ফেরিওয়ালা মিরাজুলের স্বপ্ন পূরণের পথে

‘বঙ্গবন্ধু পাঠাগার নির্মাণ, হকারি করে ৪শ’ বই কেনেন

মধ্যবয়সী, লিকলিকে চেহারা। নাম মিরাজুল হক। গত ৩০ বছর ধরে শহর অথবা গণপরিবহনে ফেরি করে সংসার চালাচ্ছেন। সে কারণে তাকে সবাই ফেরিওয়ালা মিরাজুল বলে চেনে। এ পেশায় রোজগারটা সৎ পথের। তাই এ নামটিই নিজের বেশি পছন্দ। পেশাগত কারণেই রাত পোহালেই তার দেখা মেলে মেইন বাসস্ট্যান্ডের কোন না কোন গণপরিবহনের মধ্যে। সে সময়ে তার হাতে থাকে মুড়ি চানাচুর, তিলের খাজা, মসলাযুক্ত শসা পেয়ারাসহ মুখরোচক হরেক রকমের খাবারের কোন একটি।

আবার ভিন্ন সময়ে চাহিদার প্রেক্ষিতে তালপাখা, রুমাল, অথবা ছোটদের গল্পের বইও রাখেন তিনি। তবে পবিত্র রমজান মাসে শুধুমাত্র নামাজ শিক্ষা ও ধর্মীয় বই বিক্রিতেই বেশি নির্ভর থাকেন। তবে সাংসারিক দৈন্যতা যতই থাক না কেন কাজের অবসরে বই পড়া তার অনেক দিনের নেশা। এ থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন। নিজে আওয়ামী লীগ ভক্ত মানুষ। তাই ভাবতেন সামর্থ্য আসলে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পাঠাগার নির্মাণ করবেন।

সে লক্ষ্যে নিজের কষ্টের রোজগারের প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার প্রায় ৪ শতাধিক বই কিনেছেন। অর্থাৎ মানুষকে বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করবেন। বাস্তবায়নে কয়েক দফা পাঠাগার নির্মাণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। নিজ দলের নেতাদের কোন্দল, নেতৃত্বের লোভ ও বিরোধীদের বিরোধীতার কারণে এ মহৎ কাজে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। যে কথা তুলে ধরে আগে দৈনিক সংবাদে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ব্যর্থতার পর এখন তিনি সফল হতে চলেছেন। কেননা সম্প্রতি সময়ে তিনি শহরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার নির্মাণের বেশির ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছেন। যে পাঠাগারের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠাতা ’ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক। পাঠাগারের মতো পারিবারিক জীবনে ১ মেয়েকে ২ ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সফল হয়েছেন মিরাজুল হক। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের কলেজপাড়া এলাকার মৃত

ইব্রাহিম মোল্লার পুত্র।

ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক জানান, শৈশবে দারিদ্রতার কারণে ৫ম শ্রেণীর পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। কর্মজীবনে গিয়ে অবসর সময় বই পড়ে কাটান। কিন্ত এলাকায় কোন পাঠাগার নেই। এ থেকেই একটি পাঠাগার নির্মাণের ভাবনা তার মনে। নিজে ও নিজের পরিবার আওয়ামী লীগ ঘরানার। সেই আগ্রহ থেকেই ১৯৯৮ সালে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার’ নাম দিয়ে শুরু করেন তার কর্মকা-। এজন্য অনেক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে তাকে। কিন্ত তিনি দমে যাননি। সম্প্রতি সময়ে নিজ উদ্যোগেই শহরের এম ইউ কলেজের বাহির ফলকের সামনে পৌর মেয়র আশরফুল আলম আশরাফ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারটির উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, পাঠাগারটির জন্য নিজের রোজগারের টাকায় দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে ২ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪ শতাধিক বই কিনে জমিয়েছেন।

মিরাজুল হক অতীতের অভিজ্ঞতায় সংবাদকে আরও জানান, অতীতের বাধার পর সর্বশেষ ২০১৪ সালে পুনরায় স্থানীয় আওয়ামী অনুসারীদের নিয়ে কলেজ পাড়াতে শুরু করা হলে, শুরু করেন পাঠাগার স্থাপনের কাজ। সেখানেও পদ-পদবি এবং স্বার্থের বেড়াজালে শুরু হয় জটিলতা।

এরপর ৩ বছর জায়গার অভাবে তার কেনা মূল্যবান বইগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে বস্তাবন্দী করে বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। পরে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পাঠাগারের কাহিনী। এতে এগিয়ে আসেন কিছু শিক্ষানুরাগী, সাংবাদিকসহ জনপ্রতিনিধিরা। তাদের সহযোগিতায় শহরের কলেজ রোডে জেলা পরিষদের একটি জায়গায় গত বছরের ১ লা নভেম্বর থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের নির্মাণ কাজ। বর্তমানে যা দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি বলেন, সামগ্রিক স্বার্থে কাজ করতে একটি মন থাকলেই সম্ভব।

ফেরিওয়ালা মিরাজুল আরও বলেন, নিজে লেখাপড়া শিখতে না পারলেও হকারি করেই ২ ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার্থী। আর ছোট ছেলে আলমগীর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে অনার্স তৃতীয় বষের্র শিক্ষার্থী। সে ঢাকা মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের একজন কৃতি ফুটবলার। আর শারমিন ও মুক্তা নামে দুই মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়েও দিয়েছেন। এখন তার কাজের ব্যস্ততাও কমে গেছে। ফলে পাঠাগারের জন্য জীবনের বাকি সময়টা কাজে লাগাতে পারবেন। তিনি বলেন, দৃশ্যমান হলেও এখনও পাঠাগারের অনেক কাজ বাকি রয়েছে।

কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, একজন ফেরিওয়ালার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার নির্মাণের কাজটি প্রসংশনীয়। যেটি নির্মাণ শেষ হলে বই পিপাসুরা সুফল ভোগ করতে পারবে। এজন্য অবশ্যই মিরাজুলকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া জেরিন জানান, একজন ফেরিওয়ালা হয়েও যে নিজের সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন। সেজন্য তিনি একজন সফল বাবা। আবার সবার বই পড়ার ব্যবস্থা জন্য বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পাঠাগার স্থাপনে রাতদিন কাজ করছেন এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তিনি বলেন পাঠাগারটির জন্য তিনি সাধ্যমত সাহায্য করবেন।

সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ , ২৮ চৈত্র ১৪২৮ ০৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

ফেরিওয়ালা মিরাজুলের স্বপ্ন পূরণের পথে

‘বঙ্গবন্ধু পাঠাগার নির্মাণ, হকারি করে ৪শ’ বই কেনেন

সাবজাল হোসেন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)

image

মধ্যবয়সী, লিকলিকে চেহারা। নাম মিরাজুল হক। গত ৩০ বছর ধরে শহর অথবা গণপরিবহনে ফেরি করে সংসার চালাচ্ছেন। সে কারণে তাকে সবাই ফেরিওয়ালা মিরাজুল বলে চেনে। এ পেশায় রোজগারটা সৎ পথের। তাই এ নামটিই নিজের বেশি পছন্দ। পেশাগত কারণেই রাত পোহালেই তার দেখা মেলে মেইন বাসস্ট্যান্ডের কোন না কোন গণপরিবহনের মধ্যে। সে সময়ে তার হাতে থাকে মুড়ি চানাচুর, তিলের খাজা, মসলাযুক্ত শসা পেয়ারাসহ মুখরোচক হরেক রকমের খাবারের কোন একটি।

আবার ভিন্ন সময়ে চাহিদার প্রেক্ষিতে তালপাখা, রুমাল, অথবা ছোটদের গল্পের বইও রাখেন তিনি। তবে পবিত্র রমজান মাসে শুধুমাত্র নামাজ শিক্ষা ও ধর্মীয় বই বিক্রিতেই বেশি নির্ভর থাকেন। তবে সাংসারিক দৈন্যতা যতই থাক না কেন কাজের অবসরে বই পড়া তার অনেক দিনের নেশা। এ থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন। নিজে আওয়ামী লীগ ভক্ত মানুষ। তাই ভাবতেন সামর্থ্য আসলে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পাঠাগার নির্মাণ করবেন।

সে লক্ষ্যে নিজের কষ্টের রোজগারের প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার প্রায় ৪ শতাধিক বই কিনেছেন। অর্থাৎ মানুষকে বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করবেন। বাস্তবায়নে কয়েক দফা পাঠাগার নির্মাণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। নিজ দলের নেতাদের কোন্দল, নেতৃত্বের লোভ ও বিরোধীদের বিরোধীতার কারণে এ মহৎ কাজে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। যে কথা তুলে ধরে আগে দৈনিক সংবাদে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ব্যর্থতার পর এখন তিনি সফল হতে চলেছেন। কেননা সম্প্রতি সময়ে তিনি শহরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার নির্মাণের বেশির ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছেন। যে পাঠাগারের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠাতা ’ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক। পাঠাগারের মতো পারিবারিক জীবনে ১ মেয়েকে ২ ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সফল হয়েছেন মিরাজুল হক। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের কলেজপাড়া এলাকার মৃত

ইব্রাহিম মোল্লার পুত্র।

ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক জানান, শৈশবে দারিদ্রতার কারণে ৫ম শ্রেণীর পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। কর্মজীবনে গিয়ে অবসর সময় বই পড়ে কাটান। কিন্ত এলাকায় কোন পাঠাগার নেই। এ থেকেই একটি পাঠাগার নির্মাণের ভাবনা তার মনে। নিজে ও নিজের পরিবার আওয়ামী লীগ ঘরানার। সেই আগ্রহ থেকেই ১৯৯৮ সালে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার’ নাম দিয়ে শুরু করেন তার কর্মকা-। এজন্য অনেক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে তাকে। কিন্ত তিনি দমে যাননি। সম্প্রতি সময়ে নিজ উদ্যোগেই শহরের এম ইউ কলেজের বাহির ফলকের সামনে পৌর মেয়র আশরফুল আলম আশরাফ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারটির উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন।

তিনি আরও বলেন, পাঠাগারটির জন্য নিজের রোজগারের টাকায় দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে ২ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪ শতাধিক বই কিনে জমিয়েছেন।

মিরাজুল হক অতীতের অভিজ্ঞতায় সংবাদকে আরও জানান, অতীতের বাধার পর সর্বশেষ ২০১৪ সালে পুনরায় স্থানীয় আওয়ামী অনুসারীদের নিয়ে কলেজ পাড়াতে শুরু করা হলে, শুরু করেন পাঠাগার স্থাপনের কাজ। সেখানেও পদ-পদবি এবং স্বার্থের বেড়াজালে শুরু হয় জটিলতা।

এরপর ৩ বছর জায়গার অভাবে তার কেনা মূল্যবান বইগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে বস্তাবন্দী করে বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। পরে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পাঠাগারের কাহিনী। এতে এগিয়ে আসেন কিছু শিক্ষানুরাগী, সাংবাদিকসহ জনপ্রতিনিধিরা। তাদের সহযোগিতায় শহরের কলেজ রোডে জেলা পরিষদের একটি জায়গায় গত বছরের ১ লা নভেম্বর থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগারের নির্মাণ কাজ। বর্তমানে যা দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি বলেন, সামগ্রিক স্বার্থে কাজ করতে একটি মন থাকলেই সম্ভব।

ফেরিওয়ালা মিরাজুল আরও বলেন, নিজে লেখাপড়া শিখতে না পারলেও হকারি করেই ২ ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার্থী। আর ছোট ছেলে আলমগীর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে অনার্স তৃতীয় বষের্র শিক্ষার্থী। সে ঢাকা মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের একজন কৃতি ফুটবলার। আর শারমিন ও মুক্তা নামে দুই মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়েও দিয়েছেন। এখন তার কাজের ব্যস্ততাও কমে গেছে। ফলে পাঠাগারের জন্য জীবনের বাকি সময়টা কাজে লাগাতে পারবেন। তিনি বলেন, দৃশ্যমান হলেও এখনও পাঠাগারের অনেক কাজ বাকি রয়েছে।

কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, একজন ফেরিওয়ালার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার নির্মাণের কাজটি প্রসংশনীয়। যেটি নির্মাণ শেষ হলে বই পিপাসুরা সুফল ভোগ করতে পারবে। এজন্য অবশ্যই মিরাজুলকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া জেরিন জানান, একজন ফেরিওয়ালা হয়েও যে নিজের সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন। সেজন্য তিনি একজন সফল বাবা। আবার সবার বই পড়ার ব্যবস্থা জন্য বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পাঠাগার স্থাপনে রাতদিন কাজ করছেন এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তিনি বলেন পাঠাগারটির জন্য তিনি সাধ্যমত সাহায্য করবেন।