জিঞ্জিরায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা

২ এপ্রিল, ১৯৭১। ২৫ মার্চ ঢাকায় পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা নগরীর বেঁচে যাওয়া মানুষ পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয় স্থান মনে করে বুড়িগঙ্গা নদীর অন্য পাড়ে জিঞ্জিরায় চলে যায়।

জিঞ্জিরা ও এর আশপাশের অঞ্চল ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী টার্গেট করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে।

পাকিস্তান বাহিনী ভোর সাড়ে ৫টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা চালিয়ে যায় এবং দুপুর আড়াইটায় এ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে। তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তান বাহিনী ৬০ জন লোককে একসঙ্গে একই সারিতে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ গণহত্যায় আনুমানিক সহস্রাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বেলা বাড়তে বাড়তে পাকিস্তান বাহিনী ঢুকতে থাকে গ্রামগুলোতে। একের পর এক বাড়িতে ঢুকেই ব্রাশফায়ার। মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে বুটের নিচে পিষতে থাকল কয়েকজন, নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল লোলুপ হিংস্রতায়। বাড়িগুলো ততক্ষণে পুড়ছে আগুনে। রাস্তা, পুকুর পাড়, খেত, বাগান- যাকে যেখানে পেল,

সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলতে থাকল। মেয়েদের অনেককে তুলে নিয়ে যায়।

কালিন্দ গ্রামের এক বাড়িতে ১১ জন হিন্দু নারীকে পাশাপাশি ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ধর্ষণ শেষে বেয়োনেট দিয়ে মোরব্বার মতো খোঁচাল কিছুক্ষণ। তারপর রক্তাক্ত মাংসপি-গুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে।

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরদিন, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরার গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’।

এই হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি তার জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১ বইয়ে লিখেছেন, ‘একটি ডোবার ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আমি তখন এমন একটি করুণ মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি যা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। পারিনি। আমি দেখি শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিঁটকে পড়েছে, আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সে ডোবার জলে, কিন্তু ওই মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে। শেলের আঘাতে তার মাথাটি যে দেহ থেকে উড়ে গেছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মস্তক ছিন্ন দেহটিকে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর লোকটা আর পারলো না, তার কবন্ধ দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মস্তকহীন দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তস্রোতে ভিজে গেল শুভাড্যার মাটি।’

সাবেক কূটনীতিক আবদুল হান্নান ছিলেন জিঞ্জিরা গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, ‘২ এপ্রিল ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল উত্তর দিক থেকে আসা মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের বিকট শব্দে। সবাই যে যেদিকে পারে ছুটে যেতে লাগল নিরাপত্তার সন্ধানে। আমি আমার ছয় বছরের ছেলে টিংকুকে নিয়ে এবং আমার স্ত্রী আমাদের তিন বছরের ছেলে রিংকুকে কোলে করে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে লাগলাম। আমার মেয়ে রিমি তখনো এই মন্দ পৃথিবীতে আসেনি। কিছু দূর যেতেই দেখলাম লোকগুলো সবাই পূর্ব দিকে ছুটছে। কিছুক্ষণ পর পূর্ব দিক থেকে গুলি আসছে দেখে আমরা পশ্চিম দিকে ছুটতে লাগলাম। পেছন ফিরে দেখি, আমার স্ত্রী ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পথে পড়ে গেছে। আমি বারবার ব্যাগটা ফেলে দিতে বলায় অবশেষে সে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমার পেছন পেছন ছুটতে লাগল। আমরা একটা মসজিদে আশ্রয় নিতে গেলাম। মসজিদে মানুষের ভিড়ে আর ঠাঁই ছিল না। মসজিদের পেছনে দেখি, অনেক মানুষ কবরে আশ্রয় নিয়েছে। কচুপাতা ও অন্যান্য লতাপাতায় আচ্ছাদিত একটা খালি কবর দেখে আমি ইতস্তত করি এই ভেবে যে কবরে বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড় থাকতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তো আরও বেশি হিংস্র। কচুপাতা সরিয়ে আমরা কবরে আশ্রয় নিই। বাইরে গুলির আওয়াজ ও ঘরবাড়ি পোড়ার ধোঁয়া দেখতে পেলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা পর গুলির আওয়াজ শেষ হলে কবর থেকে একে একে মানুষ উঠতে দেখে আমরাও উঠে গেলাম। সে এক পরাবাস্তব দৃশ্য। দেখি, মসজিদের সামনে মানুষের জটলা। একটা লোক আমার স্ত্রীর কাদামাখা শাড়ি দেখে আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গেল এবং আমাকে একটা লুঙ্গি ও আমার স্ত্রীকে একটা শাড়ি দিল। পরে লোকটা একটা নৌকা এনে আমাদের কামরাঙ্গীরচর হয়ে নবাবগঞ্জে পৌঁছে দিলো।’

শনিবার, ০২ এপ্রিল ২০২২ , ১৯ চৈত্র ১৪২৮ ২৯ শাবান ১৪৪৩

২ এপ্রিল ১৯৭১

জিঞ্জিরায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

২ এপ্রিল, ১৯৭১। ২৫ মার্চ ঢাকায় পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা নগরীর বেঁচে যাওয়া মানুষ পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয় স্থান মনে করে বুড়িগঙ্গা নদীর অন্য পাড়ে জিঞ্জিরায় চলে যায়।

জিঞ্জিরা ও এর আশপাশের অঞ্চল ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী টার্গেট করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে।

পাকিস্তান বাহিনী ভোর সাড়ে ৫টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা চালিয়ে যায় এবং দুপুর আড়াইটায় এ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে। তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তান বাহিনী ৬০ জন লোককে একসঙ্গে একই সারিতে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ গণহত্যায় আনুমানিক সহস্রাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বেলা বাড়তে বাড়তে পাকিস্তান বাহিনী ঢুকতে থাকে গ্রামগুলোতে। একের পর এক বাড়িতে ঢুকেই ব্রাশফায়ার। মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে বুটের নিচে পিষতে থাকল কয়েকজন, নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল লোলুপ হিংস্রতায়। বাড়িগুলো ততক্ষণে পুড়ছে আগুনে। রাস্তা, পুকুর পাড়, খেত, বাগান- যাকে যেখানে পেল,

সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলতে থাকল। মেয়েদের অনেককে তুলে নিয়ে যায়।

কালিন্দ গ্রামের এক বাড়িতে ১১ জন হিন্দু নারীকে পাশাপাশি ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ধর্ষণ শেষে বেয়োনেট দিয়ে মোরব্বার মতো খোঁচাল কিছুক্ষণ। তারপর রক্তাক্ত মাংসপি-গুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে।

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরদিন, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরার গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’।

এই হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি তার জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১ বইয়ে লিখেছেন, ‘একটি ডোবার ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আমি তখন এমন একটি করুণ মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি যা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। পারিনি। আমি দেখি শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিঁটকে পড়েছে, আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সে ডোবার জলে, কিন্তু ওই মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে। শেলের আঘাতে তার মাথাটি যে দেহ থেকে উড়ে গেছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মস্তক ছিন্ন দেহটিকে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর লোকটা আর পারলো না, তার কবন্ধ দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মস্তকহীন দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তস্রোতে ভিজে গেল শুভাড্যার মাটি।’

সাবেক কূটনীতিক আবদুল হান্নান ছিলেন জিঞ্জিরা গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, ‘২ এপ্রিল ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল উত্তর দিক থেকে আসা মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের বিকট শব্দে। সবাই যে যেদিকে পারে ছুটে যেতে লাগল নিরাপত্তার সন্ধানে। আমি আমার ছয় বছরের ছেলে টিংকুকে নিয়ে এবং আমার স্ত্রী আমাদের তিন বছরের ছেলে রিংকুকে কোলে করে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে লাগলাম। আমার মেয়ে রিমি তখনো এই মন্দ পৃথিবীতে আসেনি। কিছু দূর যেতেই দেখলাম লোকগুলো সবাই পূর্ব দিকে ছুটছে। কিছুক্ষণ পর পূর্ব দিক থেকে গুলি আসছে দেখে আমরা পশ্চিম দিকে ছুটতে লাগলাম। পেছন ফিরে দেখি, আমার স্ত্রী ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পথে পড়ে গেছে। আমি বারবার ব্যাগটা ফেলে দিতে বলায় অবশেষে সে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমার পেছন পেছন ছুটতে লাগল। আমরা একটা মসজিদে আশ্রয় নিতে গেলাম। মসজিদে মানুষের ভিড়ে আর ঠাঁই ছিল না। মসজিদের পেছনে দেখি, অনেক মানুষ কবরে আশ্রয় নিয়েছে। কচুপাতা ও অন্যান্য লতাপাতায় আচ্ছাদিত একটা খালি কবর দেখে আমি ইতস্তত করি এই ভেবে যে কবরে বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড় থাকতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তো আরও বেশি হিংস্র। কচুপাতা সরিয়ে আমরা কবরে আশ্রয় নিই। বাইরে গুলির আওয়াজ ও ঘরবাড়ি পোড়ার ধোঁয়া দেখতে পেলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা পর গুলির আওয়াজ শেষ হলে কবর থেকে একে একে মানুষ উঠতে দেখে আমরাও উঠে গেলাম। সে এক পরাবাস্তব দৃশ্য। দেখি, মসজিদের সামনে মানুষের জটলা। একটা লোক আমার স্ত্রীর কাদামাখা শাড়ি দেখে আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গেল এবং আমাকে একটা লুঙ্গি ও আমার স্ত্রীকে একটা শাড়ি দিল। পরে লোকটা একটা নৌকা এনে আমাদের কামরাঙ্গীরচর হয়ে নবাবগঞ্জে পৌঁছে দিলো।’