সালমা তালুকদার
কি কারনে দিন দিন পৃথিবীতে বিশেষ শিশুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে তার সুনির্দিষ্ট কারন অজানা। পন্ডিত ব্যক্তিরাও পরিস্কারভাবে কিছু বলতে পারেন না। বিশেষ শিশু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন আমরা নতুন নতুন ঘটনার সম্মুখীন হই। এবং প্রতিদিন উপলব্ধি করি এ বিষয়ে আরো পড়তে হবে, আরো জানতে হবে।
বিশেষ শিশুরা যেসব আচরণ করে তার প্রায় সবগুলোই স্বাভাবিক মানুষের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ সরাসরি শিশুর অভিভাবককে জিজ্ঞেস করে। কেউ চুপ করে দেখে গিয়ে বাসায় আলোচনা সমালোচনা করে। আর আলোচনা সমালোচনা গুলোও এমন হয় যে, এসব কথা বিশেষ শিশুর অভিভাবক শুনলে কষ্ট পাবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, কথার ভয়ে বিশেষ শিশুর অভিভাবকগন শিশুটিকে ঘরে আটকে রাখে। বাইরে বের করতে চায় না। এই কারনে শিশুটি কিছু শেখে না। তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। একসময় শিশুটি জড়পদার্থে পরিনত হয়।
২১ বছর আগেও বিশেষ শিশুদের চোখের আওতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন যে কোন জনসংখ্যার দিকে তাকালেই এই সংখ্যাটা খুব সহজেই চোখে পরে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিশেষ শিশুর সংখ্যাটা চোখে পরার মত হলেও আমাদের সমাজের ও পরিবারের ঔদাসিন্যের কারনে এদের নিয়ে কাজ করা মুশকিল হয়ে পরেছে। যে পরিবারে একটি বিশেষ শিশুর জন্ম হয়,হোক সে Autism, ID, Down’s কিংবা HI, VI সেই পরিবারের অনেক বড় একটা সময় চলে যায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে। এসব করতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে যায়। আর সেই সুযোগে শিশুর Early Intervention এর সময়টা পার হয়ে যায়। অথচ বয়স কম থাকা অবস্থায় তাদের নিয়ে কাজ করা সহজ হয়। এবং দিনশেষে ভালো একটা রেজাল্ট পাওয়া যায়।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশ ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। ২১ বছর আগে আমরা বিশেষ শিশু সম্পর্কে জানতাম না ঠিকই কিন্তু এই ২১ বছর পর এসে আমরা বিশেষ শিশুর Management & Education দেয়ার সব রকম নিয়মকানুন জানি। এবং ইন্টারনেটের বদৌলতে বিশেষ শিশুর ও তার পরিবারের সফলতার গল্প সম্পর্কে ও আমরা অবহিত। তবে যে পরিবার তার শিশুটিকে নিয়ে আজ সফল তার এই পর্যন্ত আসার রাস্তাটা বড় কণ্টকাকীর্ণ ছিল। এই রাস্তাটা এখনো সেই অবস্থায় আছে। বরং আরো একটু চ্যালেন্জিং হয়ে উঠেছে বৈকি। কারন এখন চারপাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত বিশেষ শিশুদের উদ্দেশ্য করে গজিয়ে উঠছে বিশেষ স্কুল। এই স্কুল গুলোতে পরামর্শ দেয়া হয় না। সরাসরি ভর্তি করানো হয়। শুরুতেই মোটা অংকের টাকা নিয়ে নেয়া হয়। তারপর অভিভাবকদের দেখানো হয় ওয়ান টু ওয়ান কাজ হচ্ছে। স্পেশাল এডুকেটর, থেরাপিস্টের একটা টিম কাজ করে। মেইন ফোকাস থাকে থেরাপি। আর থেরাপিস্ট থেরাপি দেয় একা একা। বাবা, মাকে না দেখিয়ে। আর তাই অভিভাবক গন বেশিরভাগ সময় থেরাপির বিষয়গুলো সম্পর্কে অজানা থাকেন। অথচ একজন বিশেষ শিশুকে নিয়ে কাজ করতে হলে পুরো টীমের একসাথে কাজ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, যার প্রতিষ্ঠান তিনি এই বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ। যাদের স্পেশাল এডুকেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তারা বেশিরভাগ সময় ঐ স্কুলে এসে তারপর দেখেছে বিশেষ শিশুদের আচরণ কেমন। মানে তাদের আগে থেকে কোন প্রশিক্ষন ছিল না। শুধুমাত্র থেরাপিস্টদের কেন্দ্র করে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যায়। তাহলে সেটাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। সেটা তো থেরাপি সেন্টার হওয়া উচিৎ। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কখনো থেরাপি কেন্দ্রিক হয় না। সেখানে শিক্ষা দেয়া হয়। একজন মানুষের উন্নতির জন্য শিক্ষা একটা অতি জরুরি বিষয়৷ যেখানে থাকবে সঠিকভাবে জীবন যাপনের সব রকম কৌশল। শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি শুধুমাত্র সার্টিফিকেট। কিন্তু এটা সঠিক নয়। শিক্ষা মানে একজন মানুষের পরিপূর্ণ জীবন যাপন পদ্ধতির কৌশল অবলম্বন। সেই জায়গা থেকে বিশেষ শিশুদের জন্য শিক্ষা অনেক বেশি জরুরি। আমি থেরাপিওটিক কাজগুলোকে অস্বীকার করছি না। অস্বিকার করার কোন রকম সুযোগও নেই৷ তবে একটা বিষয়ে আমাদের সবারই চিন্তার জায়গাটা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।
একজন বিশেষ শিশুর নানা রকম শারীরিক সমস্যা থাকে। কারো হাতে পায়ে সমস্যা থাকে। কেউ nonverbal থাকে অর্থাৎ কথা বলতে পারে না। কারো sensory problem থাকে। বিশেষ শিশুদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। শরীরের দেখা না দেখা অংশ গুলোর সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই থেরাপির প্রয়োজন আছে। আরো একটু ক্লিয়ার করে যদি বলি, SLT অর্থাৎ speech and Language Therapy কাজ করে কথা বলা নিয়ে। মুখের বিভিন্ন রকম exercise করিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে একজন Therapist চেষ্টা করেন শিশুটির মুখের ভাষার উন্নতি করতে। অন্যদিকে একজন OT অর্থাৎ Occupational Therapist কাজ করেন শিশুর Sensory Issues গুলো নিয়ে। এই কাজগুলোর মাধ্যমে শিশুকে তার নিজের ভেতরের ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করা হয়। বাকি রইলো PT অর্থাৎ physiotherapy.. এই থেরাপি সবার বেলায় প্রযোজ্য নয়। বিশেষ করে CP শিশু অর্থাৎ সেরেব্রাল পালসি শিশুদের এই থেরাপিটা লাগে। এছাড়া অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, আইডি শিশুর অবস্থা বুঝে ফিজিও থেরাপির প্রয়োজন হয়।
এই যে এতক্ষন থেরাপিগুলো সম্পর্কে ও এর কাজ সম্পর্কে বললাম এখানে কোথাও শিক্ষা সংক্রান্ত কিছু নেই। কারন এগুলো শুধুমাত্র একজন বিশেষ শিশুর ভাষা সমস্যা , ইন্দ্রিয়ের সমস্যা, হাত পায়ের সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তাহলে কে শিক্ষা দেয়? শিক্ষা দেয় স্পেশাল এডুকেটর। একজন বিশেষ শিক্ষক একজন শিশুর সবকিছু সম্পর্কে দক্ষ হয়ে থাকেন। তিনি একাধারে শিক্ষক, থেরাপিস্ট, কাউন্সিলর, সমন্বয়ক। থেরাপির প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি অবহিত থাকেন। কারন একটা প্রতিষ্ঠানে একজন শিশু সপ্তাহে একটা বা দুটো থেরাপি পেয়ে থাকে। কিন্তু সপ্তাহের পুরো পাঁচ দিন সে শ্রেনীকক্ষে শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকে। তাই শিক্ষক তাকে তার বিকাশের জায়গাগুলোতে যেমন সাহায্য করেন তেমনি প্রয়োজনে থেরাপি গুলোও দিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে শিশুর অভিভাবকদের সাথে parenting এর কাজটাও তিনি করেন। বিশেষ শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। একজন শিশুর বিকাশের পেছনে বিশেষ শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এই কথা প্রতিষ্ঠান প্রধান হতে শুরু করে বিশেষ শিশুর অভিভাবক, তার আত্মীয় স্বজন এমনকি থেরাপিস্টদের ও বুঝতে হবে। তাহলেই শিশুর বিকাশ সম্ভব। অথচ চারপাশে তাকালেই দেখি অভিভাবক ছুটছেন ভালো থেরাপিস্টের খোঁজে। ডাক্তারের খোঁজে। কিন্তু ওর যে দৈনন্দিন রুটিনের কোন কিছু ঠিক হচ্ছে না, সেদিকে কারো নজর নেই। শিশুটি যখন কাঁদামাটি অবস্থায় থাকে তখন তাকে তার জীবন যাপন পদ্ধতির প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করা জরুরি।
একজন অভিভাবক দুঃখ করে বলছিলেন, আপা থেরাপিস্টরা অভিভাবকদের সামনে থেরাপি দেয় না। যদি শিখে যাই তাই। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি। মনে মনে ভাবি মানুষ হয়ে মানুষকে নিয়ে ব্যবসা কিভাবে করে তারা! যেখানে সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় একজন শিশুর মানসিক ও শারীরিক উন্নতি ঘটে এটা সকলে জানি। তবু অন্যায়টা করতে আমাদের একেবারেই কোথাও আটকায় না।
থেরাপিস্টরা যে কোন একটা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে। তাই হয়তো তারা দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে। কিন্তু এটা করলে তার নিজের কিছু হবে না মাঝ থেকে শিশুটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এটা একটা সমন্বিত কার্যক্রম। অথচ এই কাজে এসে সবাই যেন প্রতিযোগীতায় নামে। একটা সাধারণ কথা বোঝা প্রয়োজন যে, শিক্ষা সবার জন্য জরুরি। এই শিক্ষা কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষা নয়। এই শিক্ষা জীবনটা সুন্দর ভাবে পরিচালিত করার শিক্ষা। একজন বিশেষ শিশু যদি আত্ম পরিচর্যা মূলক দক্ষতা অর্জন করতে পারে তাহলে এটা তার জন্য ও তার পরিবারের জন্য অনেক বড় অর্জন। এই মুহূর্তে সেটা মনে না হলেও শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে এর সত্যতা প্রমানিত হবে। তাই সময়ের কাজ সময়ে করা ভালো।
আমি সব সময় অভিভাবকদের সচেতন হতে বলি। একমাত্র অভিভাবকের সচেতনতাই একজন বিশেষ শিশুকে
স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারে। যে পরিবারে একজন বিশেষ শিশু আছে সে পরিবারের উচিত অস্থির না হয়ে এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা। মানুষ যখন কোন বিষয়ে কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করে তখন সৃষ্টিকর্তা তাকে সহযোগিতা করেন। এই বিশ্বাস মনে লালন করে সামনে এগোন। দেখবেন কোন পথটা সঠিক সেটা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। আপনার শিশুর সমস্যা সম্পর্কে আগে নিজে জানুন। তারপর এই সমস্যা সমাধানের উপায় গুলো কি কি সেটা জানুন। এভাবে প্রতিটা পদক্ষেপ চিন্তা করে নিন নিশ্চয়ই সফল হবেন। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি ব্যঙ্গের ছাতার মত যত্রতত্র বিশেষ স্কুল গজিয়ে উঠছে। যত্রতত্র গজিয়ে উঠা কোন অন্যায় না।
অন্যায় হচ্ছে বিশেষ শিশু সম্পর্কে না জেনেই এই স্কুলগুলো দিয়ে যাচ্ছে সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষজন। বাংলাদেশের মানুষ ব্যবসা বেশ ভালো বোঝে। আর এই কারনেই সব জায়গায় এরা লাভ খোঁজে। এই করতে গিয়ে মানুষকে নিয়েও তাদের ব্যবসা করতে বাঁধে না। আমি অনেক গুলো ঘটনা জানি। তারমধ্যে দু-একটি ঘটনা শেয়ার করছি। একটা স্কুল ঢাকায় বেশ নাম করেছে। স্কুলটির প্রধান নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে করে। সেই জায়গা থেকে সে শুধুমাত্র তার মুখের কথার জোরে স্কুলটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার সুযোগ হয়েছিল স্কুল প্রধানের সামনে বসে তার কার্যক্রম দেখার। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একজন অভিভাবক উপস্থিত ছিলেন। তার বাচ্চাটা গত দুই বছর ধরে সেই প্রতিষ্ঠানে আছে। কিন্তু কোন রকম উপকার তিনি পাননি। এই ভেবে খারাপ লাগলো বাচ্চাটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু Early intervention হচ্ছে না। ছোট থাকতে শিশুর পিছিয়ে থাকা জায়গা গুলো নিয়ে কাজ না করলে পরবর্তীতে সমস্যা হয়। অনেক সময় শিশুটির কিছু জায়গায় Improvement আসে না। ছোট থাকতে মস্তিষ্ক নরম কাঁদা মাটি থাকে। যে শিক্ষা দেয়া হবে সেটা শিশু শিখে যাবে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে সেটা একটু কঠিন হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন তিনি আলাদা রুমে আলাদা ভাবে একজন শিক্ষকের তত্বাবধানে একজন শিশুকে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাহলে কথা হচ্ছে দুই বছরেও শিশুর কোন improvement আসে নাই কেন! এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি কেবল বললেন সবার তো উন্নতি আসে না। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম তিনি বাচ্চা ভর্তি নেন দেড় লাখ টাকায়। এবং মাসিক বেতন ৮০০০ টাকা।
এটা গেল একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের কথা। এবার আসি একজন থেরাপিস্টের কথায়। তিনি স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে অনেক বছর চাকরী করে পরবর্তীতে সেখান থেকে বের হয়ে নিজে একটি প্রতিষ্ঠান দেন। খোঁজ নিয়ে দেখি ঐ প্রতিষ্ঠানে যে অভিভাবক তার শিশুকে নিয়ে যান তাকে প্রতি সেশনে মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়। সাথে বকাঝকা ফ্রী। অর্থাৎ থেরাপিস্ট শিশুর যে কোন সমস্যায় তার অভিভাবককে দায়ী করেন এবং কড়া ভাষায় বকাঝকা করেন।
যে পরিবারে একজন বিশেষ শিশু আছে সেই পরিবারের প্রতিটা দিন যেন যুদ্ধের ময়দান। এমন যখন অবস্থা তখন ঐ পরিবারের অভিভাবকের প্রতিনিয়ত কাউন্সিলিং প্রয়োজন। তা না হলে তার সন্তানের পেছনে উন্নতির জন্য তিনি তেমন ভুমিকা রাখতে পারবেন না। নিজের মস্তিষ্ক যখন অস্থির তখন সন্তানের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করবেন কি করে। তাই একজন স্পেশাল এডুকেটরের একটা বড় ভূমিকা থাকে অভিভাবকদের কাউন্সিলিং এর পেছনে। শিশুর সাথে কাজ করার সাথে সাথে একজন স্পেশাল এডুকেটর অবশ্যই তার অভিভাবক নিয়ে কাজ করবেন। একজন অভিভাবক যেন তার শিশুর শিক্ষককে দেখলে অটোমেটিক মন ভালো হয়ে যায়। তার সন্তানের উন্নতির পেছনে স্বতস্ফুর্তভাবে কাজ করেন সেই চেষ্টা একজন স্পেশাল এডুকেটরের থাকতে হবে। এখানে থেরাপিস্টদের ভূমিকাও নিতান্ত কম নয়।
মোট কথা হলো স্পেশাল এডুকেটর, থেরাপিস্ট, অভিভাবক, বাড়ির কাজের লোক, দারোয়ান, প্রতিবেশি, পজিটিভ মানসিকতার আত্মীয়স্বজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে একজন বিশেষ শিশু সমাজে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে। আমাকে অনেক সময় অনেক অভিভাবক জিজ্ঞেস করেন, এরা কি কখনো ভালো হয় ম্যাডাম। তাদের জন্য বলছি, যে কোন চেষ্টা কখনো বৃথা যায় না। যদি সত্যি সেই চেষ্টাটা আন্তরিক হয়। তাছাড়া আমরা বেশি চিন্তা করতে গিয়ে, বিশেষ শিশুর বেশি কেয়ার নিতে গিয়ে বরং ক্ষতি করে ফেলি। খুব ভালো হতো যদি বিশেষ শিশুটিকে বিশেষ না ভেবে অথবা বিশেষ ভাবে পরিচর্যা না করে পরিবারের অন্য ছোট সদস্যের মত লালন পালন করা যেত।
যাই হোক, পরিশেষে বলতে চাই সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা হলে পরিবারের বিশেষ শিশুটি হয়ে উঠতে পারে সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবারের গর্ব। তাই অবহেলা নয় বরং যে কোন কাজে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের বিশেষ শিশুকে সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আর এই গাইডলাইনটা পাওয়ার জন্য অভিভাবক তার নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তাকে সঠিক মানুষটির কাছে পৌছে দিবেন। এই বিশ্বাসই হচ্ছে শিশুটির সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রথম সোপান।
[লেখক: স্পেশাল এডুকেটর, ব্লু স্কাই বিশেষ স্কুল, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট]
শুক্রবার, ০৮ এপ্রিল ২০২২ , ২৫ চৈত্র ১৪২৮ ০৬ রমাদ্বান ১৪৪৩
সালমা তালুকদার
কি কারনে দিন দিন পৃথিবীতে বিশেষ শিশুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে তার সুনির্দিষ্ট কারন অজানা। পন্ডিত ব্যক্তিরাও পরিস্কারভাবে কিছু বলতে পারেন না। বিশেষ শিশু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন আমরা নতুন নতুন ঘটনার সম্মুখীন হই। এবং প্রতিদিন উপলব্ধি করি এ বিষয়ে আরো পড়তে হবে, আরো জানতে হবে।
বিশেষ শিশুরা যেসব আচরণ করে তার প্রায় সবগুলোই স্বাভাবিক মানুষের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ সরাসরি শিশুর অভিভাবককে জিজ্ঞেস করে। কেউ চুপ করে দেখে গিয়ে বাসায় আলোচনা সমালোচনা করে। আর আলোচনা সমালোচনা গুলোও এমন হয় যে, এসব কথা বিশেষ শিশুর অভিভাবক শুনলে কষ্ট পাবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, কথার ভয়ে বিশেষ শিশুর অভিভাবকগন শিশুটিকে ঘরে আটকে রাখে। বাইরে বের করতে চায় না। এই কারনে শিশুটি কিছু শেখে না। তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। একসময় শিশুটি জড়পদার্থে পরিনত হয়।
২১ বছর আগেও বিশেষ শিশুদের চোখের আওতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন যে কোন জনসংখ্যার দিকে তাকালেই এই সংখ্যাটা খুব সহজেই চোখে পরে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিশেষ শিশুর সংখ্যাটা চোখে পরার মত হলেও আমাদের সমাজের ও পরিবারের ঔদাসিন্যের কারনে এদের নিয়ে কাজ করা মুশকিল হয়ে পরেছে। যে পরিবারে একটি বিশেষ শিশুর জন্ম হয়,হোক সে Autism, ID, Down’s কিংবা HI, VI সেই পরিবারের অনেক বড় একটা সময় চলে যায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে। এসব করতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে যায়। আর সেই সুযোগে শিশুর Early Intervention এর সময়টা পার হয়ে যায়। অথচ বয়স কম থাকা অবস্থায় তাদের নিয়ে কাজ করা সহজ হয়। এবং দিনশেষে ভালো একটা রেজাল্ট পাওয়া যায়।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশ ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। ২১ বছর আগে আমরা বিশেষ শিশু সম্পর্কে জানতাম না ঠিকই কিন্তু এই ২১ বছর পর এসে আমরা বিশেষ শিশুর Management & Education দেয়ার সব রকম নিয়মকানুন জানি। এবং ইন্টারনেটের বদৌলতে বিশেষ শিশুর ও তার পরিবারের সফলতার গল্প সম্পর্কে ও আমরা অবহিত। তবে যে পরিবার তার শিশুটিকে নিয়ে আজ সফল তার এই পর্যন্ত আসার রাস্তাটা বড় কণ্টকাকীর্ণ ছিল। এই রাস্তাটা এখনো সেই অবস্থায় আছে। বরং আরো একটু চ্যালেন্জিং হয়ে উঠেছে বৈকি। কারন এখন চারপাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত বিশেষ শিশুদের উদ্দেশ্য করে গজিয়ে উঠছে বিশেষ স্কুল। এই স্কুল গুলোতে পরামর্শ দেয়া হয় না। সরাসরি ভর্তি করানো হয়। শুরুতেই মোটা অংকের টাকা নিয়ে নেয়া হয়। তারপর অভিভাবকদের দেখানো হয় ওয়ান টু ওয়ান কাজ হচ্ছে। স্পেশাল এডুকেটর, থেরাপিস্টের একটা টিম কাজ করে। মেইন ফোকাস থাকে থেরাপি। আর থেরাপিস্ট থেরাপি দেয় একা একা। বাবা, মাকে না দেখিয়ে। আর তাই অভিভাবক গন বেশিরভাগ সময় থেরাপির বিষয়গুলো সম্পর্কে অজানা থাকেন। অথচ একজন বিশেষ শিশুকে নিয়ে কাজ করতে হলে পুরো টীমের একসাথে কাজ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, যার প্রতিষ্ঠান তিনি এই বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ। যাদের স্পেশাল এডুকেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তারা বেশিরভাগ সময় ঐ স্কুলে এসে তারপর দেখেছে বিশেষ শিশুদের আচরণ কেমন। মানে তাদের আগে থেকে কোন প্রশিক্ষন ছিল না। শুধুমাত্র থেরাপিস্টদের কেন্দ্র করে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যায়। তাহলে সেটাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। সেটা তো থেরাপি সেন্টার হওয়া উচিৎ। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কখনো থেরাপি কেন্দ্রিক হয় না। সেখানে শিক্ষা দেয়া হয়। একজন মানুষের উন্নতির জন্য শিক্ষা একটা অতি জরুরি বিষয়৷ যেখানে থাকবে সঠিকভাবে জীবন যাপনের সব রকম কৌশল। শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি শুধুমাত্র সার্টিফিকেট। কিন্তু এটা সঠিক নয়। শিক্ষা মানে একজন মানুষের পরিপূর্ণ জীবন যাপন পদ্ধতির কৌশল অবলম্বন। সেই জায়গা থেকে বিশেষ শিশুদের জন্য শিক্ষা অনেক বেশি জরুরি। আমি থেরাপিওটিক কাজগুলোকে অস্বীকার করছি না। অস্বিকার করার কোন রকম সুযোগও নেই৷ তবে একটা বিষয়ে আমাদের সবারই চিন্তার জায়গাটা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।
একজন বিশেষ শিশুর নানা রকম শারীরিক সমস্যা থাকে। কারো হাতে পায়ে সমস্যা থাকে। কেউ nonverbal থাকে অর্থাৎ কথা বলতে পারে না। কারো sensory problem থাকে। বিশেষ শিশুদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। শরীরের দেখা না দেখা অংশ গুলোর সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই থেরাপির প্রয়োজন আছে। আরো একটু ক্লিয়ার করে যদি বলি, SLT অর্থাৎ speech and Language Therapy কাজ করে কথা বলা নিয়ে। মুখের বিভিন্ন রকম exercise করিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে একজন Therapist চেষ্টা করেন শিশুটির মুখের ভাষার উন্নতি করতে। অন্যদিকে একজন OT অর্থাৎ Occupational Therapist কাজ করেন শিশুর Sensory Issues গুলো নিয়ে। এই কাজগুলোর মাধ্যমে শিশুকে তার নিজের ভেতরের ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করা হয়। বাকি রইলো PT অর্থাৎ physiotherapy.. এই থেরাপি সবার বেলায় প্রযোজ্য নয়। বিশেষ করে CP শিশু অর্থাৎ সেরেব্রাল পালসি শিশুদের এই থেরাপিটা লাগে। এছাড়া অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, আইডি শিশুর অবস্থা বুঝে ফিজিও থেরাপির প্রয়োজন হয়।
এই যে এতক্ষন থেরাপিগুলো সম্পর্কে ও এর কাজ সম্পর্কে বললাম এখানে কোথাও শিক্ষা সংক্রান্ত কিছু নেই। কারন এগুলো শুধুমাত্র একজন বিশেষ শিশুর ভাষা সমস্যা , ইন্দ্রিয়ের সমস্যা, হাত পায়ের সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তাহলে কে শিক্ষা দেয়? শিক্ষা দেয় স্পেশাল এডুকেটর। একজন বিশেষ শিক্ষক একজন শিশুর সবকিছু সম্পর্কে দক্ষ হয়ে থাকেন। তিনি একাধারে শিক্ষক, থেরাপিস্ট, কাউন্সিলর, সমন্বয়ক। থেরাপির প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি অবহিত থাকেন। কারন একটা প্রতিষ্ঠানে একজন শিশু সপ্তাহে একটা বা দুটো থেরাপি পেয়ে থাকে। কিন্তু সপ্তাহের পুরো পাঁচ দিন সে শ্রেনীকক্ষে শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকে। তাই শিক্ষক তাকে তার বিকাশের জায়গাগুলোতে যেমন সাহায্য করেন তেমনি প্রয়োজনে থেরাপি গুলোও দিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে শিশুর অভিভাবকদের সাথে parenting এর কাজটাও তিনি করেন। বিশেষ শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। একজন শিশুর বিকাশের পেছনে বিশেষ শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এই কথা প্রতিষ্ঠান প্রধান হতে শুরু করে বিশেষ শিশুর অভিভাবক, তার আত্মীয় স্বজন এমনকি থেরাপিস্টদের ও বুঝতে হবে। তাহলেই শিশুর বিকাশ সম্ভব। অথচ চারপাশে তাকালেই দেখি অভিভাবক ছুটছেন ভালো থেরাপিস্টের খোঁজে। ডাক্তারের খোঁজে। কিন্তু ওর যে দৈনন্দিন রুটিনের কোন কিছু ঠিক হচ্ছে না, সেদিকে কারো নজর নেই। শিশুটি যখন কাঁদামাটি অবস্থায় থাকে তখন তাকে তার জীবন যাপন পদ্ধতির প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করা জরুরি।
একজন অভিভাবক দুঃখ করে বলছিলেন, আপা থেরাপিস্টরা অভিভাবকদের সামনে থেরাপি দেয় না। যদি শিখে যাই তাই। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি। মনে মনে ভাবি মানুষ হয়ে মানুষকে নিয়ে ব্যবসা কিভাবে করে তারা! যেখানে সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় একজন শিশুর মানসিক ও শারীরিক উন্নতি ঘটে এটা সকলে জানি। তবু অন্যায়টা করতে আমাদের একেবারেই কোথাও আটকায় না।
থেরাপিস্টরা যে কোন একটা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে। তাই হয়তো তারা দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে। কিন্তু এটা করলে তার নিজের কিছু হবে না মাঝ থেকে শিশুটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এটা একটা সমন্বিত কার্যক্রম। অথচ এই কাজে এসে সবাই যেন প্রতিযোগীতায় নামে। একটা সাধারণ কথা বোঝা প্রয়োজন যে, শিক্ষা সবার জন্য জরুরি। এই শিক্ষা কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষা নয়। এই শিক্ষা জীবনটা সুন্দর ভাবে পরিচালিত করার শিক্ষা। একজন বিশেষ শিশু যদি আত্ম পরিচর্যা মূলক দক্ষতা অর্জন করতে পারে তাহলে এটা তার জন্য ও তার পরিবারের জন্য অনেক বড় অর্জন। এই মুহূর্তে সেটা মনে না হলেও শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে এর সত্যতা প্রমানিত হবে। তাই সময়ের কাজ সময়ে করা ভালো।
আমি সব সময় অভিভাবকদের সচেতন হতে বলি। একমাত্র অভিভাবকের সচেতনতাই একজন বিশেষ শিশুকে
স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারে। যে পরিবারে একজন বিশেষ শিশু আছে সে পরিবারের উচিত অস্থির না হয়ে এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা। মানুষ যখন কোন বিষয়ে কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করে তখন সৃষ্টিকর্তা তাকে সহযোগিতা করেন। এই বিশ্বাস মনে লালন করে সামনে এগোন। দেখবেন কোন পথটা সঠিক সেটা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। আপনার শিশুর সমস্যা সম্পর্কে আগে নিজে জানুন। তারপর এই সমস্যা সমাধানের উপায় গুলো কি কি সেটা জানুন। এভাবে প্রতিটা পদক্ষেপ চিন্তা করে নিন নিশ্চয়ই সফল হবেন। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি ব্যঙ্গের ছাতার মত যত্রতত্র বিশেষ স্কুল গজিয়ে উঠছে। যত্রতত্র গজিয়ে উঠা কোন অন্যায় না।
অন্যায় হচ্ছে বিশেষ শিশু সম্পর্কে না জেনেই এই স্কুলগুলো দিয়ে যাচ্ছে সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষজন। বাংলাদেশের মানুষ ব্যবসা বেশ ভালো বোঝে। আর এই কারনেই সব জায়গায় এরা লাভ খোঁজে। এই করতে গিয়ে মানুষকে নিয়েও তাদের ব্যবসা করতে বাঁধে না। আমি অনেক গুলো ঘটনা জানি। তারমধ্যে দু-একটি ঘটনা শেয়ার করছি। একটা স্কুল ঢাকায় বেশ নাম করেছে। স্কুলটির প্রধান নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে করে। সেই জায়গা থেকে সে শুধুমাত্র তার মুখের কথার জোরে স্কুলটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার সুযোগ হয়েছিল স্কুল প্রধানের সামনে বসে তার কার্যক্রম দেখার। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একজন অভিভাবক উপস্থিত ছিলেন। তার বাচ্চাটা গত দুই বছর ধরে সেই প্রতিষ্ঠানে আছে। কিন্তু কোন রকম উপকার তিনি পাননি। এই ভেবে খারাপ লাগলো বাচ্চাটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু Early intervention হচ্ছে না। ছোট থাকতে শিশুর পিছিয়ে থাকা জায়গা গুলো নিয়ে কাজ না করলে পরবর্তীতে সমস্যা হয়। অনেক সময় শিশুটির কিছু জায়গায় Improvement আসে না। ছোট থাকতে মস্তিষ্ক নরম কাঁদা মাটি থাকে। যে শিক্ষা দেয়া হবে সেটা শিশু শিখে যাবে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে সেটা একটু কঠিন হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন তিনি আলাদা রুমে আলাদা ভাবে একজন শিক্ষকের তত্বাবধানে একজন শিশুকে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাহলে কথা হচ্ছে দুই বছরেও শিশুর কোন improvement আসে নাই কেন! এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি কেবল বললেন সবার তো উন্নতি আসে না। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম তিনি বাচ্চা ভর্তি নেন দেড় লাখ টাকায়। এবং মাসিক বেতন ৮০০০ টাকা।
এটা গেল একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের কথা। এবার আসি একজন থেরাপিস্টের কথায়। তিনি স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে অনেক বছর চাকরী করে পরবর্তীতে সেখান থেকে বের হয়ে নিজে একটি প্রতিষ্ঠান দেন। খোঁজ নিয়ে দেখি ঐ প্রতিষ্ঠানে যে অভিভাবক তার শিশুকে নিয়ে যান তাকে প্রতি সেশনে মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়। সাথে বকাঝকা ফ্রী। অর্থাৎ থেরাপিস্ট শিশুর যে কোন সমস্যায় তার অভিভাবককে দায়ী করেন এবং কড়া ভাষায় বকাঝকা করেন।
যে পরিবারে একজন বিশেষ শিশু আছে সেই পরিবারের প্রতিটা দিন যেন যুদ্ধের ময়দান। এমন যখন অবস্থা তখন ঐ পরিবারের অভিভাবকের প্রতিনিয়ত কাউন্সিলিং প্রয়োজন। তা না হলে তার সন্তানের পেছনে উন্নতির জন্য তিনি তেমন ভুমিকা রাখতে পারবেন না। নিজের মস্তিষ্ক যখন অস্থির তখন সন্তানের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করবেন কি করে। তাই একজন স্পেশাল এডুকেটরের একটা বড় ভূমিকা থাকে অভিভাবকদের কাউন্সিলিং এর পেছনে। শিশুর সাথে কাজ করার সাথে সাথে একজন স্পেশাল এডুকেটর অবশ্যই তার অভিভাবক নিয়ে কাজ করবেন। একজন অভিভাবক যেন তার শিশুর শিক্ষককে দেখলে অটোমেটিক মন ভালো হয়ে যায়। তার সন্তানের উন্নতির পেছনে স্বতস্ফুর্তভাবে কাজ করেন সেই চেষ্টা একজন স্পেশাল এডুকেটরের থাকতে হবে। এখানে থেরাপিস্টদের ভূমিকাও নিতান্ত কম নয়।
মোট কথা হলো স্পেশাল এডুকেটর, থেরাপিস্ট, অভিভাবক, বাড়ির কাজের লোক, দারোয়ান, প্রতিবেশি, পজিটিভ মানসিকতার আত্মীয়স্বজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে একজন বিশেষ শিশু সমাজে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে। আমাকে অনেক সময় অনেক অভিভাবক জিজ্ঞেস করেন, এরা কি কখনো ভালো হয় ম্যাডাম। তাদের জন্য বলছি, যে কোন চেষ্টা কখনো বৃথা যায় না। যদি সত্যি সেই চেষ্টাটা আন্তরিক হয়। তাছাড়া আমরা বেশি চিন্তা করতে গিয়ে, বিশেষ শিশুর বেশি কেয়ার নিতে গিয়ে বরং ক্ষতি করে ফেলি। খুব ভালো হতো যদি বিশেষ শিশুটিকে বিশেষ না ভেবে অথবা বিশেষ ভাবে পরিচর্যা না করে পরিবারের অন্য ছোট সদস্যের মত লালন পালন করা যেত।
যাই হোক, পরিশেষে বলতে চাই সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা হলে পরিবারের বিশেষ শিশুটি হয়ে উঠতে পারে সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবারের গর্ব। তাই অবহেলা নয় বরং যে কোন কাজে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের বিশেষ শিশুকে সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। আর এই গাইডলাইনটা পাওয়ার জন্য অভিভাবক তার নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তাকে সঠিক মানুষটির কাছে পৌছে দিবেন। এই বিশ্বাসই হচ্ছে শিশুটির সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রথম সোপান।
[লেখক: স্পেশাল এডুকেটর, ব্লু স্কাই বিশেষ স্কুল, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট]