বৈষম্যবিরোধী আইন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংশোধন এবং গঠনমূলক প্রয়োগ প্রয়োজন। এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন। গতকাল বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বক্তারা এমন মন্তব্য করেন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আলোচনা সভায় বলেন, ‘বহুদিন ধরেই নাগরিক প্লাটফর্ম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এই আইন উত্থাপনে ও খসড়া প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে আসছে। ২০১৭ সালে নাগরিক প্লাটফর্মের সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রেও এই আইন উত্থাপনের দাবি করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে সংবিধানের মৌলিক ধারাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই এই আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। তবে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন।’

এর আগে জাতীয় সংসদে বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২ উত্থাপন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুদিন ধরেই এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছিল। গতকালের আলোচনায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আইনটির বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক মিজ শাহীন আনাম এমন নারীবান্ধব আইন উত্থাপনের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘এই আইন উত্থাপন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম রয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম এর কাজ শুরু হয় এবং লক্ষ্য করা হয়। বৈষম্যকে সুনিদির্ষ্টভাবে লক্ষ্য করে কোন আইন নেই। পরবর্তীতে জনমত জরিপের মাধ্যমে ২০১৩ সালে আইন কমিশনে খসড়া জমা দেয়া হয়। এখন এই আইনটি জনগণের প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে কি-না সেটা পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে সেজন্য সঠিক মনিটরিং কমিটি প্রয়োজন।’

নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে কি ধরনের বৈষম্য চর্চা হয়, সেটা বোঝা খুব

কঠিন। উত্থাপিত আইনে সুস্পষ্টভাবে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। এক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান থাকা জরুরি। বৃহত্তর স্বার্থে মনিটরিং কমিটির মেয়াদ ২ বছরের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়া যেতে পারে।’

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী (যেমন- হিজড়া, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু) তাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের ব্যাপারে জানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে একটি আইনের মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্যকে কেন্দ্রীভূত করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে আইনে বৈষম্যের সংজ্ঞায় এখনো কিছু সমস্যা আছে। যেমন যৌনকর্মীদের পেশা বৈধ কি-না, এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এখানে লক্ষণীয়, বৈষম্যের প্রতিকার কিভাবে হবে সেটা এই আইনে স্পষ্ট নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রের অনেক আইনেই বৈষম্যমূলক ধারা আছে। যেমন সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ধর্ষিতার চরিত্রহনন, একজন নারীর কাজী না হতে পারা কিংবা প্রতিবন্ধীদের বিসিএস বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে সক্রিয়ভাবে যোগদানের সীমাবদ্ধতা। তাছাড়া মনিটরিং কমিটির ক্ষমতা, কার্যব্যপ্তি এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।’

সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস-এর সিনিয়র ফেলো ড. ফস্টিনা পেরেইরা বলেন, ‘প্রতিকারের জায়গাটা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। যেমন একজন ব্যক্তি একের অধিক ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি কী ধরনের প্রতিকার পাবেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া উত্থাপিত আইনে অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে সবশেষে প্রতিকার পেতে এক ধরনের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্যণীয়। একজন ক্ষতিগ্রস্ত নিজ থেকে অভিযোগ দায়ের করার আগেই ক্ষতিগ্রস্তের জন্য রাষ্ট্রকে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত।’

রাজনৈতিক শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যপ্তি ঘটানোর জন্যই সব ধরনের আইন প্রণিত হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি উত্থাপিত আইনে প্রতিকারের জন্য যে মনিটরিং কমিটিগুলোর কথা উল্লেখ আছে, তাদের কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করেন, অনেকক্ষেত্রেই এই ধরনের আইনে মনিটরিং কমিটি গঠিত হলেও তাদের কোন ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হয় না। ফলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায় না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বৈষম্যের কাঠামোগত সংজ্ঞায়নে মানসিক প্রতিবন্ধী, বর্ণবৈষম্য ও এসিডদগ্ধদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাছাড়া এই আইনে ভূমির আইনগত মালিকদের কথা বলা হলেও প্রথাগতভাবে ভূমির মালিকদের তথা আদিবাসীদের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। একটি বৈষম্যবিরোধী কমিশন গঠন করার মাধ্যমে উত্থাপিত আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না সেটা দেখা জরুরি।’

সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ , ২৮ চৈত্র ১৪২৮ ০৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

বৈষম্যবিরোধী আইন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আইনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সংশোধন এবং গঠনমূলক প্রয়োগ প্রয়োজন। এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন। গতকাল বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বক্তারা এমন মন্তব্য করেন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আলোচনা সভায় বলেন, ‘বহুদিন ধরেই নাগরিক প্লাটফর্ম ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো এই আইন উত্থাপনে ও খসড়া প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে আসছে। ২০১৭ সালে নাগরিক প্লাটফর্মের সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রেও এই আইন উত্থাপনের দাবি করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে সংবিধানের মৌলিক ধারাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই এই আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে। তবে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসন ও নাগরিক নজরদারি প্রয়োজন।’

এর আগে জাতীয় সংসদে বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২ উত্থাপন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বহুদিন ধরেই এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছিল। গতকালের আলোচনায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আইনটির বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক মিজ শাহীন আনাম এমন নারীবান্ধব আইন উত্থাপনের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘এই আইন উত্থাপন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম রয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম এর কাজ শুরু হয় এবং লক্ষ্য করা হয়। বৈষম্যকে সুনিদির্ষ্টভাবে লক্ষ্য করে কোন আইন নেই। পরবর্তীতে জনমত জরিপের মাধ্যমে ২০১৩ সালে আইন কমিশনে খসড়া জমা দেয়া হয়। এখন এই আইনটি জনগণের প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে কি-না সেটা পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে সেজন্য সঠিক মনিটরিং কমিটি প্রয়োজন।’

নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে কি ধরনের বৈষম্য চর্চা হয়, সেটা বোঝা খুব

কঠিন। উত্থাপিত আইনে সুস্পষ্টভাবে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। এক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান থাকা জরুরি। বৃহত্তর স্বার্থে মনিটরিং কমিটির মেয়াদ ২ বছরের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়া যেতে পারে।’

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী (যেমন- হিজড়া, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু) তাদের বিরুদ্ধে হওয়া বৈষম্যের ব্যাপারে জানিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে একটি আইনের মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্যকে কেন্দ্রীভূত করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে আইনে বৈষম্যের সংজ্ঞায় এখনো কিছু সমস্যা আছে। যেমন যৌনকর্মীদের পেশা বৈধ কি-না, এ ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এখানে লক্ষণীয়, বৈষম্যের প্রতিকার কিভাবে হবে সেটা এই আইনে স্পষ্ট নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রের অনেক আইনেই বৈষম্যমূলক ধারা আছে। যেমন সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ধর্ষিতার চরিত্রহনন, একজন নারীর কাজী না হতে পারা কিংবা প্রতিবন্ধীদের বিসিএস বা জুডিশিয়াল সার্ভিসে সক্রিয়ভাবে যোগদানের সীমাবদ্ধতা। তাছাড়া মনিটরিং কমিটির ক্ষমতা, কার্যব্যপ্তি এবং স্বাতন্ত্র্য নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।’

সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস-এর সিনিয়র ফেলো ড. ফস্টিনা পেরেইরা বলেন, ‘প্রতিকারের জায়গাটা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। যেমন একজন ব্যক্তি একের অধিক ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি কী ধরনের প্রতিকার পাবেন, সেটা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া উত্থাপিত আইনে অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে সবশেষে প্রতিকার পেতে এক ধরনের প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্যণীয়। একজন ক্ষতিগ্রস্ত নিজ থেকে অভিযোগ দায়ের করার আগেই ক্ষতিগ্রস্তের জন্য রাষ্ট্রকে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত।’

রাজনৈতিক শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার ব্যপ্তি ঘটানোর জন্যই সব ধরনের আইন প্রণিত হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি উত্থাপিত আইনে প্রতিকারের জন্য যে মনিটরিং কমিটিগুলোর কথা উল্লেখ আছে, তাদের কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করেন, অনেকক্ষেত্রেই এই ধরনের আইনে মনিটরিং কমিটি গঠিত হলেও তাদের কোন ধরনের সভা অনুষ্ঠিত হয় না। ফলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দেখা যায় না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বৈষম্যের কাঠামোগত সংজ্ঞায়নে মানসিক প্রতিবন্ধী, বর্ণবৈষম্য ও এসিডদগ্ধদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাছাড়া এই আইনে ভূমির আইনগত মালিকদের কথা বলা হলেও প্রথাগতভাবে ভূমির মালিকদের তথা আদিবাসীদের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। একটি বৈষম্যবিরোধী কমিশন গঠন করার মাধ্যমে উত্থাপিত আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না সেটা দেখা জরুরি।’