৬ বছরেও তামাককর কাঠামো বাস্তবায়ন হয়নি, সহজ লভ্যতায় হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

দেশে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আহরণে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে তামাককর কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক করনীতি গ্রহণের নির্দেশনা দিলেও তা ৬ বছরেও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কার্যকরভাবে করারোপের অভাবে তামাক পণ্য সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য পড়েছে হুমকিতে, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

গতকাল গবেষণা ও তামাকবিরোধী অ্যাডভোকেসি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মার যৌথ উদ্যোগে ‘প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সহজ ও শক্তিশালী তামাককর নীতি বাস্তবায়নে বাধা এবং করণীয়’ শীর্ষক বৈঠকে অংশ নিযয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অনুষ্ঠানে জানানো হয় বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এফসিটিসি আর্টিকেল ৬ ধারায় তামাকের চাহিদা হ্রাসকল্পে একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল যা তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে যথেষ্ট নয়। সিগারেটে বহুস্তর বিশিষ্ট অ্যাড-ভ্যালুরেম কর কাঠামো চালু থাকায় বাজারে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য সিগারেট বিদ্যমান। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলকভাবে কমদামি সিগারেট বেছে নিতে পারছে। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলো উচ্চস্তরের সিগারেট নিম্ন স্তরে ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

অন্যদিকে, সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে কেবল মূল্যস্তর বৃদ্ধির মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে বর্ধিত মূল্যের একটি বড় অংশ তামাক কোম্পানির পকেটে চলে

যাচ্ছে। তামাক কোম্পানি লাভবান হচ্ছে, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এছাড়া করের ভিত্তি এবং করহার খুবই কম হওয়ায় বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল) অধিক সহজলভ্য থেকে যাচ্ছে। তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১টিতে আনা হলে বিদ্যমান জটিল কর ব্যবস্থা সহজ হবে, সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং জনস্বাস্থ্য উপকৃত হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সহজ কর কাঠামো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। প্রধানমন্ত্রী যখন কোন ঘোষণা দেন তখন সেটা পালন করা সরকারের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে যারা গাফলতি করেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা আগে এক সময় তামাকের কর বাড়ানোর বিপক্ষে ডিও লেটার দিতেন কিন্তু এখন তারা কর বৃদ্ধির পক্ষে ডিও লেটার দিচ্ছেন। আশা করি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর এবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তামাককর সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণে স্বাস্থ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একসুরে কথা বলতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং আয়োজন করে তামাককর সংক্রান্ত এই প্রস্তাব তুলে ধরে তাহলে সেটা বেশি কার্যকর হবে।’

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আরও অংশ নেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার, বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর, সিপিডির রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত, আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।

বুধবার, ০৬ এপ্রিল ২০২২ , ২৩ চৈত্র ১৪২৮ ০৪ রমাদ্বান ১৪৪৩

৬ বছরেও তামাককর কাঠামো বাস্তবায়ন হয়নি, সহজ লভ্যতায় হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

দেশে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আহরণে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে তামাককর কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক করনীতি গ্রহণের নির্দেশনা দিলেও তা ৬ বছরেও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কার্যকরভাবে করারোপের অভাবে তামাক পণ্য সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য পড়েছে হুমকিতে, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

গতকাল গবেষণা ও তামাকবিরোধী অ্যাডভোকেসি সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মার যৌথ উদ্যোগে ‘প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সহজ ও শক্তিশালী তামাককর নীতি বাস্তবায়নে বাধা এবং করণীয়’ শীর্ষক বৈঠকে অংশ নিযয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অনুষ্ঠানে জানানো হয় বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এফসিটিসি আর্টিকেল ৬ ধারায় তামাকের চাহিদা হ্রাসকল্পে একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল যা তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে যথেষ্ট নয়। সিগারেটে বহুস্তর বিশিষ্ট অ্যাড-ভ্যালুরেম কর কাঠামো চালু থাকায় বাজারে অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য সিগারেট বিদ্যমান। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলকভাবে কমদামি সিগারেট বেছে নিতে পারছে। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলো উচ্চস্তরের সিগারেট নিম্ন স্তরে ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

অন্যদিকে, সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে কেবল মূল্যস্তর বৃদ্ধির মাধ্যমে সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে বর্ধিত মূল্যের একটি বড় অংশ তামাক কোম্পানির পকেটে চলে

যাচ্ছে। তামাক কোম্পানি লাভবান হচ্ছে, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এছাড়া করের ভিত্তি এবং করহার খুবই কম হওয়ায় বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল) অধিক সহজলভ্য থেকে যাচ্ছে। তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১টিতে আনা হলে বিদ্যমান জটিল কর ব্যবস্থা সহজ হবে, সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং জনস্বাস্থ্য উপকৃত হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সহজ কর কাঠামো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। প্রধানমন্ত্রী যখন কোন ঘোষণা দেন তখন সেটা পালন করা সরকারের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে যারা গাফলতি করেন তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা আগে এক সময় তামাকের কর বাড়ানোর বিপক্ষে ডিও লেটার দিতেন কিন্তু এখন তারা কর বৃদ্ধির পক্ষে ডিও লেটার দিচ্ছেন। আশা করি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর এবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তামাককর সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণে স্বাস্থ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একসুরে কথা বলতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং আয়োজন করে তামাককর সংক্রান্ত এই প্রস্তাব তুলে ধরে তাহলে সেটা বেশি কার্যকর হবে।’

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আরও অংশ নেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার, বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মনজুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর, সিপিডির রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাত, আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা) চেয়ে অনেক বেশি।