একাত্তরের ৮ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এদিনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি পার্বত্য চট্টগ্রামের বুড়িঘাটে অবস্থান নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার জন্য ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দুই কোম্পানি সৈন্য, সাতটি স্পিডবোট এবং দুটি লঞ্চে করে বুড়িঘাট দখলের জন্য অগ্রসর হয়। তারা মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে হঠাৎ অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তান বাহিনীর গোলাবৃষ্টির তীব্রতায় মুক্তিসেনারা পেছনে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ বাহিনীর সদস্য ল্যান্সনায়েক মুন্সি আবদুর রউফ পেছনে হটতে অস্বীকৃতি জানান। নিজ পরিখা থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করেন তিনি। মেশিনগানের এই পাল্টা আক্রমণের ফলে শত্রুদের স্পিডবোটগুলো ডুবে যায়। হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তান সেনা। এরপর পাকিস্তান সেনাদের দুটি লঞ্চ দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে দূরপাল্লার ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের ভারী গোলা এসে পরে আবদুর রউফের ওপর। লুটিয়ে পড়েন তিনি, নীরব হয়ে যায় তার মেশিনগান। পরে তাকে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে একটি টিলার ওপর সমাহিত করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
এদিনে নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালায়। এ নিয়ে তুমুল লড়াই হয় প্রায় ৫ ঘণ্টা। এ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী আর্টিলারি ও মর্টার ব্যবহার করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে নড়াইলে এসে অবস্থান নেয়।
এদিনে চাঁদপুরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতিতে হাজীগঞ্জ ডাকবাংলোতে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করার কৌশল নিয়ে এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ডা. আবদুস সাত্তার, ড. আবু ইউসুফ, হাবিবুর রহমান, সাইদুর রহমান, বিএম. কলিমুল্লাহ,আলী আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এদিনই নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার মঞ্জুরুল করিম পরিস্থিতি নিয়ে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং নোয়াখালী প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করেন। একই সময়ে ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত ও ক্যাপ্টেন আজিজ সিলেট জেলা মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এদিন রাত ১টায় সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল লালমনিরহাট থানা হেড কোয়ার্টারে অবস্থারত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিরা ‘ফির্ডগান’ আর্টিলারি ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে বদরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা করে। এ যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এদিন কুড়িগ্রামে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলনে কুড়িগ্রাম, রৌমারী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী এলাকা যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। সে বৈঠকে এই এলাকাকে রংপুর সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। রংপুর সেক্টরকে সুবেদার বোরহানউদ্দিনের নেতৃত্বে পাটগ্রাম এবং সুবেদার আরব আলীর কমান্ডে ভুরুঙ্গামারী এই দুটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। রংপুর সেক্টরের দায়িত্বে থাকেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিলেটের শালুটিকর বিমানবন্দর এবং লক্কাতুরা এলাকা থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর হামলা চালায়।
এদিন ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৯টি শরণার্থী শিবির খোলা হয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের কাছে প্রেরিত এক নোটে বলেন, ভারত পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদ যোগাচ্ছে।
কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এএসএম. সোলায়মান ঢাকায় এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে কালবিলম্ব না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রতিরোধ করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়। মুসলিম লীগ নেতা কাজী আবদুল কাদের করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অরাজকতার জন্য শেখ মুজিব ও বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ দায়ী। তিনি সেনাবাহিনীর সময়োচিত হস্তক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশ ও জনগণকে বাঁচিয়েছে।
এদিন জাকার্তায় ইন্দোনেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর প্রতিবাদে সেখানকার পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
শুক্রবার, ০৮ এপ্রিল ২০২২ , ২৫ চৈত্র ১৪২৮ ০৬ রমাদ্বান ১৪৪৩
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
একাত্তরের ৮ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এদিনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি পার্বত্য চট্টগ্রামের বুড়িঘাটে অবস্থান নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার জন্য ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দুই কোম্পানি সৈন্য, সাতটি স্পিডবোট এবং দুটি লঞ্চে করে বুড়িঘাট দখলের জন্য অগ্রসর হয়। তারা মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে হঠাৎ অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তান বাহিনীর গোলাবৃষ্টির তীব্রতায় মুক্তিসেনারা পেছনে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ বাহিনীর সদস্য ল্যান্সনায়েক মুন্সি আবদুর রউফ পেছনে হটতে অস্বীকৃতি জানান। নিজ পরিখা থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করেন তিনি। মেশিনগানের এই পাল্টা আক্রমণের ফলে শত্রুদের স্পিডবোটগুলো ডুবে যায়। হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তান সেনা। এরপর পাকিস্তান সেনাদের দুটি লঞ্চ দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে দূরপাল্লার ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের ভারী গোলা এসে পরে আবদুর রউফের ওপর। লুটিয়ে পড়েন তিনি, নীরব হয়ে যায় তার মেশিনগান। পরে তাকে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে একটি টিলার ওপর সমাহিত করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
এদিনে নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তান বাহিনী হামলা চালায়। এ নিয়ে তুমুল লড়াই হয় প্রায় ৫ ঘণ্টা। এ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী আর্টিলারি ও মর্টার ব্যবহার করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে নড়াইলে এসে অবস্থান নেয়।
এদিনে চাঁদপুরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতিতে হাজীগঞ্জ ডাকবাংলোতে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধ করার কৌশল নিয়ে এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ডা. আবদুস সাত্তার, ড. আবু ইউসুফ, হাবিবুর রহমান, সাইদুর রহমান, বিএম. কলিমুল্লাহ,আলী আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এদিনই নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার মঞ্জুরুল করিম পরিস্থিতি নিয়ে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং নোয়াখালী প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করেন। একই সময়ে ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত ও ক্যাপ্টেন আজিজ সিলেট জেলা মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এদিন রাত ১টায় সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল লালমনিরহাট থানা হেড কোয়ার্টারে অবস্থারত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিরা ‘ফির্ডগান’ আর্টিলারি ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে বদরগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা করে। এ যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এদিন কুড়িগ্রামে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলনে কুড়িগ্রাম, রৌমারী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী এলাকা যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। সে বৈঠকে এই এলাকাকে রংপুর সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। রংপুর সেক্টরকে সুবেদার বোরহানউদ্দিনের নেতৃত্বে পাটগ্রাম এবং সুবেদার আরব আলীর কমান্ডে ভুরুঙ্গামারী এই দুটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। রংপুর সেক্টরের দায়িত্বে থাকেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিলেটের শালুটিকর বিমানবন্দর এবং লক্কাতুরা এলাকা থেকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর হামলা চালায়।
এদিন ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৯টি শরণার্থী শিবির খোলা হয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের কাছে প্রেরিত এক নোটে বলেন, ভারত পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদ যোগাচ্ছে।
কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি এএসএম. সোলায়মান ঢাকায় এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে কালবিলম্ব না করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রতিরোধ করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়। মুসলিম লীগ নেতা কাজী আবদুল কাদের করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অরাজকতার জন্য শেখ মুজিব ও বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ দায়ী। তিনি সেনাবাহিনীর সময়োচিত হস্তক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশ ও জনগণকে বাঁচিয়েছে।
এদিন জাকার্তায় ইন্দোনেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর প্রতিবাদে সেখানকার পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।