দিল্লিতে ইন্দিরা-তাজউদ্দীন আলোচনা, টাঙ্গাইলে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল ছিল শনিবার। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী টাঙ্গাইল শহরে গোড়ান, সাটিয়াচড়া গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে নারকীয় গণহত্যা চালায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সঙ্গে ইপিআরের যুদ্ধে কামানের গোলা ও মর্টার শেলের আঘাতে ইপিআরের ২৯ জন সদস্য শহীদ হন।

এদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। রাত ১০টায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের পড়ার ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আলাপে তাজউদ্দীন আহমদ যে বিষয়টিতে জোর দেন তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও এই যুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্র শক্তি।

সেদিনের আলোচনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রসদ, শরণার্থীদের আহার, বাসস্থান, বাইরের জগতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রতি লাভ করেন।

ওই সাক্ষাতের সময় সরকার গঠনের বিষয়ে জানতে চান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।

ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন বিএসএফ-এর একটি অস্থায়ী ঘাঁটিতে বিএসএফ-এর ২০০ ওয়াট শর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার থেকে ৩ এপ্রিল ১৯৭১ রাতে দ্বিতীয় পর্বে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ সম্প্রচার শুরু হয়।

এদিন চুয়াডাঙ্গাতে আওয়ামী লীগের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক সভায় জাতীয় পরিষদ সদস্য ড. আসহাবুল হক জোয়ার্দারকে চেয়ারম্যান করে ‘বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি’-র জন্ম হয়।

ফরাসি টেলিভিশন করপোরেশনের একটি ভ্রাম্যমাণ দল মুক্তিবাহিনীর চুয়াডাঙ্গাস্থ সদর দপ্তরে আসে। তারা দৃঢ় মনোবলে উদীপ্ত যুদ্ধরত মুক্তিসেনা ও আহত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী লে. আতাউল্লাহ শাহসহ পাকিস্তানিদের কাছ থেকে দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ির ছবি টেলিভিশন ক্যামেরায় ধারণ করেন এবং মেজর এম.এ ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

এ দিনে সিলেটের শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। যশোর শহরের উত্তরাংশে অবস্থিত অবাঙালিদের বাসস্থানগুলোতে অবস্থান নিয়ে পাক হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে ব্যাপক কামানের গোলা নিক্ষেপ করে।

রংপুর শহরের শ্মশানঘাটে মধ্যরাতে বেশ কয়জন নেতৃস্থানীয় নাগরিককে হাত-চোখ বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সিলেটের দেওড়াছড়া চা বাগানের ৭০ জন শ্রমিককে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।

এইদিন দেশ-বিদেশের পত্রিকায় গণহত্যার খবর, বাঙালি নিধন, পূর্ব বাংলা স্বাধীন এ জাতীয় শিরোনামে বিদেশি পত্রিকাগুলো পাক-বাহিনীর নির্মমতার খবর প্রকাশ করে। সারাবিশ্বের বেতার ও টেলিভিশনে তা প্রচার হতে থাকে। খবরগুলো বিশ্ব বিবেককে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। তারা শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসী বাঙালিদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে।

সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বার্তা পাঠান সে বার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবিলার পরামর্শ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা ছিল।

রবিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২২ , ২০ চৈত্র ১৪২৮ ৩০ শাবান ১৪৪৩

৩ এপ্রিল ১৯৭১

দিল্লিতে ইন্দিরা-তাজউদ্দীন আলোচনা, টাঙ্গাইলে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল ছিল শনিবার। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী টাঙ্গাইল শহরে গোড়ান, সাটিয়াচড়া গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে নারকীয় গণহত্যা চালায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সঙ্গে ইপিআরের যুদ্ধে কামানের গোলা ও মর্টার শেলের আঘাতে ইপিআরের ২৯ জন সদস্য শহীদ হন।

এদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। রাত ১০টায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনের পড়ার ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আলাপে তাজউদ্দীন আহমদ যে বিষয়টিতে জোর দেন তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হলেও এই যুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত হবে বাংলাদেশের মিত্র শক্তি।

সেদিনের আলোচনায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রসদ, শরণার্থীদের আহার, বাসস্থান, বাইরের জগতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্প্রচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রতি লাভ করেন।

ওই সাক্ষাতের সময় সরকার গঠনের বিষয়ে জানতে চান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।

ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন বিএসএফ-এর একটি অস্থায়ী ঘাঁটিতে বিএসএফ-এর ২০০ ওয়াট শর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার থেকে ৩ এপ্রিল ১৯৭১ রাতে দ্বিতীয় পর্বে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ সম্প্রচার শুরু হয়।

এদিন চুয়াডাঙ্গাতে আওয়ামী লীগের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক সভায় জাতীয় পরিষদ সদস্য ড. আসহাবুল হক জোয়ার্দারকে চেয়ারম্যান করে ‘বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি’-র জন্ম হয়।

ফরাসি টেলিভিশন করপোরেশনের একটি ভ্রাম্যমাণ দল মুক্তিবাহিনীর চুয়াডাঙ্গাস্থ সদর দপ্তরে আসে। তারা দৃঢ় মনোবলে উদীপ্ত যুদ্ধরত মুক্তিসেনা ও আহত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী লে. আতাউল্লাহ শাহসহ পাকিস্তানিদের কাছ থেকে দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ির ছবি টেলিভিশন ক্যামেরায় ধারণ করেন এবং মেজর এম.এ ওসমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

এ দিনে সিলেটের শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। যশোর শহরের উত্তরাংশে অবস্থিত অবাঙালিদের বাসস্থানগুলোতে অবস্থান নিয়ে পাক হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে ব্যাপক কামানের গোলা নিক্ষেপ করে।

রংপুর শহরের শ্মশানঘাটে মধ্যরাতে বেশ কয়জন নেতৃস্থানীয় নাগরিককে হাত-চোখ বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সিলেটের দেওড়াছড়া চা বাগানের ৭০ জন শ্রমিককে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে।

এইদিন দেশ-বিদেশের পত্রিকায় গণহত্যার খবর, বাঙালি নিধন, পূর্ব বাংলা স্বাধীন এ জাতীয় শিরোনামে বিদেশি পত্রিকাগুলো পাক-বাহিনীর নির্মমতার খবর প্রকাশ করে। সারাবিশ্বের বেতার ও টেলিভিশনে তা প্রচার হতে থাকে। খবরগুলো বিশ্ব বিবেককে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। তারা শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা দেয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসী বাঙালিদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে।

সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বার্তা পাঠান সে বার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের খবরে উদ্বেগ, শক্তি ব্যবহার না করে রাজনৈতিক পথেই সংকট মোকাবিলার পরামর্শ ও মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার কথা ছিল।