে পৌঁছবই শহরে”

কবিতাটি এক ধরনের স্বস্তি আমাদের দেয়, যা অনেকাংশেই ব্যাখ্যাতীত। অন্যদিকে, ‘বর্ষ নামে’ কবিতায় কবির ভালোবাসা ও নতুন বছরের বারতা প্রকাশ পেয়েছে। নতুন বছরকে যেভাবে কবি ব্যাখ্যা করেছেন তা এককথায় অসামান্য।

এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য নামটি শুনলেই বোঝা যায়, ভালোবাসার নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাসমূহের মূল উপজীব্য। নাম শুনলে যে-কোনো পাঠকেরই আগ্রহ জাগে এ-বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করার। আর প্রবেশ করা মাত্রই একেবারে শুরুর দিকের যে-কবিতা সবার মন কাড়বে তার শিরোনাম ‘কালো মেয়ে।’ এটি আবিষ্কার করা দুরূহ যে কবি কাকে ভেবে এ-কবিতার জন্ম দিয়েছেন

“মাঝে-মধ্যে সময়ের পদস্খলন হয়/বর্ষ নামে হঠাৎ দেখা প্রেমের মতো/আর বৈশাখী মেলায় বাড়ে/ তোমাকে খোঁজার ব্যস্ততা/তুমি তো জানো/গতদিন ঝোড়া হাওয়া ছিল /বাগানের বিধ্বস্ত পাতা আর/ধর্ষিতা রমণীর মতো ঝরা পাপড়ি ছাড়া/কিছুই ছিল না হাতের কাছাকাছি পাঠাবার।”

এ-কবিতায় কবি বৈশাখকে প্রেমিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ তুলনায় এক নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। আবার, ‘তোমার জন্য অনামিকা’ কবিতায় দেখা যায়, কবি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাতৃভাষা বাংলার কথা বলছেন এক অপূর্ব গল্পচ্ছলে। তিনি লেখেন, “রমনার বটমূল থেকে বকুলতলা পর্যন্ত সর্বত্র/আজ তোমাকেই দেখেছি, আর ভেবেছি-/তুমিই পারবে এসব শেখাতে।”

একইভাবে তুমি বল্লে, তাই কবিতায় হরষিত বালা একজন কবির অসহায়ত্ব তুলে এনেছেন। দেখিয়েছেন প্রেমিকার কাছে একজন সৃষ্টিশীল মানুষও কোনো কোনো সময় তুচ্ছ। নি¤েœাক্ত লাইনগুলো তারই প্রমাণ বহন করে:

“একবার রবীন্দ্রনাথের চারটি লাইন চুরি করে/তোমাকে দেখালাম/তুমি না-তাকিয়েই বললে: ফালতু; কী ছাইভস্ম লেখো!/আর একবার লেখা কয়টি পঙ্ক্তি/রবি ঠাকুরের বলে চালিয়ে দিলাম-/তুমি লাফিয়ে উঠলে: চমৎকার! গুরুদেবের লেখা/ দেখেই চেনা যায়।”

এসবের ব্যাখ্যা দেয়ার খুব একটা প্রয়োজন বোধ করি না। সচেতন পাঠকমাত্রেরই বুঝতে অসুবিধা হবে না কী বোঝেতে চেয়েছেন কবি উপর্যুক্ত পঙ্ক্তি দ¦ারা।

হরষিত বালা সত্যিকার অর্থেই মানবমনের নানা অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন তাঁর কবিতা সংকলনে। এসব কবিতা মানুষকে হাসাবে, কাঁদাবে, আবার আনন্দ দিবে। সবশেষে, কবির আদর্শের জায়গাটি কেমন তা তাঁরই লেখা ‘পরিচয়’ কবিতার কয়েক ছত্র উল্লেখ করে বোঝানোর চেষ্টা করব।

“পরিচয় তুমি চেয়েছ বন্ধু-হিন্দু, না মুসলিম;/ইহুদী-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান/তারচেয়ে বড়, তারও চেয়ে মহান/ সে মানবসন্তান।”

এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য, হরষিত বালা, অতনু প্রকাশনী, ২০১৭।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২ , ১৩ মাঘ ১৪২৮, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

এক বিন্দু ভালোবাসার ছবি

শ্যামলী দাস

image

হরষিত বালা’র এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য কবিতা-সংকলন প্রেম-ভালোবাসা-পাওয়া-না-পাওয়া, সুখ-দুঃখ-বেদনা এবং ভালোবাসার নানাবিধ আবেগ-অনুভূতিতে আকীর্ণ। এ-কাব্যগ্রন্থের ৫০টি কবিতা নানা উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় উপস্থাপিত হয়েছে। বেশিরভাগ কবিতা আবেগ-শাসিত। তবে কবিতা বিশ্লেষণের আগে কবি সম্পর্কে খানিক বলা জরুরি। হরষিত বালা ’৮০ দশকের কবি। বাংলাদেশি সাহিত্যে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা রয়েছে, কেবল কবি হিসেবে নয়, গদ্যকার ও শিশুতোষ সাহিত্যিক হিসেবেও। তবে কবিতায় তিনি বেশি সচ্ছন্দ। তাঁর কবিতায় দুর্বোধ্যতা একেবারে অনুপস্থিত। সোজা-সাপ্টা কথাগুলোকে তিনি কবিতায় বেঁধেছেন।

এ-বইয়ের নামকরণ পাঠক-ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য নামটি শুনলেই বোঝা যায়, ভালোবাসার নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাসমূহের মূল উপজীব্য। নাম শুনলে যে-কোনো পাঠকেরই আগ্রহ জাগে এ-বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করার। আর প্রবেশ করা মাত্রই একেবারে শুরুর দিকের যে-কবিতা সবার মন কাড়বে তার শিরোনাম ‘কালো মেয়ে।’ এটি আবিষ্কার করা দুরুহ যে কবি কাকে ভেবে এ-কবিতার জন্ম দিয়েছেন। এর শুরুটায় আনন্দ থাকলেও শেষটা ভারী দুঃখের। এতে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার খানিকা এরূপ:

“ভুবন ভোলায় যেমন কালা’র বাঁকা বাঁশির সুর/কালো মেয়ের কালো হাসি হাসে সুমধুর/একটি হাসির উপমা এই একটি হাসির মাঝে/হাজার বীণার সুর যেন এই একটি তারেই বাজে”

কালো মেয়ের হাসির মাঝে কবি ‘হাজার বীণার সুর’ খোঁজে পান। নিশ্চয় তাঁর জীবনের বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে তিনি এ-কবিতাটি লিখেছেন। তবে যে মেয়েকে কেন্দ্র করে তিনি কবিতাটি লিখেছেন তার শেষ পরিণতি কষ্টের। শেষটি পাঠকের জন্য তুলে রাখলাম, বর্ণনা না করে। তারাই আবিষ্কার করবেন কবির মনের ব্যথা।

আবার বারটার ট্রেনে ভিড় হবে মনের মধ্যে এক অজানা অনুভূতির জন্ম দেয়। প্রথম পড়ায় মনে হবে যেন দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথন, কিন্তু আসলে কি তাই? এমন প্রশ্ন যে কারও মনেই আসতে পারে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ কবিতার চিত্রকল্প মনকাড়া।

“বারোটার ট্রেনে ভিড় হবে/ওতে যাব না আমরা...সবাই কি রোজ রোজ ঘরে ফেরে (?) ...এ’ ট্রেনে/ তোমাকে নিয়ে ওঠা যাবে না/অমর বাদুড় ঝুলে তুমি যাবে কী করে! ...বারোটার ট্রেনের জন্য মহড়া দিতে হবে অনেক আগে থেকেই.../উঠবে তো ওঠো/এ ট্রেনে আমি চাপবই/এক নিঃশ^াসে পৌঁছবই শহরে”

কবিতাটি এক ধরনের স্বস্তি আমাদের দেয়, যা অনেকাংশেই ব্যাখ্যাতীত। অন্যদিকে, ‘বর্ষ নামে’ কবিতায় কবির ভালোবাসা ও নতুন বছরের বারতা প্রকাশ পেয়েছে। নতুন বছরকে যেভাবে কবি ব্যাখ্যা করেছেন তা এককথায় অসামান্য।

এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য নামটি শুনলেই বোঝা যায়, ভালোবাসার নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাসমূহের মূল উপজীব্য। নাম শুনলে যে-কোনো পাঠকেরই আগ্রহ জাগে এ-বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করার। আর প্রবেশ করা মাত্রই একেবারে শুরুর দিকের যে-কবিতা সবার মন কাড়বে তার শিরোনাম ‘কালো মেয়ে।’ এটি আবিষ্কার করা দুরূহ যে কবি কাকে ভেবে এ-কবিতার জন্ম দিয়েছেন

“মাঝে-মধ্যে সময়ের পদস্খলন হয়/বর্ষ নামে হঠাৎ দেখা প্রেমের মতো/আর বৈশাখী মেলায় বাড়ে/ তোমাকে খোঁজার ব্যস্ততা/তুমি তো জানো/গতদিন ঝোড়া হাওয়া ছিল /বাগানের বিধ্বস্ত পাতা আর/ধর্ষিতা রমণীর মতো ঝরা পাপড়ি ছাড়া/কিছুই ছিল না হাতের কাছাকাছি পাঠাবার।”

এ-কবিতায় কবি বৈশাখকে প্রেমিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ তুলনায় এক নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। আবার, ‘তোমার জন্য অনামিকা’ কবিতায় দেখা যায়, কবি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাতৃভাষা বাংলার কথা বলছেন এক অপূর্ব গল্পচ্ছলে। তিনি লেখেন, “রমনার বটমূল থেকে বকুলতলা পর্যন্ত সর্বত্র/আজ তোমাকেই দেখেছি, আর ভেবেছি-/তুমিই পারবে এসব শেখাতে।”

একইভাবে তুমি বল্লে, তাই কবিতায় হরষিত বালা একজন কবির অসহায়ত্ব তুলে এনেছেন। দেখিয়েছেন প্রেমিকার কাছে একজন সৃষ্টিশীল মানুষও কোনো কোনো সময় তুচ্ছ। নি¤েœাক্ত লাইনগুলো তারই প্রমাণ বহন করে:

“একবার রবীন্দ্রনাথের চারটি লাইন চুরি করে/তোমাকে দেখালাম/তুমি না-তাকিয়েই বললে: ফালতু; কী ছাইভস্ম লেখো!/আর একবার লেখা কয়টি পঙ্ক্তি/রবি ঠাকুরের বলে চালিয়ে দিলাম-/তুমি লাফিয়ে উঠলে: চমৎকার! গুরুদেবের লেখা/ দেখেই চেনা যায়।”

এসবের ব্যাখ্যা দেয়ার খুব একটা প্রয়োজন বোধ করি না। সচেতন পাঠকমাত্রেরই বুঝতে অসুবিধা হবে না কী বোঝেতে চেয়েছেন কবি উপর্যুক্ত পঙ্ক্তি দ¦ারা।

হরষিত বালা সত্যিকার অর্থেই মানবমনের নানা অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন তাঁর কবিতা সংকলনে। এসব কবিতা মানুষকে হাসাবে, কাঁদাবে, আবার আনন্দ দিবে। সবশেষে, কবির আদর্শের জায়গাটি কেমন তা তাঁরই লেখা ‘পরিচয়’ কবিতার কয়েক ছত্র উল্লেখ করে বোঝানোর চেষ্টা করব।

“পরিচয় তুমি চেয়েছ বন্ধু-হিন্দু, না মুসলিম;/ইহুদী-জৈন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান/তারচেয়ে বড়, তারও চেয়ে মহান/ সে মানবসন্তান।”

এক ফোঁটা ভালবাসার জন্য, হরষিত বালা, অতনু প্রকাশনী, ২০১৭।