অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ

একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর ১১ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক দীর্ঘ ভাষণ দেন।

সে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পুনর্ব্যাক্ত করে দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নর-হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন তা প্রতিরাধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের, সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে আজ একাত্ম। পশ্চিম-পাকিস্তানি হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল।’

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যেকোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তারা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন।’

তিনি সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফের বীরত্ব ও মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহস ও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সঙ্গে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন এবং শত্রু সেনাদের সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। তার ভাষণে মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জলিল,

মেজর আহমদ, মেজর নজমুল হক, মেজর ওয়াজেশসহ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এগিয় যাওয়ার বিবরণ তুলে ধরেন।

তাজউদ্দিন আহমদ তার ভাষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের স্বচক্ষে ও সরেজমিন স্বাধীন বাংলাদেশ পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে, ‘রেডক্রস’ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহায্যের আহ্বান জানান।

বেতার ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেন, শীঘ্রই সব মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারবেন এবং যুবকদের অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য নিকটস্থ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আহ্বান জানান। তিনি যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা আছে বলে মন্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘শত্রুর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেয়ার কাজে আপনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরও নানাভাবে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রানি ও কাবু করতে পারেন।

তিনি হানাদার শত্রুবাহিনীর সঙ্গে কোন ধরনের সহযোগিতা করা বা সংশ্রব না রাখার নির্দেশ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশে আজ কোন মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রুসৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোখান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এই সুযোগে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা সাড়ে সাত কোটি দেশবাসীর রোষ বহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।’

তিনি দৃঢ় আশাব্যক্ত করে বলেন, ‘এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতোমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমর সজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নিচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালির ভবিষ্যৎ আশা ভরসা। আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে তারা বুটের নিচে নিষ্পেষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সেভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সেভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। গ্রেট বৃটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানি বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল, তাদেরকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।’

তাজউদ্দিন তার ভাষণে বলেন, ‘এ কথা এখন দিবালোকের মতো সত্য হয়ে গেছে যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরোধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।

তাজউদ্দীন আহমদ আশা প্রকাশ করেন এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং এই সংগ্রাম পৃথিবীতে স্বীকৃতি পাচ্ছে। তিনি পুরাতন পূর্ব-পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান।

এছাড়া এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনালের আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। তিনি জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হলেন। এর আগে তিনি ৩ এপ্রিল তার নিয়োগের পর ৪ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন।

একই দিন চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এন লাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, চীন সরকার মনে করে পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং ভারত যদি এই ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায় তবে চীনা সরকার ও জনগণ সবসময় পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে তাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ন্যায্য সংগ্রামে সমর্থন দেবে।

এদিনে পাকিস্তানি হানাদারেরা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় প্রথমে গোপালগঞ্জে প্রবেশ করেছিল। পরে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি মানিকহার গ্রামে আক্রমণ করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

এদিন দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানি ফুলবাড়ি চরখাই রোডে, মেজর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের কোম্পানি ঘোড়াঘাট-চরখাই রোডে অবস্থান নেয় এবং লেফটেন্যান্ট মোখলেসের কোম্পানি ডেপথ কোম্পানি হিসেবে রাখা হয়।

এদিন সকালে হানাদাররা পাবনার ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাকা- শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদারদের প্রবেশের পর পরই ঈশ্বরদীতে অবাঙালি বিহারিরা হত্যাকা- ও লুটতরাজে অংশ নেয়। প্রায় ৩২ জন বাঙালি শহীদ হন।

যশোরের বেনাপোল সড়কে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। যশোরের ঝিকরগাছায় এদিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে হানাদারদের প্রচুর ক্ষতি হয়।

১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর্টিলারি, মর্টার, ট্যাংক এবং অন্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের মাধ্যমে আঘাত হানে। উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অনেকে আহত হন।

এদিন কলকাতায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে জনসভা করে। এই জনসভায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একইসঙ্গে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর তা সমর্থন করেছিলেন।

দিল্লিতে এদিন ভারত সরকার জানায়, পাকিস্তানের সাবমেরিনে কর্মরত আটজন বাঙালি নাবিক ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত ফ্রান্সের একটি বন্দরে থাকা পাকিস্তানের সাবমেরিন থেকে পালিয়ে তারা ভারতে আসেন।

সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ , ২৮ চৈত্র ১৪২৮ ০৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

১১ এপ্রিল ১৯৭১

অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর ১১ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক দীর্ঘ ভাষণ দেন।

সে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পুনর্ব্যাক্ত করে দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নর-হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন তা প্রতিরাধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের, সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে আজ একাত্ম। পশ্চিম-পাকিস্তানি হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল।’

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যেকোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তারা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন।’

তিনি সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফের বীরত্ব ও মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহস ও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সঙ্গে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন এবং শত্রু সেনাদের সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। তার ভাষণে মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জলিল,

মেজর আহমদ, মেজর নজমুল হক, মেজর ওয়াজেশসহ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এগিয় যাওয়ার বিবরণ তুলে ধরেন।

তাজউদ্দিন আহমদ তার ভাষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের স্বচক্ষে ও সরেজমিন স্বাধীন বাংলাদেশ পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে, ‘রেডক্রস’ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহায্যের আহ্বান জানান।

বেতার ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেন, শীঘ্রই সব মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারবেন এবং যুবকদের অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য নিকটস্থ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আহ্বান জানান। তিনি যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা আছে বলে মন্তব্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘শত্রুর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেয়ার কাজে আপনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরও নানাভাবে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রানি ও কাবু করতে পারেন।

তিনি হানাদার শত্রুবাহিনীর সঙ্গে কোন ধরনের সহযোগিতা করা বা সংশ্রব না রাখার নির্দেশ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশে আজ কোন মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রুসৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোখান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এই সুযোগে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা সাড়ে সাত কোটি দেশবাসীর রোষ বহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।’

তিনি দৃঢ় আশাব্যক্ত করে বলেন, ‘এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতোমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমর সজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নিচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালির ভবিষ্যৎ আশা ভরসা। আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে তারা বুটের নিচে নিষ্পেষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সেভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সেভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। গ্রেট বৃটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানি বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল, তাদেরকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।’

তাজউদ্দিন তার ভাষণে বলেন, ‘এ কথা এখন দিবালোকের মতো সত্য হয়ে গেছে যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরোধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।

তাজউদ্দীন আহমদ আশা প্রকাশ করেন এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং এই সংগ্রাম পৃথিবীতে স্বীকৃতি পাচ্ছে। তিনি পুরাতন পূর্ব-পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান।

এছাড়া এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনালের আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। তিনি জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হলেন। এর আগে তিনি ৩ এপ্রিল তার নিয়োগের পর ৪ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন।

একই দিন চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এন লাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, চীন সরকার মনে করে পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং ভারত যদি এই ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায় তবে চীনা সরকার ও জনগণ সবসময় পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে তাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ন্যায্য সংগ্রামে সমর্থন দেবে।

এদিনে পাকিস্তানি হানাদারেরা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় প্রথমে গোপালগঞ্জে প্রবেশ করেছিল। পরে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি মানিকহার গ্রামে আক্রমণ করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

এদিন দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে পাকবাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। ক্যাপ্টেন আশরাফের কোম্পানি ফুলবাড়ি চরখাই রোডে, মেজর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের কোম্পানি ঘোড়াঘাট-চরখাই রোডে অবস্থান নেয় এবং লেফটেন্যান্ট মোখলেসের কোম্পানি ডেপথ কোম্পানি হিসেবে রাখা হয়।

এদিন সকালে হানাদাররা পাবনার ঈশ্বরদীতে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাকা- শুরু করে। পাকিস্তানি হানাদারদের প্রবেশের পর পরই ঈশ্বরদীতে অবাঙালি বিহারিরা হত্যাকা- ও লুটতরাজে অংশ নেয়। প্রায় ৩২ জন বাঙালি শহীদ হন।

যশোরের বেনাপোল সড়কে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। যশোরের ঝিকরগাছায় এদিন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে হানাদারদের প্রচুর ক্ষতি হয়।

১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর্টিলারি, মর্টার, ট্যাংক এবং অন্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের মাধ্যমে আঘাত হানে। উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অনেকে আহত হন।

এদিন কলকাতায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে জনসভা করে। এই জনসভায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একইসঙ্গে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর তা সমর্থন করেছিলেন।

দিল্লিতে এদিন ভারত সরকার জানায়, পাকিস্তানের সাবমেরিনে কর্মরত আটজন বাঙালি নাবিক ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত ফ্রান্সের একটি বন্দরে থাকা পাকিস্তানের সাবমেরিন থেকে পালিয়ে তারা ভারতে আসেন।