এ এক আশ্চর্য বাংলাদেশ

দেবাহুতি চক্রবর্তী

ঘটনা একের পরে এক ঘটেই যাচ্ছে। টিপ, বাসে জিন্স টিসার্ট পরিহিত তরুণী, গির্জায় হামলা, বিজ্ঞান শিক্ষকের শিক্ষাদানÑকোনটিই বিচ্ছিন্ন নয়। একক বা আকস্মিক কোন ঘটনা হিসেবে দেখার কোন অবকাশ নেই। এগুলো বাড়ছে, বাড়বে। মৌলবাদী অপশক্তি এখন বাংলাদেশের আদিগন্ত ছেয়ে গেছে। কোন কোন বিশেষ গোষ্ঠীকে আমরা চিনি, জানি। স্বাভাবিকভাবেই যে কোন ঘটনায় তাদের দিক আঙুল ওঠে।

কিন্তু তারা যে দেশের অধিকাংশ ঘরে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কোথাও প্রত্যক্ষ, কোথাও পরোক্ষে জায়গা করে নিয়েছে সেটাই সবচেয়ে ভয়ংকর। তা না হলে লেখাপড়ার ফাঁকে খেলাধুলা করার, সাংস্কৃতিক পরিম-লে হইহুল্লোড় করার বয়স যে শিক্ষার্থীদের তাদের ধর্মানুভূতি এত তীব্র হয় কী করে? ঘরে ঘরে ধর্মানুভূতির চাষ হচ্ছে।

সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী বাংলাদেশে চিরদিনই মেরুদ- বিহীন। ঐক্যবদ্ধ শব্দটা তারা কানে শুনে থাকবে। চাচা, আপন প্রাণ বাঁচাÑএই নীতিতে যে যার মতো ভালোমন্দে চলে। তারা তখনই কথা বলার সাহস কিছুটা পায়, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল মানবতাবাদী গোষ্ঠী যখন এগিয়ে আসে। পাশে দাঁড়ায়। শেষ বিচারে এদেশে তারাও সংখ্যালঘু। তবু সেই মুষ্টিমেয় প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোই আজ এদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আশা-ভরসার স্থল। তাদের বিপন্ন বোধে কখনো কখনো উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়, ‘সুবোধ, তুই পালিয়ে যা।’

এই দেশের অধিকাংশ সুবোধ এখন অবোধ। শিক্ষিত সচেতন হিন্দুরা এখন পালিয়ে ভারতে যেতে আগ্রহী নয়। ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা ব্রাত্য। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভারত ছাড়া দেশের বাইরে অন্যত্র পাঠাতে পারলেই তারা নিশ্চিন্ত। ওখানকার চরম পশ্চিমাবিদ্বেষী মুসলিমরাও নতুন প্রজন্মের জন্য আমেরিকা ইউরোপ বেছে নিচ্ছে। সেটা অন্য আলোচনার বিষয়।

কথা হলো, দেশটা তো রাতারাতি এমন হয়নি। তিন দশকের বেশি সময় আগে হুমায়ুন আজাদ এ ভবিষ্যৎ পাঠ করে গেছেন। আমরা পারলাম না কেন? পরিমণি হোক বা লতা সমাদ্দার হোক বা সাংবাদিক রোজিনা হোক তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য, ন্যায়বিচার পাওয়ার সুব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রের ইতিবাচক ইঙ্গিত যতক্ষণ না প্রকাশ পায়, ততক্ষণ গাছের পাতাও নড়ে না। বিচারক থেকে শুরু করে জাতির বিবেক বা বুদ্ধিজীবী বলে আমরা যাদের জানি তাদের অনেকেই সেই ইঙ্গিতের ইশারায় থাকেন। সমস্যাটা এখানে। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে, যাপিত জীবনের সব ক্ষেত্রে মৌলবাদের বীজ বপন করা হয়েছে। অধিকাংশই সেই প্রভাবমুক্ত নন।

আমরা যাব কোথায়? কথা বলতে পদে পদে ভয় পেতে হয়। আলাদা করে বিজ্ঞানের বই পড়াতে শুধু নয়, সমাজ সংস্কৃতির অনেক কথাই তো অহরহ আমরা বলি, তা যে কারও ধর্মানুভূতিকে আঘাত দিতে পারে। অনুভূতির চামড়া অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। অতি সাধারণ কথাও কীভাবে বিকৃত হয়ে যায় তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সবার সামনেই আছে। এই অবস্থায় সোজাসুজি দেশে একমুখী নীতি নিতে হবে। সবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য। বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, মানব বিবর্তনের ইতিহাস, আবহমান বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি পাঠ্যচর্চায়, জীবনচর্চায় থাকবে না শুধুই এক ধর্মভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও জীবনচর্চা বহাল থাকবে তার মীমাংসা জরুরি প্রয়োজন। তা না হলে, ঝুমুর দাস, রসরাজ, হৃদয় ম-লদের সংখ্যা ভারি হতেই থাকবে। নারী ভুক্তভোগীও বাড়বেই।

তবে এই আবশ্যকীয় মীমাংসা এত সহজে সম্পন্ন হবে না। সমীকরণটা জটিল রাজনৈতিক খেলার মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে আর হবে দীর্ঘকাল। কবে বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের ওপর পড়িয়া চন্দ্র গ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল, যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্র গ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।’ ভারতবর্ষেও ১০০ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রর ক্ষমতার টানাটানি তে হিন্দু ধর্মীয় মৌলবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু, আমাদের একুশ শতকের আশ্চর্য বাংলাদেশে, ডিজিটাল বাংলাদেশে ধর্মানুভূতির প্রবল জোয়ারের কাছে শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব ভেসে যাওয়ার উপক্রম। রাষ্ট্রযন্ত্র যার দায় উপেক্ষা করতে পারে না। আর এই জবাবদিহির মুখোমুখি রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোর দায়িত্ব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর।

[লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]

সোমবার, ১১ এপ্রিল ২০২২ , ২৮ চৈত্র ১৪২৮ ০৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

এ এক আশ্চর্য বাংলাদেশ

দেবাহুতি চক্রবর্তী

ঘটনা একের পরে এক ঘটেই যাচ্ছে। টিপ, বাসে জিন্স টিসার্ট পরিহিত তরুণী, গির্জায় হামলা, বিজ্ঞান শিক্ষকের শিক্ষাদানÑকোনটিই বিচ্ছিন্ন নয়। একক বা আকস্মিক কোন ঘটনা হিসেবে দেখার কোন অবকাশ নেই। এগুলো বাড়ছে, বাড়বে। মৌলবাদী অপশক্তি এখন বাংলাদেশের আদিগন্ত ছেয়ে গেছে। কোন কোন বিশেষ গোষ্ঠীকে আমরা চিনি, জানি। স্বাভাবিকভাবেই যে কোন ঘটনায় তাদের দিক আঙুল ওঠে।

কিন্তু তারা যে দেশের অধিকাংশ ঘরে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কোথাও প্রত্যক্ষ, কোথাও পরোক্ষে জায়গা করে নিয়েছে সেটাই সবচেয়ে ভয়ংকর। তা না হলে লেখাপড়ার ফাঁকে খেলাধুলা করার, সাংস্কৃতিক পরিম-লে হইহুল্লোড় করার বয়স যে শিক্ষার্থীদের তাদের ধর্মানুভূতি এত তীব্র হয় কী করে? ঘরে ঘরে ধর্মানুভূতির চাষ হচ্ছে।

সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী বাংলাদেশে চিরদিনই মেরুদ- বিহীন। ঐক্যবদ্ধ শব্দটা তারা কানে শুনে থাকবে। চাচা, আপন প্রাণ বাঁচাÑএই নীতিতে যে যার মতো ভালোমন্দে চলে। তারা তখনই কথা বলার সাহস কিছুটা পায়, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল মানবতাবাদী গোষ্ঠী যখন এগিয়ে আসে। পাশে দাঁড়ায়। শেষ বিচারে এদেশে তারাও সংখ্যালঘু। তবু সেই মুষ্টিমেয় প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক মানুষগুলোই আজ এদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আশা-ভরসার স্থল। তাদের বিপন্ন বোধে কখনো কখনো উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়, ‘সুবোধ, তুই পালিয়ে যা।’

এই দেশের অধিকাংশ সুবোধ এখন অবোধ। শিক্ষিত সচেতন হিন্দুরা এখন পালিয়ে ভারতে যেতে আগ্রহী নয়। ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারা ব্রাত্য। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভারত ছাড়া দেশের বাইরে অন্যত্র পাঠাতে পারলেই তারা নিশ্চিন্ত। ওখানকার চরম পশ্চিমাবিদ্বেষী মুসলিমরাও নতুন প্রজন্মের জন্য আমেরিকা ইউরোপ বেছে নিচ্ছে। সেটা অন্য আলোচনার বিষয়।

কথা হলো, দেশটা তো রাতারাতি এমন হয়নি। তিন দশকের বেশি সময় আগে হুমায়ুন আজাদ এ ভবিষ্যৎ পাঠ করে গেছেন। আমরা পারলাম না কেন? পরিমণি হোক বা লতা সমাদ্দার হোক বা সাংবাদিক রোজিনা হোক তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য, ন্যায়বিচার পাওয়ার সুব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রের ইতিবাচক ইঙ্গিত যতক্ষণ না প্রকাশ পায়, ততক্ষণ গাছের পাতাও নড়ে না। বিচারক থেকে শুরু করে জাতির বিবেক বা বুদ্ধিজীবী বলে আমরা যাদের জানি তাদের অনেকেই সেই ইঙ্গিতের ইশারায় থাকেন। সমস্যাটা এখানে। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে, যাপিত জীবনের সব ক্ষেত্রে মৌলবাদের বীজ বপন করা হয়েছে। অধিকাংশই সেই প্রভাবমুক্ত নন।

আমরা যাব কোথায়? কথা বলতে পদে পদে ভয় পেতে হয়। আলাদা করে বিজ্ঞানের বই পড়াতে শুধু নয়, সমাজ সংস্কৃতির অনেক কথাই তো অহরহ আমরা বলি, তা যে কারও ধর্মানুভূতিকে আঘাত দিতে পারে। অনুভূতির চামড়া অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। অতি সাধারণ কথাও কীভাবে বিকৃত হয়ে যায় তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সবার সামনেই আছে। এই অবস্থায় সোজাসুজি দেশে একমুখী নীতি নিতে হবে। সবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য। বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, মানব বিবর্তনের ইতিহাস, আবহমান বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি পাঠ্যচর্চায়, জীবনচর্চায় থাকবে না শুধুই এক ধর্মভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও জীবনচর্চা বহাল থাকবে তার মীমাংসা জরুরি প্রয়োজন। তা না হলে, ঝুমুর দাস, রসরাজ, হৃদয় ম-লদের সংখ্যা ভারি হতেই থাকবে। নারী ভুক্তভোগীও বাড়বেই।

তবে এই আবশ্যকীয় মীমাংসা এত সহজে সম্পন্ন হবে না। সমীকরণটা জটিল রাজনৈতিক খেলার মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে আর হবে দীর্ঘকাল। কবে বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে, পৃথিবীর ছায়া চাঁদের ওপর পড়িয়া চন্দ্র গ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল, যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্র গ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।’ ভারতবর্ষেও ১০০ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রর ক্ষমতার টানাটানি তে হিন্দু ধর্মীয় মৌলবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু, আমাদের একুশ শতকের আশ্চর্য বাংলাদেশে, ডিজিটাল বাংলাদেশে ধর্মানুভূতির প্রবল জোয়ারের কাছে শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব ভেসে যাওয়ার উপক্রম। রাষ্ট্রযন্ত্র যার দায় উপেক্ষা করতে পারে না। আর এই জবাবদিহির মুখোমুখি রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোর দায়িত্ব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর।

[লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]