নিত্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে

রেজাউল করিম খোকন

তিন কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে-করোনার প্রকোপ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া। ২০২০ সালে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ায় চাহিদা কমে গিয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমে গিয়েছিল। গত বছরের শেষ দিকে করোনার প্রকোপ কমায় হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও সচল হতে থাকে। বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অন্যান্য প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে দেশ মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। এতে দেশেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়েছে। এতেও মূল্যস্ফীতি উসকে দিচ্ছে।

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের দ্বিতীয় পর্যায় এখন চলছে। কোনো কোনো প্যাকেজের তৃতীয় পর্যায় চলছে। প্যাকেজ বাস্তবায়নের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এটিও মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এসব মিলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ হার কমাতে ও অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের গতি এগিয়ে নিতে হলে অর্থনীতির সব খাতে কঠোর তদারকি অপরিহার্য। কেননা করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করতে ঝুঁকির মাত্রা এখনো উড়ে যায়নি। নানাভাবে পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে ঝুঁকি আসতে পারে। সেদিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। গত দুই বছর করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ, কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ায় দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও বস্তি এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপের ফলে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার টিকার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতি প্রত্যাশার বেশি গতিতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আরও মনোযোগ দিতে হবে।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করেছে। গত অর্থবছরের শুরুর দিকে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৭৯৪ কোটি ডলার ক্রয় করেছে। অর্থবছরের শেষ দিকে আমদানির দেনা পরিশোধের চাপ বাড়ায় চাহিদার জোগান দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। বছর শেষে এসে ডলারের দাম বাড়ায় টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন হয়েছে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ নিয়েও সফলতা মিলছে না। গত অর্থবছরে এ ব্যবধান আগের চেয়ে বেশি বেড়েছে। বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এখন বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় কম। ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ব্যবধান বেড়েই চলেছে।

করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরে কমবে। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার কমলেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। প্রথম স্থানে থাকবে ভারত। তাদের প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৮ শতাংশ। তবে তা গত অর্থবছরের চেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে। মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশে বাড়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হবে পাকিস্তানে। দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা, তৃতীয় অবস্থানে ভারত।

করোনা-পরবর্তী চাহিদার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দেশের ভেতরেও পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। ফলে বেড়েছে আমদানি। একদিকে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও অন্যদিকে পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে আমদানি ব্যয়েও। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেই আমদানি ব্যয়ের বড় অংশ মেটানো হয়। ফলে রিজার্ভের ওপর হঠাৎ করে চাপ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এবং বিদেশে লোকজনের যাতায়াতের কারণে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। রপ্তানি আয় বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স। ঋণপ্রবাহও এখন কমেছে। এদিকে আমদানি ব্যয়সহ বিদেশে যাওয়ার খরচ বেড়েছে। ডলার ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানুষের ব্যাপক হারে দেশের বাইরে যাওয়ার কারণে হঠাৎ ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে ডলার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাটির দাম বাড়ছে। যে কারণে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এর প্রভাব পড়েছে দেশের পুরো অর্থনীতিতে, যা অস্বস্তিতে ফেলেছে জনগণকে।

আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে, তা নিশ্চিত করছে না। কোভিডসহ নানা কারণে বৈষম্য বেড়েছে। তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক দিক হলো- অর্থনীতি গতিশীল আছে। সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও লাভবান হচ্ছেন। তবে সেই লাভ হতদরিদ্রদের দরিদ্র দশা থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখছে কি না, তা দেখতে হবে। মাথাপিছু আয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক ছিল। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। করোনায় বেড়েছে দারিদ্র্য। আবার বাড়ছে মাথাপিছু আয়। জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই সময়ে।

এটা ঠিক যে মোট উৎপাদন বেড়েছে। মোট জাতীয় সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে। কিন্তু সেটা কিছু মানুষের, সবার নয়। ফলে সবার জীবনে এর প্রভাব নেই। করোনার মধ্যেও কোটিপতিদের আয় বেড়েছে। ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর আয় বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে কাজ ও ব্যবসা হারিয়েছেন। আর সাধারণ মানুষের আয় বাড়লেও তা খেয়ে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। এখন মূল্যস্ফীতির হার ছয় ভাগ।

বাংলাদেশে এই যে সবকিছুর দাম বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক সেই প্রশ্ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রতিবছর দাম বাড়ার এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রধানত পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল অথবা গ্যাস-বিদ্যুৎকে ঘিরে। ভোজ্যতেলে বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর। ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় তাদের সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছেনা। সরকারের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে না গিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বাজার মনিটরিং টিম, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন কিছুই কাজে আসছে না। বাস্তবে এখানে প্রতিযোগিতামূলক কোনো বাজার নেই। আছে সিন্ডিকেট। সাধারণ মানুষকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তুলতে হবে।

প্রকৃত অর্থেই সবার আয় বাড়তে হবে। কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দরকার। বাংলাদেশে গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক না কেন, কৃষক-শ্রমিক বা চাকরিজীবী যেই হোন না কেন, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া সবার জন্যই বাজারদর এখন বড় মাথাব্যথার কারণ। জীবনযাত্রার মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ সবখানেই। কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কীভাবে সামলাবেন। অর্থনীতির বিশেষ এই সময়ে মানুষকে স্বস্তি দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের এগুনোর কথা। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে নাভিশ্বাস অবস্থা সবার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে দায়সারা গোছের পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিছু হবে না। এজন্য কার্যকর ও জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

শুক্রবার, ০৮ এপ্রিল ২০২২ , ২৫ চৈত্র ১৪২৮ ০৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

নিত্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে

রেজাউল করিম খোকন

তিন কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে-করোনার প্রকোপ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া। ২০২০ সালে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ায় চাহিদা কমে গিয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমে গিয়েছিল। গত বছরের শেষ দিকে করোনার প্রকোপ কমায় হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও সচল হতে থাকে। বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অন্যান্য প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়ার কারণে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে দেশ মূল্যস্ফীতি আমদানি করছে। এতে দেশেও মূল্যস্ফীতির হারে চাপ বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়েছে। এতেও মূল্যস্ফীতি উসকে দিচ্ছে।

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের দ্বিতীয় পর্যায় এখন চলছে। কোনো কোনো প্যাকেজের তৃতীয় পর্যায় চলছে। প্যাকেজ বাস্তবায়নের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এটিও মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এসব মিলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ হার কমাতে ও অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের গতি এগিয়ে নিতে হলে অর্থনীতির সব খাতে কঠোর তদারকি অপরিহার্য। কেননা করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা থেকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিপূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করতে ঝুঁকির মাত্রা এখনো উড়ে যায়নি। নানাভাবে পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে ঝুঁকি আসতে পারে। সেদিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। গত দুই বছর করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ, কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ায় দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও বস্তি এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপের ফলে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার টিকার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতি প্রত্যাশার বেশি গতিতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আরও মনোযোগ দিতে হবে।

ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করেছে। গত অর্থবছরের শুরুর দিকে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৭৯৪ কোটি ডলার ক্রয় করেছে। অর্থবছরের শেষ দিকে আমদানির দেনা পরিশোধের চাপ বাড়ায় চাহিদার জোগান দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। বছর শেষে এসে ডলারের দাম বাড়ায় টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন হয়েছে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর উদ্যোগ নিয়েও সফলতা মিলছে না। গত অর্থবছরে এ ব্যবধান আগের চেয়ে বেশি বেড়েছে। বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এখন বিনিয়োগের চেয়ে সঞ্চয় কম। ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ব্যবধান বেড়েই চলেছে।

করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরে কমবে। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার কমলেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। প্রথম স্থানে থাকবে ভারত। তাদের প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৮ শতাংশ। তবে তা গত অর্থবছরের চেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে। মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশে বাড়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হবে পাকিস্তানে। দ্বিতীয় অবস্থানে শ্রীলংকা, তৃতীয় অবস্থানে ভারত।

করোনা-পরবর্তী চাহিদার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দেশের ভেতরেও পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। ফলে বেড়েছে আমদানি। একদিকে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও অন্যদিকে পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে আমদানি ব্যয়েও। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেই আমদানি ব্যয়ের বড় অংশ মেটানো হয়। ফলে রিজার্ভের ওপর হঠাৎ করে চাপ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এবং বিদেশে লোকজনের যাতায়াতের কারণে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। রপ্তানি আয় বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স। ঋণপ্রবাহও এখন কমেছে। এদিকে আমদানি ব্যয়সহ বিদেশে যাওয়ার খরচ বেড়েছে। ডলার ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানুষের ব্যাপক হারে দেশের বাইরে যাওয়ার কারণে হঠাৎ ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে ডলার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাটির দাম বাড়ছে। যে কারণে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এর প্রভাব পড়েছে দেশের পুরো অর্থনীতিতে, যা অস্বস্তিতে ফেলেছে জনগণকে।

আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের মাঝে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে, তা নিশ্চিত করছে না। কোভিডসহ নানা কারণে বৈষম্য বেড়েছে। তবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক দিক হলো- অর্থনীতি গতিশীল আছে। সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও লাভবান হচ্ছেন। তবে সেই লাভ হতদরিদ্রদের দরিদ্র দশা থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখছে কি না, তা দেখতে হবে। মাথাপিছু আয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক ছিল। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। করোনায় বেড়েছে দারিদ্র্য। আবার বাড়ছে মাথাপিছু আয়। জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই সময়ে।

এটা ঠিক যে মোট উৎপাদন বেড়েছে। মোট জাতীয় সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে। কিন্তু সেটা কিছু মানুষের, সবার নয়। ফলে সবার জীবনে এর প্রভাব নেই। করোনার মধ্যেও কোটিপতিদের আয় বেড়েছে। ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর আয় বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে কাজ ও ব্যবসা হারিয়েছেন। আর সাধারণ মানুষের আয় বাড়লেও তা খেয়ে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। এখন মূল্যস্ফীতির হার ছয় ভাগ।

বাংলাদেশে এই যে সবকিছুর দাম বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক সেই প্রশ্ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রতিবছর দাম বাড়ার এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় প্রধানত পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল অথবা গ্যাস-বিদ্যুৎকে ঘিরে। ভোজ্যতেলে বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর। ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় তাদের সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছেনা। সরকারের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে না গিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি বাজার মনিটরিং টিম, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন কিছুই কাজে আসছে না। বাস্তবে এখানে প্রতিযোগিতামূলক কোনো বাজার নেই। আছে সিন্ডিকেট। সাধারণ মানুষকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তুলতে হবে।

প্রকৃত অর্থেই সবার আয় বাড়তে হবে। কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দরকার। বাংলাদেশে গ্রাম বা শহর যেখানেই হোক না কেন, কৃষক-শ্রমিক বা চাকরিজীবী যেই হোন না কেন, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া সবার জন্যই বাজারদর এখন বড় মাথাব্যথার কারণ। জীবনযাত্রার মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ সবখানেই। কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কীভাবে সামলাবেন। অর্থনীতির বিশেষ এই সময়ে মানুষকে স্বস্তি দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের এগুনোর কথা। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে নাভিশ্বাস অবস্থা সবার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে দায়সারা গোছের পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিছু হবে না। এজন্য কার্যকর ও জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]