শীতের শেষপ্রান্তে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

ফরিদপুরের যশ খেজুরের রস। খেজুরের রস ফরিদপুরের ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে গাছিরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বসে নেই কোন গাছি। প্রকৃতিতে শীতের আগমনের বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতে ব্যস্ত হযে পড়ছেন গাছিরা। ফরিদপুরের অনেক বিখ্যাত জিনিসের মধ্যে খেজুরের রস ও গুড় একটি।

খেজুরের রস নিয়ে অনেক মজার খাবারের গল্প রয়েছে। অনেকে খেজুর রস নিয়ে বলে থাকে, খেজুরের রস দিয়ে স্বাধের পায়েস রেধে খাবো, সাঁঝে, গাছ কেটে রস নিয়ে হাড়িতে, সকাল সন্ধ্যা নিয়ে আসব বাড়িতে, বউ বসে আছে চুলার পাড়ে, পায়েস রাঁধিতে। ইত্যাদি গান প্রচার রয়েছে। জেলার মধ্যে অনেক কিছুই বিলুপ্ত হলে ও খেজুরের রস আজও আছে অবিকল। এখনো স্বাধে-ঘ্রাণে প্রাণ জুড়ায়। দিন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হলে খেজুরের রস এর যশের পরিবর্তন হয়নি। এখনও একই অবস্থায় আছে খেজুরের রস সংগ্রহের পর পাটালি গুড় তৈরির পদ্ধতি। শীতের বার্তায় গাছিদের গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য প্রাথমিকভাবে গাছ প্রস্তুত করা। প্রস্তুতির প্রথম গাছ ঝোঁড়া (যা গাছের ডাই্গ ছাড়ানো) এরপর গাছের ঝোঁড়া অংশ খেকে চেঁছে বাকল তুলে ফেলা। তার পর রস সংগ্রহের উপক্রম করা। এরপর দুই-একদিন পর ভাল মতো চেঁছে রস বের করা। গাছের যেখানে ডালা তুলে ফেলা হয়েছে সেখানে একটু গভীর করে চাঁছ দিলেই রস বেরিয়ে আসবে। এরপর প্রতি ২-১ দিন পর-পর গাছ কেটে মাটির মাটির হাড়ি গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে রাখলেই রস পাওয়া যাবে। যদিও রস হাড়িতে পড়ার জন্যে বাঁশের চটি দিয়ে নল বানাতে হয় যে নল গাছের কাটা জায়গায় ঢুকিয়ে দিলে ওই নল বেঁয়ে চুইয়ে-চুইয়ে রস হাড়ির মধ্যে পড়বে। গাছের ডালার সঙ্গে একটা রশি ঝুলিয়ে দিয়ে হাঁড়িটা বেঁধে রাখলে অনায়াশেই হাঁড়িতে রস পড়ে ভরে যায় আর প্রভাতের পরে গাছ থেকে নামিয়ে আনতে হয়। সেই রস চুলায় জালিয়ে মাটির তৈরি সাজে ঢেলে পাটালি গুড় তৈরি করতে হয়।

জেলার ভাষানচরের, ইউনুছ, আলমগীর রকিব,মহরঅলি,ডিগ্রীরচরের সাহেব আলিসহ একাধিক গাছিরা জানান,অনেক আগে তেকেই গুড় বানিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। প্রাকৃতিক ঐতিহ্য মধুবৃক্ষ থেকে মধুর রস দিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হচ্ছে গুড়-পাটালির তৈরির উৎসব। খেজুর গাছ সাধারণত বাড়ির উঠান, রাস্তার পাশ, মাঠ-ঘাট, পুকুরপাড়, ক্ষেতের আইল, বাড়ির আশপাশে অযত্নে-অবহেলায় বেড়ে উঠে খেজুর গাছ। এই গাছ সাধারণত রোপণ করতে হয় না। সাধারণভাবে খেজুরের দানা কোথাও পড়লে সেখানেই গাছ জন্মায়। এই গাছের জন্যে সার-ওষুধ-পানি ইত্যাদি দিতে হয় না।

যত্ন না করেই খেজুর গাছ বড় হয়ে হয়ে উঠে। তবে একটু খেয়াল করে,পরিকল্পিতভাবে সারিবদ্ধভাবে লাগালেই ফসল হিসেবে উপার্জনের অন্যতম দিক হতে পারে গৃহস্থের। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেছে কোন অঞ্চলে, কোথাও আবার গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়ে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি নিয়ে গাছিরা ব্যাস্ত সময় পার করছে। বিষ্ণুপুরের ফজর আলি বলেন, রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করে, গুড় তৈরি করে বিক্রি শুরু করেছি আগ থেকেই, এখন বাজারে ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে, তবে বাজারে চিনি মিশ্রিত গুড়ের কারণে ভাল গুড় হলেও ক্রেতারা সন্দেহ করে থাকে, যার কারণে পরিচিতদের গুড় ভাল দামেই বিক্রি হয়।

গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পাটালি তৈরি করতে আগের চেয়ে খরচ একটু বেশি পড়ায় লাভের পরিমাণ একটু কমে গেছে। তবে বাজারে আসল গুড়ের দাম বেশি। বর্তমানে দেশে খেজুর গাছ আনেক কমে গেছে, খেজুর গাছ বাড়াতে নতুন করে রোপণ করতে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। পাশাপাশি আরবীয় খেজুরের চারা ও বিভিন্ন নার্সারিতে তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানায় কৃষি অফিস। আরও জানায় খেজুর গাছ জ্বালানি হিসেবে ইট ভাটায় বন্ধ করা না হলে, হয়ত আগামীতে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। এক সময় হয়ত খেজুর গাছ নামে কোন বৃক্ষই থাকবে না।

শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২২ , ১৪ মাঘ ১৪২৮, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

শীতের শেষপ্রান্তে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

প্রতিনিধি, সদরপুর (ফরিদপুর)

image

গাছে হাঁড়ি বাঁধছেন গাছি। ছবিটি ফরিদপুরের পুকুরিয়া গ্রাম থেকে তোলা -সংবাদ

ফরিদপুরের যশ খেজুরের রস। খেজুরের রস ফরিদপুরের ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে গাছিরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বসে নেই কোন গাছি। প্রকৃতিতে শীতের আগমনের বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতে ব্যস্ত হযে পড়ছেন গাছিরা। ফরিদপুরের অনেক বিখ্যাত জিনিসের মধ্যে খেজুরের রস ও গুড় একটি।

খেজুরের রস নিয়ে অনেক মজার খাবারের গল্প রয়েছে। অনেকে খেজুর রস নিয়ে বলে থাকে, খেজুরের রস দিয়ে স্বাধের পায়েস রেধে খাবো, সাঁঝে, গাছ কেটে রস নিয়ে হাড়িতে, সকাল সন্ধ্যা নিয়ে আসব বাড়িতে, বউ বসে আছে চুলার পাড়ে, পায়েস রাঁধিতে। ইত্যাদি গান প্রচার রয়েছে। জেলার মধ্যে অনেক কিছুই বিলুপ্ত হলে ও খেজুরের রস আজও আছে অবিকল। এখনো স্বাধে-ঘ্রাণে প্রাণ জুড়ায়। দিন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হলে খেজুরের রস এর যশের পরিবর্তন হয়নি। এখনও একই অবস্থায় আছে খেজুরের রস সংগ্রহের পর পাটালি গুড় তৈরির পদ্ধতি। শীতের বার্তায় গাছিদের গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য প্রাথমিকভাবে গাছ প্রস্তুত করা। প্রস্তুতির প্রথম গাছ ঝোঁড়া (যা গাছের ডাই্গ ছাড়ানো) এরপর গাছের ঝোঁড়া অংশ খেকে চেঁছে বাকল তুলে ফেলা। তার পর রস সংগ্রহের উপক্রম করা। এরপর দুই-একদিন পর ভাল মতো চেঁছে রস বের করা। গাছের যেখানে ডালা তুলে ফেলা হয়েছে সেখানে একটু গভীর করে চাঁছ দিলেই রস বেরিয়ে আসবে। এরপর প্রতি ২-১ দিন পর-পর গাছ কেটে মাটির মাটির হাড়ি গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে রাখলেই রস পাওয়া যাবে। যদিও রস হাড়িতে পড়ার জন্যে বাঁশের চটি দিয়ে নল বানাতে হয় যে নল গাছের কাটা জায়গায় ঢুকিয়ে দিলে ওই নল বেঁয়ে চুইয়ে-চুইয়ে রস হাড়ির মধ্যে পড়বে। গাছের ডালার সঙ্গে একটা রশি ঝুলিয়ে দিয়ে হাঁড়িটা বেঁধে রাখলে অনায়াশেই হাঁড়িতে রস পড়ে ভরে যায় আর প্রভাতের পরে গাছ থেকে নামিয়ে আনতে হয়। সেই রস চুলায় জালিয়ে মাটির তৈরি সাজে ঢেলে পাটালি গুড় তৈরি করতে হয়।

জেলার ভাষানচরের, ইউনুছ, আলমগীর রকিব,মহরঅলি,ডিগ্রীরচরের সাহেব আলিসহ একাধিক গাছিরা জানান,অনেক আগে তেকেই গুড় বানিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। প্রাকৃতিক ঐতিহ্য মধুবৃক্ষ থেকে মধুর রস দিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হচ্ছে গুড়-পাটালির তৈরির উৎসব। খেজুর গাছ সাধারণত বাড়ির উঠান, রাস্তার পাশ, মাঠ-ঘাট, পুকুরপাড়, ক্ষেতের আইল, বাড়ির আশপাশে অযত্নে-অবহেলায় বেড়ে উঠে খেজুর গাছ। এই গাছ সাধারণত রোপণ করতে হয় না। সাধারণভাবে খেজুরের দানা কোথাও পড়লে সেখানেই গাছ জন্মায়। এই গাছের জন্যে সার-ওষুধ-পানি ইত্যাদি দিতে হয় না।

যত্ন না করেই খেজুর গাছ বড় হয়ে হয়ে উঠে। তবে একটু খেয়াল করে,পরিকল্পিতভাবে সারিবদ্ধভাবে লাগালেই ফসল হিসেবে উপার্জনের অন্যতম দিক হতে পারে গৃহস্থের। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেছে কোন অঞ্চলে, কোথাও আবার গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়ে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি নিয়ে গাছিরা ব্যাস্ত সময় পার করছে। বিষ্ণুপুরের ফজর আলি বলেন, রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করে, গুড় তৈরি করে বিক্রি শুরু করেছি আগ থেকেই, এখন বাজারে ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে, তবে বাজারে চিনি মিশ্রিত গুড়ের কারণে ভাল গুড় হলেও ক্রেতারা সন্দেহ করে থাকে, যার কারণে পরিচিতদের গুড় ভাল দামেই বিক্রি হয়।

গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পাটালি তৈরি করতে আগের চেয়ে খরচ একটু বেশি পড়ায় লাভের পরিমাণ একটু কমে গেছে। তবে বাজারে আসল গুড়ের দাম বেশি। বর্তমানে দেশে খেজুর গাছ আনেক কমে গেছে, খেজুর গাছ বাড়াতে নতুন করে রোপণ করতে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। পাশাপাশি আরবীয় খেজুরের চারা ও বিভিন্ন নার্সারিতে তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানায় কৃষি অফিস। আরও জানায় খেজুর গাছ জ্বালানি হিসেবে ইট ভাটায় বন্ধ করা না হলে, হয়ত আগামীতে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। এক সময় হয়ত খেজুর গাছ নামে কোন বৃক্ষই থাকবে না।