মূল্য কম দেখিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

নোয়াখালী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চলছে ঘুষ বাণিজ্য আর দুর্নীতি। এখানে ঘুষের বিনিময়ে জাল কাগজপত্রে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ারও ভয়ংকর চিত্র ওঠে এসেছে। বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্য (আন্ডার ভ্যালু) দেখিয়ে জমির দলিল করা নিত্যদিনের ব্যাপার। একে প্রতি বছর কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

জমির শ্রেণী পরিবর্তন ও মূল্য কম দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন বাবুলসহ ২৭ দলিল লেখককে নোটিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়াও দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকারি রাজস্বের বাইরে দলিল প্রতি মোট মূল্যের ২ থেকে ৪% হারে কমিশন না দিলে কোনো দলিল রেজিস্ট্রি হয় না এ অফিসে। হায়ার ভ্যালু, হেবা ঘোষণাতেও নেয়া হচ্ছে বাড়তি মোটা অঙ্কের টাকা। আর এসব অনিয়মের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির নেতারা।

বুধবার ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, দলিল লেখকরা প্রথমে অফিসের প্রধান সহকারী আহসান উল্ল্যার নিকট দলিল এবং দলিলের মূল্য অনুযায়ী ঘুষের টাকা জমা দিচ্ছেন। ঘুষের টাকা বুঝে নিয়ে সিরিয়াল মোতাবেক দলিল যায় সাব-রেজিস্টারের সামনে। সাব-রেজিস্টারের এজলাসে সাব-রেজিস্টার রাজিব মজুমদারের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন বাবুল দলিলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। সে পাশে থাকায় জমির শ্রেণি পরিবর্তিত ও কাগজে গড়মিলসহ নানা ত্রুটিযুক্ত দলিলও অনেকটা বাধ্য হয়েই নিবন্ধন করতে হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রার রাজিব মজুমদারকে। পুরো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুর্নীতি আর ঘুষ ওপেন সিক্রেট।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নোয়াখালী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জাল কাগজপত্রে জমির শ্রেণি অহরহ পরিবর্তন করে কম মূল্যে দলিল সম্পাদনের অভিযোগে ৪ এপিল ২২ দলিল লেখক ও পরে তলব করা হয়েছে। আরো ৫ দলিল লেখককে নোটিশ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে উচ্চমূল্যের জমিকে কমমূল্যে দলিল সম্পাদন করে উদ্দেশ্য সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের বিশাল রাজস্ব ফাঁকি দিলেও সাব-রেজিস্ট্রার ও সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়াও রয়েছে কথিত সেরেস্তার নামে টাকা আদায়। এসব ঘুষের টাকা প্রতিটি দলিল লেখককে সরকারি অফিসের সঙ্গে হিসাব করে আলাদা বুঝিয়ে দিতে হয় সাব রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান সহকারী আহসানের।

ওয়ালী উল্ল্যাহ নামের এক জমির গ্রহীতা বলেন, ৪ লাখ টাকা মূল্যের দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকার নির্ধারিত আয়কর ও ভ্যাটের টাকার ব্যাংক ড্রাফট দেয়ার পরও অতিরিক্ত আরও ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষের এ টাকা ছাড়া জমির

দলিল সম্পাদিত হয় না।

বেলাল হোসেন নামের এক জমি গ্রহীতা বলেন, তিনি ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যের একটি দলিল সম্পাদন করতে ৬০ হাজার টাকা দাবি করলে অনেক অনুরোধের পর ও ৫৪ হাজার টাকা নিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দলিল লেখক জানান, আমরা এখানে অসহায়, দলিল প্রতি নির্ধারিত অতিরিক্ত টাকা না দিলে দলিলই গ্রহণ করবে না, রেজিষ্ট্রেশন তো দূরের কথা। কোন ধরনের প্রতিবাদ করলে সনদ বাতিল করার হুমকিও রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তাদের নির্দেশেই চলতে হয়। অফিসে এন.ফিস সহ দুই-একটি খাতে নগদ লেনদেন থাকায় ওই টাকার মাধামে ঘুষের টাকা বৈধ করা সহজ হয়। নগদ লেনদেন বন্ধ করলে ঘুষও বন্ধ হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মচারী দলিল লেখক সমিতির সভাপতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আমরা দলিল লেখক সমিতির কাছে জিম্মি। দলিল লেখক সমিতির নেতাদের নির্দেশনা না মানলে, তারা কর্মবিরতি দিয়ে বসে থাকেন। এতে অফিসের সকল কর্মকান্ড অচল হয়ে পড়ে।

সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন বাবুল ঘুষের বিনিময়ে জাল কাগজপত্রে জমির শ্রেণি অহরহ পরিবর্তন করে মূল্য কম দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, দলিল লেখাকালে জরিপ অধিদপ্তর থেকে যে কাগজগুলো আসতো, আমরা সেই অনুযায়ী শ্রেণি লিখতাম। পরবর্তীতে দেখা যায় ওই কাগজগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নাই। তাই ওই কাগজগুলো আমরা ফেলে দিই। ঘুষ লেনদেন তো দুরের কথা, দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির কোন হস্তক্ষেপই নাই।

সদর সাব-রেজিস্ট্রিার (অতি.) রাজিব মজুমদার তার অফিসে ঘুষের টাকা লেনদেন এবং এজলাসে একজন দলিল লেখক কিভাবে ওঠে এই বিষয়ে কোন সদত্তোর দিতে পারেননি।

নোয়াখালী জেলা রেজিস্ট্রার মো. আবদুল খালেক বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে এখন যেহেতু শুনেছি, তাদেরকে ডেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শনিবার, ০৯ এপ্রিল ২০২২ , ২৬ চৈত্র ১৪২৮ ০৭ রমাদ্বান ১৪৪৩

ঘুষ-দুর্নীতির আখড়া নোয়াখালী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস

মূল্য কম দেখিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

প্রতিনিধি, নোয়াখালী

নোয়াখালী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চলছে ঘুষ বাণিজ্য আর দুর্নীতি। এখানে ঘুষের বিনিময়ে জাল কাগজপত্রে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ারও ভয়ংকর চিত্র ওঠে এসেছে। বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্য (আন্ডার ভ্যালু) দেখিয়ে জমির দলিল করা নিত্যদিনের ব্যাপার। একে প্রতি বছর কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

জমির শ্রেণী পরিবর্তন ও মূল্য কম দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন বাবুলসহ ২৭ দলিল লেখককে নোটিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়াও দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকারি রাজস্বের বাইরে দলিল প্রতি মোট মূল্যের ২ থেকে ৪% হারে কমিশন না দিলে কোনো দলিল রেজিস্ট্রি হয় না এ অফিসে। হায়ার ভ্যালু, হেবা ঘোষণাতেও নেয়া হচ্ছে বাড়তি মোটা অঙ্কের টাকা। আর এসব অনিয়মের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির নেতারা।

বুধবার ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, দলিল লেখকরা প্রথমে অফিসের প্রধান সহকারী আহসান উল্ল্যার নিকট দলিল এবং দলিলের মূল্য অনুযায়ী ঘুষের টাকা জমা দিচ্ছেন। ঘুষের টাকা বুঝে নিয়ে সিরিয়াল মোতাবেক দলিল যায় সাব-রেজিস্টারের সামনে। সাব-রেজিস্টারের এজলাসে সাব-রেজিস্টার রাজিব মজুমদারের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন বাবুল দলিলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। সে পাশে থাকায় জমির শ্রেণি পরিবর্তিত ও কাগজে গড়মিলসহ নানা ত্রুটিযুক্ত দলিলও অনেকটা বাধ্য হয়েই নিবন্ধন করতে হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রার রাজিব মজুমদারকে। পুরো সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুর্নীতি আর ঘুষ ওপেন সিক্রেট।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নোয়াখালী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জাল কাগজপত্রে জমির শ্রেণি অহরহ পরিবর্তন করে কম মূল্যে দলিল সম্পাদনের অভিযোগে ৪ এপিল ২২ দলিল লেখক ও পরে তলব করা হয়েছে। আরো ৫ দলিল লেখককে নোটিশ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে উচ্চমূল্যের জমিকে কমমূল্যে দলিল সম্পাদন করে উদ্দেশ্য সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের বিশাল রাজস্ব ফাঁকি দিলেও সাব-রেজিস্ট্রার ও সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়াও রয়েছে কথিত সেরেস্তার নামে টাকা আদায়। এসব ঘুষের টাকা প্রতিটি দলিল লেখককে সরকারি অফিসের সঙ্গে হিসাব করে আলাদা বুঝিয়ে দিতে হয় সাব রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান সহকারী আহসানের।

ওয়ালী উল্ল্যাহ নামের এক জমির গ্রহীতা বলেন, ৪ লাখ টাকা মূল্যের দলিল রেজিস্ট্রি করতে সরকার নির্ধারিত আয়কর ও ভ্যাটের টাকার ব্যাংক ড্রাফট দেয়ার পরও অতিরিক্ত আরও ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষের এ টাকা ছাড়া জমির

দলিল সম্পাদিত হয় না।

বেলাল হোসেন নামের এক জমি গ্রহীতা বলেন, তিনি ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যের একটি দলিল সম্পাদন করতে ৬০ হাজার টাকা দাবি করলে অনেক অনুরোধের পর ও ৫৪ হাজার টাকা নিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দলিল লেখক জানান, আমরা এখানে অসহায়, দলিল প্রতি নির্ধারিত অতিরিক্ত টাকা না দিলে দলিলই গ্রহণ করবে না, রেজিষ্ট্রেশন তো দূরের কথা। কোন ধরনের প্রতিবাদ করলে সনদ বাতিল করার হুমকিও রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে তাদের নির্দেশেই চলতে হয়। অফিসে এন.ফিস সহ দুই-একটি খাতে নগদ লেনদেন থাকায় ওই টাকার মাধামে ঘুষের টাকা বৈধ করা সহজ হয়। নগদ লেনদেন বন্ধ করলে ঘুষও বন্ধ হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মচারী দলিল লেখক সমিতির সভাপতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আমরা দলিল লেখক সমিতির কাছে জিম্মি। দলিল লেখক সমিতির নেতাদের নির্দেশনা না মানলে, তারা কর্মবিরতি দিয়ে বসে থাকেন। এতে অফিসের সকল কর্মকান্ড অচল হয়ে পড়ে।

সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুদ্দিন বাবুল ঘুষের বিনিময়ে জাল কাগজপত্রে জমির শ্রেণি অহরহ পরিবর্তন করে মূল্য কম দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, দলিল লেখাকালে জরিপ অধিদপ্তর থেকে যে কাগজগুলো আসতো, আমরা সেই অনুযায়ী শ্রেণি লিখতাম। পরবর্তীতে দেখা যায় ওই কাগজগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোন মিল নাই। তাই ওই কাগজগুলো আমরা ফেলে দিই। ঘুষ লেনদেন তো দুরের কথা, দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু দলিল লেখক সমিতির কোন হস্তক্ষেপই নাই।

সদর সাব-রেজিস্ট্রিার (অতি.) রাজিব মজুমদার তার অফিসে ঘুষের টাকা লেনদেন এবং এজলাসে একজন দলিল লেখক কিভাবে ওঠে এই বিষয়ে কোন সদত্তোর দিতে পারেননি।

নোয়াখালী জেলা রেজিস্ট্রার মো. আবদুল খালেক বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে এখন যেহেতু শুনেছি, তাদেরকে ডেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।