‘নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন’ সংস্কৃতির পথ ধরে এগোতে হবে

শেখর ভট্টাচার্য

গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং সেলিনা হায়াত আইভীর বিজয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সারাদেশব্যাপী। কী এমন জাদুর কাঠি আছে সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে- যে কারণে তাকে জনগণ বারবার নির্বাচিত করে? এ প্রশ্নের উত্তর নানাভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, গবেষক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞসহ সব শ্রেণীর মানুষ। রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ একটি। নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম একটি নদীবন্দর ও বাণিজ্যিক মহানগর। ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর নারায়ণগঞ্জ ছিল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পনগরী এবং তারও আগে অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রধান নদীবন্দর। ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ নামে একদা খ্যাত এ নগরী ছিল দেশের পাটকল ও পাট-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কালক্রমে পাটশিল্পের অবক্ষয় হলেও আবার পোশাকশিল্পে নারায়ণগঞ্জ এখন পুনরুজ্জীবিত। ১৮৭৬ সালে নারায়ণগঞ্জে পৌরসভা শুরু হয় এবং ২০১১ সালে পুরনো নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল পৌরসভাকে এক করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা দেশের সপ্তম সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক কোথায়? এ বিষয়টি এবারের নির্বাচনের পূর্ব ও নির্বাচন উত্তর প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রচার-প্রচারণা, জনসভায় দেয়া ভাষণ পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দুইজন। একজন আওয়ামী লীগ মনোনীত সেলিনা হাসান আইভী এবং অন্যজন বিএনপির সাবেক শীর্ষ নেতা তৈমূর আলম খন্দকার; যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন বিএনপির ভোট ব্যাংককে ভিত্তি করে। কৌশলগত কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও বিএনপি সমর্থক এবং স্থানীয়ভাবে দলের সদস্যরা তার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন।

নির্বাচনপূর্ব প্রচারণার উত্তাপ ছিল যথেষ্ট; কিন্তু কোথাও কোন নির্বাচনী জনসভায় প্রধান দুই প্রার্থীকে সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করতে দেখা যায়নি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকার কন্যা সেলিনা হায়াত আইভী। আইভীর পিতা ছিলেন অত্যন্ত গণমুখী এবং জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা। নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতা হিসেবেও তার ব্যাপক পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আইভী তার রাজনীতিবিদ পিতার মতোই গণমুখী। জনগণের শক্তির ওপর তার আস্থা আমরা ২০১১ সালে যখন তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন, তখন থেকেই আমরা লক্ষ্য করছি। আইভী যেরকম জনসমর্থনের ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন একইভাবে তৈমূর আলম খন্দকারও জনসমর্থনের বাইরে অন্যকোন চিন্তা করতে পারেননি। এ কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনপূর্ব প্রচারণায় এক অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ গড়ে ওঠে।

সংঘাত পরিহার করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সেলিনা হায়াত আইভীকে ফুল মার্কস দেয়া যায়। কারণ সন্ত্রাস প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি থেকেই তার রাজনীতি এবং নির্বাচনের মাঠে উত্থান ঘটে। আইভী এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিষয়টি সমার্থক হয়ে পড়ে ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় থেকে। ২০১১ সালে আওয়ামী ঘরানার এই রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতি দেন নির্বাচিত হলে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাস মুক্ত করবেন। নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট একেএম শামীম ওসমানকে এক লাখেরও বেশি ভোটে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম হন। ২০১১ সালে এ জয়ের মধ্য দিয়েই সেলিনা হায়াত আইভী বাংলাদেশের কোন সিটি করপোরেশনে প্রথম নারী মেয়র হিসেবে শপথ নিতে সমর্থ হন।

নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের সন্ত্রাসের প্রতি ভীতি আছে এবং এ ভীতি দূর করার জন্য ২০১১ সাল থেকে আইভী প্রচেষ্টা শুরু করেছেন; তার সৎ প্রচেষ্টাকে সম্মান করে আইভীর বিকল্প ভাবতে পারেন না নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা। নারায়ণগঞ্জের মানুষ যখন সহিংসতা, সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত ছিল, তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহস করে কথা বলার মতো কোন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। আইভী এরকম সময়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কেন্দ্রিক যে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ছিল আইভীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে তা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে এসেছে। এ কারণে আইভী তার একটি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন।

স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনংশগগ্রহণ হচ্ছে সুশাসনের প্রধান তিনটি স্তম্ভ। সেলিনা হায়াত আইভী তার সময়কালে স্বচ্ছতার পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন জনগণের কাছে। তৃণমূলের মানুষের সাথে তার আন্তরিক সম্পর্ক, তাকে বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের থেকে ভিন্ন মূল্যবোধের মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তার আচরণ, সাধারণ মানুষের পক্ষে শেষপর্যন্ত অবস্থান, সিটি করপোরেশনের কর্মকান্ড সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের অভিহিত করার প্রক্রিয়া তাকে সাধারণ ভোটারের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। মেয়র হিসেবে আইভী ২০১১ সাল থেকে জনগণের কাছেই জবাবদিহি করে এসেছেন এবং এই জবাবদিহিতার ফল তিনি গত নির্বাচনে ভোটারদের কাছ থেকে ফেরত পেয়েছেন।

আইভীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকার আইভীর পিতার সমসাময়িক রাজনীতিবিদ। নির্বাচনপূর্ব সময়ে আমরা পরস্পরের নির্বাচনী সভায় অনেক উত্তাপ দেখেছি কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ দেখিনি। নির্বাচনপরবর্তী সময়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখেছি। সেলিনা হায়াত আইভীকে আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেলাম প্রতিদ্বনন্দ্বীর বাড়িতে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মিষ্টিমুখ করাতে। আইভী তার তৈমূর ‘কাকাকে’ মিষ্টি মুখ করান। তৈমূরও তার ‘ভাতিজি’ আইভীকে মিষ্টিমুখ করান, মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন। তৈমূর আলম খন্দকার নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন- ‘আইভীর বাবা আলী আহম্মদ চুনকার সঙ্গে আমার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক কখনো নষ্ট হবে না। আপনারা সবাই আইভীকে সহযোগিতা করবেন। আমার শ্রদ্ধা আলী আহম্মদ চুনকার জন্য আজীবন থাকবে। তার মেয়ে আইভীর পাশে সব বিপদ-আপদে আছি ও থাকব। অদৃশ্য শক্তির মতো পাশে থাকব।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এরকম পরিবেশই কাম্য। অনেকেই আইভীর এ সৌজন্যকে রাজনীতির ‘স্টান্টবাজি’ হিসেবে প্রচার করছেন; তবে আইভীর এ সৌজন্য সাক্ষাৎ তার অতীত রাজনীতির ইতিহাসের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেলিনা হায়াত আইভীকে আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যতটুকু সোচ্চার দেখেছি, নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য যতটুকু বেপরোয়া দেখেছি- রাজনীতির শিষ্টাচার প্রদর্শনে তাকে আমরা অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে লক্ষ্য করেছি।

২০১১ সালের পর থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের রায়ই চূড়ান্ত যে কথাটি আমরা সব সময় বলে থাকি কিন্তু নির্বাচনকালীন তার প্রয়োগে ভিন্নপথ অবলম্বন করার চেষ্টা করি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় অন্তত এ সংস্কৃতিটি গড়ে উঠছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এ সংস্কৃতির প্রতি যতই বিশ্বাস বাড়বে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিও তত মজবুত হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন আইভী, নারায়ণগঞ্জে সক্রিয় রাজনৈতিক দল এবং নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজ। নারায়ণগঞ্জে নিরপেক্ষ ভোটের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং এর একটি ভালো কাঠামো পেয়েছে, এর প্রমাণ আমরা ২০১১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে পেয়ে আসছি; যার ফলশ্রুতিতে এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শান্তি ভঙ্গের, বিধি ভঙ্গের অভিযোগ বড়ভাবে করেননি। সব পক্ষই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন চেয়েছে। এছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোটারদের মনস্তত্ত্বও শক্তভাবে গড়ে ওঠেছে। সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জে যে পরিবেশ গড়ে ওঠেছে, সেটিও হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। এজন্য সব চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন সেলিনা হায়াত আইভী।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনের যে উজ্জীবিত ও পরিশুদ্ধ মডেল তৈরি হলো, সেই মডেলকে আমাদের সযত্নে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেকেই ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছেন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে তফাত আছে। জাতীয় নির্বাচনে এ মডেল ব্যবহার সম্ভব নয়। এ সমস্ত নৈরাশ্যবাদী মানুষদের বুঝতে হবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। প্রচারণার মধ্যেও নেই। জাতীয় নির্বাচনে যে সমস্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় স্থানীয় নির্বাচনেও অনুরূপ প্রক্রিয়াই অনুসৃত হয়। প্রশ হলো, আমরা কী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সৃষ্ট সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করব কিনা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা আদর্শগত কোন তর্ক-বিতর্ক দেখতে পাই না। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ঘিরেই সব আলোচনা, সমালোচনা, মতভেদ। এবার সময় এসেছে এ বিষয়ে জাতীয় সংহতি, ঐকমত্য গড়ে তোলার। নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে আমাদের সুন্দর একটি পথ দেখাতে পারে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা শুধুমাত্র প্রত্যাশা করতে পারি, স্বপ্ন দেখতে পারি। আমাদের অপার প্রত্যাশা নারায়ণগঞ্জের সূচিত পথ ধরে আমরা অনেক দূর হেঁটে যেতে সক্ষম হব।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২২ , ১৪ মাঘ ১৪২৮, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৩

‘নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন’ সংস্কৃতির পথ ধরে এগোতে হবে

শেখর ভট্টাচার্য

image

গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং সেলিনা হায়াত আইভীর বিজয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সারাদেশব্যাপী। কী এমন জাদুর কাঠি আছে সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে- যে কারণে তাকে জনগণ বারবার নির্বাচিত করে? এ প্রশ্নের উত্তর নানাভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, গবেষক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞসহ সব শ্রেণীর মানুষ। রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ একটি। নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম একটি নদীবন্দর ও বাণিজ্যিক মহানগর। ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর নারায়ণগঞ্জ ছিল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পনগরী এবং তারও আগে অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রধান নদীবন্দর। ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ নামে একদা খ্যাত এ নগরী ছিল দেশের পাটকল ও পাট-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কালক্রমে পাটশিল্পের অবক্ষয় হলেও আবার পোশাকশিল্পে নারায়ণগঞ্জ এখন পুনরুজ্জীবিত। ১৮৭৬ সালে নারায়ণগঞ্জে পৌরসভা শুরু হয় এবং ২০১১ সালে পুরনো নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল পৌরসভাকে এক করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা দেশের সপ্তম সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক কোথায়? এ বিষয়টি এবারের নির্বাচনের পূর্ব ও নির্বাচন উত্তর প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রচার-প্রচারণা, জনসভায় দেয়া ভাষণ পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দুইজন। একজন আওয়ামী লীগ মনোনীত সেলিনা হাসান আইভী এবং অন্যজন বিএনপির সাবেক শীর্ষ নেতা তৈমূর আলম খন্দকার; যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন বিএনপির ভোট ব্যাংককে ভিত্তি করে। কৌশলগত কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও বিএনপি সমর্থক এবং স্থানীয়ভাবে দলের সদস্যরা তার সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন।

নির্বাচনপূর্ব প্রচারণার উত্তাপ ছিল যথেষ্ট; কিন্তু কোথাও কোন নির্বাচনী জনসভায় প্রধান দুই প্রার্থীকে সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করতে দেখা যায়নি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকার কন্যা সেলিনা হায়াত আইভী। আইভীর পিতা ছিলেন অত্যন্ত গণমুখী এবং জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা। নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতা হিসেবেও তার ব্যাপক পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আইভী তার রাজনীতিবিদ পিতার মতোই গণমুখী। জনগণের শক্তির ওপর তার আস্থা আমরা ২০১১ সালে যখন তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন, তখন থেকেই আমরা লক্ষ্য করছি। আইভী যেরকম জনসমর্থনের ওপর আস্থা রেখে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন একইভাবে তৈমূর আলম খন্দকারও জনসমর্থনের বাইরে অন্যকোন চিন্তা করতে পারেননি। এ কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনপূর্ব প্রচারণায় এক অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ গড়ে ওঠে।

সংঘাত পরিহার করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সেলিনা হায়াত আইভীকে ফুল মার্কস দেয়া যায়। কারণ সন্ত্রাস প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি থেকেই তার রাজনীতি এবং নির্বাচনের মাঠে উত্থান ঘটে। আইভী এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিষয়টি সমার্থক হয়ে পড়ে ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় থেকে। ২০১১ সালে আওয়ামী ঘরানার এই রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতি দেন নির্বাচিত হলে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাস মুক্ত করবেন। নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট একেএম শামীম ওসমানকে এক লাখেরও বেশি ভোটে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম হন। ২০১১ সালে এ জয়ের মধ্য দিয়েই সেলিনা হায়াত আইভী বাংলাদেশের কোন সিটি করপোরেশনে প্রথম নারী মেয়র হিসেবে শপথ নিতে সমর্থ হন।

নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের সন্ত্রাসের প্রতি ভীতি আছে এবং এ ভীতি দূর করার জন্য ২০১১ সাল থেকে আইভী প্রচেষ্টা শুরু করেছেন; তার সৎ প্রচেষ্টাকে সম্মান করে আইভীর বিকল্প ভাবতে পারেন না নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা। নারায়ণগঞ্জের মানুষ যখন সহিংসতা, সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত ছিল, তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাহস করে কথা বলার মতো কোন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। আইভী এরকম সময়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কেন্দ্রিক যে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ছিল আইভীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে তা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে এসেছে। এ কারণে আইভী তার একটি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন।

স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনংশগগ্রহণ হচ্ছে সুশাসনের প্রধান তিনটি স্তম্ভ। সেলিনা হায়াত আইভী তার সময়কালে স্বচ্ছতার পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন জনগণের কাছে। তৃণমূলের মানুষের সাথে তার আন্তরিক সম্পর্ক, তাকে বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের থেকে ভিন্ন মূল্যবোধের মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তার আচরণ, সাধারণ মানুষের পক্ষে শেষপর্যন্ত অবস্থান, সিটি করপোরেশনের কর্মকান্ড সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের অভিহিত করার প্রক্রিয়া তাকে সাধারণ ভোটারের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। মেয়র হিসেবে আইভী ২০১১ সাল থেকে জনগণের কাছেই জবাবদিহি করে এসেছেন এবং এই জবাবদিহিতার ফল তিনি গত নির্বাচনে ভোটারদের কাছ থেকে ফেরত পেয়েছেন।

আইভীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকার আইভীর পিতার সমসাময়িক রাজনীতিবিদ। নির্বাচনপূর্ব সময়ে আমরা পরস্পরের নির্বাচনী সভায় অনেক উত্তাপ দেখেছি কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ দেখিনি। নির্বাচনপরবর্তী সময়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখেছি। সেলিনা হায়াত আইভীকে আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেলাম প্রতিদ্বনন্দ্বীর বাড়িতে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মিষ্টিমুখ করাতে। আইভী তার তৈমূর ‘কাকাকে’ মিষ্টি মুখ করান। তৈমূরও তার ‘ভাতিজি’ আইভীকে মিষ্টিমুখ করান, মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন। তৈমূর আলম খন্দকার নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন- ‘আইভীর বাবা আলী আহম্মদ চুনকার সঙ্গে আমার আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক কখনো নষ্ট হবে না। আপনারা সবাই আইভীকে সহযোগিতা করবেন। আমার শ্রদ্ধা আলী আহম্মদ চুনকার জন্য আজীবন থাকবে। তার মেয়ে আইভীর পাশে সব বিপদ-আপদে আছি ও থাকব। অদৃশ্য শক্তির মতো পাশে থাকব।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এরকম পরিবেশই কাম্য। অনেকেই আইভীর এ সৌজন্যকে রাজনীতির ‘স্টান্টবাজি’ হিসেবে প্রচার করছেন; তবে আইভীর এ সৌজন্য সাক্ষাৎ তার অতীত রাজনীতির ইতিহাসের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেলিনা হায়াত আইভীকে আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যতটুকু সোচ্চার দেখেছি, নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য যতটুকু বেপরোয়া দেখেছি- রাজনীতির শিষ্টাচার প্রদর্শনে তাকে আমরা অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে লক্ষ্য করেছি।

২০১১ সালের পর থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের রায়ই চূড়ান্ত যে কথাটি আমরা সব সময় বলে থাকি কিন্তু নির্বাচনকালীন তার প্রয়োগে ভিন্নপথ অবলম্বন করার চেষ্টা করি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় অন্তত এ সংস্কৃতিটি গড়ে উঠছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এ সংস্কৃতির প্রতি যতই বিশ্বাস বাড়বে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিও তত মজবুত হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন আইভী, নারায়ণগঞ্জে সক্রিয় রাজনৈতিক দল এবং নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজ। নারায়ণগঞ্জে নিরপেক্ষ ভোটের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং এর একটি ভালো কাঠামো পেয়েছে, এর প্রমাণ আমরা ২০১১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে পেয়ে আসছি; যার ফলশ্রুতিতে এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শান্তি ভঙ্গের, বিধি ভঙ্গের অভিযোগ বড়ভাবে করেননি। সব পক্ষই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন চেয়েছে। এছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোটারদের মনস্তত্ত্বও শক্তভাবে গড়ে ওঠেছে। সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জে যে পরিবেশ গড়ে ওঠেছে, সেটিও হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। এজন্য সব চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন সেলিনা হায়াত আইভী।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনের যে উজ্জীবিত ও পরিশুদ্ধ মডেল তৈরি হলো, সেই মডেলকে আমাদের সযত্নে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেকেই ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছেন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে তফাত আছে। জাতীয় নির্বাচনে এ মডেল ব্যবহার সম্ভব নয়। এ সমস্ত নৈরাশ্যবাদী মানুষদের বুঝতে হবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। প্রচারণার মধ্যেও নেই। জাতীয় নির্বাচনে যে সমস্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় স্থানীয় নির্বাচনেও অনুরূপ প্রক্রিয়াই অনুসৃত হয়। প্রশ হলো, আমরা কী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সৃষ্ট সুষ্ঠু প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করব কিনা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা আদর্শগত কোন তর্ক-বিতর্ক দেখতে পাই না। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ঘিরেই সব আলোচনা, সমালোচনা, মতভেদ। এবার সময় এসেছে এ বিষয়ে জাতীয় সংহতি, ঐকমত্য গড়ে তোলার। নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে আমাদের সুন্দর একটি পথ দেখাতে পারে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা শুধুমাত্র প্রত্যাশা করতে পারি, স্বপ্ন দেখতে পারি। আমাদের অপার প্রত্যাশা নারায়ণগঞ্জের সূচিত পথ ধরে আমরা অনেক দূর হেঁটে যেতে সক্ষম হব।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]