বাংলাদেশ একটি নজরদারি সমাজব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে : টিআইবি

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘বিটিআরসির খসড়ায় কনটেন্ট অপসারণ এবং শনাক্তকরণের যে ধারা রাখা হয়েছে, তা বাকস্বাধীনতার জন্য হুমকি। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন। এটা বাস্তবায়ন হলে বলা যায়, বাংলাদেশ একটি নজরদারি সমাজব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে।’

গতকাল ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, ‘সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’ এর খসড়া নিয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এসব কথা বলেন।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বিটিআরসির বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যেই তারা খসড়ার বিষয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারী সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এই খসড়া। এর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, অনলাইনের ক্ষতিকর বিষয়ের ঝুঁকি এবং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জায়গায় নিয়ে আসা। নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেন মানুষের বাক?স্বাধীনতা ঝুঁকিতে না পড়ে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খসড়ার উদ্দেশ সংবিধান ও মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গিতে এই নীতি হওয়ার কথা, তা এই খসড়ায় দেখা যায়নি। এখানে অনেক কিছু ভেবে দেখার সুযোগ আছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওটিটি নীতিমালার কথা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কাছাকাছি বিষয় নিয়ে নীতিমালা থাকায় প্রায়োগিক দ্বন্দ্ব ও ঝুঁকি তৈরি হবে।

ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ থাকবে এবং অপব্যবহারের সুযোগও তৈরি হবে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের নামে যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে বলা যায়, মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের নীতিমালা করা উচিত।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্লাটফর্মের অবাধ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এর অপব্যবহারও হচ্ছে। কাজেই এটি নিয়ন্ত্রণের বিষয় আছে। কিন্তু এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করারও উদ্যোগ থাকে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সহায়ক পরিবেশ পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হয় এবং মানুষের অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে। সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এ ধরনের নীতিমালা। কিন্তু বিটিআরসির খসড়া নিয়ন্ত্রণমূলক হয়েছে।

বিটিআরসির খসড়া নিয়ে টিআইবির মতামত তুলে ধরেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম। সেখানে বলা হয়, বিটিআরসির খসড়ায় সংজ্ঞা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টতা আছে। এর প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মর্জির ওপর নির্ভর করবে।

টিআইবি বলছে, খসড়ায় যেভাবে নিবন্ধন সনদ বাতিল, স্থগিত ও প্রত্যাহারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘমেয়াদের ব্যবসা পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের আগ্রহও তারা হারাতে পারেন বলে মতামতে উল্লেখ করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্লাটফর্মের স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ওপর নিবর্তনমূলক ধারা প্রয়োগের ঝুঁকি তৈরি করবে।

কনটেন্ট অপসারণ ও ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশের প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে টিআইবি। তারা উদাহরণ হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং পরবর্তী সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে। সংস্থাটি আরও বলেছে, অনলাইনে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা বাক?স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতার শামিল। এ ধারা প্রয়োগ হলে অনেক যৌক্তিক কনটেন্ট প্রকাশ থেকেও বিরত রাখার ঘটনা ঘটবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে মূল বার্তা প্রেরণকারীকে শনাক্তকরণের নীতি প্রয়োগ হলে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হবে। টিআইবি বলেছে, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ও শিশু পর্নোগ্রাফি রোধে এ ধরনের নীতি স্বীকৃত। কিন্তু কোনভাবেই তা বিরুদ্ধ মতামত, সমালোচনা বন্ধ করা বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর নজরদারির ক্ষেত্রে বৈধতা দেয় না। এই ধারা বাস্তবায়ন হলে ব্যবহারকারী নিজের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে ভয় পাবেন, পাশাপাশি এই মেসেজিং প্লাটফর্মগুলো বাংলাদেশে তাদের সেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।

টিআইবি বলেছে, খসড়ায় শাস্তির বিধানও মৌলিক অধিকার ক্ষুণেœর ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া কোন সুরক্ষাবলয় রাখা হয়নি। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওটিটির খসড়া ও বিটিআরসির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্লাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ খসড়া প্রায় একই বিষয় হওয়াতে বাস্তবায়ন ও কার্যকরের স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। পাশাপাশি তথ্য মন্ত্রণালয়ের ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা আছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি।

সোমবার, ০৪ এপ্রিল ২০২২ , ২১ চৈত্র ১৪২৮ ০১ রমাদ্বান ১৪৪৩

বাংলাদেশ একটি নজরদারি সমাজব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে : টিআইবি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘বিটিআরসির খসড়ায় কনটেন্ট অপসারণ এবং শনাক্তকরণের যে ধারা রাখা হয়েছে, তা বাকস্বাধীনতার জন্য হুমকি। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন। এটা বাস্তবায়ন হলে বলা যায়, বাংলাদেশ একটি নজরদারি সমাজব্যবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে।’

গতকাল ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, ‘সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’ এর খসড়া নিয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এসব কথা বলেন।

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বিটিআরসির বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যেই তারা খসড়ার বিষয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারী সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এই খসড়া। এর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, অনলাইনের ক্ষতিকর বিষয়ের ঝুঁকি এবং সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জায়গায় নিয়ে আসা। নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেন মানুষের বাক?স্বাধীনতা ঝুঁকিতে না পড়ে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খসড়ার উদ্দেশ সংবিধান ও মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা। কিন্তু যে দৃষ্টিভঙ্গিতে এই নীতি হওয়ার কথা, তা এই খসড়ায় দেখা যায়নি। এখানে অনেক কিছু ভেবে দেখার সুযোগ আছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওটিটি নীতিমালার কথা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কাছাকাছি বিষয় নিয়ে নীতিমালা থাকায় প্রায়োগিক দ্বন্দ্ব ও ঝুঁকি তৈরি হবে।

ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ থাকবে এবং অপব্যবহারের সুযোগও তৈরি হবে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের নামে যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে বলা যায়, মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের নীতিমালা করা উচিত।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্লাটফর্মের অবাধ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এর অপব্যবহারও হচ্ছে। কাজেই এটি নিয়ন্ত্রণের বিষয় আছে। কিন্তু এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করারও উদ্যোগ থাকে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সহায়ক পরিবেশ পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হয় এবং মানুষের অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে। সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এ ধরনের নীতিমালা। কিন্তু বিটিআরসির খসড়া নিয়ন্ত্রণমূলক হয়েছে।

বিটিআরসির খসড়া নিয়ে টিআইবির মতামত তুলে ধরেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম। সেখানে বলা হয়, বিটিআরসির খসড়ায় সংজ্ঞা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টতা আছে। এর প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মর্জির ওপর নির্ভর করবে।

টিআইবি বলছে, খসড়ায় যেভাবে নিবন্ধন সনদ বাতিল, স্থগিত ও প্রত্যাহারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘমেয়াদের ব্যবসা পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের আগ্রহও তারা হারাতে পারেন বলে মতামতে উল্লেখ করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্লাটফর্মের স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ওপর নিবর্তনমূলক ধারা প্রয়োগের ঝুঁকি তৈরি করবে।

কনটেন্ট অপসারণ ও ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশের প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে টিআইবি। তারা উদাহরণ হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং পরবর্তী সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে। সংস্থাটি আরও বলেছে, অনলাইনে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা বাক?স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতার শামিল। এ ধারা প্রয়োগ হলে অনেক যৌক্তিক কনটেন্ট প্রকাশ থেকেও বিরত রাখার ঘটনা ঘটবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে মূল বার্তা প্রেরণকারীকে শনাক্তকরণের নীতি প্রয়োগ হলে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হবে। টিআইবি বলেছে, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ও শিশু পর্নোগ্রাফি রোধে এ ধরনের নীতি স্বীকৃত। কিন্তু কোনভাবেই তা বিরুদ্ধ মতামত, সমালোচনা বন্ধ করা বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর নজরদারির ক্ষেত্রে বৈধতা দেয় না। এই ধারা বাস্তবায়ন হলে ব্যবহারকারী নিজের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে ভয় পাবেন, পাশাপাশি এই মেসেজিং প্লাটফর্মগুলো বাংলাদেশে তাদের সেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।

টিআইবি বলেছে, খসড়ায় শাস্তির বিধানও মৌলিক অধিকার ক্ষুণেœর ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া কোন সুরক্ষাবলয় রাখা হয়নি। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওটিটির খসড়া ও বিটিআরসির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওটিটি প্লাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ খসড়া প্রায় একই বিষয় হওয়াতে বাস্তবায়ন ও কার্যকরের স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। পাশাপাশি তথ্য মন্ত্রণালয়ের ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা আছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি।