টিপ ও বোরকা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

নারী কেন কপালে টিপ পড়ল, এটা হয়ে গেল নারীর অপরাধ। খোদ রাজধানীতে কপালে টিপ সিঁদুর ও হাতে শাখা পড়ার জন্য নিপীড়নের শিকার হন এক নারী। গণমাধ্যম সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে, টিপ পরা ওই নারীকে খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যর কাছে উৎপীড়িত হন। ওই নারী শুধুই নিগ্রহের শিকার হননি, তাকে হজম করতে হয়েছে অকথ্য ভাষার গালিগালাজ। এবং নিগ্রহকারী নারীর ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত করেছে।

এখন হয়ত কেউ কেউ বলতে থাকবেন, এটা একটি কুচক্রী মহলের কাজ। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য কোন পক্ষ কাজটি করেছে। এমন কথাটি যারা বলবেন, তা কিন্তু সঠিক না। আসলে বর্তমানে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্রটা বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়। এটা হলো উদেশ্য প্রণ্যোদিতভাবে সংঘটিত একটি ঘটনা। এই ঘটনা যে ব্যক্তিটি করেছে সে জেনে-বুঝেই করেছে। দিন দিন বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতিক পরিবেশ কোন দিকে যাচ্ছে, এই দিকগুলো নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক।

মুসলিম শাসনামলের (১৪০০-১৭৫৭ সাল) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলা জনপদের নারীরা কৃষি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নারীরা কৃষি কাজে শ্রম বিনিয়োগ করতেন। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে একই পাড়া বা মহল্লায় বসবাসরত নারীরা একত্রিত হতেন। তারা নানা গল্প আড্ডা মেতে উঠতো, কেউ কেউ গীত গাইত। তখনকার বাংলার নারীরা পান খেতেন। পান খাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের ঠোঁট রাঙাতেন লাল রঙে। তখনকার দিনে আজকের দিনের মতো লিপস্টিক ছিল না। এখনকার দিনের মতো সেই সময় বাজারে টিপ কিনতে পাওয়া যেত না, ওই সময়কার নারীরা দেশজ নানা উপকরণ দিয়ে টিপ তৈরি করে কপালে পরতেন। হাতে মেহেদি পরার প্রচলন ছিল। নারীরা নিজেদের শরীরকে পর্দার মধ্যে রাখতেন শাড়ি পরিধান করে। এটাই ছিল বাঙালি নারীর সংস্কৃতি।

বাঙালি নারীদের এ ধরনের সংস্কৃতির প্রথাটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমল এবং তথাকথিত ইসলামিক পাকিস্তানি আমলেও বহাল ছিল। শাশ্বত বাংলার সংস্কৃতির ধারাটি গত ১০-১২ বছর ধরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। পৃথিবীর উষ্ণম-লীয় মরুভূমি অঞ্চলের নারীরা রোদ তাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আপদমস্তক ঢেকে চলা ফেরা করেন। হঠাৎ করে ধর্মের নামে নারীদের পর্দাশীল করার লক্ষ্যে মরুভূমি এলাকার বোরখা প্রথা এদেশে গণহারে চালু হতে শুরু করে। আর পুরুষেরা নিজের স্ত্রীকে বোরখার মধ্যে রাখাটা নিরাপদ মনে করেন, কারণ তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষ দেখতে পারছে না।

বোরখার মাধ্যমে নিজের স্ত্রী-কন্যাকে ঢেকে রেখে বাইরে এসে কিছু পুরুষই বোরখাবিহীন নারীদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকান। এ ধরনের কিছু পুরুষেরাই রাস্তা ঘাটে চলাচল করার সময় বা অফিসে কর্মরত সহকর্মী নারী বা ক্লাবের সদস্য নারী বা বাজারে যে সব নারীরা বোরখা ছাড়া চলাফেরা করে তাদের দেখলেই তারা রসাত্মক আলাপে লিপ্ত হতে চান। আর যখন বোরখাবিহীন ওই নারী তার কুরুচিপূর্ণ কথার সঙ্গে সমন্বয় করে কথা বলতে রাজি হন না, বা তার নোংরামি ও কুরুচিপূর্ণ কথার প্রতিবাদ করেন। তখনই বেরিয়ে আসে পুরুষের আসল রূপটি। দেখা যায় ওই পুরুষটি বোরখাবিহীন নারীকে বেপর্দা আখ্যা দেয় এবং অশ্লীল গালিগালাজ করে। তাছাড়া রাজি না হওয়ায় নারীকে নানাভাবে উৎপীড়ন করে। আর তখন সমাজের কিছু মানুষ এই নারীকে বোরখা না পরার অপরাধে অপরাধী করেন।

বোরখা পড়লেই কি নারীরা পর্দাশীল হয়ে যায়? আরবের পোশাক পড়লেই কি নারীর পর্দানশীলতার পরিচয় মেলে। মানুষের মন কিন্তু পর্দা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

আরব অঞ্চলের ঘোমটা প্রথার আড়ালে চলছে পৈশাচিকভাবে নারীর নির্যাতন ও নিপীড়ন। আজকে বাংলাদেশকে যারা পর্দা প্রথার নামে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন, তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কি? তারা কি পর্দা নামে নারীদের ঢেকে রেখে নারীর ওপর নিজেদের কুরুচিপূর্ণ আকাক্সক্ষা মেটাতে চান। নাকি বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চালু করতে চান? পর্দা বা বোরখা পরার নামে মৌলবাদ চর্চা বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ, এ বোরখার আড়ালে অস্ত্র, মাদকসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা চলে রমরমা।

সরকারের উচিত নারীকে স্বাধীনভাবে নিজভূমে চলাফেরা করার অধিকারটি নিশ্চিত করা।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

রবিবার, ১০ এপ্রিল ২০২২ , ২৭ চৈত্র ১৪২৮ ০৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

টিপ ও বোরকা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

নারী কেন কপালে টিপ পড়ল, এটা হয়ে গেল নারীর অপরাধ। খোদ রাজধানীতে কপালে টিপ সিঁদুর ও হাতে শাখা পড়ার জন্য নিপীড়নের শিকার হন এক নারী। গণমাধ্যম সূত্র থেকে যতদূর জানা গেছে, টিপ পরা ওই নারীকে খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যর কাছে উৎপীড়িত হন। ওই নারী শুধুই নিগ্রহের শিকার হননি, তাকে হজম করতে হয়েছে অকথ্য ভাষার গালিগালাজ। এবং নিগ্রহকারী নারীর ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত করেছে।

এখন হয়ত কেউ কেউ বলতে থাকবেন, এটা একটি কুচক্রী মহলের কাজ। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য কোন পক্ষ কাজটি করেছে। এমন কথাটি যারা বলবেন, তা কিন্তু সঠিক না। আসলে বর্তমানে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্রটা বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়। এটা হলো উদেশ্য প্রণ্যোদিতভাবে সংঘটিত একটি ঘটনা। এই ঘটনা যে ব্যক্তিটি করেছে সে জেনে-বুঝেই করেছে। দিন দিন বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতিক পরিবেশ কোন দিকে যাচ্ছে, এই দিকগুলো নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক।

মুসলিম শাসনামলের (১৪০০-১৭৫৭ সাল) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলা জনপদের নারীরা কৃষি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নারীরা কৃষি কাজে শ্রম বিনিয়োগ করতেন। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে একই পাড়া বা মহল্লায় বসবাসরত নারীরা একত্রিত হতেন। তারা নানা গল্প আড্ডা মেতে উঠতো, কেউ কেউ গীত গাইত। তখনকার বাংলার নারীরা পান খেতেন। পান খাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের ঠোঁট রাঙাতেন লাল রঙে। তখনকার দিনে আজকের দিনের মতো লিপস্টিক ছিল না। এখনকার দিনের মতো সেই সময় বাজারে টিপ কিনতে পাওয়া যেত না, ওই সময়কার নারীরা দেশজ নানা উপকরণ দিয়ে টিপ তৈরি করে কপালে পরতেন। হাতে মেহেদি পরার প্রচলন ছিল। নারীরা নিজেদের শরীরকে পর্দার মধ্যে রাখতেন শাড়ি পরিধান করে। এটাই ছিল বাঙালি নারীর সংস্কৃতি।

বাঙালি নারীদের এ ধরনের সংস্কৃতির প্রথাটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমল এবং তথাকথিত ইসলামিক পাকিস্তানি আমলেও বহাল ছিল। শাশ্বত বাংলার সংস্কৃতির ধারাটি গত ১০-১২ বছর ধরে পরিবর্তন হতে শুরু করে। পৃথিবীর উষ্ণম-লীয় মরুভূমি অঞ্চলের নারীরা রোদ তাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আপদমস্তক ঢেকে চলা ফেরা করেন। হঠাৎ করে ধর্মের নামে নারীদের পর্দাশীল করার লক্ষ্যে মরুভূমি এলাকার বোরখা প্রথা এদেশে গণহারে চালু হতে শুরু করে। আর পুরুষেরা নিজের স্ত্রীকে বোরখার মধ্যে রাখাটা নিরাপদ মনে করেন, কারণ তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষ দেখতে পারছে না।

বোরখার মাধ্যমে নিজের স্ত্রী-কন্যাকে ঢেকে রেখে বাইরে এসে কিছু পুরুষই বোরখাবিহীন নারীদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকান। এ ধরনের কিছু পুরুষেরাই রাস্তা ঘাটে চলাচল করার সময় বা অফিসে কর্মরত সহকর্মী নারী বা ক্লাবের সদস্য নারী বা বাজারে যে সব নারীরা বোরখা ছাড়া চলাফেরা করে তাদের দেখলেই তারা রসাত্মক আলাপে লিপ্ত হতে চান। আর যখন বোরখাবিহীন ওই নারী তার কুরুচিপূর্ণ কথার সঙ্গে সমন্বয় করে কথা বলতে রাজি হন না, বা তার নোংরামি ও কুরুচিপূর্ণ কথার প্রতিবাদ করেন। তখনই বেরিয়ে আসে পুরুষের আসল রূপটি। দেখা যায় ওই পুরুষটি বোরখাবিহীন নারীকে বেপর্দা আখ্যা দেয় এবং অশ্লীল গালিগালাজ করে। তাছাড়া রাজি না হওয়ায় নারীকে নানাভাবে উৎপীড়ন করে। আর তখন সমাজের কিছু মানুষ এই নারীকে বোরখা না পরার অপরাধে অপরাধী করেন।

বোরখা পড়লেই কি নারীরা পর্দাশীল হয়ে যায়? আরবের পোশাক পড়লেই কি নারীর পর্দানশীলতার পরিচয় মেলে। মানুষের মন কিন্তু পর্দা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

আরব অঞ্চলের ঘোমটা প্রথার আড়ালে চলছে পৈশাচিকভাবে নারীর নির্যাতন ও নিপীড়ন। আজকে বাংলাদেশকে যারা পর্দা প্রথার নামে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন, তাদের আসল উদ্দেশ্যটা কি? তারা কি পর্দা নামে নারীদের ঢেকে রেখে নারীর ওপর নিজেদের কুরুচিপূর্ণ আকাক্সক্ষা মেটাতে চান। নাকি বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চালু করতে চান? পর্দা বা বোরখা পরার নামে মৌলবাদ চর্চা বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ, এ বোরখার আড়ালে অস্ত্র, মাদকসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা চলে রমরমা।

সরকারের উচিত নারীকে স্বাধীনভাবে নিজভূমে চলাফেরা করার অধিকারটি নিশ্চিত করা।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]