টিপ সজ্জায় বাঙালি নারী

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দারের টিপ পরার কারণে পুলিশের একজন কনস্টেবল তাকে হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠার পর ওই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সংসদ সদস্য সুবর্ণা মোস্তফা ঘটনাটি সংসদে উপস্থাপনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছেই; অসংখ্য নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের টিপ পরা ছবি পোস্ট করে অভিযুক্ত পুলিশের আচরণের নিন্দা জানাচ্ছেন। টিপ পরার বিপক্ষেও একদল লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সোচ্চার। টিপের পক্ষের পোস্টগুলোতে বিপক্ষের লোকদের অশ্লীল ভাষায় কমেন্ট করতেও দেখা গেছে।

ঘটনাটি বিভিন্ন মিডিয়ায় যত সহজভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তত সহজ বলে মনে হচ্ছে না। শুধু টিপ পরার জন্য একজন পুলিশ একজন পথচারীর সঙ্গে অসদাচরণ করার কথা নয়; কারণ রাস্তায় অসংখ্য নারীকে টিপ পরা অবস্থায় দেখা যায়। টিপ পরা নিয়ে ইতোপূর্বে কোন পথচারী নারীর সঙ্গে কেউ অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে বলে শোনা যায়নি। অন্য কোন বিষয় নিয়ে দুইজনের মধ্যে বাকবিত-া হয়েছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণ লোকজনকেও পুলিশ বা মন্ত্রীদের সঙ্গে তর্ক করতে দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একটি প্রকল্প ভিজিটে গিয়ে আরেকজনের বাড়ির সম্মুখের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মিডিয়ার লোকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, হঠাৎ জমির মালিক তার ঘর থেকে বের হয়ে এসে তার বাড়ির আঙিনা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘দুঃখিত’ বলে সরে যান এবং বাকিদেরও সরে যেতে বলেন; কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের সঙ্গে বাকবিত-া করার সাহস একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তিরই রয়েছে, সাধারণ মানুষের নয়। তাহলে কি পুলিশ কনস্টেবল নিজ দায়িত্বে দেশে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন? তিনি কি দেশের বিদ্যমান অবস্থাকে ধর্মের অনুশাসন বাস্তবায়নের অনুকূল মনে করছেন? তবুও ঘটনার পূর্বাপর না জেনে অনুমান করে পুলিশকে অভিযুক্ত করে কোন পর্যালোচনা করা যথার্থ হবে না। অবশ্য ঘটনার সত্যতা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত না হলে অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তারেককে সাময়িক বরখাস্ত করারও কথা নয়।

বাঙালি সংস্কৃতির অংশ শাড়ি আর টিপ। টিপের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। টিপ বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতি বলেই কবি বলেন, ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা’। সকল প্রকার অশুভ শক্তির নজর থেকে মুক্ত রাখতে এখনো মায়েরা সরল বিশ্বাসে সন্তানের কপালে কাজলের টিপ পরিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম স্তবকেই লেখা হয়েছেÑ ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর’। বহু বছর ধরে আমাদের দেশে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে। আমাদের ঘরেও বিভিন্ন আকার ও রঙের টিপ সম্বলিত কয়েকটি প্লাস্টিক-পাতা ড্রেসিং টেবিলে সাজানো থাকত, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে মেয়েরা পরত, কিন্তু এখন আর দেখি না। কেন এখন টিপ পরে না, স্ত্রীকে তা কখনো জিজ্ঞেস করিনি। স্ত্রীর সাজের প্রতি আমার এমন নির্লিপ্ততার কৈফিয়ত বহুবার দিতে হয়েছে। তবে বিদেশে গেলে স্ত্রীর জন্য খয়েরি রঙের একটি লিপস্টিক অবশ্যই কিনতাম।

পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সৌন্দর্য চর্চা করে থাকেন। টিপ তাদের অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ। টিপ পরার এই রীতি শুধু বাঙালি জাতি বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বের ঋকবেদে টিপের উল্লেখ থাকলেও হিন্দু সমাজে এই টিপের প্রচলন শুরু হয় মাত্র এক হাজার বছর পূর্ব থেকে। হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রবল, জাতিভেদের পার্থক্য দৃশ্যমান করতে ব্রাহ্মণেরা পরতেন সাদা তিলক, বীর যোদ্ধা ক্ষত্রীয়রা লাল টিপ, বৈশ্যয়রা হলুদ এবং নিচু শ্রেণির শূদ্রদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। এই টিপ ব্যবহারে ধর্মের কোন সংশ্লেষ নেই, আছে শ্রেণি মর্যাদার প্রতীক। সমাজে লোকদের অবস্থান বা মর্যাদার মাত্রা বোঝাতে যে টিপের শুরু তা পরবর্তীতে মেয়েদের সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। টিপকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তা পরিহারের কথা বলা হলেও টিপ প্রকৃতপক্ষে ধর্মের চেয়ে বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ হিসেবে পরিগণিত। টিপ হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, সমাজের প্রচলিত রীতি। এমন রীতি মুসলিম সমাজেও চালু আছে; এই রীতি হচ্ছে নাক কান ছিদ্র করে অলঙ্কার পরা।

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে রূপচর্চার ভিন্ন ভিন্ন রীতি-পদ্ধতির চালু আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা প্রকৃতির ফুল-পাতা নিয়ে সাজতে বেশি পছন্দ করেন। আমাদের বাঙালি মেয়েরা খোঁপায় ফুল গুঁজে আসছে সেই আদিকাল থেকে, ইদানীং বিভিন্ন উৎসবে তারা ফুল-পাতার চাকতি তৈরি করে তা মাথায় পরা শুরু করেছেন। টিপ পরা নিয়ে ইসলাম ধর্মে কোন নির্দেশনা নেই; তবে অঙ্গসৌষ্ঠবের সৌন্দর্য বর্ধনে নারীর সাজসজ্জা করার অনুমোদন রয়েছে। কিছু আলেমের মতে সৌন্দর্য বর্ধনের প্রতীক হিসেবে টিপ মুসলিম নারীরাও পরতে পারবেন, তবে সেই টিপ পরে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। তাদের অভিমত হচ্ছে, মেয়েরা সাজবে বা টিপ পরবে শুধু স্বামীর জন্য, স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য, বাইরের পরপুরুষের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য নয়। এই অভিমত মেনে কোন নারী শুধু স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য টিপ পরবে বলে মনে হয় না।

ধর্মবোধের বাইরেও সংস্কৃতি আছে। সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ, অভ্যাস। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। আমাদের বাপ-দাদারা এক সময় ধূতি পরতেন, এখন আমরা পরি না। সংস্কৃতি ধর্ম থেকে আলাদা বলেই সৌদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি দিয়ে থাকেন। সংস্কৃতির ভিন্নতার জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের আচার-আচরণে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃতি আর ধর্ম পৃথক বলেই বাঙালি পহেলা বৈশাখ, শহীদ দিবস, ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে থাকে। কিন্তু ধর্মের কোন পরিবর্তন নেই, ধর্ম স্থির এবং অনমনীয়। ধর্ম মানলে পৃথিবীর যেখানেই অবস্থান হোক না কেন একই ধর্মাবলম্বীদের জীবনাচরণ এক রকম হওয়ার কথা; কিন্তু তা হচ্ছে না। ধর্মের মৌলিক বিষয়ে যেখানে আলেমদের ঐকমত্য নেই সেখানে অনুসৃত সংস্কৃতির ব্যাপারে মতভেদ থাকবেই। বর্তমান সৌদি বাদশাহর পূর্বপুরুষরা ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সৌদি আরবে নবীজীর রওজা মোবারক ছাড়া বাকি সব সাহাবীদের কবরের চিহ্ন বা স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেন, এ নিয়ে খুন, মারামারি কম হয়নি। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি কবরস্থানে স্থাপনা রয়েছে, ভেঙে ফেলার কোন আন্দোলন তো দেখি না।

জীবন সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে ধর্মের সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় ধর্মবেত্তাদের মধ্যেও চরম মতভেদ ও বিরোধের উদ্ভব হয়। ধর্মে টিপ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও অন্য ধর্মাবলম্বীর কোন সংস্কৃতি গ্রহণ করা নাজায়েজ। হাদিস মতে, ‘যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ অনেক আলেম মনে করেন, টিপ হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত বিধায় মুসলমান নারীর জন্য তা নাজায়েজ। কিন্তু আমাদের জীবনের অনেক কিছুই তো ধার করা। নিমগাছের মেছওয়াক ব্যবহার করতে এখন কাউকে দেখা যায় না, অন্য ধর্মাবলম্বীর আবিষ্কৃত টুথব্রাশ ব্যবহার করছি, ভাত খাই কাটা চামুচ দিয়ে, উটের পরিবর্তে মোটরগাড়ি ব্যবহার করছি, আলখেল্লার পরিবর্তে স্যুট-টাই পরছি, সর্বরোগের মহৌষধ কালোজিরার পরিবর্তে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আবিষ্কৃত ওষুধ-টিকা গ্রহণ করছি, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অনুসরণ করে টেবিল-চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছি। পশ্চিমা সংস্কৃতি বিধায় ইরানিরা এখন টাই পরেন না, কিন্তু আমরা পরি, ড. জাকির নায়েকও পরেন। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পূর্বের অন্য ধর্মের রীতিনীতি কি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের ধর্মে অন্তর্ভুক্ত হয়নি? ইহুদিরাও প্রার্থনা শুরু করার আগে আজানের মতো উপাসকদের সিনাগগে আসতে আহবান জানায়, ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের বহু পূর্ব থেকেই ভাইকিংসরা সমুদ্র যাত্রা শুরুর পূর্বে তাদের দেবতা ওডিনের সন্তুষ্টির জন্য জীবজন্তু উৎসর্গ করত, হিন্দুরাও দেবতার উদ্দেশ্যে পশু বলি দিত।

টিপ পরার উৎস হিসেবে ফেইসবুক এবং ইন্টারনেটে মুসলমানদের তরফ থেকে বর্ণনা করা হচ্ছেÑ নমরুদ কর্তৃক হযরত ইব্রাহিমকে (আ.) আগুনে নিক্ষেপ করার কাহিনী। আগুনে নিক্ষেপে প্রতিবন্ধক ফেরেস্তাদের তাড়াতে শয়তানের প্ররোচনায় নমরুদ কিছু পতিতাকে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরে তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মাথায় তিলক পরানো হয়, এই তিলকই নাকি টিপ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আলেম বলেন, যেহেতু নমরুদের পতিতারা টিপ পরেছে সেহেতু কোন মুসলমান নারীর টিপ পরা নাজায়েজ। অদ্ভুত যুক্তি, পতিতারা তো পোশাকও পরেন, চুল আঁচড়ান, কানে দুল পরেন, দাঁত মাজেন, খাবার খান, বিছানায় ঘুমান, হাসি পেলে হাসেন, কান্না আসলে কাঁদেন- এগুলোও কি মুসলমান নারীদের ত্যাগ করতে হবে? উপরন্তু এই কাহিনীর কোন সত্যতা নেই। কোরআন বা সহিহ হাদিসে নমরুদের নামও নেই। ইসলামের ইতিহাস, তাফসির ও সিরাত গ্রন্থগুলোতে ব্র্যাকেট ব্যবহার করে নমরুদের নামটি টেনে আনা হয়েছে। শুধু নমরুদ নয়, ঘটনাটির এমন বর্ণনাও কোরআন-হাদিসে নেই; বলা হচ্ছেÑ এ ঘটনার বর্ণনা আছে তাফসিরে মা-রেফুল কোরআন, কাসাসুল আম্বিয়া কিংবা ইবনে কাসির রচিত আদি ইসলামের ইতিহাসে। কিন্তু তাফসির আর পবিত্র কোরআন তো এক জিনিস নয়; কোরআন আল্লাহর বাণী, তাফসির মানুষের লেখা। কোরআনের তাফসির নাকি বেদাআত, বলেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর গোলাম মাওলা। কোরআনে ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে একজন খোদাদ্রোহী ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে জনৈক ব্যক্তি কর্তৃক আগুনে নিক্ষেপ করার কথা কোরআনে বলা হলেও নমরুদ, চড়ক, ফেরেস্তা, পতিতা ইত্যাদির কোন উল্লেখ নেই। সহিহ হাদিসেও যা আছে তা হলোÑ অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রার্থনা করেছিলেনÑ ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক।’

কোরআন বা হাদিস যা নিষিদ্ধ করেনি তা নাজায়েজ আখ্যা না দিয়ে কিছু আলেম ‘টিপ না পরা উত্তম’ বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে খ্রিস্টানদের কোট-প্যান্ট-টাই কিংবা ইহুদিদের জোব্বা পরলে পুরুষদের বিরুদ্ধে কেউ কোন ধর্মীয় বিধিবিধান আরোপ করেন না, আপত্তি কেবল মেয়েদের নিয়েই।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ১০ এপ্রিল ২০২২ , ২৭ চৈত্র ১৪২৮ ০৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

টিপ সজ্জায় বাঙালি নারী

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দারের টিপ পরার কারণে পুলিশের একজন কনস্টেবল তাকে হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠার পর ওই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সংসদ সদস্য সুবর্ণা মোস্তফা ঘটনাটি সংসদে উপস্থাপনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছেই; অসংখ্য নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের টিপ পরা ছবি পোস্ট করে অভিযুক্ত পুলিশের আচরণের নিন্দা জানাচ্ছেন। টিপ পরার বিপক্ষেও একদল লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সোচ্চার। টিপের পক্ষের পোস্টগুলোতে বিপক্ষের লোকদের অশ্লীল ভাষায় কমেন্ট করতেও দেখা গেছে।

ঘটনাটি বিভিন্ন মিডিয়ায় যত সহজভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তত সহজ বলে মনে হচ্ছে না। শুধু টিপ পরার জন্য একজন পুলিশ একজন পথচারীর সঙ্গে অসদাচরণ করার কথা নয়; কারণ রাস্তায় অসংখ্য নারীকে টিপ পরা অবস্থায় দেখা যায়। টিপ পরা নিয়ে ইতোপূর্বে কোন পথচারী নারীর সঙ্গে কেউ অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে বলে শোনা যায়নি। অন্য কোন বিষয় নিয়ে দুইজনের মধ্যে বাকবিত-া হয়েছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণ লোকজনকেও পুলিশ বা মন্ত্রীদের সঙ্গে তর্ক করতে দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একটি প্রকল্প ভিজিটে গিয়ে আরেকজনের বাড়ির সম্মুখের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মিডিয়ার লোকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, হঠাৎ জমির মালিক তার ঘর থেকে বের হয়ে এসে তার বাড়ির আঙিনা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘দুঃখিত’ বলে সরে যান এবং বাকিদেরও সরে যেতে বলেন; কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশের সঙ্গে বাকবিত-া করার সাহস একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তিরই রয়েছে, সাধারণ মানুষের নয়। তাহলে কি পুলিশ কনস্টেবল নিজ দায়িত্বে দেশে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন? তিনি কি দেশের বিদ্যমান অবস্থাকে ধর্মের অনুশাসন বাস্তবায়নের অনুকূল মনে করছেন? তবুও ঘটনার পূর্বাপর না জেনে অনুমান করে পুলিশকে অভিযুক্ত করে কোন পর্যালোচনা করা যথার্থ হবে না। অবশ্য ঘটনার সত্যতা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত না হলে অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তারেককে সাময়িক বরখাস্ত করারও কথা নয়।

বাঙালি সংস্কৃতির অংশ শাড়ি আর টিপ। টিপের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। টিপ বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতি বলেই কবি বলেন, ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা’। সকল প্রকার অশুভ শক্তির নজর থেকে মুক্ত রাখতে এখনো মায়েরা সরল বিশ্বাসে সন্তানের কপালে কাজলের টিপ পরিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম স্তবকেই লেখা হয়েছেÑ ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর’। বহু বছর ধরে আমাদের দেশে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে। আমাদের ঘরেও বিভিন্ন আকার ও রঙের টিপ সম্বলিত কয়েকটি প্লাস্টিক-পাতা ড্রেসিং টেবিলে সাজানো থাকত, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে মেয়েরা পরত, কিন্তু এখন আর দেখি না। কেন এখন টিপ পরে না, স্ত্রীকে তা কখনো জিজ্ঞেস করিনি। স্ত্রীর সাজের প্রতি আমার এমন নির্লিপ্ততার কৈফিয়ত বহুবার দিতে হয়েছে। তবে বিদেশে গেলে স্ত্রীর জন্য খয়েরি রঙের একটি লিপস্টিক অবশ্যই কিনতাম।

পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি সৌন্দর্য চর্চা করে থাকেন। টিপ তাদের অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ। টিপ পরার এই রীতি শুধু বাঙালি জাতি বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বের ঋকবেদে টিপের উল্লেখ থাকলেও হিন্দু সমাজে এই টিপের প্রচলন শুরু হয় মাত্র এক হাজার বছর পূর্ব থেকে। হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রবল, জাতিভেদের পার্থক্য দৃশ্যমান করতে ব্রাহ্মণেরা পরতেন সাদা তিলক, বীর যোদ্ধা ক্ষত্রীয়রা লাল টিপ, বৈশ্যয়রা হলুদ এবং নিচু শ্রেণির শূদ্রদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। এই টিপ ব্যবহারে ধর্মের কোন সংশ্লেষ নেই, আছে শ্রেণি মর্যাদার প্রতীক। সমাজে লোকদের অবস্থান বা মর্যাদার মাত্রা বোঝাতে যে টিপের শুরু তা পরবর্তীতে মেয়েদের সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। টিপকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তা পরিহারের কথা বলা হলেও টিপ প্রকৃতপক্ষে ধর্মের চেয়ে বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ হিসেবে পরিগণিত। টিপ হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, সমাজের প্রচলিত রীতি। এমন রীতি মুসলিম সমাজেও চালু আছে; এই রীতি হচ্ছে নাক কান ছিদ্র করে অলঙ্কার পরা।

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে রূপচর্চার ভিন্ন ভিন্ন রীতি-পদ্ধতির চালু আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা প্রকৃতির ফুল-পাতা নিয়ে সাজতে বেশি পছন্দ করেন। আমাদের বাঙালি মেয়েরা খোঁপায় ফুল গুঁজে আসছে সেই আদিকাল থেকে, ইদানীং বিভিন্ন উৎসবে তারা ফুল-পাতার চাকতি তৈরি করে তা মাথায় পরা শুরু করেছেন। টিপ পরা নিয়ে ইসলাম ধর্মে কোন নির্দেশনা নেই; তবে অঙ্গসৌষ্ঠবের সৌন্দর্য বর্ধনে নারীর সাজসজ্জা করার অনুমোদন রয়েছে। কিছু আলেমের মতে সৌন্দর্য বর্ধনের প্রতীক হিসেবে টিপ মুসলিম নারীরাও পরতে পারবেন, তবে সেই টিপ পরে ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। তাদের অভিমত হচ্ছে, মেয়েরা সাজবে বা টিপ পরবে শুধু স্বামীর জন্য, স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য, বাইরের পরপুরুষের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য নয়। এই অভিমত মেনে কোন নারী শুধু স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য টিপ পরবে বলে মনে হয় না।

ধর্মবোধের বাইরেও সংস্কৃতি আছে। সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ, অভ্যাস। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। আমাদের বাপ-দাদারা এক সময় ধূতি পরতেন, এখন আমরা পরি না। সংস্কৃতি ধর্ম থেকে আলাদা বলেই সৌদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি দিয়ে থাকেন। সংস্কৃতির ভিন্নতার জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের আচার-আচরণে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃতি আর ধর্ম পৃথক বলেই বাঙালি পহেলা বৈশাখ, শহীদ দিবস, ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে থাকে। কিন্তু ধর্মের কোন পরিবর্তন নেই, ধর্ম স্থির এবং অনমনীয়। ধর্ম মানলে পৃথিবীর যেখানেই অবস্থান হোক না কেন একই ধর্মাবলম্বীদের জীবনাচরণ এক রকম হওয়ার কথা; কিন্তু তা হচ্ছে না। ধর্মের মৌলিক বিষয়ে যেখানে আলেমদের ঐকমত্য নেই সেখানে অনুসৃত সংস্কৃতির ব্যাপারে মতভেদ থাকবেই। বর্তমান সৌদি বাদশাহর পূর্বপুরুষরা ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সৌদি আরবে নবীজীর রওজা মোবারক ছাড়া বাকি সব সাহাবীদের কবরের চিহ্ন বা স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেন, এ নিয়ে খুন, মারামারি কম হয়নি। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি কবরস্থানে স্থাপনা রয়েছে, ভেঙে ফেলার কোন আন্দোলন তো দেখি না।

জীবন সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে ধর্মের সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় ধর্মবেত্তাদের মধ্যেও চরম মতভেদ ও বিরোধের উদ্ভব হয়। ধর্মে টিপ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও অন্য ধর্মাবলম্বীর কোন সংস্কৃতি গ্রহণ করা নাজায়েজ। হাদিস মতে, ‘যে ব্যক্তি যার সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ অনেক আলেম মনে করেন, টিপ হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত বিধায় মুসলমান নারীর জন্য তা নাজায়েজ। কিন্তু আমাদের জীবনের অনেক কিছুই তো ধার করা। নিমগাছের মেছওয়াক ব্যবহার করতে এখন কাউকে দেখা যায় না, অন্য ধর্মাবলম্বীর আবিষ্কৃত টুথব্রাশ ব্যবহার করছি, ভাত খাই কাটা চামুচ দিয়ে, উটের পরিবর্তে মোটরগাড়ি ব্যবহার করছি, আলখেল্লার পরিবর্তে স্যুট-টাই পরছি, সর্বরোগের মহৌষধ কালোজিরার পরিবর্তে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আবিষ্কৃত ওষুধ-টিকা গ্রহণ করছি, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অনুসরণ করে টেবিল-চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছি। পশ্চিমা সংস্কৃতি বিধায় ইরানিরা এখন টাই পরেন না, কিন্তু আমরা পরি, ড. জাকির নায়েকও পরেন। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পূর্বের অন্য ধর্মের রীতিনীতি কি আল্লাহর নির্দেশে আমাদের ধর্মে অন্তর্ভুক্ত হয়নি? ইহুদিরাও প্রার্থনা শুরু করার আগে আজানের মতো উপাসকদের সিনাগগে আসতে আহবান জানায়, ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের বহু পূর্ব থেকেই ভাইকিংসরা সমুদ্র যাত্রা শুরুর পূর্বে তাদের দেবতা ওডিনের সন্তুষ্টির জন্য জীবজন্তু উৎসর্গ করত, হিন্দুরাও দেবতার উদ্দেশ্যে পশু বলি দিত।

টিপ পরার উৎস হিসেবে ফেইসবুক এবং ইন্টারনেটে মুসলমানদের তরফ থেকে বর্ণনা করা হচ্ছেÑ নমরুদ কর্তৃক হযরত ইব্রাহিমকে (আ.) আগুনে নিক্ষেপ করার কাহিনী। আগুনে নিক্ষেপে প্রতিবন্ধক ফেরেস্তাদের তাড়াতে শয়তানের প্ররোচনায় নমরুদ কিছু পতিতাকে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরে তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মাথায় তিলক পরানো হয়, এই তিলকই নাকি টিপ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আলেম বলেন, যেহেতু নমরুদের পতিতারা টিপ পরেছে সেহেতু কোন মুসলমান নারীর টিপ পরা নাজায়েজ। অদ্ভুত যুক্তি, পতিতারা তো পোশাকও পরেন, চুল আঁচড়ান, কানে দুল পরেন, দাঁত মাজেন, খাবার খান, বিছানায় ঘুমান, হাসি পেলে হাসেন, কান্না আসলে কাঁদেন- এগুলোও কি মুসলমান নারীদের ত্যাগ করতে হবে? উপরন্তু এই কাহিনীর কোন সত্যতা নেই। কোরআন বা সহিহ হাদিসে নমরুদের নামও নেই। ইসলামের ইতিহাস, তাফসির ও সিরাত গ্রন্থগুলোতে ব্র্যাকেট ব্যবহার করে নমরুদের নামটি টেনে আনা হয়েছে। শুধু নমরুদ নয়, ঘটনাটির এমন বর্ণনাও কোরআন-হাদিসে নেই; বলা হচ্ছেÑ এ ঘটনার বর্ণনা আছে তাফসিরে মা-রেফুল কোরআন, কাসাসুল আম্বিয়া কিংবা ইবনে কাসির রচিত আদি ইসলামের ইতিহাসে। কিন্তু তাফসির আর পবিত্র কোরআন তো এক জিনিস নয়; কোরআন আল্লাহর বাণী, তাফসির মানুষের লেখা। কোরআনের তাফসির নাকি বেদাআত, বলেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর গোলাম মাওলা। কোরআনে ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে একজন খোদাদ্রোহী ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে জনৈক ব্যক্তি কর্তৃক আগুনে নিক্ষেপ করার কথা কোরআনে বলা হলেও নমরুদ, চড়ক, ফেরেস্তা, পতিতা ইত্যাদির কোন উল্লেখ নেই। সহিহ হাদিসেও যা আছে তা হলোÑ অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রার্থনা করেছিলেনÑ ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক।’

কোরআন বা হাদিস যা নিষিদ্ধ করেনি তা নাজায়েজ আখ্যা না দিয়ে কিছু আলেম ‘টিপ না পরা উত্তম’ বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে খ্রিস্টানদের কোট-প্যান্ট-টাই কিংবা ইহুদিদের জোব্বা পরলে পুরুষদের বিরুদ্ধে কেউ কোন ধর্মীয় বিধিবিধান আরোপ করেন না, আপত্তি কেবল মেয়েদের নিয়েই।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]