রইলো বাকি এক

সাঈদ চৌধুরী

যখন প্রথম দূষণ নিয়ে কথা শুরু হলো তখন বাংলাদেশ শিল্প উন্নত দেশ নয়। এখন শিল্প উন্নত বলা না গেলেও শিল্প সম্মৃদ্ধ দেশ বাংলাদেশকে বলাই যায়। উন্নয়ন ও শিল্প-সমৃদ্ধি যখন একই সুতায় গাঁথা তখন আমরা বারবারই হোঁচট খাচ্ছি টেকসই উন্নয়নের যে ব্যাপ্তি আছে সে জায়গাটিতে। কি এক অসম অপারগতার মধ্যে বন্দী হয়ে যাচ্ছি আমরা! একদিকে দূষণ অন্যদিকে অদৃশ্যভাবে আমাদের কর্মক্ষমতা হ্রাসের যে দৌড় তা কি আমরা কোনো কৌশলে রুখে দিতে পারব?

কিছুদিন আগে বায়ুদূষণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান দূষণের দিক থেকে প্রথমে। আশ্চর্যজনকভাবে বায়ুদূষণ বাড়লেও কোনোভাবেই তা আমরা কমানোর জন্য কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিতে পারিনি। বিশ্বব্যপী সবুজ আন্দোলনের বিপরীতে গিয়ে আমরা বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে বন ধ্বংস পর্যন্ত করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ইনসিনারেশন হচ্ছে বিভিন্ন বর্জ্য। বাড়ছে মিথেন গ্যাসের আধিক্য। বাতাস নিঃশ্বাসের অনুপযোগী করে আমরাই হাতরে মরছি দিনকে দিন।

এমনি একটি সময়ে আজ শব্দদূষণেরও শীর্ষে উঠে গেল বাংলাদেশ। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসলো। শব্দদূষণে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে তিন দেশই এই দক্ষিণ এশিয়ায়। তার মধ্যে ঢাকা হলো প্রথম।

এবার শুধু বাকি রইলো পানিদূষণ। পানি পানি করে পানি দিবসে চিৎকার করে তেমন একটা লাভ নেই। দেখতে হবে কী ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা নিরাপত্তার জন্য এবং কী হচ্ছে চারিদিকে? ভূগর্ভস্থ পানিকে বিশুদ্ধ রাখতে হলে যে যে বিষয় খেয়াল রাখতে হয় তা তো আমরা খেয়াল রাখিইনি এগুলো নিয়ে করা হয়েছে উপহাস।

দৈন্যতার শীর্ষে উঠেও আমরা বলছি পানির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে।

ভূগর্ভস্থ পানিকে রক্ষা করতে হলে যা যা করনীয় তার মধ্যে অন্যতম হলো পানি কম তোলা। যেহেতু গৃহস্থালি কাজে পানি তুলতেই হচ্ছে সুতরাং শিল্পায়নের জন্য পানি ব্যবহারের কার্যকরী একটা ব্যবস্থা করা। এর মধ্যে যা করনীয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো নদীর পানি ব্যবহার উপযোগী রাখা, শিল্পের নির্দিষ্ট রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পানির রিসাইকেলিং এবং পানির ব্যবহার কমানো।

কিছুদিন আগে একটি গবেষণার তথ্য দেখলাম যে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যে পানি তোলা হয় এই প্রভাব বিবেচনায় আনলে কৃষি কাজে পরিকল্পিত পানির ব্যবহার কেন নয়? এক কেজি ধান ফলাতে যদি ৬০ লিটার পানি লাগে সেটা কমিয়ে যদি ৫০ লিটারে আনার যায় তবে কি পানির ওপর চাপ আরও কমলো না ?

শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও তাই। এক কেজি প্রোডাকশনের জন্য যদি আগে ১০০ লিটার লাগতো এখন যদি তা ক্রমান্বয়ে ৬০-৭০ লিটারে আনা যা তবে কি তা সফলতার জায়গা নয়? একারণেই পানিদূষণও মারাত্মক আকার ধারণ করবে খুব শীঘ্রই। এই একটি জায়গায় এখনো আমরা প্রথম না হলেও আমার মতে পানিদূষণই এখন সবচেয়ে ভয়ের কারণ।

এই ভয়গুলো আমলে নিয়ে জাতীয়ভাবেই একটি টার্গেট দাঁড় করে এগুতে হবে। পানিদূষণ বন্ধে শিল্পাঞ্চল ও কৃষি প্রধান অঞ্চলগুলোতে খালের মধ্যে ফ্লোমিটার লাগাতে হবে। ফ্লো দেখে একটি স্ট্যান্ডার্ড করে পানির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক একটি কেপিআই সেট করতে হবে।

পানির ব্যবহার নিয়ে পরিকল্পনার পাশাপাশি নদী দূষণ মুক্ত করতে ছোট ছোট প্রজেক্ট হাতে নেওয়া যেতে পারে। সেন্ট্রাল ইটিপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হলো বিভিন্ন ধরনের ফ্যাক্টরির পানি ট্রিট করা সমস্যা হয়ে যায়। একারণে যতটা সম্ভব একই ধরনের ফ্যাক্টরিগুলোকে একীভূত করে তাদের জন্য সরকারিভাবে সেন্ট্রাল ইটিপি তৈরি করে সেখান থেকে আবার পানি দ্বিব্যবহারের জন্য ফ্যাক্টরিগুলোর কাছে সে পানিই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।

বায়ু এবং শব্দদূষণ রোধের জন্য আধুনিক শিল্পায়নের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি চিমনি ফিল্টারিং-এর আওতায় আনতে হবে। উচ্চতা মেনে চিমনি স্থাপন করতে হবে। আধুনিক ইটভাটা নির্মাণ করতে হবে। ধূলিময় রাস্তাগুলোতে পানির ফোয়ারা ও স্প্রে সিস্টেম করতে হবে। এই স্প্রে সিস্টেম রিসাইকেল ওয়াটার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

শব্দদূষণ রোধের জন্যও কাজ অনেক। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন সব জায়গা থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা। এক পরিবেশ অধিদপ্তর দিয়ে এ বিষয়গুলো তদারকি সম্ভব নয়। পরিবেশবাদী কমিটি সরকার থেকেই করে দেওয়া প্রয়োজন। তাদের প্রস্তাবনার মাধ্যমে এবং তাদের দিক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করে এগুলো তদারকি করতে হবে।

পানির জন্য যুদ্ধ হলে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে, বাতাস দূষণ মুক্ত না থাকলে প্রাণিকুলই শেষ হয়ে যাবে, শব্দদূষণ না কমলে মানসিক অসুস্থ হয়ে মানুষ অদক্ষ হয়ে পড়বে। সাবধান হবার সময়ও শেষ। আসুন একটি চিন্তা করে দক্ষ কিছু মানুষ নিয়োগ দিয়ে এই স¤পদগুলো রক্ষা করায় উদ্যোগী হই। কেবল তাহলেই আমাদের দেশের মানুষগুলো বাঁচবে সুস্বাস্থ্যে।

রইলো বাকী এক, দুই, তিন করে করে আমরা শূন্যের দিকেই যেন যাচ্ছি। আসুন সচেতনভাবে আমাদের দেশটা গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করি ।

[লেখক : রসায়নবিদ]

শুক্রবার, ০৮ এপ্রিল ২০২২ , ২৫ চৈত্র ১৪২৮ ০৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

রইলো বাকি এক

সাঈদ চৌধুরী

যখন প্রথম দূষণ নিয়ে কথা শুরু হলো তখন বাংলাদেশ শিল্প উন্নত দেশ নয়। এখন শিল্প উন্নত বলা না গেলেও শিল্প সম্মৃদ্ধ দেশ বাংলাদেশকে বলাই যায়। উন্নয়ন ও শিল্প-সমৃদ্ধি যখন একই সুতায় গাঁথা তখন আমরা বারবারই হোঁচট খাচ্ছি টেকসই উন্নয়নের যে ব্যাপ্তি আছে সে জায়গাটিতে। কি এক অসম অপারগতার মধ্যে বন্দী হয়ে যাচ্ছি আমরা! একদিকে দূষণ অন্যদিকে অদৃশ্যভাবে আমাদের কর্মক্ষমতা হ্রাসের যে দৌড় তা কি আমরা কোনো কৌশলে রুখে দিতে পারব?

কিছুদিন আগে বায়ুদূষণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান দূষণের দিক থেকে প্রথমে। আশ্চর্যজনকভাবে বায়ুদূষণ বাড়লেও কোনোভাবেই তা আমরা কমানোর জন্য কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিতে পারিনি। বিশ্বব্যপী সবুজ আন্দোলনের বিপরীতে গিয়ে আমরা বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে বন ধ্বংস পর্যন্ত করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ইনসিনারেশন হচ্ছে বিভিন্ন বর্জ্য। বাড়ছে মিথেন গ্যাসের আধিক্য। বাতাস নিঃশ্বাসের অনুপযোগী করে আমরাই হাতরে মরছি দিনকে দিন।

এমনি একটি সময়ে আজ শব্দদূষণেরও শীর্ষে উঠে গেল বাংলাদেশ। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসলো। শব্দদূষণে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে তিন দেশই এই দক্ষিণ এশিয়ায়। তার মধ্যে ঢাকা হলো প্রথম।

এবার শুধু বাকি রইলো পানিদূষণ। পানি পানি করে পানি দিবসে চিৎকার করে তেমন একটা লাভ নেই। দেখতে হবে কী ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা নিরাপত্তার জন্য এবং কী হচ্ছে চারিদিকে? ভূগর্ভস্থ পানিকে বিশুদ্ধ রাখতে হলে যে যে বিষয় খেয়াল রাখতে হয় তা তো আমরা খেয়াল রাখিইনি এগুলো নিয়ে করা হয়েছে উপহাস।

দৈন্যতার শীর্ষে উঠেও আমরা বলছি পানির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে।

ভূগর্ভস্থ পানিকে রক্ষা করতে হলে যা যা করনীয় তার মধ্যে অন্যতম হলো পানি কম তোলা। যেহেতু গৃহস্থালি কাজে পানি তুলতেই হচ্ছে সুতরাং শিল্পায়নের জন্য পানি ব্যবহারের কার্যকরী একটা ব্যবস্থা করা। এর মধ্যে যা করনীয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো নদীর পানি ব্যবহার উপযোগী রাখা, শিল্পের নির্দিষ্ট রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পানির রিসাইকেলিং এবং পানির ব্যবহার কমানো।

কিছুদিন আগে একটি গবেষণার তথ্য দেখলাম যে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যে পানি তোলা হয় এই প্রভাব বিবেচনায় আনলে কৃষি কাজে পরিকল্পিত পানির ব্যবহার কেন নয়? এক কেজি ধান ফলাতে যদি ৬০ লিটার পানি লাগে সেটা কমিয়ে যদি ৫০ লিটারে আনার যায় তবে কি পানির ওপর চাপ আরও কমলো না ?

শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও তাই। এক কেজি প্রোডাকশনের জন্য যদি আগে ১০০ লিটার লাগতো এখন যদি তা ক্রমান্বয়ে ৬০-৭০ লিটারে আনা যা তবে কি তা সফলতার জায়গা নয়? একারণেই পানিদূষণও মারাত্মক আকার ধারণ করবে খুব শীঘ্রই। এই একটি জায়গায় এখনো আমরা প্রথম না হলেও আমার মতে পানিদূষণই এখন সবচেয়ে ভয়ের কারণ।

এই ভয়গুলো আমলে নিয়ে জাতীয়ভাবেই একটি টার্গেট দাঁড় করে এগুতে হবে। পানিদূষণ বন্ধে শিল্পাঞ্চল ও কৃষি প্রধান অঞ্চলগুলোতে খালের মধ্যে ফ্লোমিটার লাগাতে হবে। ফ্লো দেখে একটি স্ট্যান্ডার্ড করে পানির পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক একটি কেপিআই সেট করতে হবে।

পানির ব্যবহার নিয়ে পরিকল্পনার পাশাপাশি নদী দূষণ মুক্ত করতে ছোট ছোট প্রজেক্ট হাতে নেওয়া যেতে পারে। সেন্ট্রাল ইটিপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হলো বিভিন্ন ধরনের ফ্যাক্টরির পানি ট্রিট করা সমস্যা হয়ে যায়। একারণে যতটা সম্ভব একই ধরনের ফ্যাক্টরিগুলোকে একীভূত করে তাদের জন্য সরকারিভাবে সেন্ট্রাল ইটিপি তৈরি করে সেখান থেকে আবার পানি দ্বিব্যবহারের জন্য ফ্যাক্টরিগুলোর কাছে সে পানিই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।

বায়ু এবং শব্দদূষণ রোধের জন্য আধুনিক শিল্পায়নের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি চিমনি ফিল্টারিং-এর আওতায় আনতে হবে। উচ্চতা মেনে চিমনি স্থাপন করতে হবে। আধুনিক ইটভাটা নির্মাণ করতে হবে। ধূলিময় রাস্তাগুলোতে পানির ফোয়ারা ও স্প্রে সিস্টেম করতে হবে। এই স্প্রে সিস্টেম রিসাইকেল ওয়াটার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

শব্দদূষণ রোধের জন্যও কাজ অনেক। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন সব জায়গা থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা। এক পরিবেশ অধিদপ্তর দিয়ে এ বিষয়গুলো তদারকি সম্ভব নয়। পরিবেশবাদী কমিটি সরকার থেকেই করে দেওয়া প্রয়োজন। তাদের প্রস্তাবনার মাধ্যমে এবং তাদের দিক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করে এগুলো তদারকি করতে হবে।

পানির জন্য যুদ্ধ হলে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে, বাতাস দূষণ মুক্ত না থাকলে প্রাণিকুলই শেষ হয়ে যাবে, শব্দদূষণ না কমলে মানসিক অসুস্থ হয়ে মানুষ অদক্ষ হয়ে পড়বে। সাবধান হবার সময়ও শেষ। আসুন একটি চিন্তা করে দক্ষ কিছু মানুষ নিয়োগ দিয়ে এই স¤পদগুলো রক্ষা করায় উদ্যোগী হই। কেবল তাহলেই আমাদের দেশের মানুষগুলো বাঁচবে সুস্বাস্থ্যে।

রইলো বাকী এক, দুই, তিন করে করে আমরা শূন্যের দিকেই যেন যাচ্ছি। আসুন সচেতনভাবে আমাদের দেশটা গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করি ।

[লেখক : রসায়নবিদ]