নৌদুর্ঘটনা কেন রোধ করা যাচ্ছে না

মর্তুজা হাসান সৈকত

গত ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে রূপসী-৯ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমএল আশরাফ উদ্দিন-২ নামের একটি লঞ্চ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে। এতে লঞ্চটির অন্তত এগারোজন যাত্রী মারা গেছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রুপসী-৯ নামের বিশাল কার্গো জাহাজ একটা ছোট লঞ্চকে পেছন থেকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে আসছে। বিশালাকৃতির জাহাজটির ধাক্কা খেতে খেতে লঞ্চটি যখন ডুবতে শুরু করল- তখন প্রাণ বাঁচাতে ছিটকে পানিতে পড়ছে অসহায় মানুষগুলো। আর একসময় যখন লঞ্চটিও ডুবে গেল তখন ডুবন্ত লঞ্চ আর কিছু ভেসে থাকা মানুষের ওপর দিয়ে বীরদর্পে চলে গেল সেই কার্গো জাহাজটি।

ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে বেঁচে ফেরা যাত্রীরা জানিয়েছেন- ১০ মিনিট ধরে ধাক্কা দিতে দিতে লঞ্চটিকে সামনে নিয়ে গেছে কার্গো জাহাজটি। এ লঞ্চডুবির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের উপ-পরিচালক (নৌ নিট্রা) বাবু লাল বৈদ্য বাদী হয়ে বন্দর থানায় মামলাটি করেন। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসও লঞ্চডুবির এ ঘটনাকে রীতিমতো হত্যাকান্ড আখ্যায়িত করে বলেছেন, যেভাবে এসব মানুষকে মারা হলো, সেই ঘটনায় হত্যা মামলা করে তাদের সাজা দেওয়া সম্ভব হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।

নজিরবিহীন এ লঞ্চডুবি থেকে বেঁচে আসা একজন সহকারী অধ্যাপক জানিয়েছেন- এমএল আশরাফ উদ্দিন নামের লঞ্চের যাত্রী ছিলেন তিনি ও তার স্ত্রী স্কুলশিক্ষক স্ত্রী উম্মে খায়রুন ফাতিমা। মুন্সীগঞ্জ শহরে অবস্থিত প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) থেকে স্ত্রী ফাতিমার সনদ সংগ্রহ করার জন্য তারা দুজন রোববার দুপুরে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ শহরে যাচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে একে-অপরের দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখলেও একপর্যায়ে তার হাত থেকে স্ত্রীর হাত ছুটে যায়। চোখের সামনেই স্ত্রী ফাতিমা পানিতে তলিয়ে গেলেও তাকে বাঁচাতে কোনো সহায়তা করার সুযোগ তিনি পাননি। ভাবা যায় কী মর্মান্তিক ছিল সেই সময়ের ঘটনাগুলো!

সাধারণত ঝড় বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে কিংবা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। এ কারণে ঝড়-বৃষ্টির দিনে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তবে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আরও একটি এমন দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম- নৌযান দুটির চালকের ইচ্ছে থাকলেই যেটি এড়ানো যেত। শীতলক্ষ্যায় এদিন কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। আশরাফ উদ্দিন লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রূপসী-৯ কার্গো জাহাজটি কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই লঞ্চটিকে এসে ধাক্কা দিয়েছে। পেছন থেকে অন্ধ দানবের মতো দ্রুতগতিতে কার্গোটিকে এগিয়ে আসতে দেখে লঞ্চচালককে সাবধান হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু লঞ্চচালকও যাত্রীদের সেই সাবধান বাণীকে কোনো গুরুত্ব দেননি। এই যে কার্গো জাহাজটির চালকের সামনে যাত্রীবোঝাই লঞ্চ দেখেও গতিপথ থেকে সরে না আসা এবং লঞ্চচালকের একগুঁয়েমি- এই দুটোর যোগফলই হলো এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। মানে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই এ দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত।

এদিকে এ লঞ্চডুবির মধ্যেই গণমাধ্যমে খবর এসেছে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি-মাঝিকান্দি নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে অনুমোদনের চেয়ে বেশি আসন বসানো হয়েছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শনে আরও বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। কোনো লঞ্চেই ওপরের ডেকে যাত্রীদের হাতের নাগালে বয়া রাখার ব্যবস্থা নেই। এ লঞ্চগুলোও কাঠামো এবং আকৃতিতে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটে চলাচল করা লঞ্চগুলোর মতোই। আসন্ন ঝড়ের মৌসুমে এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ নকশার লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

লঞ্চডুবির ঘটনা এ দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করার ‘সুযোগ’ পাওয়াসহ লঞ্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কিছুদিন এ নিয়ে হৈ চৈ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু তদন্ত কমিটি কী অনুসন্ধান করে, কী সুপারিশ করে, তা দেশবাসীর কাছে অজানা থেকে যায়। প্রভাবশালী লঞ্চমালিকেরা যেমন তদন্তকাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান, তেমনই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নেও বিভিন্নভাবে বাধা দেন। অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকান্ডের পরও এরকম কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিগুলো কী রিপোর্ট দিয়েছে কিংবা দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা- সেসবের কোনোকিছুই আর সামনে আসেনি।

শীতলক্ষ্যায় এ লঞ্চডুবির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ-চাঁদপুরসহ বিভিন্ন রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। চাঁদপুর নৌবন্দর কর্মকর্তা কায়সারুল ইসলাম বলেন, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী সব কটি লঞ্চে নানা ত্রুটি আছে। কিন্তু কথা হলো ত্রুটি যেহেতু আছে তাহলে এগুলো নিয়ে আগে কেনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো না। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে- নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ কিংবা অন্যান্য রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো মান্ধাতা আমলের এবং ছোট আকারের। কোনোটাতেই নেই পর্যাপ্ত জীবনরক্ষাকারী বয়া বা লাইফ জ্যাকেট। রোববার দুর্ঘটনায় পড়া লঞ্চটিও ৪৯ বছর আগে ১৯৭৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব লঞ্চ এতদিন ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী বহন করেছে বিআইডব্লিউটিআইয়ের নাকের ডগায় বসেই।

যদিও প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়মিত নৌযান পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। তারা নিয়মিতভাবে এগুলোর দেখভাল করলে অনেক দুর্ঘটনাই ঘটতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাদের এখানে বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর কিছুদিন তারা দায়িত্ব পালন করেন তারপর আর কোনো খবর থাকে না। যেমন অভিযান-১০ লঞ্চে দুর্ঘটনার তিন দিন পরে আমি ঢাকা থেকে বরগুনা আসার সময় লঞ্চে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি দেখেছি, কেবিনের ভেতরে আলাদা করে লাইফ জ্যাকেটও পেয়েছি। কিন্তু মাস তিন পার না হতেই সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই এই রুটে চলাচল করা একটি লঞ্চেও। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে বরগুনা আসা এবং যাওয়ার পথে দেখে এসেছি আগের মতোই নিজেদের স্টাইলে চলছে এ রুটের লঞ্চগুলো। লাইফ জ্যাকেটও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কেবিন থেকে। বিআইডব্লিউটিআইয়ের কর্মকর্তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে স্মরণকালের ইতিহাসের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরে এত দ্রুতই আগের মতো গা-ছাড়াভাবে চলতে পারতো না নিশ্চয়ই।

দেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে মূলত অসতর্কতা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? এমএল আশরাফ উদ্দিন-২ লঞ্চটি যেভাবে ডুবে গেলো, তা কোনোভাবেই সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা হত্যাকান্ডের মতোই। নরওয়েজিয়ান সমাজবিজ্ঞানী জোহান গ্যালটাঙ্গের ‘কাঠামোগত সহিংসতার তত্ত্ব’ মানলে এটি স্পষ্টতই একটি কাঠামোগত হত্যা। নৌপথকে নিরাপদ করতে অচিরেই এগুলোর সুরাহা করতে হবে। এজন্য প্রচলিত আইনকে যুগোপযোগী করার সময় এসেছে। ১৯৭৬ সালের একটি সরকারি অধ্যাদেশকে পাঁচ দফায় সংশোধন করার পরও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে পাঁচ বছরের জেল আর মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা! তাই এ অব্যবস্থাপনাজনিত লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে কঠোর শাস্তির বিধান করার পাশাপাশি নৌ-নিরাপত্তা নিয়েও সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। কারণ প্রতি বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু এ কারণেই ঘটছে যে- এসব দুর্ঘটনায় কারও তেমন কোনো শাস্তি হয় না।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শুক্রবার, ০১ এপ্রিল ২০২২ , ১৮ চৈত্র ১৪২৮ ২৮ শাবান ১৪৪৩

নৌদুর্ঘটনা কেন রোধ করা যাচ্ছে না

মর্তুজা হাসান সৈকত

image

গত ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে রূপসী-৯ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এমএল আশরাফ উদ্দিন-২ নামের একটি লঞ্চ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে। এতে লঞ্চটির অন্তত এগারোজন যাত্রী মারা গেছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রুপসী-৯ নামের বিশাল কার্গো জাহাজ একটা ছোট লঞ্চকে পেছন থেকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে আসছে। বিশালাকৃতির জাহাজটির ধাক্কা খেতে খেতে লঞ্চটি যখন ডুবতে শুরু করল- তখন প্রাণ বাঁচাতে ছিটকে পানিতে পড়ছে অসহায় মানুষগুলো। আর একসময় যখন লঞ্চটিও ডুবে গেল তখন ডুবন্ত লঞ্চ আর কিছু ভেসে থাকা মানুষের ওপর দিয়ে বীরদর্পে চলে গেল সেই কার্গো জাহাজটি।

ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে বেঁচে ফেরা যাত্রীরা জানিয়েছেন- ১০ মিনিট ধরে ধাক্কা দিতে দিতে লঞ্চটিকে সামনে নিয়ে গেছে কার্গো জাহাজটি। এ লঞ্চডুবির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের উপ-পরিচালক (নৌ নিট্রা) বাবু লাল বৈদ্য বাদী হয়ে বন্দর থানায় মামলাটি করেন। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসও লঞ্চডুবির এ ঘটনাকে রীতিমতো হত্যাকান্ড আখ্যায়িত করে বলেছেন, যেভাবে এসব মানুষকে মারা হলো, সেই ঘটনায় হত্যা মামলা করে তাদের সাজা দেওয়া সম্ভব হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।

নজিরবিহীন এ লঞ্চডুবি থেকে বেঁচে আসা একজন সহকারী অধ্যাপক জানিয়েছেন- এমএল আশরাফ উদ্দিন নামের লঞ্চের যাত্রী ছিলেন তিনি ও তার স্ত্রী স্কুলশিক্ষক স্ত্রী উম্মে খায়রুন ফাতিমা। মুন্সীগঞ্জ শহরে অবস্থিত প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) থেকে স্ত্রী ফাতিমার সনদ সংগ্রহ করার জন্য তারা দুজন রোববার দুপুরে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ শহরে যাচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে একে-অপরের দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখলেও একপর্যায়ে তার হাত থেকে স্ত্রীর হাত ছুটে যায়। চোখের সামনেই স্ত্রী ফাতিমা পানিতে তলিয়ে গেলেও তাকে বাঁচাতে কোনো সহায়তা করার সুযোগ তিনি পাননি। ভাবা যায় কী মর্মান্তিক ছিল সেই সময়ের ঘটনাগুলো!

সাধারণত ঝড় বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে কিংবা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। এ কারণে ঝড়-বৃষ্টির দিনে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তবে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আরও একটি এমন দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম- নৌযান দুটির চালকের ইচ্ছে থাকলেই যেটি এড়ানো যেত। শীতলক্ষ্যায় এদিন কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। আশরাফ উদ্দিন লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রূপসী-৯ কার্গো জাহাজটি কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই লঞ্চটিকে এসে ধাক্কা দিয়েছে। পেছন থেকে অন্ধ দানবের মতো দ্রুতগতিতে কার্গোটিকে এগিয়ে আসতে দেখে লঞ্চচালককে সাবধান হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু লঞ্চচালকও যাত্রীদের সেই সাবধান বাণীকে কোনো গুরুত্ব দেননি। এই যে কার্গো জাহাজটির চালকের সামনে যাত্রীবোঝাই লঞ্চ দেখেও গতিপথ থেকে সরে না আসা এবং লঞ্চচালকের একগুঁয়েমি- এই দুটোর যোগফলই হলো এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। মানে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই এ দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত।

এদিকে এ লঞ্চডুবির মধ্যেই গণমাধ্যমে খবর এসেছে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি-মাঝিকান্দি নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোতে অনুমোদনের চেয়ে বেশি আসন বসানো হয়েছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শনে আরও বেশ কিছু ত্রুটি ধরা পড়েছে। কোনো লঞ্চেই ওপরের ডেকে যাত্রীদের হাতের নাগালে বয়া রাখার ব্যবস্থা নেই। এ লঞ্চগুলোও কাঠামো এবং আকৃতিতে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটে চলাচল করা লঞ্চগুলোর মতোই। আসন্ন ঝড়ের মৌসুমে এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ নকশার লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

লঞ্চডুবির ঘটনা এ দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করার ‘সুযোগ’ পাওয়াসহ লঞ্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কিছুদিন এ নিয়ে হৈ চৈ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু তদন্ত কমিটি কী অনুসন্ধান করে, কী সুপারিশ করে, তা দেশবাসীর কাছে অজানা থেকে যায়। প্রভাবশালী লঞ্চমালিকেরা যেমন তদন্তকাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান, তেমনই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নেও বিভিন্নভাবে বাধা দেন। অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকান্ডের পরও এরকম কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিগুলো কী রিপোর্ট দিয়েছে কিংবা দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা- সেসবের কোনোকিছুই আর সামনে আসেনি।

শীতলক্ষ্যায় এ লঞ্চডুবির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ-চাঁদপুরসহ বিভিন্ন রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। চাঁদপুর নৌবন্দর কর্মকর্তা কায়সারুল ইসলাম বলেন, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী সব কটি লঞ্চে নানা ত্রুটি আছে। কিন্তু কথা হলো ত্রুটি যেহেতু আছে তাহলে এগুলো নিয়ে আগে কেনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো না। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে- নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ কিংবা অন্যান্য রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো মান্ধাতা আমলের এবং ছোট আকারের। কোনোটাতেই নেই পর্যাপ্ত জীবনরক্ষাকারী বয়া বা লাইফ জ্যাকেট। রোববার দুর্ঘটনায় পড়া লঞ্চটিও ৪৯ বছর আগে ১৯৭৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব লঞ্চ এতদিন ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী বহন করেছে বিআইডব্লিউটিআইয়ের নাকের ডগায় বসেই।

যদিও প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়মিত নৌযান পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। তারা নিয়মিতভাবে এগুলোর দেখভাল করলে অনেক দুর্ঘটনাই ঘটতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাদের এখানে বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর কিছুদিন তারা দায়িত্ব পালন করেন তারপর আর কোনো খবর থাকে না। যেমন অভিযান-১০ লঞ্চে দুর্ঘটনার তিন দিন পরে আমি ঢাকা থেকে বরগুনা আসার সময় লঞ্চে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি দেখেছি, কেবিনের ভেতরে আলাদা করে লাইফ জ্যাকেটও পেয়েছি। কিন্তু মাস তিন পার না হতেই সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই এই রুটে চলাচল করা একটি লঞ্চেও। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে বরগুনা আসা এবং যাওয়ার পথে দেখে এসেছি আগের মতোই নিজেদের স্টাইলে চলছে এ রুটের লঞ্চগুলো। লাইফ জ্যাকেটও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কেবিন থেকে। বিআইডব্লিউটিআইয়ের কর্মকর্তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে স্মরণকালের ইতিহাসের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরে এত দ্রুতই আগের মতো গা-ছাড়াভাবে চলতে পারতো না নিশ্চয়ই।

দেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে মূলত অসতর্কতা কিংবা দায়িত্বে অবহেলা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? এমএল আশরাফ উদ্দিন-২ লঞ্চটি যেভাবে ডুবে গেলো, তা কোনোভাবেই সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা নয়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা হত্যাকান্ডের মতোই। নরওয়েজিয়ান সমাজবিজ্ঞানী জোহান গ্যালটাঙ্গের ‘কাঠামোগত সহিংসতার তত্ত্ব’ মানলে এটি স্পষ্টতই একটি কাঠামোগত হত্যা। নৌপথকে নিরাপদ করতে অচিরেই এগুলোর সুরাহা করতে হবে। এজন্য প্রচলিত আইনকে যুগোপযোগী করার সময় এসেছে। ১৯৭৬ সালের একটি সরকারি অধ্যাদেশকে পাঁচ দফায় সংশোধন করার পরও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে পাঁচ বছরের জেল আর মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা! তাই এ অব্যবস্থাপনাজনিত লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে কঠোর শাস্তির বিধান করার পাশাপাশি নৌ-নিরাপত্তা নিয়েও সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। কারণ প্রতি বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু এ কারণেই ঘটছে যে- এসব দুর্ঘটনায় কারও তেমন কোনো শাস্তি হয় না।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]